পৌষ সংক্রান্তিতে গোসাই নবান্ন উৎসব উপলক্ষে ২৪৩তম ঐতিহ্যবাহী মারবেল মেলার আসর বসেছে বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়ায়। করোনার কারনে সরকারী আদেশে গণসমাবেশ নিষিদ্ধ থাকার দুই বছর পরে এবছর নতুন করে আড়ম্বরপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে মারবেল খেলার মেলা।
আজ শনিবার রাতে শুভ অধিবাস ও রবিবার ভোর রাতে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া পৌষ সংক্রান্তির গোসাই নবান্ন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সংকীর্ত্তন চলবে সোমবার রাত পর্যস্ত। অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে একই সময় গড়াবে মারবেল খেলা।
বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার ইউনিয়নের রামানন্দেরআঁক গ্রামের মা সোনাই চাঁদ আউলিয়া মন্দির আঙ্গিনায় অনুষ্ঠিত ২শ ৪৩ বছরের ঐতিহ্যবাহী বার্ষিক সংকীর্ত্তন ও গোসাই নবান্ন উৎসব উপলক্ষে অন্যান্য বছরের মতো এবছরও সেখানে অনুষ্ঠিত হবে ঐতিহ্যবাহী মারবেল খেলার প্রতিযোগীতা।
আয়োজকরা জানান, মারবেল মেলায় আগত খেলোয়ার ও দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভীরের কারণে পূর্বের স্থানে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় এ বছর রামানন্দেরআঁক মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে আয়োজন করা হয়েছে মারবেল খেলার।
রবিবার কাক ডাকা ভোর থেকেই শুরু হবে ২শ ৪৩ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই মারবেল খেলার মেলা। দিনের আলো ফুটে ওঠার সাথে সাথে লোক সমাগম বাড়তে থাকবে মেলায়।
মেলায় আগৈলঝাড়া উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন উপজেলার বিভিন্ন বয়সী হাজার হাজার শিশু ও নারী-পুরুষ মেলার প্রধান আকর্ষণ ‘মারবেল খেলা’য় অংশগ্রহণ করে থাকে।
মেলার আয়োজক কমিটির উপদেষ্টা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানও মহিলা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী মলিনা রানী রায় ও মেলা পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক (নিওনেটোলজি) শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. বিধান চন্দ্র (বিসি) বিশ্বাস অনুষ্ঠিত গোসাই নবান্ন উৎসব ও মেলার উৎপত্তি সম্পর্কে বলেন জানান, স্থানীয় আউলিয়াপাশ গ্রামের ছয় বছর বয়সী সোনাই চাঁদ নামে এক মেয়ের বিয়ের বছর না ঘুরতেই তার স্বামী মারা যায়। স্বামীর মৃত্যুর পর শোকাহত সদ্য বিধবা কিশোরী স্ত্রী স্বামীর বাড়িতে একটি নীম গাছের নীচে দেবাদীদেব মহাদেবের আরাধনা ও পূজার্চণা শুরু করে।
পূজার্চণা থেকে সাধনা। সময়ের পরিক্রমায় ওই কিশোরী সাধনার উচ্চ মার্গে সিদ্ধ হলে সোনাই চাঁদের অলৌকিক কর্মকান্ড এলাকা ছাড়িয়ে বাইরেও প্রচার পায়। সোনাই’র জীবদ্দশায় আনুমানিক ১৭৮০ খ্রিঃ তাঁর নামে ‘সোনাই চাঁদ আউলিয়া মন্দির’ স্থাপন করা হয়। সোনাইর মৃত্যুর পরেও তার স্থাপিত মন্দির আঙ্গিনায় চলে আসছে নাম সংকীর্ত্তন ও নবান্ন উৎসব। স্থানীয়দের উদ্যোগে ২০১২ সালে ওই মন্দিরটি পুনঃমির্মাণ করা হয়।
পঞ্জিকা মতে, প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তির দিন হরিনাম সংকীর্ত্তন ও গোসাই নবান্ন মহাউৎসবকে সামনে রেখে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। আর এই উৎসবকে ঘিরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে গ্রামীণ ঐতিহ্যর ধারক মারবলে খেলা। যা এখন মারবেল মেলা নামেই পরিচিতি পেয়েছে সর্বত্র।
প্রতি বছরের মতো এ বছরও মেলা উলক্ষে বৈষ্ণব সেবা, হরিনাম সংকীর্ত্তন শেষে সোয়া মণ (৫০ কেজি) চালের গুড়ার সাথে সোয়া মণ গুড়, ৫০ জোড়া (১শ পিচ) নারকেল ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য খাদ্য উপকরণ মিলিয়ে তৈরী করা হয় গোসাই নবান্ন। ওই নবান্ন (মলিদা) মেলায় আগত দর্শণার্থীদের প্রসাদ হিসাবে পরিবেশন করা হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম পার্বণ পৌষ সংক্রান্তিতে ২৪৩ বছর ধরে ওই গ্রামে এই দিন উৎসব ও মারবেল মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
মারবেল খেলার মূল রহস্য সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, শীতকালে মাঠ-ঘাট শুকিয়ে যাওয়ায় তাদের পূর্ব পুরুষেরা মেলার এই দিনে মারবেল খেলার প্রচলন শুরু করেন করেছিলেন। যা ঐতিহ্যর ধারক হিসেবে আজও অব্যাহত আছে। উত্তরসূরী হিসেবে এখন তারাও গ্রামীণ ঐতিহ্যর মারবেল খেলা ধরে রেখেছেন। এ দিনটিকে সামনে রেখে রামানন্দেরআঁক গ্রামে কয়েকদিন পর্যন্ত উৎসবের আমেজ বিরাজ করে।
স্থানীয় অধিবাসীরা তাদের মেয়ে-জামাইসহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের এই মার্বেল খেলায় আমন্ত্রণ জানানো হয়। কয়েকদিন আগে থেকেই আয়োজন শুরু হয় মেলার। এলাকার প্রতিটি বাড়ির আত্মীয়-স্বজন ও দর্শনার্থীদের ভিড়ে ওই গ্রাম হয়ে ওঠে লোকে-লোকারণ্য। বাড়িতে বাড়িতে চিড়া, মুড়ি, খেঁজুর গুড়ের পিঠা খাওয়ার ধুম পরে যায়। ঐতিহ্যবাহী এই মেলায় এবছরও প্রধান আকর্ষণ ছিল সকল বয়সী নারী-পুরুষের মধ্যে মারবেল খেলার প্রতিযোগিতা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, স্কুল মাঠ ছাড়িয়ে প্রায় ৫ বর্গ কি.মি এলাকা জুড়ে মারবেল খেলার আসর পেতেছে বিভিন্ন বয়সী নারী পুরুষ ও শিশুরা। আশপাশের বাড়ির আঙ্গিনায়ও ছিল এই মারবেল খেরার আসর। মেলাকে কেন্দ্র করে পুলিশ প্রশাসন ব্যপক প্রস্তুতি গ্রহন করেছে।
মেলাকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে বাঁশ-বেত শিল্প সামগ্রী, মনিহারী, খেলনা, মিষ্টি, ফল, চটপটি, ফুচকাসহ হরেক রকমের খাদ্যদ্রব্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় পন্যের দোকানের পশরা বসেছে।