আলোচিত ও বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের লক্ষ্যে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য গত জানুয়ারি মাসে আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগের সচিবকে প্রধান করে ৬ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছিল সরকার।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ সম্পর্কিত আইন পর্যালোচনা করার পাশাপাশি তারা কীভাবে আইনটি প্রয়োগ করে, তাদের আইনের সঙ্গে আমাদের আইনের কী পার্থক্য আছে এবং আইনে কোথাও কোনো প্রকার অসঙ্গতি আছে কি না তা পর্যালোচনার মাধ্যমে সুপারিশ তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কমিটিকে।
কিন্তু কমিটি ৪ মাসেও সুপারিশ তৈরি করতে পারেনি। ফলে কমিটি গঠনের মধ্যেই আটকে আছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের উদ্যোগ। তাই বর্তমান সরকারের এ মেয়াদে আইনটি আদৌ সংশোধন করা সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের সাংবাদিক, সুশীল সমাজ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিরোধিতার মধ্যেই ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে পাস হয়েছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এর পর আইনটির অপপ্রয়োগের নানা অভিযোগ, উদ্বেগ আর বিতর্ক চলতেই থাকে। আইনের অপপ্রয়োগের বিষয়টি আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও একাধিকবার স্বীকার করেছেন।
বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আইনটি বাতিলের দাবি জানানো হলেও কয়েক দিন আগে এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন আইন বাতিল হবে না, সংশোধন করা হবে।
তবে তিনি আইনটির বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধনে বারবার আশ্বাস দিলেও এ লক্ষ্যে কমিটি গঠন ছাড়া এখন পর্যন্ত কার্যত তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আইনটি সংশোধনের লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগের সচিবকে সভাপতি করে ৬ সদস্যের কমিটি কাজ করছে।
কমিটিতে রয়েছেন-লেজিসলেটিভ বিভাগের একজন কর্মকর্তা, আইন মন্ত্রণালয়ের বিচার বিভাগের একজন কর্মকর্তা এবং স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের একজন করে কর্মকর্তা।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ৯টি ধারাকে বিপজ্জনক আখ্যায়িত করেছে সম্পাদক পরিষদ। এগুলো হচ্ছে-ধারা ৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩।
এ ছাড়া এ আইনের ১৯টি ধারার মধ্যে ১৪টির ক্ষেত্রেই অপরাধ আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য। পুলিশকে নিছক সন্দেহের কারণে এবং পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেওয়ায় এবং এত অপরাধের অভিযোগকে আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য করায় আইনটি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি এক বাস্তব হুমকি।
এর মধ্যে ৮ নং ধারায় বলা হয়েছে-‘যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিকট প্রতীয়মান হয় যে, ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের বা উহার কোনো অংশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকা-, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ণ করে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণার সঞ্চার করে, তাহা হইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উক্ত তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা ব্লক করিবার জন্য মহাপরিচালকের মাধ্যমে, বিটিআরসিকে অনুরোধ করিতে পারিবেন।’
এ বিষয়ে সম্পাদক পরিষদ বলছে, প্রকাশিত বিষয়বস্তু অপসারণ বা ব্লক করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যুক্তি আইনটিতে এত অস্পষ্ট যে তা নানা ব্যক্তি নানাভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন।
এতে আইনটির অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, কোনো প্রকল্পের দুর্নীতির খবর প্রকাশ করার ফলে যদি সেটার অর্থায়নকারী বা কোনো বিনিয়োগকারী অর্থায়ন বন্ধ করে দেন, তা হলে এ আইনের অধীনে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক ‘অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিঘ্ন সৃষ্টি করা’র দায়ে অভিযুক্ত হতে পারেন এবং তা ওই খবর ব্লক বা অপসারণ পর্যন্ত গড়াতে পারে।
আইনের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য ডিজিটাল বা ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ ও সংরক্ষণ করেন বা সহায়তা করেন, তা হলে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সাজা।
২৫ লাখ টাকা জরিমানা। ৩৪ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যাকিং করেন তা হলে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সাজা। জরিমানা ১ কোটি টাকা। সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহফুজ আনাম বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি সংশোধনের চলমান প্রক্রিয়াটিতেও সাংবাদিকদের উপেক্ষা করা হচ্ছে এবং আমলাদের হাতে এর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকছে বলে মনে হচ্ছে। সংশোধন প্রক্রিয়ায় সাংবাদিকদের কোনো সংগঠনের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনাই করা হয়নি।
সে ক্ষেত্রে আমরা অনুমান করতে পারি, এর ফলাফল কী হবে। কারণ তারা মত প্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার জন্য প্রশিক্ষিত।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, অনেক দিন ধরেই আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছি। এ আইনের জন্য মূল ধারার সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। সাংবাদিকরা হয়রানি শিকার হচ্ছেন।
ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সির সদ্যবিদায়ি মহাপরিচালক আবু সাঈদ মো. কামরুজ্জামান বলেন, আইনের সংশোধনীর বিষয়ে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে গত মার্চ মাসে একটি বৈঠক করা হয়েছে। শিগগিরই আরেকটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে মতামত পাওয়া গেছে। কেউ কেউ আইনটিই বাতিল করতে বলেছেন। কিন্তু তা সম্ভব নয়। তাই বিশিষ্টজনদের মতামতের ভিত্তিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংশোধনী আনা হবে তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সুপারিশের বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের লক্ষ্যে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটির সদস্য সচিব এবং আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের যুগ্ম সচিব (ড্রাফটিং) মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান নূর জানান, আইনটি সংশোধনের বিষয়ে বিদেশি ও দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করা হয়েছে। তারা কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন।
সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এগুলো আইনমন্ত্রীর কাছে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। মন্ত্রীর অনুমোদনের পর সুপারিশগুলো আইসিটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে আইসিটি মন্ত্রণালয় সংশোধিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি মন্ত্রিপরিষদে পাঠাবে।সেখান থেকে ভেটিংয়ের জন্য আবার পাঠানো হবে আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগে। ভেটিং শেষে তারা আবার মন্ত্রিপরিষদে পাঠাবে। তখন সংশোধিত আইনটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে উত্থাপন করা হবে।
মন্ত্রিসভা তা অনুমোদন করলে পাঠানো হবে সংসদে। আইসিটি মন্ত্রী এটি সংসদ অধিবেশনে উত্থাপনের পর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠানো হবে সংসদীয় কমিটিতে।কমিটি তাদের রিপোর্ট সংসদে উত্থাপনের পর এটি পাস করার জন্য উত্থাপন করা হবে। ফলে ডিজিটাল নিরাপত্তা (সংশোধন) আইন পাস হতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হবে।
তাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের লক্ষ্যে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটি এখনও সুপারিশ প্রণয়ন করতে না পারায় আইনটির সংশোধনী সরকারের চলতি মেয়াদে আদৌ পাস করা সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধনের চেষ্টা করা হবে। আইনের অপপ্রয়োগ আরও কমাতে এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করতে সংস্কারের লক্ষ্যে একটি কমিটি করা হয়েছে।
কমিটি ২ থেকে ৩ বার বৈঠক করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দফতর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে একটি ‘টেকনিক্যাল নোট’ দিয়েছে।
সেটির পর্যালোচনাও প্রায় শেষ। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়নি দাবি করে আইনমন্ত্রী বলেন, সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ করতেই আইনটি করা হয়েছে। এ আইনে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে তা একটি সেলে পাঠানো হয়। সেল পর্যালোচনা করে যদি মামলা করার মতো উপাদান পায়, তা হলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।