ঢাকা , মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

অসহায় আইনের কাহিনী

  • হামিদ মীর
  • আপডেট সময় ১১:২০:৩৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ মার্চ ২০২৩
  • ১১৪০ বার পড়া হয়েছে

এটি এমন এক চিত্রশিল্পীর কাহিনী, যিনি ২১ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন জেলখানায় নিজের বেদনাকে কখনো চোখের পানিতে বইয়ে দিয়েছেন, আবার কখনো এ বেদনাকে রঙ দিয়ে কাগজে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এই দুঃখী চিত্রশিল্পীর আঁকা চিত্রগুলোতে চাঁদের ভালোবাসা ও দাসত্বের প্রতি ঘৃণা বেশ প্রকাশ পেয়েছে। ২১ বছর পর তিনি এক ছোট জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে বড় জেলখানায় প্রবেশ করেছেন।

প্রথম বন্দিদশায় তিনি শুধু নিজের মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন। দ্বিতীয় জেলখানায় তিনি নিজের পরিবার, শহর ও শেকলে বাঁধা পুরো জাতির মুক্তির জন্য ভাবেন। এ দুর্ভাগা চিত্রশিল্পীর নাম মুহাম্মদ আহমদ গোলাম রব্বানি, যিনি তার ভাই আবদুর রহিম গোলাম রব্বানির সাথে ২১ বছর পর আমেরিকা থেকে মুক্তি পেয়ে পাকিস্তানে ফিরে এসেছেন। আহমদ রব্বানির নাম কয়েক বছর আগে আমি প্রথম শুনি ব্রিটিশ উকিল ক্লাইভ স্টেফোর্ড স্মিথের মুখে, যিনি আমেরিকার সময়ের কলঙ্ক গুয়ানতানামো বে জেলখানায় বন্দী কয়েদিদের মুক্তির জন্য আইনি লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ক্লাইভ আহমদ রব্বানির আঁকা চিত্রগুলোতে লুকিয়ে থাকা বেদনাকে বাইরে বের করে আনেন। তারই সহায়তায় আহমদ রব্বানির এক বেদনাগাথা আমেরিকার লসএঞ্জেলস টাইমস পত্রিকায় প্রকাশ হয়। আহমদ রব্বানি লিখেছিলেন, ‘কোনো এককালে আমিও মানুষ ছিলাম। আমারও একটি পরিচয় ছিল। কিন্তু এখন আমার পরিচয় শুধু কয়েদি নম্বর-১৪৬১, যাকে ২০০২ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের প্রশাসন করাচি থেকে গ্রেফতার করে আমেরিকার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।’

বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, আহমদ রব্বানি ও তার ভাই আবদুর রহিম রব্বানিকে আমেরিকানরা দুই দশক পর্যন্ত নিজেদের কারাগারে রাখল, অথচ তারা এ সময়ের মধ্যে তাদের উভয়ের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও আরোপ করেনি, কোনো বিচারও করেনি। তবে উভয়ের ওপর নির্যাতন চালিয়ে বাধ্য করা হতো, যাতে তারা আল-কায়েদার সাথে তাদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেন। কিন্তু উভয়ে এমন কোনো স্বীকারোক্তি দেননি। আহমদ রব্বানি ও তার ভাইয়ের কাহিনী শুধু মার্কিন প্রশাসনের জুলুম-নির্যাতনের কাহিনী নয়; বরং এটি পাকিস্তানের ক্ষমতাধর শ্রেণীর দেশ বিক্রিরও এক হৃদয়বিদারক কাহিনী, যেখানে চার হাজারেরও অধিক পাকিস্তানিকে শুধু পাঁচ হাজার ডলারের বিনিময়ে আমেরিকাসহ অপর কয়েকটি দেশের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। জেনারেল পারভেজ মোশাররফের ‘সবার আগে পাকিস্তান’ স্লোগান দিয়ে পাকিস্তানকে সবার পেছনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছেন।

জেনারেল পারভেজের প্রশাসন শুধু আমেরিকাকে নয়; বরং ব্রিটেন, ফ্রান্স, মিসর, সৌদি আরব, জর্দান, সুদান ও মৌরিতানিয়া প্রভৃতি দেশের কাছেও বন্দী ধরে ধরে বেচে দিতেন। লিবিয়ায় কর্নেল গাদ্দাফির ক্ষমতা শেষ হলে তার জেল থেকে এমন কয়েকজন কয়েদি মুক্তি পায়, যারা আফগানিস্তানে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জিহাদ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু গাদ্দাফি তাদের সন্ত্রাসী অভিহিত করেন। নাইন-ইলেভেনের পর পাকিস্তানের প্রশাসন তাদের গ্রেফতার করে আমেরিকার কাছে বেচে দেয় এবং আমেরিকা তাদের গাদ্দাফির হাতে তুলে দেয়। জেনারেল পারভেজ মোশাররফ তার ‘ইন দ্য লাইন অব ফায়ার’ গ্রন্থের ইংরেজি ভার্সনে তার দাস ব্যবসার কথা স্বীকার করেন। কিন্তু ‘সবার আগে পাকিস্তান’ নামে তার গ্রন্থের উর্দু অনুবাদ প্রকাশ হলে সেখানে দাস ব্যবসার কথা মুছে দেয়া হয়।

পাকিস্তানের দাস ব্যবসায়ী শাসক যখন পরকালের পথে পাড়ি জমালেন, তখন তার বিদেশী ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোতে কোটি কোটি ডলার পড়ে আছে। অথচ পাকিস্তান সরকারও দাস ব্যবসা সত্ত্বে ও এক একটি ডলারের মুখাপেক্ষী। নাইন-ইলেভেনের পর জাতীয় স্বার্থের নামে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক যুদ্ধে ফ্রন্টলাইন স্টেট বানানো হয়। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকরা না পেরেছে পাকিস্তানের অর্থনীতি রক্ষা করতে, না পেরেছে সন্ত্রাসবাদ থেকে জনগণকে রক্ষা করতে। এই আন্তর্জাতিক খেলায় আফিয়া সিদ্দিকী পাকিস্তানের আইন-কানুনের অসহায়ত্বের রূপকে পরিণত হয়েছেন। আহমদ রব্বানির মতো নির্যাতিত পাকিস্তানিদের আমেরিকার কাছে বিক্রির বিরুদ্ধে কোনো আইনপ্রিয় বিচারকের স্বপ্রণোদিত নোটিশ জারির হিম্মত হয়নি। আমাদের মতো দুর্বল মানুষ যখনই আফিয়া সিদ্দিকী বা আহমদ রব্বানির জন্য আওয়াজ উঠিয়েছে, তখনই আমাদের সন্ত্রাসীদের হিতাকাক্সক্ষী অভিহিত করা হয়েছে।

নির্মম পরিহাস দেখুন, ২০০২ সালে আমেরিকা পাকিস্তানের সংস্থাগুলোকে বলল, হাসান গুল নামে এক ব্যক্তিকে তাদের দরকার, যিনি উসামা বিন লাদেনের পক্ষে কাজ করেন। তিনি সৌদি আরবে জন্মগ্রহণ করলেও পাকিস্তানের নাগরিক। তিনি স্বাভাবিক গতিতে অনর্গল আরবিতে কথা বলেন। পাকিস্তানের সংস্থাগুলো হাসান গুলকে খুঁজে পেলো না। তবে আহমদ রব্বানির ব্যাপারে তাদের জানা ছিল যে, তিনি সৌদি আরবে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি করাচিতে রিকশা চালান। সৌদি সরকার জাল কাগজপত্র দেখিয়ে চাকরি নেয়ার অভিযোগে তাকে সে দেশ থেকে বের করে দেয়। আহমদ রব্বানিও বেশ ভালো আরবি বলতে পারেন। সুতরাং আহমদ রব্বানি ও তার ভাই আবদুর রহিম রব্বানিকে হাসান গুল ও তার সহযোগী সাজিয়ে আমেরিকার কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। আমেরিকা উভয়কে কাবুলের বাগরাম জেলে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের ওপর দিন-রাত নির্যাতন চালানো হয়। এরপর সেখান থেকে তাদের গুয়ানতানামো বে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

কুদরতের খেলা দেখুন। আসল হাসান গুলকে ২০০৪ সালে ইরাকের কুর্দিস্তান থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি আবু মুসআব আয জারকাবির কাছে উসামা বিন লাদেনের পত্রাবলি নিয়ে যেতেন। মার্কিনিরা তাকে দুই বছর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তার কাছে কোনো বিশেষ তথ্য না পাওয়ায় তাকে পাকিস্তানের হাতে তুলে দেয়া হয়। পাকিস্তান ২০০৭ সালে তাকে ছেড়ে দেয়। এ হাসান গুল ২০১২ সালে উত্তর ওয়াজিরিস্তানে এক ড্রোন হামলার শিকার হন। আহমদ রব্বানিকে হাসান গুল ভেবে গ্রেফতার করা হয়। অথচ সব রহস্য উন্মোচন হওয়ার পরও আহমদ রব্বানিকে মুক্ত করা হয়নি, যাতে তিনি মুক্তির পর বিশ্বকে এটি জানাতে না পারেন যে, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর গোয়েন্দা সংস্থা কতটা অযোগ্য। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের সিনেটে সিনেটর মুশতাক আহমদ খান প্রশ্ন করেন, আহমদ রব্বানি ও তার ভাইকে বিনাবিচারে আমেরিকার জেলখানায় কেন রাখা হলো? তৎকালীন পার্লামেন্ট-বিষয়ক মন্ত্রী আলী মুহাম্মদ খান প্রশ্নের সোজাসাপটা জবাব না দিয়ে সিনেটর মুশতাক আহমদ খানের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আক্রমণ শুরু করেন। আজ আলী মুহাম্মদ খানের দল তেহরিকে ইনসাফ রাষ্ট্রীয় জুলুম-নির্যাতন নিয়ে বেশ কান্নাকাটি করছে। যখন এই দলের নিজেদের সরকার ছিল, তখন তাদের প্রধান ইমরান খান আহমদ রব্বানি ও আফিয়া সিদ্দিকীকে ভুলে গিয়েছিলেন।

কারো ভালো লাগুক বা খারাপ লাগুক, সত্য কথা হচ্ছে, আহমদ রব্বানির ওপর চালানো ২১ বছরের নির্যাতনের কাহিনী মূলত পাকিস্তানের আইনের অসহায়ত্বের কাহিনী। একজন পাকিস্তানি নাগরিককে প্রমাণ ছাড়া আমেরিকার কাছে বেচে দেয়া পাকিস্তানের আইনের পরিপন্থী ছিল। এই আইনপরিপন্থী কাজ সম্পর্কে বিচারপতি শেখ রিয়াজ আহমদ থেকে নিয়ে বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়াল পর্যন্ত এক ডজন চিফ জাস্টিস নীরব থেকেছেন। যখন বারবার আইন ভঙ্গকারী স্বৈরশাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে এক সাহসী বিচারপতি দণ্ড দেন, তখন ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সেনাপ্রধান জেনারেল কমর জাভেদ বাজওয়া ও চিফ জাস্টিস গুলজার আহমদের সাথে হাত মিলিয়ে ওই বিচারপতির রায়কে বাতিল করিয়ে দেন। আর রায় বাতিলকারী বিচারপতি আজ সুপ্রিম কোর্টে বসে আছেন। মোশাররফকে রক্ষাকারী সব ব্যক্তি আজ পরস্পর পরস্পরের জামার কলার ধরতে ব্যস্ত। আর আহমদ রব্বানি দিশেহারা, তিনি আমেরিকার জেল থেকে তো মুক্তি পেলেন, কিন্তু নতুন জেল থেকে কিভাবে মুক্তি পাবেন, যেখানে পুরো পাকিস্তানই আইএমএফের হাতে বন্দী? কারো কাছে কি এতটুকু আত্মমর্যাদা রয়েছে যে, তিনি আহমদ রব্বানিকে একবার ‘স্যরি’ বলবেন?

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ হতে
উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
হামিদ মীর : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

অসহায় আইনের কাহিনী

আপডেট সময় ১১:২০:৩৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৯ মার্চ ২০২৩

এটি এমন এক চিত্রশিল্পীর কাহিনী, যিনি ২১ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন জেলখানায় নিজের বেদনাকে কখনো চোখের পানিতে বইয়ে দিয়েছেন, আবার কখনো এ বেদনাকে রঙ দিয়ে কাগজে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এই দুঃখী চিত্রশিল্পীর আঁকা চিত্রগুলোতে চাঁদের ভালোবাসা ও দাসত্বের প্রতি ঘৃণা বেশ প্রকাশ পেয়েছে। ২১ বছর পর তিনি এক ছোট জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে বড় জেলখানায় প্রবেশ করেছেন।

প্রথম বন্দিদশায় তিনি শুধু নিজের মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন। দ্বিতীয় জেলখানায় তিনি নিজের পরিবার, শহর ও শেকলে বাঁধা পুরো জাতির মুক্তির জন্য ভাবেন। এ দুর্ভাগা চিত্রশিল্পীর নাম মুহাম্মদ আহমদ গোলাম রব্বানি, যিনি তার ভাই আবদুর রহিম গোলাম রব্বানির সাথে ২১ বছর পর আমেরিকা থেকে মুক্তি পেয়ে পাকিস্তানে ফিরে এসেছেন। আহমদ রব্বানির নাম কয়েক বছর আগে আমি প্রথম শুনি ব্রিটিশ উকিল ক্লাইভ স্টেফোর্ড স্মিথের মুখে, যিনি আমেরিকার সময়ের কলঙ্ক গুয়ানতানামো বে জেলখানায় বন্দী কয়েদিদের মুক্তির জন্য আইনি লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ক্লাইভ আহমদ রব্বানির আঁকা চিত্রগুলোতে লুকিয়ে থাকা বেদনাকে বাইরে বের করে আনেন। তারই সহায়তায় আহমদ রব্বানির এক বেদনাগাথা আমেরিকার লসএঞ্জেলস টাইমস পত্রিকায় প্রকাশ হয়। আহমদ রব্বানি লিখেছিলেন, ‘কোনো এককালে আমিও মানুষ ছিলাম। আমারও একটি পরিচয় ছিল। কিন্তু এখন আমার পরিচয় শুধু কয়েদি নম্বর-১৪৬১, যাকে ২০০২ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের প্রশাসন করাচি থেকে গ্রেফতার করে আমেরিকার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।’

বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, আহমদ রব্বানি ও তার ভাই আবদুর রহিম রব্বানিকে আমেরিকানরা দুই দশক পর্যন্ত নিজেদের কারাগারে রাখল, অথচ তারা এ সময়ের মধ্যে তাদের উভয়ের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও আরোপ করেনি, কোনো বিচারও করেনি। তবে উভয়ের ওপর নির্যাতন চালিয়ে বাধ্য করা হতো, যাতে তারা আল-কায়েদার সাথে তাদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেন। কিন্তু উভয়ে এমন কোনো স্বীকারোক্তি দেননি। আহমদ রব্বানি ও তার ভাইয়ের কাহিনী শুধু মার্কিন প্রশাসনের জুলুম-নির্যাতনের কাহিনী নয়; বরং এটি পাকিস্তানের ক্ষমতাধর শ্রেণীর দেশ বিক্রিরও এক হৃদয়বিদারক কাহিনী, যেখানে চার হাজারেরও অধিক পাকিস্তানিকে শুধু পাঁচ হাজার ডলারের বিনিময়ে আমেরিকাসহ অপর কয়েকটি দেশের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। জেনারেল পারভেজ মোশাররফের ‘সবার আগে পাকিস্তান’ স্লোগান দিয়ে পাকিস্তানকে সবার পেছনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছেন।

জেনারেল পারভেজের প্রশাসন শুধু আমেরিকাকে নয়; বরং ব্রিটেন, ফ্রান্স, মিসর, সৌদি আরব, জর্দান, সুদান ও মৌরিতানিয়া প্রভৃতি দেশের কাছেও বন্দী ধরে ধরে বেচে দিতেন। লিবিয়ায় কর্নেল গাদ্দাফির ক্ষমতা শেষ হলে তার জেল থেকে এমন কয়েকজন কয়েদি মুক্তি পায়, যারা আফগানিস্তানে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জিহাদ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু গাদ্দাফি তাদের সন্ত্রাসী অভিহিত করেন। নাইন-ইলেভেনের পর পাকিস্তানের প্রশাসন তাদের গ্রেফতার করে আমেরিকার কাছে বেচে দেয় এবং আমেরিকা তাদের গাদ্দাফির হাতে তুলে দেয়। জেনারেল পারভেজ মোশাররফ তার ‘ইন দ্য লাইন অব ফায়ার’ গ্রন্থের ইংরেজি ভার্সনে তার দাস ব্যবসার কথা স্বীকার করেন। কিন্তু ‘সবার আগে পাকিস্তান’ নামে তার গ্রন্থের উর্দু অনুবাদ প্রকাশ হলে সেখানে দাস ব্যবসার কথা মুছে দেয়া হয়।

পাকিস্তানের দাস ব্যবসায়ী শাসক যখন পরকালের পথে পাড়ি জমালেন, তখন তার বিদেশী ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোতে কোটি কোটি ডলার পড়ে আছে। অথচ পাকিস্তান সরকারও দাস ব্যবসা সত্ত্বে ও এক একটি ডলারের মুখাপেক্ষী। নাইন-ইলেভেনের পর জাতীয় স্বার্থের নামে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক যুদ্ধে ফ্রন্টলাইন স্টেট বানানো হয়। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকরা না পেরেছে পাকিস্তানের অর্থনীতি রক্ষা করতে, না পেরেছে সন্ত্রাসবাদ থেকে জনগণকে রক্ষা করতে। এই আন্তর্জাতিক খেলায় আফিয়া সিদ্দিকী পাকিস্তানের আইন-কানুনের অসহায়ত্বের রূপকে পরিণত হয়েছেন। আহমদ রব্বানির মতো নির্যাতিত পাকিস্তানিদের আমেরিকার কাছে বিক্রির বিরুদ্ধে কোনো আইনপ্রিয় বিচারকের স্বপ্রণোদিত নোটিশ জারির হিম্মত হয়নি। আমাদের মতো দুর্বল মানুষ যখনই আফিয়া সিদ্দিকী বা আহমদ রব্বানির জন্য আওয়াজ উঠিয়েছে, তখনই আমাদের সন্ত্রাসীদের হিতাকাক্সক্ষী অভিহিত করা হয়েছে।

নির্মম পরিহাস দেখুন, ২০০২ সালে আমেরিকা পাকিস্তানের সংস্থাগুলোকে বলল, হাসান গুল নামে এক ব্যক্তিকে তাদের দরকার, যিনি উসামা বিন লাদেনের পক্ষে কাজ করেন। তিনি সৌদি আরবে জন্মগ্রহণ করলেও পাকিস্তানের নাগরিক। তিনি স্বাভাবিক গতিতে অনর্গল আরবিতে কথা বলেন। পাকিস্তানের সংস্থাগুলো হাসান গুলকে খুঁজে পেলো না। তবে আহমদ রব্বানির ব্যাপারে তাদের জানা ছিল যে, তিনি সৌদি আরবে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি করাচিতে রিকশা চালান। সৌদি সরকার জাল কাগজপত্র দেখিয়ে চাকরি নেয়ার অভিযোগে তাকে সে দেশ থেকে বের করে দেয়। আহমদ রব্বানিও বেশ ভালো আরবি বলতে পারেন। সুতরাং আহমদ রব্বানি ও তার ভাই আবদুর রহিম রব্বানিকে হাসান গুল ও তার সহযোগী সাজিয়ে আমেরিকার কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়। আমেরিকা উভয়কে কাবুলের বাগরাম জেলে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের ওপর দিন-রাত নির্যাতন চালানো হয়। এরপর সেখান থেকে তাদের গুয়ানতানামো বে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

কুদরতের খেলা দেখুন। আসল হাসান গুলকে ২০০৪ সালে ইরাকের কুর্দিস্তান থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি আবু মুসআব আয জারকাবির কাছে উসামা বিন লাদেনের পত্রাবলি নিয়ে যেতেন। মার্কিনিরা তাকে দুই বছর ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তার কাছে কোনো বিশেষ তথ্য না পাওয়ায় তাকে পাকিস্তানের হাতে তুলে দেয়া হয়। পাকিস্তান ২০০৭ সালে তাকে ছেড়ে দেয়। এ হাসান গুল ২০১২ সালে উত্তর ওয়াজিরিস্তানে এক ড্রোন হামলার শিকার হন। আহমদ রব্বানিকে হাসান গুল ভেবে গ্রেফতার করা হয়। অথচ সব রহস্য উন্মোচন হওয়ার পরও আহমদ রব্বানিকে মুক্ত করা হয়নি, যাতে তিনি মুক্তির পর বিশ্বকে এটি জানাতে না পারেন যে, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর গোয়েন্দা সংস্থা কতটা অযোগ্য। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের সিনেটে সিনেটর মুশতাক আহমদ খান প্রশ্ন করেন, আহমদ রব্বানি ও তার ভাইকে বিনাবিচারে আমেরিকার জেলখানায় কেন রাখা হলো? তৎকালীন পার্লামেন্ট-বিষয়ক মন্ত্রী আলী মুহাম্মদ খান প্রশ্নের সোজাসাপটা জবাব না দিয়ে সিনেটর মুশতাক আহমদ খানের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আক্রমণ শুরু করেন। আজ আলী মুহাম্মদ খানের দল তেহরিকে ইনসাফ রাষ্ট্রীয় জুলুম-নির্যাতন নিয়ে বেশ কান্নাকাটি করছে। যখন এই দলের নিজেদের সরকার ছিল, তখন তাদের প্রধান ইমরান খান আহমদ রব্বানি ও আফিয়া সিদ্দিকীকে ভুলে গিয়েছিলেন।

কারো ভালো লাগুক বা খারাপ লাগুক, সত্য কথা হচ্ছে, আহমদ রব্বানির ওপর চালানো ২১ বছরের নির্যাতনের কাহিনী মূলত পাকিস্তানের আইনের অসহায়ত্বের কাহিনী। একজন পাকিস্তানি নাগরিককে প্রমাণ ছাড়া আমেরিকার কাছে বেচে দেয়া পাকিস্তানের আইনের পরিপন্থী ছিল। এই আইনপরিপন্থী কাজ সম্পর্কে বিচারপতি শেখ রিয়াজ আহমদ থেকে নিয়ে বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়াল পর্যন্ত এক ডজন চিফ জাস্টিস নীরব থেকেছেন। যখন বারবার আইন ভঙ্গকারী স্বৈরশাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে এক সাহসী বিচারপতি দণ্ড দেন, তখন ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সেনাপ্রধান জেনারেল কমর জাভেদ বাজওয়া ও চিফ জাস্টিস গুলজার আহমদের সাথে হাত মিলিয়ে ওই বিচারপতির রায়কে বাতিল করিয়ে দেন। আর রায় বাতিলকারী বিচারপতি আজ সুপ্রিম কোর্টে বসে আছেন। মোশাররফকে রক্ষাকারী সব ব্যক্তি আজ পরস্পর পরস্পরের জামার কলার ধরতে ব্যস্ত। আর আহমদ রব্বানি দিশেহারা, তিনি আমেরিকার জেল থেকে তো মুক্তি পেলেন, কিন্তু নতুন জেল থেকে কিভাবে মুক্তি পাবেন, যেখানে পুরো পাকিস্তানই আইএমএফের হাতে বন্দী? কারো কাছে কি এতটুকু আত্মমর্যাদা রয়েছে যে, তিনি আহমদ রব্বানিকে একবার ‘স্যরি’ বলবেন?

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ হতে
উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
হামিদ মীর : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট