ইন্দো-প্যাসিফিক, অর্থাৎ ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিয়ে নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ। এই অঞ্চলকে ঘিরে ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কী হবে, সেটাই মূলত তুলে ধরা হয়েছে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা’ নামের ওই নীতিতে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফরের আগে সোমবার রূপরেখাটি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যে কৌশল নেয়া হচ্ছে, তার মধ্যে এই তিনটি দেশই আছে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক বলছেন, ‘২০১৮ সাল থেকেই এটা আলোচনায় ছিল, কিন্তু প্রকাশ্য করা হয়নি। কিন্তু গত কয়েক বছরে অনেক কিছু ঘটেছে। সেজন্য এটা এখন প্রকাশ্যে নিয়ে আসা হলো।’
কিন্তু এই রূপরেখা দিয়ে আসলে কি বোঝানো হচ্ছে? কী রয়েছে ইন্দো প্যাসিফিক রূপরেখায়?
ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা কী?
ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর ঘিরে যেসব দেশ রয়েছে, সেগুলোকে নিয়েই ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল। এর মধ্যে যেমন যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে, তেমনি জাপান, চীন, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও বাংলাদেশের মতো অনেক দেশ রয়েছে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি বা আইপিএস কৌশল ঘোষণা করে বাইডেন প্রশাসন। সেখানে প্রেসিডেন্ট বাইডেন এক অবাধ, মুক্ত, সংযুক্ত, সমৃদ্ধ এবং সুরক্ষিত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের কথা ঘোষণা করেন।
এই নীতি বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথ ইস্ট এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান), কোয়াড্রিল্যাটেরাল সিকিউরিটি ডায়লগ (কোয়াড), অস্ট্রেলিয়া এবং ব্রিটেনের মতো মিত্র দেশ ও জোটকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চায়।
বিশ্লেষকরা ধারণা করেন, মূলত চীনের অর্থনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব ঠেকানোই এই কৌশলের মূল লক্ষ্য। যেসব দেশ মার্কিন এই কৌশলের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে, তাদের বেশিরভাগের সাথে চীনের নানা বিষয়ে বিরোধ রয়েছে।
জাপান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চল নিয়ে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি বা কৌশলপত্র প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশের কেন এই নীতি
গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের সাথে চীনের যে বৈরিতা প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার করার ব্যাপারে বরাবরই একটা চাপ ছিল।
কারণ ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
এর আগেও বিভিন্ন দেশ এই কৌশলের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করলেও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অবস্থানের ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে কিছু ঘোষণা করা হয়নি।
মার্চ মাসেই ভারত সফর করার সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা নয়া দিল্লিতে তার বক্তব্যে এই অঞ্চলের জন্য ‘একটি নতুন পরিকল্পনার’ কথা জানিয়েছেন, যেখানে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তিসহ বাংলাদেশের সাথে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন।
ওই মাসেই যুক্তরাজ্যের ইন্দো-প্যাসিফিক মন্ত্রী অ্যানে-মেরি ট্রেভেলিয়ান বাংলাদেশ সফর করেন।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়ান ইন্সটিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান ফরেন পলিসি ডটকমে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশকে কেন এই দেশগুলো ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ করতে চায়, সেটা বোঝা কঠিন নয়। ভারতের সাথে সীমান্তবর্তী দেশটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে এবং দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবেশপথ হিসেবে কাজ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র, কোয়াডের অন্য সদস্য এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে ঢাকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। এসব কিছু মিলিয়ে বাংলাদেশে ভালো সহযোগী দেশ হতে পারে।‘’
তিনি বলছেন, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের দিকে এগোলেও বাংলাদেশ চীনকেও আশ্বস্ত করতে চায়। ফলে এর আগে বাংলাদেশ যে খসড়া করেছে, সেখানে বিভিন্ন দেশের বৈরিতার বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বা সামরিক কোো লক্ষ্য রাখা হয়নি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরো অনেক দেশ এই নীতি অনুসরণ করেছে।
কূটনীতিকরা বলছেন, ২০১৮ সাল থেকেই এরকম একটি রূপরেখা তৈরির ব্যাপারে আলোচনা শুরু হয়েছিল। এখন সেটা প্রকাশ্যে নিয়ে আসা হলো।
গত বছর একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছিল, যদিও সেটি শেষপর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি।
সোমবার ওই রূপরেখা ঘোষণা করতে গিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, ‘আপনারা প্রশ্নটি অনেকবার করেছেন এবং কথাবার্তা হয় যে বিষয়টি নিয়ে, সেটি হলো ইন্দো প্যাসিফিকে বাংলাদেশের অবস্থান।’ সেই অবস্থান পরিষ্কার করতেই রূপরেখা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
চীন যে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) নিয়েছে, তাতে অংশীদার হয়েছে বাংলাদেশ। অনেক বিশেষজ্ঞ ওই প্রকল্পকে চীনের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের সঙ্গে তুলনা করেন।
ফলে বাংলাদেশকে এই বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের জন্য সহযোগী দেশগুলোর পক্ষ থেকে বরাবরই আহ্বান জানানো হয়েছে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক বলছেন, ‘বাংলাদেশ প্রথমবারের
ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে তাদের অবস্থান ঘোষণা করল। আগেও ইন্টারনাল একটা বোঝাপড়া ছিল, এখন সেটা পাবলিক করা হলো। বাংলাদেশের যে ভারসাম্যমূলক অবস্থান, সেটা এর মাধ্যমে অনেক পরিষ্কার হবে।’
‘আগে যেভাবে ভারসাম্য রক্ষা করা হতো, এখন সেটা করা যাচ্ছে না। কারণ চীন-ভারত, চীন-যুক্তরাষ্ট্র বৈরিতা প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ যেহেতু বে অব বেঙ্গলের একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নিয়ে আছে, তারা মনে করছে, এখন নিজেদের অবস্থান জানানোর সময় এসেছে। সেজন্যই সরকার এখন এটা প্রকাশ করলো।’
রূপরেখায় চার মূলনীতি
বাংলাদেশ যে রূপরেখা ঘোষণা করেছে, সেখানে একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত অবাধ, মুক্ত চলাচল, বাণিজ্যের অগ্রাধিকারে কথা বলা হয়েছে, তেমনি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের বিষয়টি রয়েছে।
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান পররাষ্ট্রনীতি ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ এই রূপরেখার চার মৌলিক নীতির একটি। সেই সাথে অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্কে শক্তি প্রয়োগ পরিহার এবং জাতিসংঘ আইন ও সনদের নীতির প্রতি সমর্থন জানানো হয়েছে।
সমুদ্র আইন সংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদ এবং চুক্তিগুলো মেনে চলার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সেই সাথে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করার কথা হয়েছে ওই নীতিতে।
মৌল নীতির সাথে ১৫টি লক্ষ্য সামনে রেখে বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি পরিচালিত হবে।
এর মধ্যে রয়েছে
ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতা অব্যাহত রাখা।
সমুদ্র বিষয়ক সুরক্ষা ও নিরাপত্তার কাঠামো শক্তিশালী করা, অবাধ সামুদ্রিক চলাচল ও ভূখণ্ড বা জলসীমার ওপর দিয়ে আন্তঃ রাষ্ট্রীয় বিমান চলাচলের অধিকারের বিষয়ে পূর্ণ সমর্থন বজায় রাখা।।
আন্তর্জাতিক নিরস্ত্রীকরণ, শান্তিরক্ষা, সন্ত্রাস বিরোধী কার্যক্রমে সহযোগিতা ও সহায়তা।
আন্তঃদেশীয় অপরাধ দমনে নীতি কাঠামো তৈরি এবং আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।
নারী, শান্তি ও নিরাপত্তায় আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার বজায়, আন্তঃ ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষা করা।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সমৃদ্ধি, সুষম ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখা।
ভৌত, প্রাতিষ্ঠানিক, জ্বালানি, ডিজিটাল উন্নয়ন, পণ্য, পরিষেবা, পুঁজি ও জনগণের সহজ চলাচল এবং প্রযুক্তির হস্তান্তরে কার্যক্রম অব্যাহত রাখা।
ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন ও অবাধ বাণিজ্য প্রবাহ রক্ষা।
মহাসাগর, সাগর ও সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ, ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনা সুসংহত করা।
খাদ্য নিরাপত্তা, দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশ্নে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ।।
জলবায়ু পরিবর্তন, জীব বৈচিত্র্য হ্রাস, সামুদ্রিক দূষণ ও পরিবেশের ক্ষতিকর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা।
নবায়নযোগ্য খাতে বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি হস্তান্তরসহ এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি।
বিষ্যৎ মহামারী রোধে সমন্বিত উদ্যোগ ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা জোরদারকরণ।
আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ।
বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গবেষণা ও উদ্ভাবন খাতে সহযোগিতা জোরদার করা।
সূত্র : বিবিসি