নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে দখলের জমি এক মন্ত্রীকে উপহার দেওয়া হয়েছে। দখলকৃত জমিতে লাগানো হয়েছে মন্ত্রীর কোম্পানির সাইনবোর্ড। আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা এই জমিতে মন্ত্রীর প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড নিয়ে রূপগঞ্জে চলছে তোলপাড়। গত ৩০ ডিসেম্বর সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে প্রভাবশালী ওই মন্ত্রীর গানম্যান ও সরকারি স্টাফদের নিয়ে সাইনবোর্ড স্থাপনের পর থেকেই হতবাক এলাকাবাসী।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, আমরা জমি বিক্রি করিনি। আমাদের জমি রংধনুর রফিক কীভাবে মন্ত্রীকে উপহার দেয়? শুধু তাই নয়, জমি দখলের আগে জমির মালিকের তিন তলা বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে রংধনুর রফিক। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, স্থানীয় একটি পক্ষের সঙ্গে সরকারের প্রভাবশালী ওই মন্ত্রীর জমি ব্যবসায় জড়ানো নিয়ে খবর ছিল। তবে ওই মন্ত্রী নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের নন। এমনকি ঢাকা বিভাগেরও নন। খবর নিয়ে জানা গেছে, প্রভাবশালী এই মন্ত্রীর বাড়ি চট্টগ্রামে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের নাওড়া মৌজার জেএল ১১০ এ আরএস খতিয়ান নম্বর ১৯০, ১৯১ ও আরএস দাগ ৭৬৩, ৭৬৪, ৭৫৮ তিন দাগে ৯৫ শতাংশ জমি রয়েছে। জমির মালিক রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের আবুল হোসেন। ৯৫ শতাংশ জমির ওপর বাড়ি নির্মাণের জন্য সম্মিলিতভাবে মাটি ভরাট করেছিল তার ছেলে ও মেয়েরা।
সেই জমিতে নজর পড়ে কায়েতপাড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের। ওই জমি দখল করতে না পেরে জমির মালিক কায়েতপাড়া ইউনিয়নের আবুল হোসেনের তিন তলা বাড়িটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় রফিক ও তার সন্ত্রাসীরা। প্রাণভয়ে বাড়িছাড়া হয় ভুক্তভোগী পরিবার। এর পরই ৯৫ শতাংশ জমি দখল করে নেয় রফিক।
রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম এ জমিটি মন্ত্রীকে উপহার দিয়েছে বলে জানা গেছে। রফিকের দেওয়া উপহারের জমিতে নিজ প্রতিষ্ঠান বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসের নামে এই সাইনবোর্ড লাগিয়েছেন মন্ত্রীর লোকজন।
ভুক্তভোগী জমির মালিকরা বলেন, রফিকুল ইসলাম কায়েতপাড়া ইউনিয়নে নিজের একক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে দেশের শীর্ষস্থানীয় ক্ষমতাবানদের তার অপকর্মের সঙ্গে জড়াচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় নিজের দখল করা জমি মন্ত্রীকে উপহার দিয়েছে।
জমিটি মন্ত্রীর দখলে থাকলে ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ এই দখলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারবে না। তারা আরও বলেন, আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও একটি জমিতে সরকারের শীর্ষস্থানীয় একজন মন্ত্রী কীভাবে সাইনবোর্ড টানান? রফিক এবার নিয়ে এলো নতুন আরেক প্রভাবশালী মন্ত্রীকে।
সূত্র বলছে, ভুয়া দলিল দেখিয়ে শান্তিনগরের বাসিন্দা মোজাম্মেল হোসেনের কাছে জমি বিক্রি করে রফিক। জমি কেনার পর দখল বুঝে নিতে রফিককে চাপ দেন মোজাম্মেল। এরই ধারাবাহিকতায় আবুল হোসেনের ৯৫ শতাংশ জমি মোজাম্মেলকে বুঝিয়ে দেয় রফিক।
মোজাম্মেল জমি দখল করতে এলে আবুল হোসেন ও তার পরিবারের সদস্যরা বাধা দেন। পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর মামলা করেন। মোকদ্দমা নম্বর ১০৫৫/২০২৩। মামলার পর জমির দখল নিতে চট্টগ্রাম বিভাগের ওই মন্ত্রীকে জমি উপহার দেয় রফিক।
নথি যাচাই করে দেখা যায়, মামলার পর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মৌসুমী বাইন হীরা মোজাম্মেল অর্থাৎ বিবাদীকে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৪৫ ধারায় কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশকে নালিশা ভূমিতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য নির্দেশ দেন। সংশ্লিষ্ট সরকারি ভূমি কমিশনারকে দখল বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা দেন।
তথ্য সূত্রে জানা যায়, সেই ৯৫ শতাংশের ৩১.৩৫ শতাংশ বা ১৯ কাঠা জমি মন্ত্রীকে উপহার দেয় রফিক। সেই জমিতে সাইনবোর্ড ও গাছ লাগাতে গত ৩০ ডিসেম্বর (শনিবার) বিকাল ৩টায় মন্ত্রীর প্রটোকলের গাড়ি নিয়ে আসেন তিনজন। এরমধ্যে একজন নিজেকে মন্ত্রীর গাড়ির ড্রাইভার, অন্যজন মন্ত্রীর গানম্যান (সুরুজ মিয়া) বলে পরিচয় দেন।
অপরজন নিজের পরিচয় দেননি। জমিতে সাইনবোর্ড দিতে ঢাকা মেট্রো-ঠ ১৩-৫৮০২ নম্বরের পুলিশ জিপে আসেন তারা (যার ভিডিও সংরক্ষিত রয়েছে)। এ সময় তারা ‘এই সম্পত্তির মালিক বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসেস লিমিটেড’ লেখা সাইনবোর্ড টানিয়ে দেন। জমির সাইনবোর্ড লাগাতে এসে ঢাকা মেট্রো-ঠ ১৩-৫৮০২ গাড়িতে করে গাছের চারা আনেন ওই তিনজন। যা ওই সময়ে জমির সীমানাপ্রাচীরের ভিতরে লাগানো হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসেস লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল ম্যানেজার পদে চাকরিরত আছেন নূর উদ্দিন। যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসেস লিমিটেড জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি। যার পরিচালনায় রয়েছেন চট্টগ্রামের একজন মন্ত্রী এবং তার স্ত্রী।
জমির মালিক ভুক্তভোগী মো. মামুন মিয়া বলেন, আমরা জমি বিক্রি করিনি। রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম আমাদের জমি জোরপূর্বক দখল করে নিয়েছে। আমরা বাড়ি করার জন্য ৯৫ শতাংশ জমি বালু দিয়ে ভরাট করি। সে আমাদের বাড়ি করতে দেয়নি। জোর করে দখল করে সাইনবোর্ড দিয়েছে। সেই জমিতে তিনটি বাউন্ডারি করেছে।
এর মধ্যে ১৯ কাঠা জমি মন্ত্রীকে উপহার দিয়েছে। শনিবার (৩০ ডিসেম্বর) সেই জমিতে সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেন মন্ত্রীর লোকজন। আমরা জমি বিক্রি করিনি, অথচ রফিক কীভাবে আমাদের জমি অন্যত্র বিক্রি করে? আবার কোনো কাগজপত্র ছাড়াই মন্ত্রীকে উপহারও দিয়েছে। রফিক আমাদের জমি দখলে নেওয়ার পর আমরা আদালতে মামলা করি। সেই মামলা চলমান।
একই অভিযোগ করেন জমির আরেক অংশীদার জনি আহমেদ। তিনি বলেন, আমাদের ৯৫ শতাংশ জমির ওপর বাড়ি নির্মাণের জন্য সম্মিলিতভাবে মাটি ভরাট করি। পরবর্তীতে জোরপূর্বক রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম আমাদের জমি দখল করে নেয়। রফিকুল ইসলাম পরে সেই জমি মো. মোজাম্মেল হোসেনের কাছে বিক্রি করে দেয়।
পরে আমি বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর মামলা করি। মামলার প্রেক্ষিতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মৌসুমী বাইন হীরা দ্বিতীয় পক্ষকে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৪৫ ধারায় কারণ দর্শানোর নোটিস দেন। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশকে নালিশা ভূমিতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার নির্দেশ দেন। সংশ্লিষ্ট সরকারি ভূমি কমিশনারকে দখল বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা দেন।
জনি আহমেদ আরও বলেন, আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে আমাদের জমি সরকারের মন্ত্রীকে উপহার দেওয়া হয়েছে বলে আমরা জেনেছি। মন্ত্রী তার নিজের লোকজন পাঠিয়ে ৩০ ডিসেম্বর দখলে নিয়ে জমিতে একটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেন। সরকারের একজন মন্ত্রী হয়ে কোনোরকম কাগজপত্র ছাড়া আমাদের জমি কীভাবে দখলে নেন? মন্ত্রীর লোকজন এসে আমাদের মালিকানার জমিতে সাইনবোর্ড লাগানোর ঘটনায় আমরা হতভম্ব হয়ে পড়েছি।