ঢাকা , শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

ডলারের মূল্য নিয়ন্ত্রণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি ব্যবহারের কথা ভাবছে বাংলাদেশ ব্যাংক

  • সূর্যোদয় ডেস্ক:
  • আপডেট সময় ১০:৪০:২৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২৪
  • ১১১৫ বার পড়া হয়েছে

বাংলাদেশের বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির হারে লাগাম টানার লক্ষ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

নতুন মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার আরো এক দফা বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা হয়েছে।

এর আগে সর্বশেষ গত বছরের নভেম্বরে নীতি সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে সাত দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছিল।

সেইসাথে ডলারের বিনিময় মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে ‘ক্রলিং পেগ’ নামে নতুন একটি পদ্ধতি ব্যবহারের চিন্তা করা হচ্ছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে।

‘ক্রলিং পেগ’হচ্ছে দেশিয় মুদ্রার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি।

এই পদ্ধতিতে একটি মুদ্রার বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করার অনুমতি দেয়া হয়।

এক্ষেত্রে মুদ্রার দরের একটি সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করা থাকে। ফলে একবারেই খুব বেশি বাড়তে পারবে না, আবার কমতেও পারবে না।

বুধবার বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মেলনকক্ষে জানুয়ারি-জুন মাস পর্যন্ত ছয় মাসের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নতুন দফায় সরকার গঠনের পর প্রথম একটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হলো।

ঘোষণাটি এমন এক সময়ে আসলো যখন মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভ সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ চাপের মুখে রয়েছে।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

তাদের সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের অংশ হিসেবেই নতুন মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি কমানোর প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে।

এর আগে জুন মাসে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে সুদহারের সীমা তুলে দেয়া হয়েছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এ সময় জানান, মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশের মধ্যে ধরে রাখার লক্ষ্য নিয়েই ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জানুয়ারি-জুন দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি তৈরি করা হয়েছে।

নতুন এই মুদ্রানীতির মাধ্যমে আগামী জুন মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার সাত দশমিক পাঁচ শতাংশে এবং বছর শেষে ছয় শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন তিনি।

এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হচ্ছে না।

এ বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে একটু সময়ের প্রয়োজন হয়। বেশ সময় লেগে যায়। আগের চেয়ে না বাড়লেও গত নভেম্বর থেকে ক্রমাগত কমছে মূল্যস্ফীতি।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে দেশে এখন সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে নয় দশমিক ৪১ শতাংশ।

আরো যা বলা হয়েছে
গত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশে ডলার সঙ্কট চলছে। এতে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১১০ টাকা হয়েছে। যদিও খোলা বাজারে লেনদেন হচ্ছে আরো বেশি দামে।

এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে।

২০২১ সালের আগস্টে যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল প্রায় ৪৮ বিলিয়ন ডলার, সঙ্কটের কারণে সেটি অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে, বর্তমানে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে ২৫ দশমিক ৫৬ বিয়িলন ডলার।

তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী, এখন রিজার্ভ ২০ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার।

এই পরিস্থিতিতে বিদেশী মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণে নতুন মুদ্রানীতিতে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি ব্যবহারের কথা চিন্তা করা হচ্ছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

‘ক্রলিং পেগ’হচ্ছে দেশিয় মুদ্রার সাথে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি।

এই পদ্ধতিতে একটি মুদ্রার বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করার অনুমতি দেয়া হয়।

এক্ষেত্রে মুদ্রার দরের একটি সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করা থাকে। ফলে একবারেই খুব বেশি বাড়তে পারবে না, আবার কমতেও পারবে না।

ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, কোস্টারিকাসহ কিছু দেশ এই পদ্ধতি চালু রয়েছে বলে জানা গেছে।

তবে বাংলাদেশে এই পদ্ধতিতে ডলারের বিনিময় হার কত হবে, তা এখনই জানানো হয়নি। বলা হয়েছে, সেটি পরে জানানো হবে।

ব্যাংক খাতের অনিয়ম রোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

কী প্রভাব পড়বে?
মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে এবার বাজারে অর্থের জোগান আরো কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এরই অংশ হিসেবে ব্যাংকের রেপো বা নীতি সুদহার বাড়িয়ে আট শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে এখন ব্যাংক ঋণ নেয়া আগের চেয়ে ব্যয়বহুল হতে চলেছে।

তবে বর্তমান বাস্তবতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তকে যৌক্তিক হিসেবেই দেখছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন মূল্যস্ফীতি এমনিতেই বেশি। এই অবস্থায় বেশি বেশি ঋণ দেয়া হলে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। কাজেই মানুষকে ঋণে নিরুৎসাহীত করার এই নীতি বাস্তবসম্মত বলেই আমার মনে হয়েছে।’

তবে কেবল এর মাধ্যমেই যে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে, সেটি মানতে নারাজ খন্দকার মোয়াজ্জেম।

‘নীতি সুদহার কমানোর অর্থ হচ্ছে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমানো। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এটি আংশিক ভূমিকা পালন করবে। অন্য নিয়ামকগুলোর প্রতিও দৃষ্টি দিতে হবে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।

বেসরকারি খাতকে ঋণ নিতে নিরুৎসাহিতি করে সরকার যদি এখন নিজে মোটা অঙ্কের ঋণ গ্রহণ করে তাহলে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন খন্দকার মোয়াজ্জেম।

এছাড়া বিদেশী মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতির ব্যবহার করে খুব একটা লাভ হবে বলে মনে করছেন না সিপিডির এই অর্থনীতিবিদ।

‘ডলারের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়ার চেয়ে বরং মার্কেট ওপেন করে দেয়া উচিত। কারণ মূল্য নির্ধারণ করা হলেও খোলা বাজারে সেটি কার্যকর দেখা যাচ্ছে না’, বিবিসি বাংলাকে বলেন খন্দকার মোয়াজ্জেম।

এ অবস্থায় ডলারের বাজার উন্মুক্ত করে দিয়ে সেটি ভালোমত মনিটরিং করার প্রতি গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

একইসাথে, দেশের ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে কী ধরনের ‘ম্যাকানিজম’ ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটিও প্রকাশ করা উচিত বলে মনে করছেন সিপিডি’র এই পরিচালক।

‘কী ম্যাকানিজম দিয়ে কোন কোন ইন্সট্রুমেন্ট তারা ব্যবহার করে ব্যাংকিংখাতে শৃঙ্খলা ফেরাবেন, তা সবার জানা দরকার,’ বলেন ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

‘এমনকি তারা যদি প্রতি মাসে কোনো টার্গেটও নির্ধারণ করে থাকেন, মাস শেষে কতটুকু অর্জন করতে পেরেছেন সেটাও মানুষকে জানানো উচিত’ বলে মনে করেন তিনি।

আগের যত উদ্যোগ
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম প্রধান কাজ।

দেশের বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত এক বছরে বেশ কিছু উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে বাংলাদেশ ব্যাংককে।

এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শেও বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে ব্যাংকিংখাতের এই অভিভাবক প্রতিষ্ঠানটি।

আইএমএফের ঋণের শর্তানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহারের করিডর প্রথা চালু, সুদহারের সীমা প্রত্যাহার, ডলারের একক দাম, রিজার্ভের প্রকৃত হিসাবায়নসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এছাড়া মূল্যস্ফীতি রোধে মুদ্রা সরবরাহনির্ভর নীতি থেকে সরে এসে সুদহার লক্ষ্য করে মুদ্রানীতি প্রণয়ন শুরুর ঘোষণা দেয়া হয়।

মূল্যস্ফীতি কমাতে ঋণের সুদহার কিছুটা বাজারভিত্তিক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি নীতি সুদের হারও বাড়িয়েছে।

এতে ঋণের সুদের হার নয় শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ।

এছাড়া গত বছরের ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি আট শতাংশে এবং আগামী জুনের মধ্যে তা ছয় শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যের ঘোষণা আগেও দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

তবে গত ডিসেম্বর শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতি নয় দশমিক ৪১ শতাংশ এবং সার্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি নয় দশমিক ৫৮ শতাংশে দাঁড়াতে দেখা গেছে।

সূত্র : বিবিসি

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

ডলারের মূল্য নিয়ন্ত্রণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি ব্যবহারের কথা ভাবছে বাংলাদেশ ব্যাংক

আপডেট সময় ১০:৪০:২৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ জানুয়ারী ২০২৪

বাংলাদেশের বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির হারে লাগাম টানার লক্ষ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

নতুন মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার আরো এক দফা বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা হয়েছে।

এর আগে সর্বশেষ গত বছরের নভেম্বরে নীতি সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে সাত দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছিল।

সেইসাথে ডলারের বিনিময় মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে ‘ক্রলিং পেগ’ নামে নতুন একটি পদ্ধতি ব্যবহারের চিন্তা করা হচ্ছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে।

‘ক্রলিং পেগ’হচ্ছে দেশিয় মুদ্রার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি।

এই পদ্ধতিতে একটি মুদ্রার বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করার অনুমতি দেয়া হয়।

এক্ষেত্রে মুদ্রার দরের একটি সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করা থাকে। ফলে একবারেই খুব বেশি বাড়তে পারবে না, আবার কমতেও পারবে না।

বুধবার বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মেলনকক্ষে জানুয়ারি-জুন মাস পর্যন্ত ছয় মাসের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নতুন দফায় সরকার গঠনের পর প্রথম একটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হলো।

ঘোষণাটি এমন এক সময়ে আসলো যখন মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভ সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ চাপের মুখে রয়েছে।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

তাদের সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের অংশ হিসেবেই নতুন মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি কমানোর প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে।

এর আগে জুন মাসে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে সুদহারের সীমা তুলে দেয়া হয়েছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এ সময় জানান, মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশের মধ্যে ধরে রাখার লক্ষ্য নিয়েই ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জানুয়ারি-জুন দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি তৈরি করা হয়েছে।

নতুন এই মুদ্রানীতির মাধ্যমে আগামী জুন মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতির হার সাত দশমিক পাঁচ শতাংশে এবং বছর শেষে ছয় শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন তিনি।

এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব হচ্ছে না।

এ বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে একটু সময়ের প্রয়োজন হয়। বেশ সময় লেগে যায়। আগের চেয়ে না বাড়লেও গত নভেম্বর থেকে ক্রমাগত কমছে মূল্যস্ফীতি।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে দেশে এখন সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে নয় দশমিক ৪১ শতাংশ।

আরো যা বলা হয়েছে
গত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশে ডলার সঙ্কট চলছে। এতে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১১০ টাকা হয়েছে। যদিও খোলা বাজারে লেনদেন হচ্ছে আরো বেশি দামে।

এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে।

২০২১ সালের আগস্টে যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল প্রায় ৪৮ বিলিয়ন ডলার, সঙ্কটের কারণে সেটি অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে, বর্তমানে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে ২৫ দশমিক ৫৬ বিয়িলন ডলার।

তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী, এখন রিজার্ভ ২০ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার।

এই পরিস্থিতিতে বিদেশী মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণে নতুন মুদ্রানীতিতে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি ব্যবহারের কথা চিন্তা করা হচ্ছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

‘ক্রলিং পেগ’হচ্ছে দেশিয় মুদ্রার সাথে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি।

এই পদ্ধতিতে একটি মুদ্রার বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করার অনুমতি দেয়া হয়।

এক্ষেত্রে মুদ্রার দরের একটি সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করা থাকে। ফলে একবারেই খুব বেশি বাড়তে পারবে না, আবার কমতেও পারবে না।

ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, কোস্টারিকাসহ কিছু দেশ এই পদ্ধতি চালু রয়েছে বলে জানা গেছে।

তবে বাংলাদেশে এই পদ্ধতিতে ডলারের বিনিময় হার কত হবে, তা এখনই জানানো হয়নি। বলা হয়েছে, সেটি পরে জানানো হবে।

ব্যাংক খাতের অনিয়ম রোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।

কী প্রভাব পড়বে?
মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে এবার বাজারে অর্থের জোগান আরো কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এরই অংশ হিসেবে ব্যাংকের রেপো বা নীতি সুদহার বাড়িয়ে আট শতাংশ করা হয়েছে। এর ফলে এখন ব্যাংক ঋণ নেয়া আগের চেয়ে ব্যয়বহুল হতে চলেছে।

তবে বর্তমান বাস্তবতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সিদ্ধান্তকে যৌক্তিক হিসেবেই দেখছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন মূল্যস্ফীতি এমনিতেই বেশি। এই অবস্থায় বেশি বেশি ঋণ দেয়া হলে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। কাজেই মানুষকে ঋণে নিরুৎসাহীত করার এই নীতি বাস্তবসম্মত বলেই আমার মনে হয়েছে।’

তবে কেবল এর মাধ্যমেই যে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে, সেটি মানতে নারাজ খন্দকার মোয়াজ্জেম।

‘নীতি সুদহার কমানোর অর্থ হচ্ছে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমানো। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এটি আংশিক ভূমিকা পালন করবে। অন্য নিয়ামকগুলোর প্রতিও দৃষ্টি দিতে হবে,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।

বেসরকারি খাতকে ঋণ নিতে নিরুৎসাহিতি করে সরকার যদি এখন নিজে মোটা অঙ্কের ঋণ গ্রহণ করে তাহলে মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন খন্দকার মোয়াজ্জেম।

এছাড়া বিদেশী মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতির ব্যবহার করে খুব একটা লাভ হবে বলে মনে করছেন না সিপিডির এই অর্থনীতিবিদ।

‘ডলারের মূল্য নির্ধারণ করে দেয়ার চেয়ে বরং মার্কেট ওপেন করে দেয়া উচিত। কারণ মূল্য নির্ধারণ করা হলেও খোলা বাজারে সেটি কার্যকর দেখা যাচ্ছে না’, বিবিসি বাংলাকে বলেন খন্দকার মোয়াজ্জেম।

এ অবস্থায় ডলারের বাজার উন্মুক্ত করে দিয়ে সেটি ভালোমত মনিটরিং করার প্রতি গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

একইসাথে, দেশের ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে কী ধরনের ‘ম্যাকানিজম’ ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটিও প্রকাশ করা উচিত বলে মনে করছেন সিপিডি’র এই পরিচালক।

‘কী ম্যাকানিজম দিয়ে কোন কোন ইন্সট্রুমেন্ট তারা ব্যবহার করে ব্যাংকিংখাতে শৃঙ্খলা ফেরাবেন, তা সবার জানা দরকার,’ বলেন ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

‘এমনকি তারা যদি প্রতি মাসে কোনো টার্গেটও নির্ধারণ করে থাকেন, মাস শেষে কতটুকু অর্জন করতে পেরেছেন সেটাও মানুষকে জানানো উচিত’ বলে মনে করেন তিনি।

আগের যত উদ্যোগ
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম প্রধান কাজ।

দেশের বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত এক বছরে বেশ কিছু উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে বাংলাদেশ ব্যাংককে।

এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শেও বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে ব্যাংকিংখাতের এই অভিভাবক প্রতিষ্ঠানটি।

আইএমএফের ঋণের শর্তানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহারের করিডর প্রথা চালু, সুদহারের সীমা প্রত্যাহার, ডলারের একক দাম, রিজার্ভের প্রকৃত হিসাবায়নসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এছাড়া মূল্যস্ফীতি রোধে মুদ্রা সরবরাহনির্ভর নীতি থেকে সরে এসে সুদহার লক্ষ্য করে মুদ্রানীতি প্রণয়ন শুরুর ঘোষণা দেয়া হয়।

মূল্যস্ফীতি কমাতে ঋণের সুদহার কিছুটা বাজারভিত্তিক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি নীতি সুদের হারও বাড়িয়েছে।

এতে ঋণের সুদের হার নয় শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ।

এছাড়া গত বছরের ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি আট শতাংশে এবং আগামী জুনের মধ্যে তা ছয় শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যের ঘোষণা আগেও দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

তবে গত ডিসেম্বর শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতি নয় দশমিক ৪১ শতাংশ এবং সার্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি নয় দশমিক ৫৮ শতাংশে দাঁড়াতে দেখা গেছে।

সূত্র : বিবিসি