ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

কে ছিলেন পৃথিবীর প্রথম নারী ইতিহাসবিদ

  • কালসি একার্ট
  • আপডেট সময় ১১:০৬:১২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ জানুয়ারী ২০২৩
  • ১৩৫৫ বার পড়া হয়েছে

ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে নারীদের কথা ও কর্ম অন্তর্ভুক্তকরণে গৎবাঁধা নানা বাধা আছে। শুধু এখন নয়, অতীতেও এমন বাধা ছিল। পুরুষদের তুলনায় নারীদের কথা, কর্ম ও ভাবনা সম্পর্কে জানা সব সময়ই কঠিনতর কাজ। [ইংরেজ ইতিহাসবেত্তা] ড. বেটানি হিউজেস বলছেন, ইতিহাসের মাত্র ০.৫ শতাংশ লেখা হয়েছে নারীদের নিয়ে। [ভারতীয়] ইতিহাসবেত্তা অপর্ণা বসু এই সত্য উদ্ঘাটন করেছেন যে, ‘ইতিহাসের প্রচলিত পাঠ্যপুস্তকে শুধু সেসব নারীর নাম খুঁজে পাওয়া যায়- যারা সফলভাবে পুরুষের মতো ভূমিকা পালন করেছেন কিংবা যাকে যশস্বী কোনো পুরুষ ভালোবেসেছেন।’ ইতিহাসের শিক্ষকরা যা পড়ান, তা সবই হলো ‘পুরুষের পালা’ (his-story)। পুরুষভিন্ন যেন কোনো ইতিহাস নেই, কোনো আখ্যান-উপাখ্যান নেই।

ইতিহাস লেখা হতো মূলত পুরুষের দ্বারা এবং পুরুষদের সম্পর্কে। এমনকি যখন নারীরা ইতিহাস লিখেছেন, তখন তারা পুরুষদের নিয়েই লিখেছেন। ইতিহাস আলোকপাত করে রাজনীতি, কূটনীতি, ব্যবসা ও সামরিক ক্ষেত্রগুলোর ওপর। আর এই ক্ষেত্রগুলোয় নারীদের অপরিহার্য অনুপস্থিতি নারীদের ইতিহাসকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। তবে স্রোতের উজানে সামাজিক ইতিহাস লেখার অপেক্ষাকৃত নতুন অভিপ্রায় ও প্রয়াস নারীদের নিয়ে ইতিহাস রচনার এবং অতীত খুঁড়ে নারীদের কণ্ঠস্বর খুঁজে পাওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে।

আমরা নারীদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে কতটা জানি, সেই শূন্যতা পূরণের জন্য ১৯ শতকের শেষাংশে এবং ২০ শতকের শুরুর দিকে নারী ইতিহাসবেত্তারা নারীর অতীত ও বর্তমান সম্পর্কে পেশাগতভাবে লেখার জন্য কলম ধরা শুরু করেন। কেউ কেউ মাঝে মধ্যে তাদের ইতিহাসবেত্তা স্বামীদের সঙ্গে সহ-লেখক হিসেবেও লিখেছেন। প্রায় একই সময় নারী কলেজের উত্থান ঘটে। এই নারীরা নারীর ইতিহাস সম্পর্কে লেখার জন্য অগ্রসর হন। তবে তারা যে নারীদের জন্য ইতিহাসে নতুন একটা ক্ষেত্র তৈরি করতে পেরেছিলেন, নিশ্চিতভাবে এটা বলা যায় না। আরেকটা কথা, এ সময়কেই নারীর ঐতিহাসিক লেখার সূচনাকাল বলে ধরে নেওয়া ঠিক হবে না।

গত শতাব্দীর পেশাদার নারীদের থেকে শত শত বছর আগে ইতিহাস নিয়ে লিখেছিলেন অপেশাদার নারীরা। ভালো এই যে তাদের শিক্ষার অভাব, লিঙ্গ ও নারীদের বিষয়গুলোর প্রতি অভিনিবেশ তাদের ইতিহাসকর্মকে শুধু আড়াল করে রেখেছিল। তবে ভয়ানক এই যে, পুরুষ প্রাধান্য বা পুরুষের আধিপত্য, সহিংসতা ও দমন নারীদের ইতিহাসকর্মকে চিরতরে অন্ধকারে নির্বাসিত করেছিল। গত শতকের নারী ইতিহাসবেত্তাদের প্রকৃত কৃতিত্ব এই যে, তারা তাদের পূর্বসূরি বোনদের ইতিহাসকর্ম অন্ধকার থেকে আলোয় তুলে এনেছিলেন।

পাঠশালায় ইতিহাসের আলোচনায় নারী চরিত্রের অনুপস্থিতি আমাদের এই ভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে যে, মৌলিক ও মুখ্য বিষয়গুলো নিয়ে নারীদের চিন্তা এবং অনুভূতি নথিভুক্ত করা হয়নি। অথচ প্রতিটি যুগে, প্রতিটি সংস্কৃতিতে যখনই নারীরা বিদ্যায়তন থেকে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে কিংবা তাদের অনুৎসাহিত করা হয়েছে অথবা জোর করে শিক্ষাগ্রহণ থেকে বিমুখ করা হয়েছে- তখনো নারীরা লিখেছেন, এঁকেছেন এবং তাদের গল্প বলেছেন। ইতিহাসবেত্তাদের সমস্যা হলো, নারী লেখকের সংখ্যা বরাবরই কম। এর ওপর নারী লেখকদের কর্তৃত্ব সব সময় প্রশ্নবিদ্ধ এবং পুরুষ প্রাধান্য বা লেখার বিষয়াদির জন্য বহু নারী লেখক আঁধারে-আড়ালেই রয়ে গেছেন।

প্রথম পেশাদার ইতিহাসবেত্তারা ছিলেন গ্রিক ও রোমান অধিবাসী। তাদের কাছ থেকেই ইতিহাসকে ‘পুরুষের কাহিনি’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার পশ্চিমা নজির পাওয়া যায়। এ ইতিহাস কখনই নারীর ছিল না। ধ্রুপদী রোমান সাহিত্যের [ব্রিটিশ] গবেষক মেরি বিয়ার্ড ব্যাখা করেছেন, কীভাবে প্রাচীনকালে প্রচলিত ধারায় পুরুষদের কাছে নারীর অধীনতা বা আজ্ঞানুবর্তিতা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে সংস্কৃতি ও বিবরণে গভীরভাবে বদ্ধমূল ধারণা তৈরি করেছিল। তিনি ‘হোমার’-এর ওডিসির লৈঙ্গিক বিশ্লেষণ করেছেন। উদাহরণ হিসেবে তিনি পেনেলোপের কথা তুলে ধরেন। বিয়ার্ড বলছেন, ‘যেমন হোমারে বর্ণিত আছে- একজন বেটাছেলের পুরুষ হয়ে ওঠার অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো, জনতার জল্পনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং নারীদের কণ্ঠস্বর নীরব করতে শেখা।’

বিয়ার্ড মনে করেন, সাহিত্যকর্মের প্রায় পুরোটায় নারী ক্ষমতার অর্থহীনতা ও হীনাবস্থাকে তুলে ধরা হয়েছে। পৌরাণিক অ্যামাজন নারী বিদ্রোহীদের সম্পর্কে গল্পগুলো বিশ্লেষণ করে বিয়ার্ড এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, ‘সব গল্পের অন্তর্নিহিত বার্তা- নারীর শাসন থেকে সভ্যতাকে রক্ষা করা পুরুষেরই কর্তব্য।’ বিয়ার্ড অত্যন্ত সুচারুভাবে দেখিয়েছেন, পশ্চিমের সাহিত্যকর্মে বাগ্মিতা ও ক্ষমতা সব সময়ই পুরুষের একক আধিপত্য এবং কর্তৃত্বের বলয় বলে প্রতীয়মান।

নারীদের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তাদের কর্ম সম্পর্কে তথ্য খুঁজে পাওয়াই অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। নারীরা তাদের ইতিহাস লিখে রাখেননি, এটা ধরে নিয়ে অনুসন্ধান না করার প্রবৃত্তিকে ন্যায্যতা দিতে চাইলে আমাদের অতীত ভুলের পুনরাবৃত্তির সমূহ আশঙ্কা আছেÑ আমাদের পূর্বপুরুষরা নারীদের জীবনের গল্পকে অবহেলা করেছিল এবং আমরা তাদের জীবন ও গল্পের নথি উন্মোচনের চেষ্টা না করে সেই অবহেলাকে জিইয়ে রেখেছি। [ব্রিটিশ ইতিহাসবেত্তা] রোজালিন্ড মাইলস বলেছেন, ‘এমনকি নারীদের কাজের সবচেয়ে স্বল্পকালীন জরিপ থেকেও বোঝা যায়- নারীদের কাজ পরিসর, পরিমাণ ও গুরুত্বের দিক থেকে ব্যাপকভাবে অবমূল্যায়িত হয়েছে; অন্তত নারীরা নিজেদের এত অবমূল্যায়ন করেন না।’ লেখালেখির ইতিহাসের শুরু থেকেই নারীরা তাদের গল্প লিখে আসছেন। কিন্তু তাদের অল্প কিছু গল্প ঐতিহাসিক পাঠের অংশ হতে পেরেছে।

হ্যান সাম্রাজ্যের আগে চীনে প্রথম ইতিহাসবেত্তাদের উত্থান হয়নি। তবে হ্যান শাসনামলে চীনে স্থিতিশীলতা এসেছিল, সম্পদে সমৃদ্ধ হয়েছিল। নারী বুদ্ধিজীবী ও নেতাদের সামনে সুবর্ণ সময় হয়ে দেখা দিয়েছিল এ সময়টা। চীনের প্রথম ইতিহাসবেত্তা নারী ছিলেন বান জ (৪৫-১১৭)। সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারের মানুষ ছিলেন তিনি। সাম্রাজ্যের আদালতে তাদের পারিবারিক মর্যাদা ছিল। তার বাবা বান বিয়ো ছিলেন একজন ইতিহাসবিদ। পূর্বসূরিদের চেয়ে ভালোভাবে ইতিহাস লিখতেন আগ্রহী ছিলেন তিনি। কিন্তু এত বিষয়ে ও বিশদ পরিসরে লিখতে শুরু করেছিলেন যা তার জীবদ্দশায় সম্পূর্ণ করা উচ্চাভিলাষীই ছিল বটে। সেই অসমাপ্ত ইতিহাস লেখার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন বান জ। তিনি ডনগুয়ান ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরির শিক্ষক ছিলেন। ওই গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত পুঁথি ও নথি দেখা এবং পড়ার অবাধ সুযোগ ছিল তার। রাজার আদালতে শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বান জ জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, ইতিহাস, কনফুসিয়ান সাহিত্য ও সমাজের দৃষ্টিতে নারীর গুণাবলি সম্পর্কে পড়াতেন। তিনি ক্ষমতাধর নারীদেরও পড়িয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন চীনের সম্রাজ্ঞী, সম্রাটের উপপত্নীরা ও সম্রাজ্ঞীর সেবাদাসীরা।

বান জ ক্ষমতাশালী ও নামজাদা নারীদের সঙ্গ পেয়েছিলেন। ফলে বাবার ইতিহাস সম্পন্ন করার পর তিনি যে নারীদের ইতিহাস লেখা শুরু করেছিলেন, এটা সহজেই অনুমান করা যায়। তিনি নারী শিক্ষা সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ লিখেছিলেন। ওটাই ছিল নারীদের সম্পর্কে প্রথম চীনা দর্শন- যা তার জীবদ্দশায় অনেক বেশি টিকে ছিল। বান জ তার সময় থেকে অনাক্রম্য ছিলেন না। তার চিন্তাধারায় প্রভাবশালী কনফুসিয়ান ভাবধারার প্রচণ্ড প্রভাবিত ছিল। পূর্বতনদের প্রতি আনুগত্য ও সম্মান করার ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়েছে কনফুসিয়ান মতাবদে। এই মতবাদের কারণে পরিবারের মধ্যে ক্ষমতার কঠোর ক্রমানুসার টিকিয়ে রাখা হতো- যেখানে কর্তৃত্ব নির্ধারণ হতো বয়স ও লিঙ্গ অনুযায়ী এবং নারীরা সেখানে অধীনস্তই থাকতেন।

বান জ লিখে গেছেন- ‘একজন নারীর চারটি গুণ থাকতে হবে : (১) নারীসুলভ গুণাবলি; (২) নারীসুলভ কথা; (৩) নারীসুলভ ভাবমূর্তি; (৪) নারীসুলভ কাজ। নারীসুলভ গুণাবলি বলতেই যে দীপ্ত-দক্ষতার দরকার, তা নয়। তবে অন্তত অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রমীভাবে ভিন্নতর হতে হবে। নারীসুলভ কথা বলা মানে বিতর্ক চতুর না হওয়া কিংবা কথোপকথনে উৎসাহী না হওয়া। নারীসুলভ প্রতিমায় সুন্দর মুখ কিংবা নির্ভুল গঠন আবশ্যিক নয়। নারীসুলভ কাজ বলতে অন্যদের চেয়ে নিপুণভাবে কাজ করার দক্ষতা না থাকা।’

নিজের কাজ মনে-প্রাণে করার জন্য এবং সব বিষয়ে স্বামী ও পরিবারের কাছে নিবেদন করার জন্য বান জ নারীদের প্রণোদিত করতেন। পুরুষ আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্বের এমন আদর্শ সমর্থনের জন্য তাকে কত যে ক্ষমতার চাপ অনুভব করতে হয়েছিল, তা ঠাহর করে কে বা বলতে পারেন! তার মনে কি এই ভয় ছিল যে, সমসাময়িক চিন্তকদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হলে পাছে তার সব কর্মই বাতিল বলে প্রত্যাখ্যাত হয়ে যায়? নাকি তিনি তার নির্দেশাবলিকে নারীর আপেক্ষিক মুক্তির পথ হিসেবে দেখেছিলেন? আধুনিক বুদ্ধিজীবীরা প্রায়ই তার কাজকে নারীর ভূমিকা ও সম্ভাবনাকে হ্রাস করা বলে সমালোচনা করেন। সম্ভবত তারা সঠিক। কিন্তু তিনি ছাড়া নারী শিক্ষার প্রতি মনোযোগ আদৌ আসত কিনা, বিস্তর সন্দেহ আছে।

বান জর মৃত্যুতে সম্রাজ্ঞী দ্বারা সম্মানিত হওয়া সত্ত্বেও তার কাজ পুরুষ পণ্ডিতদের দ্বারা উপেক্ষিত হয়েছিল। তার কাজ ছিল বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে খুবই বাস্তবধর্মী। কিন্তু তার সাহিত্যকর্ম বেশিরভাগ নারী পাঠকের নাগালের বাইরে রয়ে গিয়েছিল। তবে নারী সাক্ষরতার হার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার কর্মের পাঠক বেড়েছে। এর পাশাপাশি তার বিশিষ্টতাও স্পষ্ট হয়েছে বহুগুণে। এ জন্য পরবর্তীকালে নারী লেখকরা তাকে নারীর অবস্থান ও নারী শিক্ষার অগ্রদূত হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

বান জ অনন্য ছিলেন তার অবস্থানের কারণে। বিশ্ব ইতিহাসের কথা ধরলে বলা যায়, তারাই ইতিহাস লিখেছেন যারা ছিলেন বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত। বান জর ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। নারীদের প্রতি তার যে নির্দেশাবলি- এতে চীনে নারীদের, বিশেষ করে দরিদ্র নারীদের দুর্দশা উপেক্ষিত। চীনে ব্যাপক হারে নারী ভ্রুণ হত্যার যে ইতিহাস ছিল, সে বিষয়ে তিনি কোনো আলোকপাতই করেননি।

যতটুকু জানা গেছে, পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম পেশাদার ইতিহাসবিদ ছিলেন বাইজেন্টাইন প্রিন্সেস আনা কমেনা (১০৮৩-১১৫৩)। বান জর মতোই একজন মহীয়ান ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। আর দর্শন ও ইতিহাস সম্পর্কে তার নিজের ধারণাগুলো নথিভুক্ত করার মতো যথেষ্ট সুযোগও তিনি পেয়েছিলেন। তার জীবন ছিল অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। তিনি তার বাবা ও ভাইয়ের রাজত্ব দেখেছেন। ভাইকে উৎখাত করে স্বামীকে সিংহাসনে বসানোর ষড়যন্ত্রও তিনি করেছিলেন। ওই চক্রান্ত অবশ্য ব্যর্থ হয়েছিল। এর খেসারতও দিতে হয় তাকে ষড়যন্ত্রের কথা জানাজানি হওয়ার পর থেকে সন্ন্যাস-ভবনে জোরপূর্বক নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হয় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

এ কাহিনি দ্বাদশ শতকের। বন্দি থাকাকালে সন্ন্যাসীদের সহায়তায় কমেনা ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ঐতিহাসিক ধারাবিবরণী লিখেছিলেন পনেরো খণ্ডে। ওই সন্ন্যাস-ভবনে পাওয়া পুঁথি-নথি ও আপন অভিজ্ঞতার আলোকে এ বই তিনি লিখেছিলেন। ইতিহাসের এই গ্রন্থে তিনি প্রথম ধর্মযুদ্ধ [(১০৯৬-১০৯৯)] নিয়েও আলোকপাত করেছিলেন। পশ্চিমাদের প্রতি তার অবজ্ঞা ছিল অনেক। তার চোখে পশ্চিমারা ছিল বর্বর লুটেরা [(বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী)] কনস্টান্টিনোপলকে রক্ষা করতে যারা ব্যর্থ হয়েছিল। সমসাময়িক পুরুষ ইতিহাসবিদদের চেয়ে তার লেখা ইতিহাস বেশি ন্যায়নিষ্ট ছিল। তার লেখনীর মধ্যে ওই সময়ের পুরুষ লেখকদের মতো অতিরঞ্জিত করার প্রবণতা মোটেও ছিল না। তবে এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, এ বই স্বভাবতই তার বাবার প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। শাসক হিসেবে বাবার কিছু ব্যর্থতা কথা তুলে ধরলেও কমেনার অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি একে রঙিন ও চিত্রগ্রাহী করে তুলেছিল।

স্বামীর ভীরুতা ও সিংহাসন সুরক্ষিত করতে ব্যর্থতার জন্য বিরক্তিবোধ ও নিজের ওপর নিজের ঘৃণাবোধর কথা কমেনা লিখেছিলেন। তিনি অনুমান করেছিলেন, ‘সম্ভবত তাদের দুজনের জন্ম হওয়া উচিত ছিল বিপরীত লিঙ্গের মানুষ হয়ে।’

অবশ্যই কমেনা অন্যান্য ইতিহাসবিদদের মতোই রাজনীতি ও সামরিক বিষয়ে লিখেছিলেন। তবে বান জর মতো তিনিও নারীদের সম্পর্কে লেখার সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তার দাদি আনা ডালাসেনাকে লেখনীর মাধ্যমে মহিমান্বিত করার প্রয়াস নিয়েছিলেন। দাদি সম্পর্কে তিনি লিখে গেছেন :

‘জেনে কেউ বিস্মিত হতে পারে যে, আমার বাবা সম্রাট [প্রথম আলেক্সিয়াস কমেনাস] তার মাকে এমন মর্যাদার আসনে উন্নীত করেছিলেন এবং তার হাতে সম্পূর্ণ ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন। বলা চলে, সরকারের দায়িত্বভার ছেড়ে দিয়ে তিনি মায়ের শাসননীতি মেনে এগোচ্ছিলেন- যখন তার মা সাম্রাজ্যের রথ চালাচ্ছিলেন।’

‘আমার বাবা বর্বরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষমতা নিজের কাছে সংরক্ষিত রেখেছিলেন। আর রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, বেসামরিক কর্মচারী নির্বাচন এবং সাম্রাজ্যের রাজস্ব ও ব্যয়ের আর্থিক ব্যবস্থাপনার সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন মায়ের ওপর। এ কাহিনি পড়ে কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন, রাজকীয় সরকারকে অন্তঃপুরবাসীর হাতে অর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার বাবা ভুল করেছিলেন।’

‘কিন্তু একবার এই নারীর যোগ্যতা, তার শ্রেষ্ঠত্ব, তার বিবেচনাবোধ ও কঠোর পরিশ্রমের জন্য তার অসাধারণ সক্ষমতাকে বুঝতে পারলে আপনি সমালোচনা ছেড়ে বরং প্রশংসাই করবেন।’

‘রাষ্ট্রীয় বিষয়গুলো পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া আমার দাদির জন্য সৌভাগ্যই ছিল বটে। কীভাবে সংগঠিত করতে হয়, কীভাবে পরিচালনা করতে হয়- তা তিনি এত ভালোভাবে জানতেন যে, কেবল রোমান সাম্রাজ্যই নয়; সূর্যের অধীন থাকা অন্যসব রাজ্যকেও শাসন করতে সক্ষম ছিলেন…।’

‘কোনো কিছু দখল করার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিলেন এবং এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নিঃসন্দেহে চতুর ছিলেন। তার শুধু অসামান্য বুদ্ধিমত্তাই ছিল না, তার কথা বলার ক্ষমতাও ছিল অসাধারণ। তিনি সত্যিকার অর্থেই একজন অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তা ছিলেন। কখনই অযথা কথা বাড়াতেন না। কথায় কোনো দীর্ঘসূত্রতা রাখতেন না।’

‘দরিদ্রদের প্রতি তার যে মমতা, অসহায়দের প্রতি তার যে অমায়িক উদারতা- লিখে সবটা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তার ঘর ছিল অভাবী আত্মীয়দের জন্য আশ্রয়স্থল, আগন্তুকদের জন্য যেন এক টুকরো স্বর্গ। তার মূল চরিত্র ফুটে উঠত তার অভিব্যক্তিতেই। তিনি বলতেন- দেবদূতকে উপাসনা করো। আর রাক্ষসের জন্য নিজেই ছিলেন ত্রাস।’

দাদির প্রতি কমেনার এই যে দরদ কিংবা পক্ষাবলম্বন, এ থেকে বোঝা যায়- তার দাদি নিজের জীবদ্দশায় যোগ্য স্বীকৃতি পাননি। যে সময় সবকিছুই ছিল পুরুষপ্রধান, সে সময় নারীরা প্রাপ্ত ক্ষমতা কীভাবে প্রয়োগ করেছিলেন তার লেখা থেকে এও বোঝা যায়।

বান জর মতো কমেনার কর্মও পুরুষ ইতিহাসবিদদের মতো বিশিষ্টতা অর্জন করতে পারেনি। তবে কমেনা নারীত্বের জন্যই যে কেবল কামিয়াবি হতে পারেননি, তা নয়। তিনি তার ভাইয়ের সিংহাসনের বিশ্বাসঘাতক ছিলেন এবং ফলস্বরূপ নিঃসঙ্গ বন্দিজীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও বলব, তার লেখা উল্লেখযোগ্য ছিল। আধুনিক ইতিহাসবিদরা যেন তার বিবরণ উপেক্ষা করে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না করেন।

কালসি একার্ট : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, প্লাইমাউথ স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

রওশন আরা অমি : শিক্ষার্থী (স্নাতক, প্রথম বর্ষ), ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

কে ছিলেন পৃথিবীর প্রথম নারী ইতিহাসবিদ

আপডেট সময় ১১:০৬:১২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ জানুয়ারী ২০২৩

ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে নারীদের কথা ও কর্ম অন্তর্ভুক্তকরণে গৎবাঁধা নানা বাধা আছে। শুধু এখন নয়, অতীতেও এমন বাধা ছিল। পুরুষদের তুলনায় নারীদের কথা, কর্ম ও ভাবনা সম্পর্কে জানা সব সময়ই কঠিনতর কাজ। [ইংরেজ ইতিহাসবেত্তা] ড. বেটানি হিউজেস বলছেন, ইতিহাসের মাত্র ০.৫ শতাংশ লেখা হয়েছে নারীদের নিয়ে। [ভারতীয়] ইতিহাসবেত্তা অপর্ণা বসু এই সত্য উদ্ঘাটন করেছেন যে, ‘ইতিহাসের প্রচলিত পাঠ্যপুস্তকে শুধু সেসব নারীর নাম খুঁজে পাওয়া যায়- যারা সফলভাবে পুরুষের মতো ভূমিকা পালন করেছেন কিংবা যাকে যশস্বী কোনো পুরুষ ভালোবেসেছেন।’ ইতিহাসের শিক্ষকরা যা পড়ান, তা সবই হলো ‘পুরুষের পালা’ (his-story)। পুরুষভিন্ন যেন কোনো ইতিহাস নেই, কোনো আখ্যান-উপাখ্যান নেই।

ইতিহাস লেখা হতো মূলত পুরুষের দ্বারা এবং পুরুষদের সম্পর্কে। এমনকি যখন নারীরা ইতিহাস লিখেছেন, তখন তারা পুরুষদের নিয়েই লিখেছেন। ইতিহাস আলোকপাত করে রাজনীতি, কূটনীতি, ব্যবসা ও সামরিক ক্ষেত্রগুলোর ওপর। আর এই ক্ষেত্রগুলোয় নারীদের অপরিহার্য অনুপস্থিতি নারীদের ইতিহাসকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। তবে স্রোতের উজানে সামাজিক ইতিহাস লেখার অপেক্ষাকৃত নতুন অভিপ্রায় ও প্রয়াস নারীদের নিয়ে ইতিহাস রচনার এবং অতীত খুঁড়ে নারীদের কণ্ঠস্বর খুঁজে পাওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে।

আমরা নারীদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে কতটা জানি, সেই শূন্যতা পূরণের জন্য ১৯ শতকের শেষাংশে এবং ২০ শতকের শুরুর দিকে নারী ইতিহাসবেত্তারা নারীর অতীত ও বর্তমান সম্পর্কে পেশাগতভাবে লেখার জন্য কলম ধরা শুরু করেন। কেউ কেউ মাঝে মধ্যে তাদের ইতিহাসবেত্তা স্বামীদের সঙ্গে সহ-লেখক হিসেবেও লিখেছেন। প্রায় একই সময় নারী কলেজের উত্থান ঘটে। এই নারীরা নারীর ইতিহাস সম্পর্কে লেখার জন্য অগ্রসর হন। তবে তারা যে নারীদের জন্য ইতিহাসে নতুন একটা ক্ষেত্র তৈরি করতে পেরেছিলেন, নিশ্চিতভাবে এটা বলা যায় না। আরেকটা কথা, এ সময়কেই নারীর ঐতিহাসিক লেখার সূচনাকাল বলে ধরে নেওয়া ঠিক হবে না।

গত শতাব্দীর পেশাদার নারীদের থেকে শত শত বছর আগে ইতিহাস নিয়ে লিখেছিলেন অপেশাদার নারীরা। ভালো এই যে তাদের শিক্ষার অভাব, লিঙ্গ ও নারীদের বিষয়গুলোর প্রতি অভিনিবেশ তাদের ইতিহাসকর্মকে শুধু আড়াল করে রেখেছিল। তবে ভয়ানক এই যে, পুরুষ প্রাধান্য বা পুরুষের আধিপত্য, সহিংসতা ও দমন নারীদের ইতিহাসকর্মকে চিরতরে অন্ধকারে নির্বাসিত করেছিল। গত শতকের নারী ইতিহাসবেত্তাদের প্রকৃত কৃতিত্ব এই যে, তারা তাদের পূর্বসূরি বোনদের ইতিহাসকর্ম অন্ধকার থেকে আলোয় তুলে এনেছিলেন।

পাঠশালায় ইতিহাসের আলোচনায় নারী চরিত্রের অনুপস্থিতি আমাদের এই ভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে যে, মৌলিক ও মুখ্য বিষয়গুলো নিয়ে নারীদের চিন্তা এবং অনুভূতি নথিভুক্ত করা হয়নি। অথচ প্রতিটি যুগে, প্রতিটি সংস্কৃতিতে যখনই নারীরা বিদ্যায়তন থেকে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে কিংবা তাদের অনুৎসাহিত করা হয়েছে অথবা জোর করে শিক্ষাগ্রহণ থেকে বিমুখ করা হয়েছে- তখনো নারীরা লিখেছেন, এঁকেছেন এবং তাদের গল্প বলেছেন। ইতিহাসবেত্তাদের সমস্যা হলো, নারী লেখকের সংখ্যা বরাবরই কম। এর ওপর নারী লেখকদের কর্তৃত্ব সব সময় প্রশ্নবিদ্ধ এবং পুরুষ প্রাধান্য বা লেখার বিষয়াদির জন্য বহু নারী লেখক আঁধারে-আড়ালেই রয়ে গেছেন।

প্রথম পেশাদার ইতিহাসবেত্তারা ছিলেন গ্রিক ও রোমান অধিবাসী। তাদের কাছ থেকেই ইতিহাসকে ‘পুরুষের কাহিনি’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার পশ্চিমা নজির পাওয়া যায়। এ ইতিহাস কখনই নারীর ছিল না। ধ্রুপদী রোমান সাহিত্যের [ব্রিটিশ] গবেষক মেরি বিয়ার্ড ব্যাখা করেছেন, কীভাবে প্রাচীনকালে প্রচলিত ধারায় পুরুষদের কাছে নারীর অধীনতা বা আজ্ঞানুবর্তিতা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে সংস্কৃতি ও বিবরণে গভীরভাবে বদ্ধমূল ধারণা তৈরি করেছিল। তিনি ‘হোমার’-এর ওডিসির লৈঙ্গিক বিশ্লেষণ করেছেন। উদাহরণ হিসেবে তিনি পেনেলোপের কথা তুলে ধরেন। বিয়ার্ড বলছেন, ‘যেমন হোমারে বর্ণিত আছে- একজন বেটাছেলের পুরুষ হয়ে ওঠার অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো, জনতার জল্পনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং নারীদের কণ্ঠস্বর নীরব করতে শেখা।’

বিয়ার্ড মনে করেন, সাহিত্যকর্মের প্রায় পুরোটায় নারী ক্ষমতার অর্থহীনতা ও হীনাবস্থাকে তুলে ধরা হয়েছে। পৌরাণিক অ্যামাজন নারী বিদ্রোহীদের সম্পর্কে গল্পগুলো বিশ্লেষণ করে বিয়ার্ড এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, ‘সব গল্পের অন্তর্নিহিত বার্তা- নারীর শাসন থেকে সভ্যতাকে রক্ষা করা পুরুষেরই কর্তব্য।’ বিয়ার্ড অত্যন্ত সুচারুভাবে দেখিয়েছেন, পশ্চিমের সাহিত্যকর্মে বাগ্মিতা ও ক্ষমতা সব সময়ই পুরুষের একক আধিপত্য এবং কর্তৃত্বের বলয় বলে প্রতীয়মান।

নারীদের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তাদের কর্ম সম্পর্কে তথ্য খুঁজে পাওয়াই অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। নারীরা তাদের ইতিহাস লিখে রাখেননি, এটা ধরে নিয়ে অনুসন্ধান না করার প্রবৃত্তিকে ন্যায্যতা দিতে চাইলে আমাদের অতীত ভুলের পুনরাবৃত্তির সমূহ আশঙ্কা আছেÑ আমাদের পূর্বপুরুষরা নারীদের জীবনের গল্পকে অবহেলা করেছিল এবং আমরা তাদের জীবন ও গল্পের নথি উন্মোচনের চেষ্টা না করে সেই অবহেলাকে জিইয়ে রেখেছি। [ব্রিটিশ ইতিহাসবেত্তা] রোজালিন্ড মাইলস বলেছেন, ‘এমনকি নারীদের কাজের সবচেয়ে স্বল্পকালীন জরিপ থেকেও বোঝা যায়- নারীদের কাজ পরিসর, পরিমাণ ও গুরুত্বের দিক থেকে ব্যাপকভাবে অবমূল্যায়িত হয়েছে; অন্তত নারীরা নিজেদের এত অবমূল্যায়ন করেন না।’ লেখালেখির ইতিহাসের শুরু থেকেই নারীরা তাদের গল্প লিখে আসছেন। কিন্তু তাদের অল্প কিছু গল্প ঐতিহাসিক পাঠের অংশ হতে পেরেছে।

হ্যান সাম্রাজ্যের আগে চীনে প্রথম ইতিহাসবেত্তাদের উত্থান হয়নি। তবে হ্যান শাসনামলে চীনে স্থিতিশীলতা এসেছিল, সম্পদে সমৃদ্ধ হয়েছিল। নারী বুদ্ধিজীবী ও নেতাদের সামনে সুবর্ণ সময় হয়ে দেখা দিয়েছিল এ সময়টা। চীনের প্রথম ইতিহাসবেত্তা নারী ছিলেন বান জ (৪৫-১১৭)। সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারের মানুষ ছিলেন তিনি। সাম্রাজ্যের আদালতে তাদের পারিবারিক মর্যাদা ছিল। তার বাবা বান বিয়ো ছিলেন একজন ইতিহাসবিদ। পূর্বসূরিদের চেয়ে ভালোভাবে ইতিহাস লিখতেন আগ্রহী ছিলেন তিনি। কিন্তু এত বিষয়ে ও বিশদ পরিসরে লিখতে শুরু করেছিলেন যা তার জীবদ্দশায় সম্পূর্ণ করা উচ্চাভিলাষীই ছিল বটে। সেই অসমাপ্ত ইতিহাস লেখার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন বান জ। তিনি ডনগুয়ান ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরির শিক্ষক ছিলেন। ওই গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত পুঁথি ও নথি দেখা এবং পড়ার অবাধ সুযোগ ছিল তার। রাজার আদালতে শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বান জ জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, ইতিহাস, কনফুসিয়ান সাহিত্য ও সমাজের দৃষ্টিতে নারীর গুণাবলি সম্পর্কে পড়াতেন। তিনি ক্ষমতাধর নারীদেরও পড়িয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন চীনের সম্রাজ্ঞী, সম্রাটের উপপত্নীরা ও সম্রাজ্ঞীর সেবাদাসীরা।

বান জ ক্ষমতাশালী ও নামজাদা নারীদের সঙ্গ পেয়েছিলেন। ফলে বাবার ইতিহাস সম্পন্ন করার পর তিনি যে নারীদের ইতিহাস লেখা শুরু করেছিলেন, এটা সহজেই অনুমান করা যায়। তিনি নারী শিক্ষা সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত গ্রন্থ লিখেছিলেন। ওটাই ছিল নারীদের সম্পর্কে প্রথম চীনা দর্শন- যা তার জীবদ্দশায় অনেক বেশি টিকে ছিল। বান জ তার সময় থেকে অনাক্রম্য ছিলেন না। তার চিন্তাধারায় প্রভাবশালী কনফুসিয়ান ভাবধারার প্রচণ্ড প্রভাবিত ছিল। পূর্বতনদের প্রতি আনুগত্য ও সম্মান করার ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়েছে কনফুসিয়ান মতাবদে। এই মতবাদের কারণে পরিবারের মধ্যে ক্ষমতার কঠোর ক্রমানুসার টিকিয়ে রাখা হতো- যেখানে কর্তৃত্ব নির্ধারণ হতো বয়স ও লিঙ্গ অনুযায়ী এবং নারীরা সেখানে অধীনস্তই থাকতেন।

বান জ লিখে গেছেন- ‘একজন নারীর চারটি গুণ থাকতে হবে : (১) নারীসুলভ গুণাবলি; (২) নারীসুলভ কথা; (৩) নারীসুলভ ভাবমূর্তি; (৪) নারীসুলভ কাজ। নারীসুলভ গুণাবলি বলতেই যে দীপ্ত-দক্ষতার দরকার, তা নয়। তবে অন্তত অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রমীভাবে ভিন্নতর হতে হবে। নারীসুলভ কথা বলা মানে বিতর্ক চতুর না হওয়া কিংবা কথোপকথনে উৎসাহী না হওয়া। নারীসুলভ প্রতিমায় সুন্দর মুখ কিংবা নির্ভুল গঠন আবশ্যিক নয়। নারীসুলভ কাজ বলতে অন্যদের চেয়ে নিপুণভাবে কাজ করার দক্ষতা না থাকা।’

নিজের কাজ মনে-প্রাণে করার জন্য এবং সব বিষয়ে স্বামী ও পরিবারের কাছে নিবেদন করার জন্য বান জ নারীদের প্রণোদিত করতেন। পুরুষ আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্বের এমন আদর্শ সমর্থনের জন্য তাকে কত যে ক্ষমতার চাপ অনুভব করতে হয়েছিল, তা ঠাহর করে কে বা বলতে পারেন! তার মনে কি এই ভয় ছিল যে, সমসাময়িক চিন্তকদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হলে পাছে তার সব কর্মই বাতিল বলে প্রত্যাখ্যাত হয়ে যায়? নাকি তিনি তার নির্দেশাবলিকে নারীর আপেক্ষিক মুক্তির পথ হিসেবে দেখেছিলেন? আধুনিক বুদ্ধিজীবীরা প্রায়ই তার কাজকে নারীর ভূমিকা ও সম্ভাবনাকে হ্রাস করা বলে সমালোচনা করেন। সম্ভবত তারা সঠিক। কিন্তু তিনি ছাড়া নারী শিক্ষার প্রতি মনোযোগ আদৌ আসত কিনা, বিস্তর সন্দেহ আছে।

বান জর মৃত্যুতে সম্রাজ্ঞী দ্বারা সম্মানিত হওয়া সত্ত্বেও তার কাজ পুরুষ পণ্ডিতদের দ্বারা উপেক্ষিত হয়েছিল। তার কাজ ছিল বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে খুবই বাস্তবধর্মী। কিন্তু তার সাহিত্যকর্ম বেশিরভাগ নারী পাঠকের নাগালের বাইরে রয়ে গিয়েছিল। তবে নারী সাক্ষরতার হার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার কর্মের পাঠক বেড়েছে। এর পাশাপাশি তার বিশিষ্টতাও স্পষ্ট হয়েছে বহুগুণে। এ জন্য পরবর্তীকালে নারী লেখকরা তাকে নারীর অবস্থান ও নারী শিক্ষার অগ্রদূত হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

বান জ অনন্য ছিলেন তার অবস্থানের কারণে। বিশ্ব ইতিহাসের কথা ধরলে বলা যায়, তারাই ইতিহাস লিখেছেন যারা ছিলেন বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত। বান জর ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। নারীদের প্রতি তার যে নির্দেশাবলি- এতে চীনে নারীদের, বিশেষ করে দরিদ্র নারীদের দুর্দশা উপেক্ষিত। চীনে ব্যাপক হারে নারী ভ্রুণ হত্যার যে ইতিহাস ছিল, সে বিষয়ে তিনি কোনো আলোকপাতই করেননি।

যতটুকু জানা গেছে, পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম পেশাদার ইতিহাসবিদ ছিলেন বাইজেন্টাইন প্রিন্সেস আনা কমেনা (১০৮৩-১১৫৩)। বান জর মতোই একজন মহীয়ান ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। আর দর্শন ও ইতিহাস সম্পর্কে তার নিজের ধারণাগুলো নথিভুক্ত করার মতো যথেষ্ট সুযোগও তিনি পেয়েছিলেন। তার জীবন ছিল অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। তিনি তার বাবা ও ভাইয়ের রাজত্ব দেখেছেন। ভাইকে উৎখাত করে স্বামীকে সিংহাসনে বসানোর ষড়যন্ত্রও তিনি করেছিলেন। ওই চক্রান্ত অবশ্য ব্যর্থ হয়েছিল। এর খেসারতও দিতে হয় তাকে ষড়যন্ত্রের কথা জানাজানি হওয়ার পর থেকে সন্ন্যাস-ভবনে জোরপূর্বক নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হয় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

এ কাহিনি দ্বাদশ শতকের। বন্দি থাকাকালে সন্ন্যাসীদের সহায়তায় কমেনা ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ঐতিহাসিক ধারাবিবরণী লিখেছিলেন পনেরো খণ্ডে। ওই সন্ন্যাস-ভবনে পাওয়া পুঁথি-নথি ও আপন অভিজ্ঞতার আলোকে এ বই তিনি লিখেছিলেন। ইতিহাসের এই গ্রন্থে তিনি প্রথম ধর্মযুদ্ধ [(১০৯৬-১০৯৯)] নিয়েও আলোকপাত করেছিলেন। পশ্চিমাদের প্রতি তার অবজ্ঞা ছিল অনেক। তার চোখে পশ্চিমারা ছিল বর্বর লুটেরা [(বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী)] কনস্টান্টিনোপলকে রক্ষা করতে যারা ব্যর্থ হয়েছিল। সমসাময়িক পুরুষ ইতিহাসবিদদের চেয়ে তার লেখা ইতিহাস বেশি ন্যায়নিষ্ট ছিল। তার লেখনীর মধ্যে ওই সময়ের পুরুষ লেখকদের মতো অতিরঞ্জিত করার প্রবণতা মোটেও ছিল না। তবে এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, এ বই স্বভাবতই তার বাবার প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। শাসক হিসেবে বাবার কিছু ব্যর্থতা কথা তুলে ধরলেও কমেনার অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি একে রঙিন ও চিত্রগ্রাহী করে তুলেছিল।

স্বামীর ভীরুতা ও সিংহাসন সুরক্ষিত করতে ব্যর্থতার জন্য বিরক্তিবোধ ও নিজের ওপর নিজের ঘৃণাবোধর কথা কমেনা লিখেছিলেন। তিনি অনুমান করেছিলেন, ‘সম্ভবত তাদের দুজনের জন্ম হওয়া উচিত ছিল বিপরীত লিঙ্গের মানুষ হয়ে।’

অবশ্যই কমেনা অন্যান্য ইতিহাসবিদদের মতোই রাজনীতি ও সামরিক বিষয়ে লিখেছিলেন। তবে বান জর মতো তিনিও নারীদের সম্পর্কে লেখার সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তার দাদি আনা ডালাসেনাকে লেখনীর মাধ্যমে মহিমান্বিত করার প্রয়াস নিয়েছিলেন। দাদি সম্পর্কে তিনি লিখে গেছেন :

‘জেনে কেউ বিস্মিত হতে পারে যে, আমার বাবা সম্রাট [প্রথম আলেক্সিয়াস কমেনাস] তার মাকে এমন মর্যাদার আসনে উন্নীত করেছিলেন এবং তার হাতে সম্পূর্ণ ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন। বলা চলে, সরকারের দায়িত্বভার ছেড়ে দিয়ে তিনি মায়ের শাসননীতি মেনে এগোচ্ছিলেন- যখন তার মা সাম্রাজ্যের রথ চালাচ্ছিলেন।’

‘আমার বাবা বর্বরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষমতা নিজের কাছে সংরক্ষিত রেখেছিলেন। আর রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, বেসামরিক কর্মচারী নির্বাচন এবং সাম্রাজ্যের রাজস্ব ও ব্যয়ের আর্থিক ব্যবস্থাপনার সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন মায়ের ওপর। এ কাহিনি পড়ে কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন, রাজকীয় সরকারকে অন্তঃপুরবাসীর হাতে অর্পণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার বাবা ভুল করেছিলেন।’

‘কিন্তু একবার এই নারীর যোগ্যতা, তার শ্রেষ্ঠত্ব, তার বিবেচনাবোধ ও কঠোর পরিশ্রমের জন্য তার অসাধারণ সক্ষমতাকে বুঝতে পারলে আপনি সমালোচনা ছেড়ে বরং প্রশংসাই করবেন।’

‘রাষ্ট্রীয় বিষয়গুলো পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া আমার দাদির জন্য সৌভাগ্যই ছিল বটে। কীভাবে সংগঠিত করতে হয়, কীভাবে পরিচালনা করতে হয়- তা তিনি এত ভালোভাবে জানতেন যে, কেবল রোমান সাম্রাজ্যই নয়; সূর্যের অধীন থাকা অন্যসব রাজ্যকেও শাসন করতে সক্ষম ছিলেন…।’

‘কোনো কিছু দখল করার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিলেন এবং এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নিঃসন্দেহে চতুর ছিলেন। তার শুধু অসামান্য বুদ্ধিমত্তাই ছিল না, তার কথা বলার ক্ষমতাও ছিল অসাধারণ। তিনি সত্যিকার অর্থেই একজন অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তা ছিলেন। কখনই অযথা কথা বাড়াতেন না। কথায় কোনো দীর্ঘসূত্রতা রাখতেন না।’

‘দরিদ্রদের প্রতি তার যে মমতা, অসহায়দের প্রতি তার যে অমায়িক উদারতা- লিখে সবটা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তার ঘর ছিল অভাবী আত্মীয়দের জন্য আশ্রয়স্থল, আগন্তুকদের জন্য যেন এক টুকরো স্বর্গ। তার মূল চরিত্র ফুটে উঠত তার অভিব্যক্তিতেই। তিনি বলতেন- দেবদূতকে উপাসনা করো। আর রাক্ষসের জন্য নিজেই ছিলেন ত্রাস।’

দাদির প্রতি কমেনার এই যে দরদ কিংবা পক্ষাবলম্বন, এ থেকে বোঝা যায়- তার দাদি নিজের জীবদ্দশায় যোগ্য স্বীকৃতি পাননি। যে সময় সবকিছুই ছিল পুরুষপ্রধান, সে সময় নারীরা প্রাপ্ত ক্ষমতা কীভাবে প্রয়োগ করেছিলেন তার লেখা থেকে এও বোঝা যায়।

বান জর মতো কমেনার কর্মও পুরুষ ইতিহাসবিদদের মতো বিশিষ্টতা অর্জন করতে পারেনি। তবে কমেনা নারীত্বের জন্যই যে কেবল কামিয়াবি হতে পারেননি, তা নয়। তিনি তার ভাইয়ের সিংহাসনের বিশ্বাসঘাতক ছিলেন এবং ফলস্বরূপ নিঃসঙ্গ বন্দিজীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও বলব, তার লেখা উল্লেখযোগ্য ছিল। আধুনিক ইতিহাসবিদরা যেন তার বিবরণ উপেক্ষা করে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না করেন।

কালসি একার্ট : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, প্লাইমাউথ স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

রওশন আরা অমি : শিক্ষার্থী (স্নাতক, প্রথম বর্ষ), ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়