ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

আবার কি পরীক্ষাগারে শিক্ষা-শিশু?

স্কুল পর্যায়ে গতানুগতিক সিলেবাস, পাঠ্যপুস্তক, শিখন কৌশল ও পরীক্ষাপদ্ধতি নিয়ে দারুণ অস্বস্তি রয়েছে দেশবাসীর। আর সব সীমাবদ্ধতা ও অস্বস্তির ফাঁক দিয়ে প্রায় অনিবার্যভাবেই যেন ঢুকে পড়ে কোচিং ও গাইড বই ব্যবসা। ফলে জ্ঞানচর্চা নিয়ে প্রজন্মের বেড়ে ওঠার পথ বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। ১৯৯৬ সালে কারিকুলামে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

আমি প্রথমে সিদ্ধান্তটিকে স্বাগত জানাতে চাই। এত দিনে সম্ভবত একটি যৌক্তিক পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার কারিকুলাম ও শিখন ক্ষেত্র এবং মূল্যায়ন পদ্ধতিতে। এত দিনের চলমান পদ্ধতি নিয়ে সব মহলেই অস্বস্তি ছিল। এবার এই অস্বস্তি থেকে বেরিয়ে আসার প্রকৃত পথ তৈরি হলো কি না, তা দেখার বিষয়। পত্রিকায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ মতামত ও নানা প্রকাশিত প্রতিবেদন পড়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করি। এটুকু বুঝতে পারি, অনেক বছর ধরে আমরা যে চাওয়া-পাওয়ার কথা লিখেছি, যেসব পরামর্শ রাখার চেষ্টা করেছি, তা-ই যেন বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল, শিশু শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার্থী বানানোর ভয়ংকর খেলা থেকে বের করে প্রকৃত শিক্ষার্থীর জায়গায় নিয়ে আসা। এর একটি সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি নতুন ব্যবস্থাপনায়।

আবার নতুনভাবে পাঠক্রম তৈরি হয়েছে। সেই আলোকে বই লেখা হয়েছে। মূল্যায়ন পদ্ধতিতে আসছে বড় পরিবর্তন। শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত পারদর্শিতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তৈরি হয়েছে জীবনধর্মী শিক্ষাক্রম। বিষয়টি প্রথম বুঝতে পারিনি। পরে বুঝলাম শিক্ষার্থীদের এখন থেকেই বর্তমান দেশ ও বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপযোগী পেশাগত দক্ষতা অর্জনের দিকে লক্ষ রাখা হয়েছে। তথ্য মতে, ১ জানুয়ারি থেকে নতুন পদ্ধতিতে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম ও পদ্ধতির বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। আগামী বছর বাকি শ্রেণিগুলোতে বাস্তবায়ন করার চিন্তা রয়েছে।

স্বাভাবিকভাবেই এই নতুন ধারা বাস্তবায়নের প্রথম যোদ্ধা স্কুলের শিক্ষকরা। তাঁরা পুরো বিষয় আত্মস্থ না করতে পারলে এবং সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত না হলে সামগ্রিকভাবে পরিকল্পনাটির বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। এ ব্যাপারে এনসিটিবি ও মাউশির গাইডলাইন রয়েছে। সেই মতো প্রতি জেলায় প্রতিটি বিষয়ের জন্য তিনজন করে মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করা হবে। তাঁরা প্রতি উপজেলায় তিনজন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেবেন। আবার তাঁদের মাধ্যমে গেল বছর ডিসেম্বরের মধ্যে সারা দেশের শিক্ষকদের সশরীরে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা। না হলে ১ জানুয়ারি থেকে নতুন পদ্ধতি বাস্তবায়িত হবে কেমন করে!

সাধারণভাবে আশাব্যঞ্জক একটি পরিবর্তনই যেন দেখতে পাচ্ছি। পাশাপাশি বুঝতে পারছি এখনো পুরো বিষয়টিই পরীক্ষাগারে। যেহেতু এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার অতীত অভিজ্ঞতা খুব ভালো নয়, তাই ঘরপোড়া গরুর মতোই একটি আতঙ্ক কাজ করছে। বারবার মনে হচ্ছে, এমন বিশাল পরিবর্তন বাস্তবায়নের জন্য আরো সময় নেওয়া উচিত ছিল। সারা দেশের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ সফলভাবে শেষ করার আগে বাস্তবায়নের পথে হাঁটা বুমেরাং হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করছে। আমাদের দেশের রাজনীতির একটি অন্ধকার দিক হচ্ছে, বড় বড় প্রকল্প নির্বাচনী বছর এলে তড়িঘড়ি বাস্তবায়ন করতে চাওয়া। আমি জানি না এখানেও এই ফর্মুলা কাজ করছে কি না। তেমন চিন্তা হয়ে থাকলে তা খুব বাস্তবধর্মী হয়েছে, এমন বলা যাবে না। আধাখেঁচড়াভাবে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী যখন খাবি খাবে, তখন তা থেকে ক্ষুব্ধ জনমত তৈরি হতে পারে।

মাস্টার ট্রেইনারের কথা সামনে আসায় আমার ২০১১-এর অভিজ্ঞতা মনে পড়ল। ২০০৬ ও ২০১১-এর কারিকুলাম সংস্কার ও পাঠ্য বই রচনায় এনসিটিবির আয়োজনের সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা ছিল। ২০১১-এর নতুন রূপরেখায় সৃজনশীল পদ্ধতি ও প্রশ্নের বিষয়টি উত্থাপিত হলে আমার কিছু ভিন্নমত ছিল সভায়। আমি সরলভাবে আমার মত প্রকাশ করে শিক্ষার্থীর সৃজনশীল মেধা তৈরির পথ দেখিয়েছিলাম। দেশের নানা অঞ্চলের স্কুলগুলোর শিক্ষকরা স্থানিক সুবিধামতো সপ্তাহে একবার একেকটি গ্রুপের শিক্ষার্থীদের কাছের নদীর তীরে, ফুটবল খেলার মাঠে, জাদুঘরে, শিল্প-কারখানায়, প্রাচীন ইমারতের কাছে, প্রত্নস্থানে নিয়ে যেতে পারেন। এরপর একেকজন শিক্ষার্থীকে একেক ধরনের ধারণা দিয়ে বাড়ির কাজ দেওয়া যেতে পারে, যা স্কুলে পরে উপস্থাপন করবে। উপস্থিত সবাই মেনেও নিয়েছিলেন এই প্রস্তাব। আমি ২০১৮ সালে উত্তর আয়ারল্যান্ডে গিয়ে ওখানকার শিশু শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল চিন্তা ও পরিচর্যা অনেকটা এভাবেই দেখেছিলাম। সভায় দু-একজন ভিন্ন একটি ‘সৃজনশীল’ প্রশ্ন-উত্তরের প্রস্তাব রাখলেন। বিষয়টি খুব একটা সমর্থিত হয়নি। পরে আমি বলেছিলাম, আমরা যেন এমন সৃজনশীল পদ্ধতির দিকে না যাই, যাতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী আবার গাইড বইয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বাস্তবে তা-ই ঘটল। বলেছিলাম, প্রান্তিক অঞ্চল পর্যন্ত শিক্ষকদের সৃজনশীলের ব্যাপারে প্রশিক্ষিত না করতে পারলে এমন পদ্ধতি কোনো কাজে লাগবে না। শেষ পর্যন্ত তা-ই ঘটেছিল। নানা ঘাটের জল ঘোলা করে শেষে অদ্ভুতুড়ে সৃজনশীলকে ছুটি দেওয়া হলো। পরীক্ষাগারের এত সব ব্যর্থতা দেখেও নতুন পদ্ধতিতে ‘মাস্টার ট্রেইনার’-এর কথা শুনে আবার চমকে উঠলাম।

বলা হয়েছে, পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি স্কুলে পাইলটিং করা হয়েছে। কিন্তু এর ফল কী, আমরা এখনো তা জানতে পারিনি। তথ্য মতে, গেল বছর ডিসেম্বরের মধ্যে সারা দেশে শিক্ষকদের সশরীরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। যত দূর জানা যায়, ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু জেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাহলে জানুয়ারি থেকে চালু হওয়া ক্লাসগুলোর দশা কী হবে?

সৃজনশীল প্রশ্ন সামনে রেখে কয়েক বছরেও কিন্তু প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়নি। এই ব্যর্থতায় লাভবান হয়েছেন গাইড বই ব্যবসায়ীরা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সুবিধাভোগী শ্রেণি। আমাকে একজন সুপরিচিত সিনিয়র সাংবাদিক ওই সময়ের অভিজ্ঞতায় অনেক শিক্ষকের মনস্তাত্ত্বিক সংকটের কথা বলেছিলেন। সংকটগুলো এমন—১. অনেক শিক্ষকই মাস্টার ট্রেইনার নামের নিজ সহকর্মীর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহী ছিলেন না; ২. অনেক শিক্ষক মনে করেছেন ট্রেনিং নিতে যাওয়া মাস্টার ট্রেইনার সহকর্মী নানা সুবিধা ভোগ করেছেন। এখন তাঁরা বিনা লাভে ট্রেনিং নিতে যাবেন কেন!—এসব জটিলতা এবারও থাকবে না কে বলতে পারে। আমরা চাই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষকদের শতভাগ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা হোক। এর সঙ্গে জবাবদিহির প্রশ্নটিও থাকতে হবে।

আরেকটি জরুরি প্রশ্নের অবতারণা করতে চাই। আমার কাছে পুরো পরিকল্পনার লক্ষ্য হিসেবে মনে হয়েছে, উন্নত বাংলাদেশের পথে হাঁটার জন্য কর্মমুখী শিক্ষার দিকে নজর স্থির করা হয়েছে। কারিগরি, আইসিটি শিক্ষা গুরুত্ব পেয়েছে। পাশাপাশি এসব উন্নয়ন ও অগ্রগতি টেকসই করার জন্য যে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রয়োজন, সেদিকে তেমন গুরুত্ব আরোপ আমার চোখে পড়েনি।

আমি ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো প্যারিসে গিয়ে একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। প্যারিস শহরে অবস্থিত ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে সম্পর্কিত বিখ্যাত বাস্তিল দুর্গ দেখতে গিয়েছিলাম। জানি দুর্গটি ধ্বংস হয়েছিল। সেটি কী অবস্থায় সংরক্ষণ করেছে, তা দেখার উদ্দেশ্যে বাস্তিল শহরে গেলাম। সেইন নদীর দুই পারেই শহর। দুর্গ কোন পারে হবে, তা বুঝে উঠতে পারছি না। ইংরেজির ব্যবহার এত কম যে ভাষা সংকটেও পড়লাম। শেষ পর্যন্ত সেতুর ওপর ছবি আঁকায় ব্যস্ত এক ফরাসি চিত্রকর ও দুজন ফরাসি তরুণ-তরুণীর শরণাপন্ন হলাম। বিস্ময়ের সঙ্গে জানলাম ওরা ফরাসি বিপ্লব ও বাস্তিল দুর্গ কোনোটিরই খবর রাখে না। পরে নিজেই আবিষ্কার করলাম। কাছেই সড়কদ্বীপে যে উঁচু একটি মন্যুমেন্ট দাঁড়িয়ে, ওটিই বাস্তিল দুর্গের স্মারক। রাতে হোটেলে সুশিক্ষিত ফরাসি ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি জানালেন, ফরাসি নীতিনির্ধারকরা বিশ্বাস করেন ফ্রান্স যে আজ উন্নত দেশ তার পেছনের প্রধান চালিকাশক্তি তাঁদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। এ কারণে তাঁরা ইংরেজিকে সতর্কভাবে সরিয়ে রেখে নিজ ভাষাচর্চাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। আধুনিক সময়ের শিক্ষা কারিকুলামে এসব চর্চা কমে গেছে। তাই বর্তমান প্রজন্ম ঐতিহ্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে এখন গভীরভাবে ভাবছেন ফরাসি নীতিনির্ধারকরা। প্রজন্মকে ধ্রুপদি জ্ঞান ও সংস্কৃতির দিকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য নতুন কারিকুলাম তৈরির কথা ভাবছেন।

আর আমাদের নতুন পাঠ্য তালিকা দেখে অনেকটা হতাশ আমি। এখানে কর্মমুখী শিক্ষার দিকে গুরুত্ব আরোপ করতে গিয়ে ইতিহাস-ঐতিহ্যকে অনেকটা গুরুত্বহীন করে ফেলা হয়েছে। আশঙ্কা থাকে শক্ত ভিত্তি ছাড়া চকচকে ইমারত না যেন মুখ থুবড়ে পড়ে। আমরা বিশ্বাস করি জ্ঞানী বিশেষজ্ঞরা অনেক শ্রম ও মেধায় একটি নতুন শিক্ষা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। সাধারণভাবে এর অনেক ইতিবাচক দিক চোখে পড়ে। তবে এর বাস্তবায়নে বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। নিকট অতীতের অভিজ্ঞতার কারণে পরীক্ষাগারেই এমন ভালো পদক্ষেপের অপমৃত্যু হোক, তা আমরা চাইব না।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

আবার কি পরীক্ষাগারে শিক্ষা-শিশু?

আপডেট সময় ১১:০৪:৫৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৪ জানুয়ারী ২০২৩

স্কুল পর্যায়ে গতানুগতিক সিলেবাস, পাঠ্যপুস্তক, শিখন কৌশল ও পরীক্ষাপদ্ধতি নিয়ে দারুণ অস্বস্তি রয়েছে দেশবাসীর। আর সব সীমাবদ্ধতা ও অস্বস্তির ফাঁক দিয়ে প্রায় অনিবার্যভাবেই যেন ঢুকে পড়ে কোচিং ও গাইড বই ব্যবসা। ফলে জ্ঞানচর্চা নিয়ে প্রজন্মের বেড়ে ওঠার পথ বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। ১৯৯৬ সালে কারিকুলামে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

আমি প্রথমে সিদ্ধান্তটিকে স্বাগত জানাতে চাই। এত দিনে সম্ভবত একটি যৌক্তিক পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার কারিকুলাম ও শিখন ক্ষেত্র এবং মূল্যায়ন পদ্ধতিতে। এত দিনের চলমান পদ্ধতি নিয়ে সব মহলেই অস্বস্তি ছিল। এবার এই অস্বস্তি থেকে বেরিয়ে আসার প্রকৃত পথ তৈরি হলো কি না, তা দেখার বিষয়। পত্রিকায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ মতামত ও নানা প্রকাশিত প্রতিবেদন পড়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করি। এটুকু বুঝতে পারি, অনেক বছর ধরে আমরা যে চাওয়া-পাওয়ার কথা লিখেছি, যেসব পরামর্শ রাখার চেষ্টা করেছি, তা-ই যেন বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল, শিশু শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার্থী বানানোর ভয়ংকর খেলা থেকে বের করে প্রকৃত শিক্ষার্থীর জায়গায় নিয়ে আসা। এর একটি সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি নতুন ব্যবস্থাপনায়।

আবার নতুনভাবে পাঠক্রম তৈরি হয়েছে। সেই আলোকে বই লেখা হয়েছে। মূল্যায়ন পদ্ধতিতে আসছে বড় পরিবর্তন। শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত পারদর্শিতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তৈরি হয়েছে জীবনধর্মী শিক্ষাক্রম। বিষয়টি প্রথম বুঝতে পারিনি। পরে বুঝলাম শিক্ষার্থীদের এখন থেকেই বর্তমান দেশ ও বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপযোগী পেশাগত দক্ষতা অর্জনের দিকে লক্ষ রাখা হয়েছে। তথ্য মতে, ১ জানুয়ারি থেকে নতুন পদ্ধতিতে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম ও পদ্ধতির বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। আগামী বছর বাকি শ্রেণিগুলোতে বাস্তবায়ন করার চিন্তা রয়েছে।

স্বাভাবিকভাবেই এই নতুন ধারা বাস্তবায়নের প্রথম যোদ্ধা স্কুলের শিক্ষকরা। তাঁরা পুরো বিষয় আত্মস্থ না করতে পারলে এবং সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত না হলে সামগ্রিকভাবে পরিকল্পনাটির বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। এ ব্যাপারে এনসিটিবি ও মাউশির গাইডলাইন রয়েছে। সেই মতো প্রতি জেলায় প্রতিটি বিষয়ের জন্য তিনজন করে মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করা হবে। তাঁরা প্রতি উপজেলায় তিনজন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেবেন। আবার তাঁদের মাধ্যমে গেল বছর ডিসেম্বরের মধ্যে সারা দেশের শিক্ষকদের সশরীরে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা। না হলে ১ জানুয়ারি থেকে নতুন পদ্ধতি বাস্তবায়িত হবে কেমন করে!

সাধারণভাবে আশাব্যঞ্জক একটি পরিবর্তনই যেন দেখতে পাচ্ছি। পাশাপাশি বুঝতে পারছি এখনো পুরো বিষয়টিই পরীক্ষাগারে। যেহেতু এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার অতীত অভিজ্ঞতা খুব ভালো নয়, তাই ঘরপোড়া গরুর মতোই একটি আতঙ্ক কাজ করছে। বারবার মনে হচ্ছে, এমন বিশাল পরিবর্তন বাস্তবায়নের জন্য আরো সময় নেওয়া উচিত ছিল। সারা দেশের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ সফলভাবে শেষ করার আগে বাস্তবায়নের পথে হাঁটা বুমেরাং হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করছে। আমাদের দেশের রাজনীতির একটি অন্ধকার দিক হচ্ছে, বড় বড় প্রকল্প নির্বাচনী বছর এলে তড়িঘড়ি বাস্তবায়ন করতে চাওয়া। আমি জানি না এখানেও এই ফর্মুলা কাজ করছে কি না। তেমন চিন্তা হয়ে থাকলে তা খুব বাস্তবধর্মী হয়েছে, এমন বলা যাবে না। আধাখেঁচড়াভাবে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী যখন খাবি খাবে, তখন তা থেকে ক্ষুব্ধ জনমত তৈরি হতে পারে।

মাস্টার ট্রেইনারের কথা সামনে আসায় আমার ২০১১-এর অভিজ্ঞতা মনে পড়ল। ২০০৬ ও ২০১১-এর কারিকুলাম সংস্কার ও পাঠ্য বই রচনায় এনসিটিবির আয়োজনের সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা ছিল। ২০১১-এর নতুন রূপরেখায় সৃজনশীল পদ্ধতি ও প্রশ্নের বিষয়টি উত্থাপিত হলে আমার কিছু ভিন্নমত ছিল সভায়। আমি সরলভাবে আমার মত প্রকাশ করে শিক্ষার্থীর সৃজনশীল মেধা তৈরির পথ দেখিয়েছিলাম। দেশের নানা অঞ্চলের স্কুলগুলোর শিক্ষকরা স্থানিক সুবিধামতো সপ্তাহে একবার একেকটি গ্রুপের শিক্ষার্থীদের কাছের নদীর তীরে, ফুটবল খেলার মাঠে, জাদুঘরে, শিল্প-কারখানায়, প্রাচীন ইমারতের কাছে, প্রত্নস্থানে নিয়ে যেতে পারেন। এরপর একেকজন শিক্ষার্থীকে একেক ধরনের ধারণা দিয়ে বাড়ির কাজ দেওয়া যেতে পারে, যা স্কুলে পরে উপস্থাপন করবে। উপস্থিত সবাই মেনেও নিয়েছিলেন এই প্রস্তাব। আমি ২০১৮ সালে উত্তর আয়ারল্যান্ডে গিয়ে ওখানকার শিশু শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল চিন্তা ও পরিচর্যা অনেকটা এভাবেই দেখেছিলাম। সভায় দু-একজন ভিন্ন একটি ‘সৃজনশীল’ প্রশ্ন-উত্তরের প্রস্তাব রাখলেন। বিষয়টি খুব একটা সমর্থিত হয়নি। পরে আমি বলেছিলাম, আমরা যেন এমন সৃজনশীল পদ্ধতির দিকে না যাই, যাতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী আবার গাইড বইয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বাস্তবে তা-ই ঘটল। বলেছিলাম, প্রান্তিক অঞ্চল পর্যন্ত শিক্ষকদের সৃজনশীলের ব্যাপারে প্রশিক্ষিত না করতে পারলে এমন পদ্ধতি কোনো কাজে লাগবে না। শেষ পর্যন্ত তা-ই ঘটেছিল। নানা ঘাটের জল ঘোলা করে শেষে অদ্ভুতুড়ে সৃজনশীলকে ছুটি দেওয়া হলো। পরীক্ষাগারের এত সব ব্যর্থতা দেখেও নতুন পদ্ধতিতে ‘মাস্টার ট্রেইনার’-এর কথা শুনে আবার চমকে উঠলাম।

বলা হয়েছে, পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি স্কুলে পাইলটিং করা হয়েছে। কিন্তু এর ফল কী, আমরা এখনো তা জানতে পারিনি। তথ্য মতে, গেল বছর ডিসেম্বরের মধ্যে সারা দেশে শিক্ষকদের সশরীরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। যত দূর জানা যায়, ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু জেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাহলে জানুয়ারি থেকে চালু হওয়া ক্লাসগুলোর দশা কী হবে?

সৃজনশীল প্রশ্ন সামনে রেখে কয়েক বছরেও কিন্তু প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়নি। এই ব্যর্থতায় লাভবান হয়েছেন গাইড বই ব্যবসায়ীরা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সুবিধাভোগী শ্রেণি। আমাকে একজন সুপরিচিত সিনিয়র সাংবাদিক ওই সময়ের অভিজ্ঞতায় অনেক শিক্ষকের মনস্তাত্ত্বিক সংকটের কথা বলেছিলেন। সংকটগুলো এমন—১. অনেক শিক্ষকই মাস্টার ট্রেইনার নামের নিজ সহকর্মীর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহী ছিলেন না; ২. অনেক শিক্ষক মনে করেছেন ট্রেনিং নিতে যাওয়া মাস্টার ট্রেইনার সহকর্মী নানা সুবিধা ভোগ করেছেন। এখন তাঁরা বিনা লাভে ট্রেনিং নিতে যাবেন কেন!—এসব জটিলতা এবারও থাকবে না কে বলতে পারে। আমরা চাই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষকদের শতভাগ প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা হোক। এর সঙ্গে জবাবদিহির প্রশ্নটিও থাকতে হবে।

আরেকটি জরুরি প্রশ্নের অবতারণা করতে চাই। আমার কাছে পুরো পরিকল্পনার লক্ষ্য হিসেবে মনে হয়েছে, উন্নত বাংলাদেশের পথে হাঁটার জন্য কর্মমুখী শিক্ষার দিকে নজর স্থির করা হয়েছে। কারিগরি, আইসিটি শিক্ষা গুরুত্ব পেয়েছে। পাশাপাশি এসব উন্নয়ন ও অগ্রগতি টেকসই করার জন্য যে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রয়োজন, সেদিকে তেমন গুরুত্ব আরোপ আমার চোখে পড়েনি।

আমি ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো প্যারিসে গিয়ে একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। প্যারিস শহরে অবস্থিত ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে সম্পর্কিত বিখ্যাত বাস্তিল দুর্গ দেখতে গিয়েছিলাম। জানি দুর্গটি ধ্বংস হয়েছিল। সেটি কী অবস্থায় সংরক্ষণ করেছে, তা দেখার উদ্দেশ্যে বাস্তিল শহরে গেলাম। সেইন নদীর দুই পারেই শহর। দুর্গ কোন পারে হবে, তা বুঝে উঠতে পারছি না। ইংরেজির ব্যবহার এত কম যে ভাষা সংকটেও পড়লাম। শেষ পর্যন্ত সেতুর ওপর ছবি আঁকায় ব্যস্ত এক ফরাসি চিত্রকর ও দুজন ফরাসি তরুণ-তরুণীর শরণাপন্ন হলাম। বিস্ময়ের সঙ্গে জানলাম ওরা ফরাসি বিপ্লব ও বাস্তিল দুর্গ কোনোটিরই খবর রাখে না। পরে নিজেই আবিষ্কার করলাম। কাছেই সড়কদ্বীপে যে উঁচু একটি মন্যুমেন্ট দাঁড়িয়ে, ওটিই বাস্তিল দুর্গের স্মারক। রাতে হোটেলে সুশিক্ষিত ফরাসি ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি জানালেন, ফরাসি নীতিনির্ধারকরা বিশ্বাস করেন ফ্রান্স যে আজ উন্নত দেশ তার পেছনের প্রধান চালিকাশক্তি তাঁদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। এ কারণে তাঁরা ইংরেজিকে সতর্কভাবে সরিয়ে রেখে নিজ ভাষাচর্চাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। আধুনিক সময়ের শিক্ষা কারিকুলামে এসব চর্চা কমে গেছে। তাই বর্তমান প্রজন্ম ঐতিহ্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে এখন গভীরভাবে ভাবছেন ফরাসি নীতিনির্ধারকরা। প্রজন্মকে ধ্রুপদি জ্ঞান ও সংস্কৃতির দিকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য নতুন কারিকুলাম তৈরির কথা ভাবছেন।

আর আমাদের নতুন পাঠ্য তালিকা দেখে অনেকটা হতাশ আমি। এখানে কর্মমুখী শিক্ষার দিকে গুরুত্ব আরোপ করতে গিয়ে ইতিহাস-ঐতিহ্যকে অনেকটা গুরুত্বহীন করে ফেলা হয়েছে। আশঙ্কা থাকে শক্ত ভিত্তি ছাড়া চকচকে ইমারত না যেন মুখ থুবড়ে পড়ে। আমরা বিশ্বাস করি জ্ঞানী বিশেষজ্ঞরা অনেক শ্রম ও মেধায় একটি নতুন শিক্ষা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। সাধারণভাবে এর অনেক ইতিবাচক দিক চোখে পড়ে। তবে এর বাস্তবায়নে বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। নিকট অতীতের অভিজ্ঞতার কারণে পরীক্ষাগারেই এমন ভালো পদক্ষেপের অপমৃত্যু হোক, তা আমরা চাইব না।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়