বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়ে যে গানটি অতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, সেই ‘দেশটা তোমার বাপের নাকি’-র আদলে, কথাগুলি বদলিয়ে দিয়ে একটি গান গাওয়ার অভিযোগে আসামের এক মুসলিম গায়ককে গ্রেফতার করেছে সে রাজ্যের পুলিশ।
অসমিয়া গানটিতে ‘দেশটা তোমার বাপের নাকি’র মূল সুরের সাথেই আসামের বিহুর সুর এবং ছন্দও কিছুটা মেশানো হয়েছিল।
আসামের পুলিশ জানিয়েছে যে- আলতাফ হোসেইন নামের ওই ইউটিউবার ও গায়ক তার গানটির মাধ্যমে ‘হিন্দু এবং মিঞা সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈরিতা’-র প্রচেষ্টা করেছেন। সদ্য চালু হওয়া ভারতীয় ন্যায় সংহিতার যে ধারায় মামলা দায়ের হয়েছে, সেটি ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত দেয়া সংক্রান্ত ধারা।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা ওই গ্রেফতারি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন যে- আসামের ঐতিহ্যবাহী ‘বিহু’কে ‘মিঞা বিহু’তে পরিণত করতে চাইলে আসামের মানুষ তা মেনে নেবেন না।
গত শনিবার আসামের ধুবড়ি জেলা থেকে গ্রেফতার করা হয় আলতাফ হোসেইনকে। তিন দিন পুলিশ রিমাণ্ডে থাকার পরে মঙ্গলবার তাকে আদালতে আবারো তোলা হয়।
গানের মাধ্যমে কী বলেছিলেন গায়ক?
আলতাফ হোসেইন তার আপলোড করা গানটি মুছে দিয়েছেন সামাজিক মাধ্যম থেকে।
গুয়াহাটি থেকে বিবিসি-র সহযোগী সাংবাদিক জানাচ্ছেন যে- গানটি মুছে দেয়ার সাথেই তিনি একটি মন্তব্যও করেছিলেন সামাজিক মাধ্যমে, যেখানে তিনি বলেছিলেন যে- তার গানের কথায় যদি কারো ভাবাবেগে আঘাত লেগে থাকে, তাহলে তিনি দুঃখিত।
সাধারণ মানুষের প্রতি তিনি আবেদন জানিয়েছিলেন যে- আর কেউ যেন তার গানটি শেয়ারও না করেন।
মূল গানটি মুছে দেয়া হলেও ইউটিউবে খুঁজলেই গানটি এখনো পাওয়া যায়।
সেখানে বাংলাদেশের জনপ্রিয় প্রতিবাদী গানটির সুরে কথা কিছুটা বদলিয়ে দেয়া হয়েছিল।
গানের শুরুটা বাংলায় তর্জমা করলে এরকম দাঁড়ায়- ‘আসাম তোমার বাপের নাকি যে খালি মিঞা খেদানোর চেষ্টা করো!’
‘মিঞা’ শব্দটি আসামের বাংলাভাষী মুসলমানদের প্রতি অপমানজনক সম্বোধন হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
গানটিতে এরকম লাইনও রয়েছে যেখানে বলা হয়েছে যে- অপরাধ তো সকলেই করে, কিন্তু চোখে পড়ে শুধু ‘মিঞা’দের এবং মন্দিরের পূজারীরাও তো ধর্ষণে অভিযুক্ত হয়, কিন্তু চোখে পড়ে শুধু ‘মিঞা’রা তা করলেই!
গত ২২ অগাস্ট আসামের নগাঁও জেলায় এক ১৪ বছরের কিশোরী গণধর্ষণের শিকার হন। ঘটনায় অভিযুক্তরা তিনজনেই বাংলাভাষী মুসলমান, যাদের ‘মিঞা’ বলে অপমানজনক সম্বোধন করা হয়ে থাকে।
পুরো আসাম জুড়েই ওই গণধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদ চলেছে।
‘মিঞা বিহু’ জনপ্রিয় করার চেষ্টা
গায়ক আলতাফ হোসেইন গ্রেফতার হওয়ার পরে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা সামাজিক মাধ্যমে এক বিবৃতি দেন।
সেখানে তিনি বলেন, ‘কিছু মানুষ ‘মিঞা বিহু’ জনপ্রিয় করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এরকমই একজন গায়ক, আলতাফ হোসেইনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। আমাদের সমাজ ব্যবস্থার ওপরের কোনও আঘাত আমরা সহ্য করব না। আমাদের আক্রমণ করার চেষ্টাও যেন কেউ না করেন।’
তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘আমাদের গর্বের বিহু সঙ্গীতকে যদি ‘মিঞা বিহু’তে রূপান্তরিত করা হয়, তাহলে কোনো অসমিয়া সেটা মেনে নেবেন?
‘আমরা কতদিন জীবিত থাকব জানি না, কিন্তু যতদিন এখানে আছি, মাথা নত করে বাঁচব না। মাথা উঁচু করে, মর্যাদার সঙ্গে বাঁচব। আশা করব মানুষ যেন এই বার্তাটিকে ইতিবাচক হিসাবে দেখেন,’ সামাজিক মাধ্যমে বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা।
‘ধর্ম না দেখে অপরাধী হিসাবে শাস্তি চাই’
আসামের মুসলমান ছাত্রছাত্রীদের শক্তিশালী সংগঠন অল আসাম মাইনরিটি স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন বা ‘আমসু’ বলছে আলতাফ হোসেইন বা যে কোনো মুসলিম যদি কোনো অপরাধ করে থাকেন, তাহলে আইন অনুযায়ী তাদের শাস্তি হোক।
কিন্তু একই সাথে তারা চান যে- এক্ষেত্রে অভিযুক্ত বা অপরাধীর ধর্মীয় পরিচয় যেন বিচার্য না হয়।
আমসু-র সভাপতি রেজাউল করিম সরকার বিবিসি বাংলাকে টেলিফোনে বলছিলেন, ‘আলতাফ হোসেইন তার গানে কিছু আপত্তিকর কথা বলেছেন বলে অভিযোগ তোলা হচ্ছে। আমরাও দেখেছি যে- তিনি কিছু আপত্তিজনক কথাবার্তা বলেছেন গানে। এগুলো নিশ্চই তদন্ত হওয়া দরকার। আলতাফ হোসেইন ছাড়া আরও যদি এরকম কেউ কিছু করে থাকে, তাদেরও বিচার হওয়া দরকার।’
‘তবে আরও কিছু ভিডিও ভাইরাল হয়েছে যেখানে টুপি-পাঞ্জাবি পরিহিত ব্যক্তিদের কিছু শিশুকে দিয়ে মারপিট করানো হচ্ছে মিঞা বলে। সেগুলোরও বিচার হওয়া উচিত।’
‘বেশ কিছু ভ্লগারকে দেখা গেছে, মিঞা নামে কোনও সম্প্রদায়ের যেখানে কোনও অস্তিত্বই নেই, সেখানে মুসলমানদের মতো সাজপোষাক পরিয়ে তাদের হেনস্থা করা হচ্ছে। সেগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত’, বলছিলেন রেজাউল করিম সরকার।
তিনি এও বলছিলেন যে আলতাফ হোসেইনের বিরুদ্ধে যেমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তেমনই আসামের বেশ কিছু লেখক আছেন যারা ‘সব সময়ে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করছেন, তবে সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনও অ্যাকশন নিচ্ছেন না। আমরা বিষয়গুলি বারবার পুলিশের নজরে এনেছি, কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।’
গণধর্ষণে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
ধিং থানায় দায়ের করা এফআইআর অনুযায়ী, ২২ আগস্ট, অর্থাৎ গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ ওই গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে।
সেদিন সন্ধ্যায় টিউশন পড়ে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন ওই ছাত্রী। অভিযোগ, ফেরার পথে নির্জন রাস্তার ধারে তার উপর হামলা চালায় তিন যুবক এবং তাকে গণধর্ষণ করা হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার পর তিন অভিযুক্ত মেয়েটিকে অর্ধচেতন অবস্থায় ফেলে পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন।
নগাঁও মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন নির্যাতনের শিকার ওই ছাত্রী।
স্কুলছাত্রীকে গণধর্ষণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে গোটা রাজ্যে। গত কয়েকদিন ধরে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন নারীরা।
শহরের দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং শত শত নারী হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় বসে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছেন নিরাপত্তার।
তাদের হাতে যে প্ল্যাকার্ড রয়েছে তাতে লেখা ‘আমরা ন্যায় বিচার চাই’, ‘নারীদের নিরাপত্তা দিন’, ‘ধর্ষণ বন্ধ হোক, ধর্ষককে চরম শাস্তি দেয়া হোক’ ইত্যাদি।
আসামের ওই ছাত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুধুমাত্র যে নারীরাই প্রতিবাদে পথে নেমেছেন এমনটা নয়। ছাত্র সংগঠন-সহ বেশ কয়েকটা সংগঠনের সদস্যরাও দোষীদের কঠোর শাস্তির দাবিতে ধর্নায় বসেছেন।
নির্যাতনের শিকার পড়ুয়ার গণধর্ষণের ঘটনায় বিচারের দাবিতে আসামের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভও করছেন সাধারণ মানুষ।
সূত্র : বিবিসি