ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

ছোট শব্দ বড় ফজিলত

  • সূর্যোদয় ডেস্ক:
  • আপডেট সময় ১১:৪৫:৩১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪
  • ১১০১ বার পড়া হয়েছে

কুরআন ও হাদিসে আস্তাগফিরুল্লাহর বহুমুখী উপকারিতা বর্ণনা করা হয়েছে। আরবি দু’টি শব্দ মিলে আস্তাগফিরুল্লাহ গঠিত। অর্থ ‘আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি’। আপনার দ্বারা কোনো ভুল কাজ সংঘটিত হয়েছে, যা আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয়, সাথে সাথেই ইস্তেগফার বা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। সেই ক্ষমা প্রার্থনার ভাষা হবে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ অর্থাৎ ‘আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’ আল্লাহর একজন সত্যিকার বান্দার আচরণ এমনটিই হওয়া উচিত। ভুল হবে, সাথে সাথেই ক্ষমা প্রার্থনা করবে। এটি আনুগত্যশীল ও অনুগত বান্দার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমি বলেছি নিজেদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা চাও। নিঃসন্দেহে তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল। তিনি আকাশ থেকে তোমাদের ওপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষাবেন। সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দিয়ে সাহায্য করবেন, তোমাদের জন্য বাগান সৃষ্টি করবেন আর নদী-নালা প্রবাহিত করে দেবেন’ (সূরা নূহ : ১০-১২)। সূরা হুদে বর্ণিত হয়েছে- হজরত হুদ আ: তাঁর কওমের লোকদের বললেন, ‘হে আমার কওমের লোকেরা, তোমরা তোমাদের প্রভুর কাছে ইস্তেগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করো, তার দিকে ফিরে যাও। তিনি তোমাদের ওপর আসমান থেকে প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন এবং তোমাদের শক্তি ও ক্ষমতা আরো বাড়িয়ে দেবেন’ (আয়াত-৫২)। একই সূরায় বলা হয়েছে- ‘তোমরা আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার বা ক্ষমা চাও এবং তাঁর দিকে ফিরে এসো, তা হলে তিনি একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তোমাদের উত্তম জীবন সামগ্রী দেবেন এবং অনুগ্রহ লাভের যোগ্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার অনুগ্রহ দান করবেন’ (আয়াত-৩)।

ইস্তেগফারের উপকারিতাসমূহ : উল্লিখিত আয়াতসমূহে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা ইস্তেগফারের কয়েকটি উপকারিতার কথা বলেছেন।

১. আল্লাহ অপরাধ ক্ষমা করে দেন; ২. শক্তি ও ক্ষমতা বাড়িয়ে দেন; ৩. অনুগ্রহ দান করেন; ৪. আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষাণ; ৫. ধন-সম্পদ বাড়িয়ে দেন; ৬. সন্তান-সন্ততি দান করেন; ৭. ফসল, ফল ও ফলাদি উৎপন্ন করে দেন; ৮. নদী-নালা প্রবাহিত করে দেন।

আল কুরআনের বিভিন্ন স্থানে এ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আল কুরআনে বলা হয়েছে- আল্লাহদ্রোহিতার আচরণ মানুষের জীবনকে শুধু আখিরাতেই নয় দুনিয়াতেও সঙ্কীর্ণ করে দেয়। অপর পক্ষে কোনো জাতি যদি অবাধ্যতার পরিবর্তে ঈমান, তাকওয়া এবং আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার পথ অনুসরণ করে তাহলে তা শুধু আখিরাতের জন্যই কল্যাণকর হয় না, দুনিয়াতেও তার ওপর আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহ বর্ষিত হতে থাকে। সূরা ত্বোহায় বলা হয়েছে- ‘আর যে ব্যক্তি আমার জিকর (উপদেশমালা) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তার জন্য দুনিয়ায় সঙ্কীর্ণ জীবন এবং কিয়ামতের দিন আমি তাকে উঠাব অন্ধ করে’ (আয়াত-১২৪)। দুনিয়ায় সঙ্কীর্ণ জীবন মানে শুধু এই নয় যে, তাকে অভাব-অনটনের মধ্যে জীবনযাপন করতে হবে বরং এর অর্থ হচ্ছে এই যে, এখানে মানসিক স্থিরতা লাভ করতে পারবে না। কোটিপতি হওয়ার পরও মানসিক অস্থিরতায় ভুগবে। সাত মহাদেশের মহাপরাক্রমশালী সম্রাট হলেও মানসিক অস্থিরতা ও অতৃপ্তির হাত থেকে মুক্তি পাবে না। তার পার্থিব সাফল্যগুলো হবে হাজারো ধরনের অবৈধ কলাকৌশল অবলম্বনের ফল। এগুলোর কারণে নিজের বিবেকসহ চার পাশের পুরো সামাজিক পরিবেশের প্রত্যেকটি জিনিসের সাথে তার লাগাতার দ্বন্দ্ব চলতে থাকবে। যার ফলে সে কখনো মানসিক প্রশান্তি ও প্রকৃত সুখ লাভ করতে পারবে না। সূরা মায়িদায় বলা হয়েছে- ‘আহলে কিতাব যদি তাদের রবের পক্ষ থেকে প্রেরিত তাওরাত ইনজিল ও অন্যান্য আসমানি কিতাবের বিধানাবলি মেনে চলত তাহলে তাদের জন্য ওপর থেকেও রিজিক বর্ষিত হতো এবং নিচ থেকেও ফুটে বের হতো’ (আয়াত-৬৬)।

হজরত মূসা আ: বনি ইসরাইল জাতিকে এ কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তারা পুরোপুরি ও যথাযথভাবে আল্লাহর বিধান অনুসরণ করে চললে আল্লাহর রহমত ও বরকত কিভাবে তাদের ওপর বর্ষিত হবে এবং আল্লাহর কিতাবকে পেছনে ফেলে দিয়ে তাঁর নাফরমানি করতে থাকলে কিভাবে বালা-মুসিবত, আপদ-বিপদ ও ধ্বংস চতুর্দিক থেকে তাদেরকে ঘিরে ফেলবে। সূরা আরাফে বলা হয়েছে- ‘জনপদসমূহের অধিবাসীরা যদি ঈমান আনত এবং তাকওয়ার নীতি অনুসরণ করত তাহলে আমি তাদের জন্য আসমান ও জমিনের বরকতের দরজাসমূহ খুলে দিতাম’ (আয়াত-৯৬)।

যারা তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করে এবং ভুল-ত্রুটির জন্য ইস্তেগফার করে দুনিয়ায় তাদের অবস্থান করার জন্য যে সময় নির্ধারিত রয়েছে সেই সময় পর্যন্ত মহান আল্লাহ তায়ালা তাদের খারাপভাবে নয়; বরং ভালোভাবেই রাখবেন। তাঁর নিয়ামতসমূহ তাদের ওপর বর্ষিত হবে। তাঁর বরকত ও প্রাচুর্য লাভে তারা ধন্য হবে। তারা সুখী-সমৃদ্ধ থাকবে। তাদের জীবন শান্তিময় ও নিরাপদ হবে। লাঞ্ছনা, হীনতা ও দীনতার সাথে নয়; বরং সম্মান ও মর্যাদার সাথে জীবনযাপন করবে। এই বক্তব্যটি সূরা নাহলে এভাবে বলা হয়েছে- ‘যে ব্যক্তিই ঈমানসহকারে সৎকাজ করবে, সে পুরুষ হোক বা নারী, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব’ (আয়াত-৯৭)।

কুরআন মাজিদের এ নির্দেশনা অনুসারে কাজ করতে গিয়ে একবার দুর্ভিক্ষের সময় হজরত উমর রা: দোয়া করতে বের হলেন এবং শুধু ইস্তেগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করেই শেষ করলেন। সবাই বলল, হে আমিরুল মুমিনিন! আপনি তো আদৌ দোয়া করলেন না। তিনি বললেন, আমি আসমানের ওইসব দরজায় কড়াঘাত করেছি যেখান থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয়। এ কথা বলেই তিনি সূরা নূহের ১০-১২ আয়াত পাঠ করে শুনালেন (ইবনে জরির ও ইবনে কাসির)। অনুরূপ একবার এক ব্যক্তি হাসান বসরির মজলিসে অনাবৃষ্টির অভিযোগ করলে তিনি বললেন, আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করো। অপর এক ব্যক্তি দারিদ্র্যের কথা বলল। তৃতীয় এক ব্যক্তি বলল, আমার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। চতুর্থ এক ব্যক্তি বলল, আমার ফসলের মাঠে ফলন খুব কম হচ্ছে। তিনি সবাইকে একই জবাব দিলেন। অর্থাৎ আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করো। লোকেরা বলল, কী ব্যাপার যে, আপনি প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন সমস্যার একই প্রতিকার বলে দিচ্ছেন। তখন তিনি সূরা নূহের এই আয়াতগুলো পাঠ করে শুনালেন (তাফসিরে কাশশাফ)।

আল কুরআনের অনেক আয়াতে ইস্তেগফারের উল্লেখ রয়েছে। এটি নবী সা:-এর একটি প্রসিদ্ধ সুন্নাহ। তিনি সালাতের সালাম ফেরানোর পর ইস্তেগফার পাঠ করতেন। হজরত সাওবান রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: সালাত শেষ করে তিনবার ইস্তেগফার করতেন এবং বলতেন আল্লাহুম্মা আনতাস সালামু ওয়া মিনকাস সালাম তাবারাকতা ইয়া জাল জালালি ওয়াল ইকরাম’ (অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমিই শান্তিময় এবং তোমার থেকে শান্তি আসে। তুমি কল্যাণময় এবং সম্মান ও প্রতিপত্তির অধিকারী)। হাদিস বর্ণনাকারী ওয়ালিদ বলেন, আমি আওজাইকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি কিভাবে ইস্তেগফার করতেন। তিনি বললেন, তিনি বলতেন, আস্তাগফিরুল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ (মুসলিম-১২২১)।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতএব, হে নবী! ভালো করে জেনে নাও, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ ইবাদতের যোগ্য নয়। নিজের ত্রুটির জন্য ইস্তেগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং মুমিন নারী ও পুরুষের জন্যও। আল্লাহ তোমাদের তৎপরতা সম্পর্কে অবহিত এবং তোমাদের ঠিকানা সম্পর্কেও অবহিত’ (সূরা মুহাম্মদ-১৯)। ইসলাম মানুষকে যেসব নৈতিক শিক্ষা দিয়েছে তার একটি হচ্ছে বান্দা তার প্রভুর বন্দেগি ও ইবাদত করবে এবং তাঁর দ্বীনের জন্য জীবনপাত করতে নিজের পক্ষ থেকে যত চেষ্টা সাধনাই করুক না কেন, তার মধ্যে এমন ধারণা কখনো আসা উচিত নয় যে, তার যা করা উচিত ছিল তা সে করেছে। তার বরং মনে করা উচিত যে, তার ওপর তার মালিকের যে দাবি ও অধিকার ছিল তা সে পালন করতে পারেনি। তার উচিত সবসময় দোষ-ত্রুটি স্বীকার করে আল্লাহর কাছে এ দোয়া করা যে, তোমার কাছে আমার যে ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অপরাধ হয়েছে তা ক্ষমা করে দাও। আল্লাহর যেসব বান্দা তাঁর বন্দেগি করবে, তারা যেন তার নিজের এ কাজের জন্য তার অন্তরে গর্ব ও অহঙ্কারের লেশমাত্র প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য বেশি বেশি ইস্তেগফার করবে। আল্লাহর প্রিয়জনরা মর্যাদার উচ্চ শিখরে অবস্থান করার পরও এবং নিজেদের মহামূল্যবান খেদমত সত্ত্বেও তাঁরা প্রভুর সামনে নিজের অপরাধ স্বীকার করেছেন। এ অবস্থা ও মানসিকতার কারণেই রাসূলুল্লাহ সা: সালাত সম্পন্ন করার পর সাথে সাথে তিনবার আস্তাগফিরুল্লাহ বলতেন। এর বাইরেও তিনি বেশি বেশি ইস্তেগফার করতেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তুমি তোমার রবের হামদসহকারে তাঁর তাসবিহ পড় এবং তাঁর কাছে ইস্তেগফার করো’ (সূরা নসর-৩)।

উপরোল্লেখিত আয়াতগুলো ছাড়াও সূরা নিসা-১০৬, ১১০, সূরা হুদ-৫২ ও আনফাল-৩৩-এ ইস্তেগফারের কথা বলা হয়েছে।

লেখক :

  • জাফর আহমাদ

প্রবন্ধকার ও গবেষক

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

ছোট শব্দ বড় ফজিলত

আপডেট সময় ১১:৪৫:৩১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৮ জুন ২০২৪

কুরআন ও হাদিসে আস্তাগফিরুল্লাহর বহুমুখী উপকারিতা বর্ণনা করা হয়েছে। আরবি দু’টি শব্দ মিলে আস্তাগফিরুল্লাহ গঠিত। অর্থ ‘আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি’। আপনার দ্বারা কোনো ভুল কাজ সংঘটিত হয়েছে, যা আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয়, সাথে সাথেই ইস্তেগফার বা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। সেই ক্ষমা প্রার্থনার ভাষা হবে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ অর্থাৎ ‘আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’ আল্লাহর একজন সত্যিকার বান্দার আচরণ এমনটিই হওয়া উচিত। ভুল হবে, সাথে সাথেই ক্ষমা প্রার্থনা করবে। এটি আনুগত্যশীল ও অনুগত বান্দার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।

আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমি বলেছি নিজেদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা চাও। নিঃসন্দেহে তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল। তিনি আকাশ থেকে তোমাদের ওপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষাবেন। সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দিয়ে সাহায্য করবেন, তোমাদের জন্য বাগান সৃষ্টি করবেন আর নদী-নালা প্রবাহিত করে দেবেন’ (সূরা নূহ : ১০-১২)। সূরা হুদে বর্ণিত হয়েছে- হজরত হুদ আ: তাঁর কওমের লোকদের বললেন, ‘হে আমার কওমের লোকেরা, তোমরা তোমাদের প্রভুর কাছে ইস্তেগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করো, তার দিকে ফিরে যাও। তিনি তোমাদের ওপর আসমান থেকে প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন এবং তোমাদের শক্তি ও ক্ষমতা আরো বাড়িয়ে দেবেন’ (আয়াত-৫২)। একই সূরায় বলা হয়েছে- ‘তোমরা আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার বা ক্ষমা চাও এবং তাঁর দিকে ফিরে এসো, তা হলে তিনি একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তোমাদের উত্তম জীবন সামগ্রী দেবেন এবং অনুগ্রহ লাভের যোগ্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার অনুগ্রহ দান করবেন’ (আয়াত-৩)।

ইস্তেগফারের উপকারিতাসমূহ : উল্লিখিত আয়াতসমূহে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা ইস্তেগফারের কয়েকটি উপকারিতার কথা বলেছেন।

১. আল্লাহ অপরাধ ক্ষমা করে দেন; ২. শক্তি ও ক্ষমতা বাড়িয়ে দেন; ৩. অনুগ্রহ দান করেন; ৪. আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষাণ; ৫. ধন-সম্পদ বাড়িয়ে দেন; ৬. সন্তান-সন্ততি দান করেন; ৭. ফসল, ফল ও ফলাদি উৎপন্ন করে দেন; ৮. নদী-নালা প্রবাহিত করে দেন।

আল কুরআনের বিভিন্ন স্থানে এ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আল কুরআনে বলা হয়েছে- আল্লাহদ্রোহিতার আচরণ মানুষের জীবনকে শুধু আখিরাতেই নয় দুনিয়াতেও সঙ্কীর্ণ করে দেয়। অপর পক্ষে কোনো জাতি যদি অবাধ্যতার পরিবর্তে ঈমান, তাকওয়া এবং আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার পথ অনুসরণ করে তাহলে তা শুধু আখিরাতের জন্যই কল্যাণকর হয় না, দুনিয়াতেও তার ওপর আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহ বর্ষিত হতে থাকে। সূরা ত্বোহায় বলা হয়েছে- ‘আর যে ব্যক্তি আমার জিকর (উপদেশমালা) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তার জন্য দুনিয়ায় সঙ্কীর্ণ জীবন এবং কিয়ামতের দিন আমি তাকে উঠাব অন্ধ করে’ (আয়াত-১২৪)। দুনিয়ায় সঙ্কীর্ণ জীবন মানে শুধু এই নয় যে, তাকে অভাব-অনটনের মধ্যে জীবনযাপন করতে হবে বরং এর অর্থ হচ্ছে এই যে, এখানে মানসিক স্থিরতা লাভ করতে পারবে না। কোটিপতি হওয়ার পরও মানসিক অস্থিরতায় ভুগবে। সাত মহাদেশের মহাপরাক্রমশালী সম্রাট হলেও মানসিক অস্থিরতা ও অতৃপ্তির হাত থেকে মুক্তি পাবে না। তার পার্থিব সাফল্যগুলো হবে হাজারো ধরনের অবৈধ কলাকৌশল অবলম্বনের ফল। এগুলোর কারণে নিজের বিবেকসহ চার পাশের পুরো সামাজিক পরিবেশের প্রত্যেকটি জিনিসের সাথে তার লাগাতার দ্বন্দ্ব চলতে থাকবে। যার ফলে সে কখনো মানসিক প্রশান্তি ও প্রকৃত সুখ লাভ করতে পারবে না। সূরা মায়িদায় বলা হয়েছে- ‘আহলে কিতাব যদি তাদের রবের পক্ষ থেকে প্রেরিত তাওরাত ইনজিল ও অন্যান্য আসমানি কিতাবের বিধানাবলি মেনে চলত তাহলে তাদের জন্য ওপর থেকেও রিজিক বর্ষিত হতো এবং নিচ থেকেও ফুটে বের হতো’ (আয়াত-৬৬)।

হজরত মূসা আ: বনি ইসরাইল জাতিকে এ কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তারা পুরোপুরি ও যথাযথভাবে আল্লাহর বিধান অনুসরণ করে চললে আল্লাহর রহমত ও বরকত কিভাবে তাদের ওপর বর্ষিত হবে এবং আল্লাহর কিতাবকে পেছনে ফেলে দিয়ে তাঁর নাফরমানি করতে থাকলে কিভাবে বালা-মুসিবত, আপদ-বিপদ ও ধ্বংস চতুর্দিক থেকে তাদেরকে ঘিরে ফেলবে। সূরা আরাফে বলা হয়েছে- ‘জনপদসমূহের অধিবাসীরা যদি ঈমান আনত এবং তাকওয়ার নীতি অনুসরণ করত তাহলে আমি তাদের জন্য আসমান ও জমিনের বরকতের দরজাসমূহ খুলে দিতাম’ (আয়াত-৯৬)।

যারা তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করে এবং ভুল-ত্রুটির জন্য ইস্তেগফার করে দুনিয়ায় তাদের অবস্থান করার জন্য যে সময় নির্ধারিত রয়েছে সেই সময় পর্যন্ত মহান আল্লাহ তায়ালা তাদের খারাপভাবে নয়; বরং ভালোভাবেই রাখবেন। তাঁর নিয়ামতসমূহ তাদের ওপর বর্ষিত হবে। তাঁর বরকত ও প্রাচুর্য লাভে তারা ধন্য হবে। তারা সুখী-সমৃদ্ধ থাকবে। তাদের জীবন শান্তিময় ও নিরাপদ হবে। লাঞ্ছনা, হীনতা ও দীনতার সাথে নয়; বরং সম্মান ও মর্যাদার সাথে জীবনযাপন করবে। এই বক্তব্যটি সূরা নাহলে এভাবে বলা হয়েছে- ‘যে ব্যক্তিই ঈমানসহকারে সৎকাজ করবে, সে পুরুষ হোক বা নারী, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব’ (আয়াত-৯৭)।

কুরআন মাজিদের এ নির্দেশনা অনুসারে কাজ করতে গিয়ে একবার দুর্ভিক্ষের সময় হজরত উমর রা: দোয়া করতে বের হলেন এবং শুধু ইস্তেগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করেই শেষ করলেন। সবাই বলল, হে আমিরুল মুমিনিন! আপনি তো আদৌ দোয়া করলেন না। তিনি বললেন, আমি আসমানের ওইসব দরজায় কড়াঘাত করেছি যেখান থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয়। এ কথা বলেই তিনি সূরা নূহের ১০-১২ আয়াত পাঠ করে শুনালেন (ইবনে জরির ও ইবনে কাসির)। অনুরূপ একবার এক ব্যক্তি হাসান বসরির মজলিসে অনাবৃষ্টির অভিযোগ করলে তিনি বললেন, আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করো। অপর এক ব্যক্তি দারিদ্র্যের কথা বলল। তৃতীয় এক ব্যক্তি বলল, আমার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। চতুর্থ এক ব্যক্তি বলল, আমার ফসলের মাঠে ফলন খুব কম হচ্ছে। তিনি সবাইকে একই জবাব দিলেন। অর্থাৎ আল্লাহর কাছে ইস্তেগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করো। লোকেরা বলল, কী ব্যাপার যে, আপনি প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন সমস্যার একই প্রতিকার বলে দিচ্ছেন। তখন তিনি সূরা নূহের এই আয়াতগুলো পাঠ করে শুনালেন (তাফসিরে কাশশাফ)।

আল কুরআনের অনেক আয়াতে ইস্তেগফারের উল্লেখ রয়েছে। এটি নবী সা:-এর একটি প্রসিদ্ধ সুন্নাহ। তিনি সালাতের সালাম ফেরানোর পর ইস্তেগফার পাঠ করতেন। হজরত সাওবান রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: সালাত শেষ করে তিনবার ইস্তেগফার করতেন এবং বলতেন আল্লাহুম্মা আনতাস সালামু ওয়া মিনকাস সালাম তাবারাকতা ইয়া জাল জালালি ওয়াল ইকরাম’ (অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমিই শান্তিময় এবং তোমার থেকে শান্তি আসে। তুমি কল্যাণময় এবং সম্মান ও প্রতিপত্তির অধিকারী)। হাদিস বর্ণনাকারী ওয়ালিদ বলেন, আমি আওজাইকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি কিভাবে ইস্তেগফার করতেন। তিনি বললেন, তিনি বলতেন, আস্তাগফিরুল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ (মুসলিম-১২২১)।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতএব, হে নবী! ভালো করে জেনে নাও, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ ইবাদতের যোগ্য নয়। নিজের ত্রুটির জন্য ইস্তেগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং মুমিন নারী ও পুরুষের জন্যও। আল্লাহ তোমাদের তৎপরতা সম্পর্কে অবহিত এবং তোমাদের ঠিকানা সম্পর্কেও অবহিত’ (সূরা মুহাম্মদ-১৯)। ইসলাম মানুষকে যেসব নৈতিক শিক্ষা দিয়েছে তার একটি হচ্ছে বান্দা তার প্রভুর বন্দেগি ও ইবাদত করবে এবং তাঁর দ্বীনের জন্য জীবনপাত করতে নিজের পক্ষ থেকে যত চেষ্টা সাধনাই করুক না কেন, তার মধ্যে এমন ধারণা কখনো আসা উচিত নয় যে, তার যা করা উচিত ছিল তা সে করেছে। তার বরং মনে করা উচিত যে, তার ওপর তার মালিকের যে দাবি ও অধিকার ছিল তা সে পালন করতে পারেনি। তার উচিত সবসময় দোষ-ত্রুটি স্বীকার করে আল্লাহর কাছে এ দোয়া করা যে, তোমার কাছে আমার যে ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অপরাধ হয়েছে তা ক্ষমা করে দাও। আল্লাহর যেসব বান্দা তাঁর বন্দেগি করবে, তারা যেন তার নিজের এ কাজের জন্য তার অন্তরে গর্ব ও অহঙ্কারের লেশমাত্র প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য বেশি বেশি ইস্তেগফার করবে। আল্লাহর প্রিয়জনরা মর্যাদার উচ্চ শিখরে অবস্থান করার পরও এবং নিজেদের মহামূল্যবান খেদমত সত্ত্বেও তাঁরা প্রভুর সামনে নিজের অপরাধ স্বীকার করেছেন। এ অবস্থা ও মানসিকতার কারণেই রাসূলুল্লাহ সা: সালাত সম্পন্ন করার পর সাথে সাথে তিনবার আস্তাগফিরুল্লাহ বলতেন। এর বাইরেও তিনি বেশি বেশি ইস্তেগফার করতেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তুমি তোমার রবের হামদসহকারে তাঁর তাসবিহ পড় এবং তাঁর কাছে ইস্তেগফার করো’ (সূরা নসর-৩)।

উপরোল্লেখিত আয়াতগুলো ছাড়াও সূরা নিসা-১০৬, ১১০, সূরা হুদ-৫২ ও আনফাল-৩৩-এ ইস্তেগফারের কথা বলা হয়েছে।

লেখক :

  • জাফর আহমাদ

প্রবন্ধকার ও গবেষক