ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

আওয়ামী লীগের দাবি বিএনপি আরো বেকায়দায়

  • জসিম উদ্দিন
  • আপডেট সময় ১১:৩৭:৪৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ জুন ২০২৩
  • ১১৩৭ বার পড়া হয়েছে

অপরাধের বিচার কখনো তামাদি হয়ে যায় না। এ কথা জানা থাকার পরও অপকর্ম বন্ধ হয় না। অপরাধী নিষ্ক্রান্ত হয় না। ইতিহাসের সেই শিক্ষা যা থেকে মানুষ শিক্ষা নেয় না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কিছু অন্যায় নিয়ে সরকারকে বহু নসিহত করা হয়েছে। ন্যায়বাক্যে কান দেয়ার সদিচ্ছা কখনো সরকারের মধ্যে দেখা যায়নি। পরে নানাভাবে অনুরোধ করা হয়েছে, তাতেও সরকারের বোধোদয় হয়নি। বিরোধী দল ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি ওইসব অনুরোধ ছিল। শেষে শক্তিমানদের পক্ষ থেকে ঠাণ্ডা মাথায় আইনকানুনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। সেগুলোও উপেক্ষিত হয়েছে। যত ধরনের হুমকি হুঁশিয়ারি এসেছে নিজস্ব শক্তির জোরে সরকার থোড়াই তা কেয়ার করেছে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ২০২১ সালে ১০ ডিসেম্বর এসেছে। ভাগ্য ভালো, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের মতো নিষ্ঠুরতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে কিছুটা খামোশ হলাম আমরা।

আমেরিকা সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ওই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। আমাদের কাজ ছিল গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখা। সত্যিকার অর্থে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এর সাথে জড়িত ছিল কিনা তা তদন্ত করা। একটি নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থায় মাধ্যমে এর একটি যবনিকা টানা। এতে যদি অভিযুক্তরা নির্দোষ প্রমাণ হতো এখানে বলার আর কিছু থাকত না। দেশের মানুষের জীবনে নিরাপত্তা নেমে এলে মুশকিল আসান হয়ে যেত। এই পথে না গিয়ে সরকার গিয়েছে নিষেধাজ্ঞা উঠানোর দেনদরবারে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ, সরকারি কর্মকর্তাদের সে দেশে গিয়ে ধরনা দেয়া, আর আলোচনার টেবিলে সবার আগে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য মোচড়ামুচড়ি করা হয়েছে। সরকারের এ ধরনের প্রচেষ্টা রীতিমতো শোভন ছিল না, তার পরেও ছেঁড়ার মতো আমরা চালিয়েছি।

বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনা কমে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটলেও ভোটের অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকার চর্চা একেবারে সঙ্কুচিত অবস্থায় থেকেছে। সরকার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য যে শ্রম সময় ও অর্থের অপচয় করেছে তার কিছুটা যদি এগুলোর উন্নয়নে ব্যয় করত তাহলে ভিসা নিয়ন্ত্রণের যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী পদক্ষেপটি হয়তো ঠেকানো যেত। অন্তত এটি আরোপ করার জন্য যেসব কারণ তারা উল্লেখ করেছে তাতে বিষয়টি একেবারে স্পষ্ট বোঝা যায়। বিএনপির মহাসচিব দাবি করেছেন তাদের ৬০০ নেতাকর্মীকে গুম করা হয়েছে; সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। ধরে নিলাম, তিনি বাড়িয়ে বলছেন। কিন্তু চৌধুরী আলম ও ইলিয়াস আলী কোথায় আছেন? তাদের পরিবার কি তাদের লুকিয়ে রেখেছে? বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার দেয়া তথ্যমতে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৩৪৪ জনকে গুম করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। ৬৬ জনকে সরকারি হেফাজতে পাওয়া গেছে। বাকিদের পরিণতি কী হয়েছে সেটা জানা জরুরি। কিন্তু সরকারের পক্ষে থেকে কোনো ধরনের তদন্তের ব্যবস্থা দেখা যায়নি। এ পর্যন্ত হেফাজতে মৃত্যু নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একটি মাত্র তদন্ত কমিটি হতে দেখা গেল। নওগাঁর ভূমি সহকারী সুলতানা জেসমিনের র‌্যাব হেফাজতে মৃত্যু নিয়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ওই তদন্ত কমিটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন সচিবের নেতৃত্বে কাজ করছে। এ ধরনের তদন্ত কাজে পূর্ণ সফলতা না এলেও অপরাধীদের লাগাম টেনে ধরার কাজে আসে। অন্ততপক্ষে তারা ভয় পেতে পারে যে, একটা ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা পাওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাক, প্রমোশন দেয়ার মতো ঘটনাও দেখা যাচ্ছে। সরকারের এমন অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া বৈশ্বিক শক্তিগুলোকে নিঃসন্দেহে আরো ক্ষেপিয়ে তুলেছে।

নির্বিঘ্নে ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারলে, বাধাহীন রাজনৈতিক সভাসমাবেশ করতে পারলে এবং অবাধে মতপ্রকাশের সুযোগ থাকলে এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। অথচ এটি আরোপের পরও সরকারি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কথাবার্তার মধ্যে কোনো ধরনের দায়িত্ববোধ নেই। তারা বলছেন, ভিসানীতির কারণে বিএনপি বেকায়দায় পড়বে। বিগত ১৪ বছরে বর্তমান সরকারের দ্বারা বিএনপি কতটা বেকায়দায় পড়েছে তার চেয়ে বেশি বেকায়দায় যে আর পড়া সম্ভব নয় সেটা সরকারি দলের নেতারা চোখে দেখতে পাচ্ছেন না। এর সামান্য ফিরিস্তি তুলে ধরলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

গত বছরে দেশব্যাপী বিএনপির বড় বড় জনসমাবেশ ঘিরে নতুন কায়দায় দলটির নেতাকর্মীদের ওপর আরেক দফা নির্দয় নিপীড়ন নেমে আসে। এ নিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারির ১৩ তারিখে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত সারা দেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের নামে দেড় লাখ মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩৬ লাখ। কারাগারে আটক রয়েছেন ২০ হাজার। যারা মামলা মাথায় নিয়ে কারাগারের বাইরে থাকেন তাদের অবস্থা থাকে আরো করুণ। আদালত থেকে জামিন নেওয়া, জামিন না পেলে রাতে দিনে কোথায় থাকবেন তার নিশ্চয়তা থাকে না। তাদের পালিয়ে বেড়াতে হয়। বর্তমান সরকারের আমলে এই চরম নিপীড়নের শিকার হয়ে লাখ লাখ মানুষ সর্বস্ব খুইয়েছেন। হয়রানির আরেক নাম গায়েবি মামলা। ‘মিথ্যা মামলা’ বলে এগুলোকে সংজ্ঞায়িত করা যাচ্ছে না। ডয়েচে ভেলে জানাচ্ছে, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এই ‘গায়েবি মামলা’ শব্দদ্বয়ের আবির্ভাব। কারণ এ এমন মামলা যে, আদতে কোনো কিছুই ঘটেনি। এসব মামলায় দেখা যায়, কেউ সিটি করপোরেশনের গাড়িতে ঢিল ছুড়ছেন, কেউ কারো ভ্যানিটি ব্যাগ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন। এ ধরনের মামলায় আসামি করা হয়েছে হাই প্রোফাইল লোকদেরও। যারা এমন ছিঁচকে কাজ করবেন, সেটা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। মামলার আসামি হয়েছে এমন লোকেরা যারা বিদেশে রয়েছেন, এমনকি কারাগারে থাকা লোকেরাও আসামি হয়ে গেছে, মারা গেছে এমন বহু লোকও ছিল আসামির তালিকায়। একেকটি মামলায় যুক্ত করা হয়েছে হাজার হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তিকে। বিরোধী দলের কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মী এই পীড়ন থেকে রেহাই পায়নি। পুলিশ দিয়ে এবং আদালতকে ব্যবহার করে যেভাবে তাদের জীবন সম্পদ ও সম্মানের হানি করা হয়েছে তার চেয়ে বেশি পীড়ন কী হতে পারে? যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে এতে করে নির্দয় নিষ্পেষণের শিকার বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা আবার কিভাবে বেকায়দায় পড়বেন দেশের মানুষ সেটা বুঝতে পারছে না। এর পরেও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এমনটা মনে করে রাজনৈতিক গাঁজাখুরি বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।
অন্য বিরোধী দল জামায়াতের বিরুদ্ধে সরকারি পীড়ন ছিল আরো নির্মম। তাদের জন্য কোনো রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। নাগরিক অধিকার থেকেও তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। পরিস্থিতি তাদের জন্য আরো প্রতিকূল হয়ে যায় দেশের প্রধান সংবাদমাধ্যমে তাদের প্রতি অব্যাহতভাবে বিমাতাসুলভ আচরণ করার কারণে। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ঘোষণার পরও জামায়াতের নেতাদের ওপর পীড়নের স্টিমরোলার থামেনি। দলটির কয়েকজন আইনজীবী নেতা সমাবেশের অনুমতি চাইতে ঢাকা মেট্রপলিটন পুলিশের কার্যালয়ে গেলে তাদের অতর্কিত আটক করা হয়। যেভাবে তাদের জবরদস্তি করে তুলে নেওয়া হয় সেটা অত্যন্ত আপত্তিকর। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে যে অধিকার সেটা তাদের জন্য নেই, আইনজীবী হিসেবে যে মর্যাদা সেটাও তোয়াক্কা করা হয়নি। যাই হোক, আগের মত তাদের বেআইনিভাবে মামলায় জড়িয়ে দেয়া হয়নি। অনেকে এটাকে আমেরিকার ভিসানীতির একটি ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখছেন।

যে কারণে আমেরিকা ভিসা সঙ্কোচন নীতি প্রয়োগ করতে যাচ্ছে সেটা ঘটিয়েছে বর্তমান সরকার। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে আওয়ামী লীগ। কারণগুলো হচ্ছে, ভোটাধিকার হরণ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া, রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে বাধা দেয়া, মানুষকে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও বিচার বঞ্চিত করা। আর এর প্রধান শিকার হয়েছে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। তাহলে এই ভিসানীতি মূলত কাদের বিরুদ্ধে দেয়া হলো? এখন এটা কিভাবে সম্ভব যে, যারা অপরাধের শিকার হলেন, তারাই ফের বেকায়দায় পড়বেন। অন্যদিকে এতদিন যারা অপরাধ করেছেন তারা থাকবেন ফুরফুরে! এ কেমন অলীক কল্পনা!

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

আওয়ামী লীগের দাবি বিএনপি আরো বেকায়দায়

আপডেট সময় ১১:৩৭:৪৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১ জুন ২০২৩

অপরাধের বিচার কখনো তামাদি হয়ে যায় না। এ কথা জানা থাকার পরও অপকর্ম বন্ধ হয় না। অপরাধী নিষ্ক্রান্ত হয় না। ইতিহাসের সেই শিক্ষা যা থেকে মানুষ শিক্ষা নেয় না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কিছু অন্যায় নিয়ে সরকারকে বহু নসিহত করা হয়েছে। ন্যায়বাক্যে কান দেয়ার সদিচ্ছা কখনো সরকারের মধ্যে দেখা যায়নি। পরে নানাভাবে অনুরোধ করা হয়েছে, তাতেও সরকারের বোধোদয় হয়নি। বিরোধী দল ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি ওইসব অনুরোধ ছিল। শেষে শক্তিমানদের পক্ষ থেকে ঠাণ্ডা মাথায় আইনকানুনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। সেগুলোও উপেক্ষিত হয়েছে। যত ধরনের হুমকি হুঁশিয়ারি এসেছে নিজস্ব শক্তির জোরে সরকার থোড়াই তা কেয়ার করেছে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ২০২১ সালে ১০ ডিসেম্বর এসেছে। ভাগ্য ভালো, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের মতো নিষ্ঠুরতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে কিছুটা খামোশ হলাম আমরা।

আমেরিকা সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ওই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। আমাদের কাজ ছিল গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখা। সত্যিকার অর্থে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এর সাথে জড়িত ছিল কিনা তা তদন্ত করা। একটি নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থায় মাধ্যমে এর একটি যবনিকা টানা। এতে যদি অভিযুক্তরা নির্দোষ প্রমাণ হতো এখানে বলার আর কিছু থাকত না। দেশের মানুষের জীবনে নিরাপত্তা নেমে এলে মুশকিল আসান হয়ে যেত। এই পথে না গিয়ে সরকার গিয়েছে নিষেধাজ্ঞা উঠানোর দেনদরবারে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ, সরকারি কর্মকর্তাদের সে দেশে গিয়ে ধরনা দেয়া, আর আলোচনার টেবিলে সবার আগে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য মোচড়ামুচড়ি করা হয়েছে। সরকারের এ ধরনের প্রচেষ্টা রীতিমতো শোভন ছিল না, তার পরেও ছেঁড়ার মতো আমরা চালিয়েছি।

বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনা কমে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটলেও ভোটের অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকার চর্চা একেবারে সঙ্কুচিত অবস্থায় থেকেছে। সরকার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য যে শ্রম সময় ও অর্থের অপচয় করেছে তার কিছুটা যদি এগুলোর উন্নয়নে ব্যয় করত তাহলে ভিসা নিয়ন্ত্রণের যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী পদক্ষেপটি হয়তো ঠেকানো যেত। অন্তত এটি আরোপ করার জন্য যেসব কারণ তারা উল্লেখ করেছে তাতে বিষয়টি একেবারে স্পষ্ট বোঝা যায়। বিএনপির মহাসচিব দাবি করেছেন তাদের ৬০০ নেতাকর্মীকে গুম করা হয়েছে; সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। ধরে নিলাম, তিনি বাড়িয়ে বলছেন। কিন্তু চৌধুরী আলম ও ইলিয়াস আলী কোথায় আছেন? তাদের পরিবার কি তাদের লুকিয়ে রেখেছে? বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার দেয়া তথ্যমতে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৩৪৪ জনকে গুম করা হয়েছে। এর মধ্যে ৪০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। ৬৬ জনকে সরকারি হেফাজতে পাওয়া গেছে। বাকিদের পরিণতি কী হয়েছে সেটা জানা জরুরি। কিন্তু সরকারের পক্ষে থেকে কোনো ধরনের তদন্তের ব্যবস্থা দেখা যায়নি। এ পর্যন্ত হেফাজতে মৃত্যু নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একটি মাত্র তদন্ত কমিটি হতে দেখা গেল। নওগাঁর ভূমি সহকারী সুলতানা জেসমিনের র‌্যাব হেফাজতে মৃত্যু নিয়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ওই তদন্ত কমিটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন সচিবের নেতৃত্বে কাজ করছে। এ ধরনের তদন্ত কাজে পূর্ণ সফলতা না এলেও অপরাধীদের লাগাম টেনে ধরার কাজে আসে। অন্ততপক্ষে তারা ভয় পেতে পারে যে, একটা ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা পাওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাক, প্রমোশন দেয়ার মতো ঘটনাও দেখা যাচ্ছে। সরকারের এমন অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া বৈশ্বিক শক্তিগুলোকে নিঃসন্দেহে আরো ক্ষেপিয়ে তুলেছে।

নির্বিঘ্নে ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারলে, বাধাহীন রাজনৈতিক সভাসমাবেশ করতে পারলে এবং অবাধে মতপ্রকাশের সুযোগ থাকলে এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। অথচ এটি আরোপের পরও সরকারি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কথাবার্তার মধ্যে কোনো ধরনের দায়িত্ববোধ নেই। তারা বলছেন, ভিসানীতির কারণে বিএনপি বেকায়দায় পড়বে। বিগত ১৪ বছরে বর্তমান সরকারের দ্বারা বিএনপি কতটা বেকায়দায় পড়েছে তার চেয়ে বেশি বেকায়দায় যে আর পড়া সম্ভব নয় সেটা সরকারি দলের নেতারা চোখে দেখতে পাচ্ছেন না। এর সামান্য ফিরিস্তি তুলে ধরলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

গত বছরে দেশব্যাপী বিএনপির বড় বড় জনসমাবেশ ঘিরে নতুন কায়দায় দলটির নেতাকর্মীদের ওপর আরেক দফা নির্দয় নিপীড়ন নেমে আসে। এ নিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারির ১৩ তারিখে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত সারা দেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের নামে দেড় লাখ মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩৬ লাখ। কারাগারে আটক রয়েছেন ২০ হাজার। যারা মামলা মাথায় নিয়ে কারাগারের বাইরে থাকেন তাদের অবস্থা থাকে আরো করুণ। আদালত থেকে জামিন নেওয়া, জামিন না পেলে রাতে দিনে কোথায় থাকবেন তার নিশ্চয়তা থাকে না। তাদের পালিয়ে বেড়াতে হয়। বর্তমান সরকারের আমলে এই চরম নিপীড়নের শিকার হয়ে লাখ লাখ মানুষ সর্বস্ব খুইয়েছেন। হয়রানির আরেক নাম গায়েবি মামলা। ‘মিথ্যা মামলা’ বলে এগুলোকে সংজ্ঞায়িত করা যাচ্ছে না। ডয়েচে ভেলে জানাচ্ছে, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এই ‘গায়েবি মামলা’ শব্দদ্বয়ের আবির্ভাব। কারণ এ এমন মামলা যে, আদতে কোনো কিছুই ঘটেনি। এসব মামলায় দেখা যায়, কেউ সিটি করপোরেশনের গাড়িতে ঢিল ছুড়ছেন, কেউ কারো ভ্যানিটি ব্যাগ চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন। এ ধরনের মামলায় আসামি করা হয়েছে হাই প্রোফাইল লোকদেরও। যারা এমন ছিঁচকে কাজ করবেন, সেটা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। মামলার আসামি হয়েছে এমন লোকেরা যারা বিদেশে রয়েছেন, এমনকি কারাগারে থাকা লোকেরাও আসামি হয়ে গেছে, মারা গেছে এমন বহু লোকও ছিল আসামির তালিকায়। একেকটি মামলায় যুক্ত করা হয়েছে হাজার হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তিকে। বিরোধী দলের কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মী এই পীড়ন থেকে রেহাই পায়নি। পুলিশ দিয়ে এবং আদালতকে ব্যবহার করে যেভাবে তাদের জীবন সম্পদ ও সম্মানের হানি করা হয়েছে তার চেয়ে বেশি পীড়ন কী হতে পারে? যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে এতে করে নির্দয় নিষ্পেষণের শিকার বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা আবার কিভাবে বেকায়দায় পড়বেন দেশের মানুষ সেটা বুঝতে পারছে না। এর পরেও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা এমনটা মনে করে রাজনৈতিক গাঁজাখুরি বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।
অন্য বিরোধী দল জামায়াতের বিরুদ্ধে সরকারি পীড়ন ছিল আরো নির্মম। তাদের জন্য কোনো রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। নাগরিক অধিকার থেকেও তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। পরিস্থিতি তাদের জন্য আরো প্রতিকূল হয়ে যায় দেশের প্রধান সংবাদমাধ্যমে তাদের প্রতি অব্যাহতভাবে বিমাতাসুলভ আচরণ করার কারণে। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ঘোষণার পরও জামায়াতের নেতাদের ওপর পীড়নের স্টিমরোলার থামেনি। দলটির কয়েকজন আইনজীবী নেতা সমাবেশের অনুমতি চাইতে ঢাকা মেট্রপলিটন পুলিশের কার্যালয়ে গেলে তাদের অতর্কিত আটক করা হয়। যেভাবে তাদের জবরদস্তি করে তুলে নেওয়া হয় সেটা অত্যন্ত আপত্তিকর। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে যে অধিকার সেটা তাদের জন্য নেই, আইনজীবী হিসেবে যে মর্যাদা সেটাও তোয়াক্কা করা হয়নি। যাই হোক, আগের মত তাদের বেআইনিভাবে মামলায় জড়িয়ে দেয়া হয়নি। অনেকে এটাকে আমেরিকার ভিসানীতির একটি ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখছেন।

যে কারণে আমেরিকা ভিসা সঙ্কোচন নীতি প্রয়োগ করতে যাচ্ছে সেটা ঘটিয়েছে বর্তমান সরকার। আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে আওয়ামী লীগ। কারণগুলো হচ্ছে, ভোটাধিকার হরণ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া, রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে বাধা দেয়া, মানুষকে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও বিচার বঞ্চিত করা। আর এর প্রধান শিকার হয়েছে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। তাহলে এই ভিসানীতি মূলত কাদের বিরুদ্ধে দেয়া হলো? এখন এটা কিভাবে সম্ভব যে, যারা অপরাধের শিকার হলেন, তারাই ফের বেকায়দায় পড়বেন। অন্যদিকে এতদিন যারা অপরাধ করেছেন তারা থাকবেন ফুরফুরে! এ কেমন অলীক কল্পনা!