আগুন ও ধসে পড়ার ঝুঁকিতে থাকা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আটটি মার্কেট ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব মার্কেট ভেঙে সেখানে আধুনিক বহুতল মার্কেট নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে ডিএনসিসি। বারবার চিঠি দেওয়ার পরও ব্যবসায়ীরা মার্কেট ছেড়ে না দেওয়ায় এবার কঠোর হতে যাচ্ছে ডিএনসিসি। ঝুঁকিপূর্ণ এসব মার্কেটের বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, টেলিফোনসহ সব সেবা সংস্থার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।
মেয়রের নির্দেশের পর সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে মার্কেটগুলোর দোকান মালিকদের বরাবর চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। ভাঙার জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও নিয়োগ করা হয়েছে। খুব শিগগিরই মার্কেটগুলোতে অভিযান চালাতে যাচ্ছে সিটি করপোরেশন। তবে মার্র্কেটগুলোতে বিদ্যমান দোকানগুলো কোথায় যাবে, কীভাবে ব্যবসা পরিচালনা করবে- এ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা জানাতে পারেনি সিটি করপোরেশন। একসঙ্গে এতগুলো দোকান উচ্ছেদ করা হলে ব্যবসায়ীদের বিরাট সংকটে পড়ার আশঙ্কা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে জীবনের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ভেঙে ফেলতে কাজ শুরু করছে সিটি করপোরেশন।
কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের ভবনটি রেট্রোফিটিং করার জন্য বুয়েটের কারিগরি দল ২০০৯ সালে সুপারিশ করে। এরপর ১৪ বছরেও ভবনটিতে কোনো কাজ করেনি সিটি করপোরেশন। কারওয়ান বাজারের ভবনটি ১৯৮৬ সালে নির্মিত। সে হিসেবে ভবনের বয়স হয়েছে মাত্র ৩৭ বছর।
ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘বারবার নোটিশ দেওয়ার পরও ব্যবসায়ীরা মার্কেট ছেড়ে যাচ্ছেন না। এবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সমস্ত সেবা সংস্থার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে। সেবা সংস্থার সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন করা হলে বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ীরা চলে যাবেন।’
মার্কেটগুলো বন্ধ হলে ব্যবসায়ীরা সংকট পড়বেন- এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র বলেন, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা সবার আগে। ব্যবসায়িক ক্ষতি হতে পারে; কিন্তু আগুন লেগে বা ধসে পড়ে প্রাণহানি ঘটলে সে ক্ষতি কে দেবে? তাই আগে মানুষের নিরাপত্তা, পরে ব্যবসা।
ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আ ন ম তরিকুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘মেয়রের নির্দেশের পর আমরা প্রকৌশল বিভাগকে চিঠি দিয়েছি। এরই মধ্যে মার্কেটগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে নোটিশ টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভাঙার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটও নিয়োগ করা হয়েছে। রাজস্ব বিভাগ থেকে অতি নাজুক আটটি মার্কেটের সব সেবা সংস্থার (গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি) সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে প্রকৌশল বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়েছে গত ২৪ এপ্রিল। প্রকৌশল বিভাগ সে চিঠিতে নোট দিয়ে ফেরত দিয়েছে।’
গুলশান উত্তর ডিএনসিসির কাঁচাবাজার দোকান মালিক ব্যবসায়ী সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবদুল মালেক আমাদের সময়কে বলেন, ‘শুনেছি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করেছে। তারা ভেঙে ফেলবে। আমাদের সঙ্গে একটি বৈঠক হয়েছে। আবারো বৈঠক হওয়ার কথা। আমাদের জায়গা না দিয়ে কীভাবে ভাঙে? এটা তো তারা করতে পারে না।’
কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটটি ১৯৮৪ সালে নির্মিত। নির্মাণের দুই বছর পর ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কেট হস্তান্তর করা হয়। এরপর ২০১৯ সালে সিটি করপোরেশন মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে। বুয়েটের প্রকৌশল বিভাগের মূল্যায়ন অনুযায়ী একটি ভবন ৯৯ থেকে ১০০ বছরের জন্য নির্মাণ করা হয়। তিনি বলেন, ভবনটি ১২ তলা হবার কথা, করল ৫ তলা। এখন ৩২ বছর পর এসে বললো ঝুঁকিপূর্ণ। এটা কি মগের মুল্লুক? আমরা ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়েছি, ৩২ বছরের জন্য নয়।
উন্নত দেশগুলোতে রেট্রোফিটিং বহুল প্রচলিত ভবন সংস্কার পদ্ধতি। ডেভেলপার ও বিল্ডিং সার্ভিস কোম্পানিগুলো পুরো স্ট্রাকচার ডিজাইন করা থেকে যাবতীয় সংস্কার ও পরিচর্যামূলক কাজ পরিচালনা করে থাকে। এগুলোর ভেতর বহুতল শপিংমল, ঐতিহ্যবাহী পুরনো স্থাপনা ও পূর্বপরুষের স্থাপনার সংখ্যাই বেশি।
বুয়েট যখন সুপারিশ করেছিল, সে সময় ঢাকা সিটি করপোরেশন ছিল একটি। এরপর প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণে ভাগ করা হয়। কিন্তু এই ভাগের আগে বা পরে সুপারিশ বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।
নগর কর্তৃপক্ষের নথিপত্র বলছে, গত চার বছরে ডিএনসিসি সম্পত্তি বিভাগ থেকে প্রকৌশল বিভাগে এ বিষয়ে পাঁচবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে পরিত্যক্ত ঘোষণা করার পর এসব ভবন অবকাঠামোর মূল্য নির্ধারণ এবং নিলাম আয়োজনের তাগাদা দেওয়া হয়।
সবশেষ ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ডিএনসিসির প্রধান প্রকৌশলীর কাছে পাঠানো চিঠিতে তৎকালীন প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক লিখেছিলেন, পরিত্যক্ত মার্কেট ভবন ভেঙে সেখানে আধুনিক বহুতল শপিংমল ও মার্কেট নির্মাণের জন্য প্রকৌশল বিভাগ এবং মার্কেটের স্থায়ী বরাদ্দ গ্রহীতাদের অস্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তাকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পরিত্যক্ত মার্কেট ভবনগুলোর অবকাঠামো নিলামে বিক্রয় বা অপসারণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে সরকারি মূল্য নির্ধারণের জন্য ৪ বার অনুরোধ করা হলেও মার্কেটের কোনো সরকারি মূল্য পাওয়া যায়নি। বিলম্বের কারণে এসব মার্কেটে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ‘সম্পত্তি বিভাগ দায়ী থাকবে না’, এমন কথাও লেখা হয় সেই চিঠিতে।
ঈদের পর কিছু মার্কেট বন্ধ করে দেওয়া হবে, এ কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানও। ঈদের আগে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, ঈদের ঠিক পরে ঢাকার কিছু বিপণিবিতান বন্ধ করে দেওয়া হবে। এক বা দুটো বিপণিবিতানকে আমরা মনে করি অনিরাপদ এবং সেখানে আকস্মিক দুর্ঘটনা (ডিজাস্টার) ঘটতে পারে। তাদের বিষয়ে আমাদের কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
অতি নাজুক হিসেবে চিহ্নিত আটটি মার্কেট হচ্ছে মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেট (পাকা ও কাঁচা মার্কেট), গুলশান কাঁচা মার্কেট (উত্তর) গুলশান-২, গুলশান পাকা মার্কেট (দক্ষিণ) গুলশান-১, রায়ের বাজার মার্কেট, কারওয়ান বাজার কাঁচা মার্কেট (কিচেন মার্কেট), কারওয়ান বাজার ১ নম্বর ভবন মার্কেট, কারওয়ান বাজার ২ নম্বর ভবন মার্কেট ও কারওয়ান বাজার আড়ত ভবন।