আহলে কুরআন বা আহলুল কুরআন। শব্দে ভিন্নতা থাকলেও অর্থে ভিন্নতা নেই। কুরআনওয়ালা। কুরআনের ধারক-বাহক। দ্বীন ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাসম্পন্ন শব্দ। রাসূলে কারিম সা:-এর পবিত্র জবান মোবারকে উচ্চারিত শব্দ। হজরত আনাস ইবনে মালেক রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন- ‘নিশ্চয় মানুষের মধ্যে অনেকে আল্লাহর আহল। অর্থাৎ আল্লাহর ঘনিষ্ঠজন।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! তারা কারা?’ আল্লাহর রাসূল সা: বললেন- ‘যারা আহলুল কুরআন-কুরআনওয়ালা, তারাই আল্লাহর আহল এবং আল্লাহর ঘনিষ্ঠজন।’ (সুনানে নাসায়ি : ৭৯৭৭; সুনানে ইবনে মাজাহ : ২১৫)
পবিত্র কুরআন নাজিলের সূচনাকাল থেকে নিয়ে এখন পর্যন্ত আল্লাহর ঘনিষ্ঠজন তথা আহলে কুরআন ছিল এবং আছে। কিন্তু দীর্ঘ এই সময়ের মধ্যে কেউ নিজেদের পরিচয় দেয়ার জন্য ‘আহলে কুরআন’ শব্দ ব্যবহার করেননি। সবাই পরিচয় দিয়েছেন ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’ হিসেবে। তাহলে এই নতুন ফেরকা কারা, যারা নিজেদেরকে আহলে কুরআন বলে দাবি করছে এবং পরিচয় দিচ্ছে? আমরা তাদের পরিচয় জানার চেষ্টা করব। তাদের দাবিদাওয়া নিয়েও আলোচনা করব।
বাতিলের একটা মৌলিক নিয়ম হলো, তারা কখনো অপরিচিত ব্যানার ব্যবহার করে না। তারা তাদের সামনে এমন শব্দ রাখে, যেটা সবাই জানে। শুনলে পরিচিত এবং পবিত্র মনে হয়। আর এই পরিচিত ও পবিত্র শব্দে ভর করেই তারা তাদের গোমহারি ছড়াতে থাকে। ‘আহলে কুরআন’ এই পবিত্রতম শব্দ ব্যবহার করে উম্মাহর মাঝে ‘ইনকারে হাদিস’ তথা হাদিস অস্বীকারের ফেতনা ছড়িয়ে দিচ্ছে। দ্বিতীয় হিজরি শতকের শেষের দিকে পৃথিবীতে প্রথম তাদের সন্ধান পাওয়া যায়।
তখন এমন কিছু লোকের আবির্ভাব ঘটে, যারা সুন্নাহকে অস্বীকার করত। হাদিস মানত না। ইমাম শাফেঈ রহ: এমন একজন হাদিস অস্বীকারকারীর সাথে মুনাযারা করেছেন এবং পরবর্তী সময়ে তার কিতাবুল উম্ম-এ সেটি উল্লেখ করেছেন। (কিতাবুল উম্ম, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা : ২৮৭-২৯২) সেখানে তিনি তাদের দাবিগুলো খণ্ডন করেছেন, দাবির অসারতা প্রমাণ করেছেন। এরপর দীর্ঘ এগারো শত বছর হাদিস বা সুন্নাহ অস্বীকারকারীদের অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিগত শতাব্দীতে পুনরায় এই ফেতনার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। প্রথম মিসরে, সেখান থেকে ইরাক এবং ভারতে। বর্তমানে আমাদের বাংলাদেশেও এই ভ্রষ্ট আকিদার কিছু ব্যক্তির আবির্ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। এই হাদিস ও সুন্নাহ অস্বীকারকারী ব্যক্তিরাই হলো আহলে কুরআন। নিজেদের পরিচয় তারা এই পবিত্র শব্দ দ্বারা দিয়ে থাকে।
আহলে কুরআনদের স্লোগান হলো- ‘রাসূলের হাদিস, সুন্নাত, সিরাত নয়; মানব শুধু আল কুরআন।’ তারা কেনো হাদিস, সুন্নাত বা সিরাত মানবে না, এর পেছনে যেসব যুক্তি দিয়ে থাকে, তা স্পষ্ট না, মজবুতও না। ধোঁয়াশায় ঢাকা, ঘোলাটেপূর্ণ। তাদের বক্তব্য হলো- রাসূলের দায়িত্ব ছিল পৌঁছে দেয়া, তিনি পৌঁছে দিয়েছেন; সুতরাং তাঁর দায়িত্ব শেষ। রাসূলকে মানার কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু কুরআনই মানতে হবে। কুরআনের ওপরেই আমল করতে হবে। তারা রাসূল সা:কে একজন বার্তাবাহক বা ডাকপিয়নের মতো মনে করে (নাউজুবিল্লাহ)। সাহাবায়ে কেরাম তো তাদের কাছে কিছুই না। ‘আমরা এখন কুরআন পেয়েছি, সুতরাং কুরআনই আমরা আমল করব, আমরা নিজেরাই এটা বুঝব। আমাদের জন্য কুরআনই যথেষ্ট।’ তাদের বক্তব্যের সারাংশ এমনই। অথচ তারা এটা বুঝতে চায় না, যে কুরআন তারা মানতে চায়, সেই কুরআনেরই অসংখ্য জায়গায় আল্লাহ তায়ালা নবীজী সা:কে মানতে নির্দেশ করেছেন। তাঁকে অনুসরণ করতে বলেছেন, রাসূল সা:কে কুরআনের ব্যাখ্যা করতে বলেছেন। সাহাবায়ে কেরামের অনুসরণ করতে বলেছেন।
হাদিস না মানার পেছনে তাদের যুক্তি হলো- হাদিসের বিভিন্ন প্রকার আছে। জাল, সহিহ, হাসান, জইফ ইত্যাদি। হাদিসের মধ্যে সহিহ ও গায়রে সহিহ আছে। যে হাদিস বিভিন্ন প্রকার, সহিহ গায়রে সহিহ মিশ্রিত; সেটি কেন মানব? কত হাস্যকর এবং দুর্বল তাদের যুক্তি। এটা খণ্ডন করতে আমরা এখানে তথ্যবহুল কিছু আনতে চাচ্ছি না, তবে শুধু এতটুকু বলব- এই উম্মাহর জানবাজ মুহাদ্দিসরা যুগে যুগে শুধু হাদিস তথা নবীজীর কথা, কাজ ও সম্মতিগুলো হেফাজত করেছেন এমন নয়; বরং এগুলো সঠিকভাবে হেফাজত করার জন্য যে বর্ণনাকারীরা এগুলো বর্ণনা করেছেন, তাদের জীবনী পর্যন্ত অক্ষরে অক্ষরে হেফাজত করেছেন এবং এখনো করে যাচ্ছেন। তাঁদের নাম, বাবা ও দাদার নাম; তাঁরা কোথায় কবে জন্মগ্রহণ করেছেন, কোথায় শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, ব্যক্তিজীবনে তাঁরা কেমন ছিলেন; সবকিছু সংরক্ষিত আছে।
নবীজী সা: চলে গেছেন চৌদ্দ শত বছরের বেশি হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত উম্মাহর কাছে নবীজীর প্রতিটি কথা সংরক্ষিত আছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে ইনশাআল্লাহ। প্রতিজন রাবির জীবনী সংরক্ষিত আছে এবং থাকবে ইনশাআল্লাহ। সেই নবীর হাদিস অস্বীকার এত খোঁড়া যুক্তি দিয়ে কোনোভাবেই করা যায় না, এমনকি ময়দানে টিকে থাকা যায় না সামান্য সময়ও; সেটি তারা কেনো বুঝেন না, আমরা তো সেটিই বুঝি না। (চলবে)
লেখক :
- হুমায়ুন কবীর
শিক্ষার্থী, দাওরায়ে হাদিস, জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া, আরজাবাদ মাদরাাসা।