রাজধানীসহ সারা দেশে সম্প্রতি কালেমাখচিত কালো পতাকা নিয়ে মিছিলগুলো সঙ্ঘবদ্ধ করছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ। পুলিশ এবং গোয়েন্দাদের তদন্তে এমনই তথ্য বেরিয়ে আসছে। এই পতাকা মিছিলের ছবি ও ভিডিও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে দিয়ে তারা বাংলাদেশে মৌলবাদীদের উত্থান হিসেবে দেখাতে চায়। স্কুল-কলেজের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা কিছু না বুঝেই আওয়ামী লীগের দেশবিরোধী এই পরিকল্পনার ফাঁদে পা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলকে তারা বোঝাতে চাচ্ছে বাংলাদেশে তারা ক্ষমতায় না থাকলে এখানে জঙ্গি উত্থান ঘটবে এবং সেই উত্থান ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় এই কালো পতাকা নিয়ে মিছিলের ঘটনা ইতোমধ্যে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় তুলেছে। স্কুল-কলেজ ও বেসরকারি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা রাস্তায় এসব মিছিল করছে।
মিছিল থেকে ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধ, ইসলামের নবী মুহাম্মদ সা:কে কটূক্তির প্রতিবাদ কিংবা ইসলামী খেলাফত কায়েমেরও দাবি তোলা হচ্ছে। বাংলাদেশে ইসলামী খেলাফত কায়েম করতেই তারা এই পতাকা নিয়ে মিছিল করছে বলে দাবি করছে। কেউ কেউ বলছেন, এর পেছনে নিষিদ্ধঘোষিত হিজবুত তাহরীরের সংশ্লিষ্টতা থাকলেও মূল পরিকল্পনাকারী হচ্ছে আওয়ামী লীগ। ব্যাপক গণহত্যার দায়ে এই দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। এমনকি আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিও উঠেছে। বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ক্লাসে ঢুকলে ওই ক্লাস বর্জন করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
পুলিশ ও গোয়েন্দারা বলছেন, এতকিছুর পরেও বসে নেই আওয়ামী লীগ। তার ছাত্র সংগঠনকে দিয়ে এখন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সঙ্ঘবদ্ধ করছে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করার জন্য। এ জন্য তারা বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বেসরকারি শিক্ষার্থীদের মাঠে নামিয়েছে কালো পতাকা হাতে দিয়ে! রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার একটি কলেজের শিক্ষার্থীরা গত সোমবার এরূপ একটি মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামে। সবুজবাগ বৌদ্ধমন্দির এলাকায় ওই মিছিলকারীদের একজনের সাথে কথা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই শিক্ষার্থী জানান, তারা নবীর প্রেমে এবং ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদ জানাতে মাঠে নেমেছেন। কিন্তু ওই মিছিলে কালো পতাকা কারা সরবরাহ করছে তা জানেন না ওই শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, কালো পতাকা তারা বানাননি। কারা দিয়েছে তাও জানেন না। মিছিল শুরুর পরে কয়েকজনের হাতে ওই পতাকা দেখা যায়। কিন্তু মিছিলকারীরা অতকিছু চিন্তা করেননি। তারা কালেমাখচিত পতাকা দেখেছেন, ভেবেছেন ভালোকিছু!
গত ৬ অক্টোবর রোববার বিকেলে ঢাকার অফিসার্স ক্লাবের সামনের রাস্তাসহ কয়েকটি এলাকায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েক শ’ শিক্ষার্থী এমন পতাকা হাতে মিছিল করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যারা কালো পতাকা নিয়ে মিছিল করছে তারা নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন হিজবুত তাহরিরের সদস্য। রাজধানীতে কালো পতাকা নিয়ে মিছিলে যাদের অংশ নিতে দেখা গেছে তাদের বেশির ভাগই ঢাকার নামিদামি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। আর কিশোরগঞ্জের মিছিলে কারা কথিত আইএসের পতাকা ব্যবহার করেছে সে বিষয় নিয়ে পুলিশ তদন্ত করছে। আইএসের পতাকা হাতে প্রকাশ্যে মিছিল ও তৎপরতার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। কিশোরগঞ্জের এসপি গতকাল বলেন, এটি বুঝে করেছে, না বুঝে করেছে, এর পেছনে কারো ইন্ধন আছে কি না তা নিয়ে তদন্ত চলছে। তিনি বলেন, দেশের ভাবমর্যাদা নষ্ট করার ষড়যন্ত্র রয়েছে কি না-সবকিছু খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক এ বিষয়ে বলেছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সূত্র ধরে ঐক্যবদ্ধভাবে রাষ্ট্র সংস্কারের যে কাজ শুরু হয়েছে সেটিতে বিভাজন সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে একটি মহল। এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ওই চক্রান্তকারী মহলের কেউ কেউ শিক্ষার্থীদের হাতে আইএস পতাকা প্রদর্শন করছে, বিভিন্ন বিতর্কিত স্লোগান দেয়াচ্ছে। বাস্তবতা হলো- যে শিক্ষার্থীদের দিয়ে এই কাজগুলো করানো হচ্ছে, এত অল্প বয়সে তাদের বোঝার কথা নয়; তারা কী মারাত্মকভাবে রাষ্ট্রীয় নীতির বিপক্ষে গিয়ে কাজগুলো করছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।
ফিলিস্তিনসহ কয়েকটি দেশে ইসরাইলি হামলার প্রতিবাদে সম্প্রতি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম থেকে একটি মিছিল বের করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ওই মিছিল থেকে তিনজনকে আটক করা হয়। পরবর্তীতে রাজধানীর বেশ কিছু এলাকায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের কালো পতাকা নিয়ে মিছিল করতে দেখা গেছে। জাতীয় সংসদ ভবনের সামনেও এমন একটি মিছিল দেখা যায়। ওই মিছিল বের করে সেখানকার একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। ‘সচেতন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা, সেন্ট জোসেফ হাইয়ার সেকেন্ডারি স্কুল’ ব্যানার নিয়ে এই মিছিলটিতে বিভিন্ন সেøাগান, প্ল্যাকার্ড ও কালেমাখচিত পতাকা ছিল। তাদের হাতে বাংলাদেশের পতাকা, ফিলিস্তিনের পতাকা এবং কালেমা লেখা পতাকাও ছিল। তারা যে ব্যানার নিয়ে মিছিল করছিল সেখানে লেখা ছিল ইসলামের নবীকে ভারতীয় পুরোহিত কর্তৃক কটূক্তি ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের জবাবে তাদের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল। সেই মিছিলে তাদের সেøাগান দিতে শোনা যায়, ‘মুক্তির এক পথ, খিলাফত-খিলাফত’, ‘তুমি কে আমি কে, মুসলমান-মুসলমান’। একই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি এলাকায় একই রকম একটি মিছিল দেখা যায়। যেই মিছিলে শিক্ষার্থীদের হাতে আইএসের পতকার আদলে কালো ও সাদা পতাকা দেখা যায়। ঢাকার নটর ডেম কলেজ, ঢাকা কলেজ, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষার্থীদের রাজধানীতে আলাদা আলাদা মিছিল করতে দেখা যায়। যেখানে তাদের কারো কারো হাতে অভিন্ন কালো পতাকা দেখা যায়।
গোয়েন্দাদের একটি সূত্র জানায়, এই মিছিলগুলো অর্গানাইজ করছে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের কিছু কর্মী ওই মিছিলে মিশে গিয়ে কালোপতাকা প্রদর্শন করছে। এটা তাদের দীর্ঘ পরিকল্পনার একটি অংশ। এই ছবি ও ভিডিও ধারণ করে আন্তর্জাতিক মহলে তারা প্রমাণ করতে চাচ্ছে- আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরপরই বাংলাদেশে জঙ্গি উত্থান ঘটেছে। যাতে আন্তর্জাতিকভাবে বর্তমান সরকার চাপের মধ্যে পড়ে। এ ব্যাপারে আইজিপির মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি কোনো জবাব দেননি।