পরাধীন ভারতবর্ষের মুক্তিসংগ্রামের আন্দোলনে যারা অগ্রগণ্য ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত। ১৮৫৬ সালের ২৫ জানুয়ারি বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বাটাজোর বন্দর সংলগ্ন হরহর গ্রামে তার জন্ম।
তৎকালীন উ”চ শিক্ষিত রাজনীতিবিদদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। তাই বরিশালে বসেই কাঁপিয়ে দিয়েছেন ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের ভিত। ১৮৮৫ সালে তখন জাতীয় কংগ্রেসের যাত্রা শুরু হয়নি। ওইসময় অশ্বিনী কুমার দত্ত স্থানীয় গায়কদের সঙ্গী করে বরিশালের বাজার রোড, হাটখোলাসহ জনবহুল এলাকায়, খাল ও নদীর ধারে গানের সাথে একটি কাঠের বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে সামাজিক, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে বক্তব্য দিতেন। বরিশালের নানা সমস্যা, দেশের পরিস্থিতি তিনি প্রচার করে জনমানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। এভাবেই ‘জনসাধারণের সভা’ নামে এক রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগ পরে পরিণতি লাভ করে। অশ্বিনী কুমার দত্তের এই জন গণমুখিতা ছিল অসাধারণ।
মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও সাংবাদিক সুশান্ত ঘোষের একটি গবেষনায় দেখা গেছে, অশ্বিনী কুমার দত্ত জাতীয় নেতা হতে পারতেন। কিন্ত তিনি চাইলেন বরিশালের মানুষের ভালো মন্দের সাথে জড়িয়ে আঞ্চলিক নেতা হয়ে থাকতে। তাই রাজনীতির সাথে জনসেবা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে বরিশালকে তিনি বদলে দিয়েছেন। প্রথমে তিনি ১৮২৯ সালে তৎকালীন বাকেরগঞ্জের কালেকটর মি গ্যারেট একটি ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেও সেটি স্থায়ী হয়নি। পরবর্তীতে ১৮৮৪ সালের ২৭ জুন ‘সত্য-প্রেম-পবিত্রতা’কে মহামন্ত্র করে বাবা ব্রজমোহন দত্তের নামে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন ব্রজমোহন বিদ্যালয়।
সূত্রমতে, ‘সত্য-প্রেম পবিত্রতা’ শুধু কাগজের বাণী ছিলোনা। বিদ্যালয়ের পতাকায়, প্রবেশ পথে, অধ্যয়ন কক্ষে সর্বত্র এটি প্রচারিত হতো। শিক্ষার্থীরা সত্যিকার অর্থেই ‘সত্য-প্রেম-পবিত্রতা’ ভাবনায় জীবনভর চালিত হতো। এমনকি বিদ্যালয়ে সংগীতও ছিল- ‘সত্য, প্রেম পবিত্রতা’ নিয়ে। ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে শুধু শিক্ষা গৃহ নয়, এখানে নীতি শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হতো। স্কুলটি পরিদর্শনে এসে সুপন্ডিত ক্যানিংহাম মন্তব্য করেছিলেন, ‘বঙ্গদেশে ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের মতো বিদ্যালয় থাকিতে বাঙালি ছাত্ররা অক্সফোর্ড বা কেম্ব্রিজে কেন যায় আমি তাহা বুঝি না।’ শিক্ষা কার্যক্রমে এ স্কুল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফলে ওপরের দিকে অবস্থান করতো। যেকারণে ‘অক্সফোর্ড অব বেঙ্গল’ নামে অভিহিত ব্রজমোহন বিদ্যালয় ও ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রজমোহন কলেজ দক্ষিণাঞ্চলের আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
১৯০৮ সালে বরিশালের বিখ্যাত স্বদেশ বান্ধব সমিতিকে ইংরেজ শাসক নিষিদ্ধ করে। অশ্বিনী কুমার দত্ত ছিলেন ওই সমিতির সভাপতি। এছাড়া অশ্বিনী কুমার দত্তকে দুইবছর বিনাবিচারে আটক করে রাখা হয়। শুধু তাই নয়; সরকারী রোষানলে ব্রজমোহন স্কুলের বৃত্তি পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯২২ সালে বরিশালে কংগ্রেসের একটি জনসভা যোগদান করেন মহাত্মা গান্ধী। সে সময়ে বরিশালের ব্রিটিশ বিরোধিতা ছিল সারা ভারতবর্ষের মতো প্রবাদ সম। এজন্যই মহাত্মা গান্ধী ওই জনসভায় উচ্চারণ করেছিলেন-‘সমগ্র ভারত যখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন, তখন বরিশাল সদা জাগ্রত’। ১৯২৩ সালের ৭ নভেম্বর সেই সত্য, প্রেম, পবিত্রতা বাণীর ধারক বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ও আধুনিক বরিশালের রূপকার মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত পরলোকগমন করেন।
মহাত্মা অশ্বিনী কুমার স্মৃতি সংসদ বরিশাল জেলা কমিটির সভাপতি স্নেহাংশু কুমার বিশ্বাস জানিয়েছেন, মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের জন্মদিন উপলক্ষে দুই দিনব্যাপী অশ্বিনী মেলার আয়োজন করা হয়েছে। স্মৃতি সংসদের আয়োজনে সরকারী বরিশাল কলেজ মাঠে ২৭ জানুয়ারি বিকেলে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে মেলার উদ্বোধণ করবেন সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য প্রফেসর ড. মো. ছাদেকুল আরেফিন।
২০১৯ সাল থেকে আয়োজিত এ মেলায় সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের উপস্থি’তিতে মিলনমেলায় পরিণত হয়। এবছর ২৭ জানুয়ারি বিকেল তিনটায় অশ্বিনী মেলার উদ্বোধণের পর চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। মেলার সমাপনী দিনে ২৮ জানুয়ারি বিকেলে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন। মেলা চলাকালীন দুইদিন সন্ধ্যায়ই পরিবেশিত হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এছাড়া ২৫ জানুয়ারি বিকেল পাঁচটায় মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে।
উইকিপিডিয়ার তথ্যে জানা গেছে, অশ্বিনী কুমার দত্তের বাবা ছিলেন সাব-জজ ব্রজমোহন দত্ত। বরিশালে বিভিন্ন সমাজহিতৈষী ও কল্যাণমূলক রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কারণে অশ্বিনী কুমার দত্ত সুপরিচিত ছিলেন। জাতীয়তাবাদী রাজনীতি, জনকল্যাণ ও উন্নয়নমূলক কাজকর্মের জন্য তাকে মহাত্মা অশ্বিনী কুমার বা আধুনিক বরিশালের রূপকার বলে অভিহিত করা হতো। তিনি ছিলেন দুর্নীতি, সামাজিক গোঁড়ামি, কুসংস্কার ইত্যাদির বিরুদ্ধে ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নিবেদিত প্রান। বরিশাল শহরে নিজের দান করা জমিতে তিনি তার বাবার নামে ব্রজমোহন বিদ্যালয় ও ব্রজমোহন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধী প্রথম বরিশালে এসে অশ্বিনী কুমার দত্তকে জেলার অদ্বিতীয় নেতা হিসেবে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছিলেন। তিনি ১৮৮৪ সালে ব্রজমোহন স্কুল, ১৮৮৬ সালে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য পিপলস্ অ্যাসোসিয়েশন, ১৮৮৭ সালে তার প্রচেষ্টায় বরিশাল ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড, ১৮৮৭ সালে নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য বাকেরগঞ্জ হিতৈষিণী সভা এবং একটি বালিকা বিদ্যালয়, ১৮৮৯ সালে ব্রজমোহন কলেজ স্থাপন করেছেন।