দেশে ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর পুষ্টির চাহিদা পূরণে বছরব্যাপী ফলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। নতুন কাজ যুক্ত করার কারণে প্রকল্পের মেয়াদ ও খরচ দফায় দফায় বৃদ্ধি করা হয়। ফলে ছয় বছরের প্রকল্প এখন ১০ বছরে গড়িয়েছে। আর ১৯৫ কোটি টাকা খরচ থেকে এখন ৬৭২ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে বিদেশ প্রশিক্ষণ ও সফর। আর ওই খাতের ১০ কোটি টাকা সমর্পণ করা হয়েছে। নতুন করে ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাবনা মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) অনুমোদনের জন্য পেশ করা হচ্ছে। আর পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, আমরা অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ করি। সরকারি অর্থ ব্যয় করে কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর বন্ধ করতে হবে। প্রকল্প পরিচালক জানান, বিদেশ ট্যুর বাদ দেয়া হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংশোধিত প্রস্তাবনার তথ্য থেকে জানা গেছে, ফল উৎপাদন ও সংরক্ষণে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারের কারণে মানুষ যাও খাচ্ছে তা থেকে কোনো ধরনের সুফল পাচ্ছে না। উল্টো ক্ষতির শিকার হচ্ছে বলে পুষ্টিবিদরা বলছেন। কৃষিপ্রধান দেশ হলেও এ দেশের মানুষের দৈনিক ফল খাতে পুষ্টি ঘাটতি ৬১ শতাংশ বা ১২২ গ্রাম। আর এই চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে পুষ্টি ঘাটতি পূরণের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে সরকার। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৫ কোটি টাকার বেশি প্রকল্পে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে। সেই সমীক্ষা না করিয়েই প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তি সত্ত্বেও ২০১৫ সালে ১৯৫ কোটি টাকায় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন দেয়া হয়। এর পরে আবারো ব্যয় ১০৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা ও মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে প্রথম সংশোধন করা হয়। ২০২১ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৮০ শতাংশ। এরপর ব্যয় ২৯৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা বাড়ানো হয়। আাবার খরচ ৪৬০ কোটি ২৮ লাখ টাকা বাড়িয়ে মেয়াদ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এখন খরচ ৬৭১ কোটি ৬০ লাখ টাকা করে মেয়াদ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়।
জানা যায়, দেশব্যাপী উদ্যান ফসলের সেবা চাষিপর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ৪৫টি জেলায় বিদ্যমান ৬০টি হর্টিকালচার সেন্টারের আধুনিকায়ন এবং ৯টি নতুন হর্টিকালচার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। দেশের ৪৫ জেলার ৩৬২টি উপজেলায় এটি বাস্তবায়ন করা হবে। ঢাকায় ১০৩টি, চট্টগ্রামে ৭৯টি, সিলেটে ১৯টি, রাজশাহীতে ৭১টি, রংপুরে ৩৫টি, খুলনায় ৩১টি এবং বরিশালে ২৪টি উপজেলায় বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পের মাধ্যমে এক লাখ ৬৫ হাজার কৃষক-কৃষাণী ও ফল ব্যবসায়ী, ৯০০ মালি, ৩০ হাজার গৃহিণী, ৯ম ও ১০ম শ্রেণীর ৩০ হাজার স্কুলগামী বালিকাকে পুষ্টি সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।
প্রধান কার্যক্রম হলো কৃষক, মহিলা উদ্যোক্তা, এসএএইচও বা এসএএও, নার্সারিম্যান, মালি ও স্প্রেম্যান মোট চার লাখ ৭৬ হাজার ১৬০ জন প্রশিক্ষণ, সাড়ে ১৩টি বাণিজ্যিক মিশ্র ফল বাগান, ৯ হাজার বাণিজ্যিক ফল বাগান, ২৩ হাজার বসতবাড়ি বাগান, আড়াই হাজার ড্রাগন বাগান, আড়াই হাজার এমডি-২ আনারস বাগান প্রদর্শনী, বিদ্যমান ও নতুন প্রস্তাবিত হর্টিকালচার সেন্টারের ১৬ লাখ ঘনমিটার ভূমি উন্নয়ন ও ৫২ একর ভূমি ক্রয়, ৫টি বিদ্যমান ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ, ২৬টি অফিস ভবন কাম ট্রেনিং রুম, ৩৫ হাজার ৭০০ আরএম সীমানা প্রাচীর, ৩০টি লেবার শেড, ৪৫টি গার্ড শেড, ৬০টি নার্সারি শেড, ১৫টি গ্রাফটিং হাউজ নির্মাণ এবং মেহেরপুর জেলায় ঐতিহাসিক মুজিবনগর আম্রকাননের পরিচর্যা।
প্রকল্পের ব্যয় পর্যালোচনা থেকে দেখা যায়, মূল প্রকল্প ব্যয় প্রাক্কলন করা হয় পিডব্লিউডির ২০১৪ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী। এরপর এখন ২০১৮ সালের রেট শিডিউল ধরে অসমাপ্ত কাজের জন্য নতুন করে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। এখন আবার ২০২২ সালের রেট শিডিউল ধরে ব্যয় ধরা হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ফলের দেশ। ফল আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্যের অংশ। এ দেশে প্রায় ৭০ রকমের ফল জন্মে। দেশীয় ফল অনেক বেশি পুষ্টিসমৃদ্ধ। কিন্তু তা চাহিদার চেয়ে অনেক কম উৎপাদন হয়। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস-১১) তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর এ দেশে তিন লাখ ৪৮ হাজার হেক্টর জমিতে ৪৩ লাখ ৮০ হাজার টন ফল এবং চার লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে ৩০ লাখ ৬০ হাজার টন সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। আমাদের দৈনিক ফল খাওয়া দরকার ২০০ গ্রাম। কিন্তু বাস্তবে খাওয়া হচ্ছে মাত্র ৭৮ গ্রাম; যা চাহিদার চেয়ে মাত্র ৩৯ শতাংশ। কম খাওয়ার মূল কারণ হলো চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ব্যবধান। এ প্রকল্পের মাধ্যমে উদ্যান ফসলের উৎপাদন প্রায় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে দেশের ১৯টি জেলায় কোনো হর্টিকালচার সেন্টার নেই।
প্রকল্প সংশোধনের কারণ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম বিলম্ব, রেট শিডিউল পরিবর্তন, যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলায় ১টি, গাইবান্ধা জেলার সাদুল্লাপুর/পলাশবাড়ীতে ১টি ও কুষ্টিয়া জেলায় ১টি মোট ৩টি নতুন হর্টিকালচার সেন্টার নির্মাণ, খাগড়াছড়ি জেলায় বিদ্যমান মাটিরাঙ্গা হর্টিকালচার সেন্টারটির ভূমি উন্নয়ন ও বিদ্যমান ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত এবং মেহেরপুর জেলায় প্রায় ৩৬ একর এলাকাজুড়ে ঐতিহাসিক মুজিবনগর আম্রকাননের যথাযথ পরিচর্যার কার্যক্রম প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তি।
আইএমইডির পর্যালোচনায় প্রকল্পের কিছু দুর্বল দিকগুলো হলো প্রকল্পের কোনো বেইস লাইন সার্ভে ও বিস্তারিত এক্সিট পরিকল্পনা নেই। বিদেশী ফলের লাগসই প্রযুক্তির ঘাটতি এবং প্রকল্পের কার্যক্রম মনিটরিং ও প্রযুক্তি সেবার ঘাটতি আছে। সাইনবোর্ড ও ফলগাছের নামফলক অনেক বাগানে ও ফলগাছে নেই। সার সঠিক পরিমাণে সরবরাহ করা হয়নি বলে কোনো কোনো এলাকার কৃষকরা উল্লেখ করেছেন। প্রকল্পের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার পদ্ধতি দুর্বল। প্রকল্পের কোনো ওয়েবসাইট বা নলেজ ব্যাংক নেই। প্রকল্পের আওতায় ফলবাগানের নকশা বা মডেল তৈরি ও সরবরাহ করার প্রক্রিয়া দুর্বল। প্রকল্পের সাথে বিভিন্ন গবেষণা ইনস্টিটিউটের যোগাযোগ সীমিত।
পরিকল্পনা কমিশনের সংস্থাটি আরো বলছে, প্রকল্পের কার্যক্রম ও প্রযুক্তিবিষয়ক তথ্য সংরক্ষণ ও তা অনলাইনে শেয়ারের জন্য কোনো ওয়েবসাইট বা নলেজ ব্যাংক নেই। প্রকল্পের প্রযুক্তিবিষয়ক তথ্য সংরক্ষণ এবং শেয়ারের জন্য একটি আলাদা ওয়েবসাইট বা নলেজ ব্যাংক তৈরি করার সুপারিশ করা হলো। প্রকল্পের প্রশিক্ষণসামগ্রী আরো তথ্যবহুল ও মানসম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন। কৃষকরা উৎপাদিত ফলের সঠিক বাজারজাত ও সঠিক মূল্য পাওয়া নিয়ে চিন্তিত। কাজেই ফলের সঠিক মূল্য ও বিক্রয়ের জন্য মার্কেটিং নেটওয়ার্ক তৈরির কার্যকর ব্যবস্থা অবিলম্বে গ্রহণ করা উচিত। অধিকাংশ বাগানের বিদেশী ফলগাছগুলো থেকে ফল পেতে আরো দু-তিন বছর অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২১ সাল পর্যন্ত। প্রকল্প সমাপ্তির পর প্রযুক্তিগত সহায়তার অভাবে কৃষকের বাগানে ফল উৎপাদন হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।
এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক ড. মো: মেহেদি মাসুদের সাথে তার মোবাইল ফোনে প্রকল্প সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, ৯০ শতাংশ অগ্রগতি গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
খরচ এত বাড়ছে কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, নতুন করে কিছু কাজ অন্তর্ভুক্ত করার কারণেই খরচ বাড়ছে। যেমন যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলায় ১টি, গাইবান্ধা জেলার সাদুল্লাপুরে ১টি ও কুষ্টিয়া জেলায় ১টি মোট ৩টি নতুন হর্টিকালচার সেন্টার নির্মাণ করা হবে। এই জায়গাতে কোনো হর্টিকালচার সেন্টার নেই। ন্যায্যমূল্যে কৃষকরা চারা পাচ্ছে। উদ্যান সম্প্রসারণ হবে। প্রকল্পে খরচ কম হয়েছে কাজ বাকি আছে সে জন্য তো সংশোধন হচ্ছে না। নতুন করে কাজ যুক্ত করার কারণে প্রকল্প সংশোধন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, নতুন সংশোধন প্রস্তাবনায় ২১১ কোটি টাকা বাড়ছে। এর মধ্যে জমি কিনতে গিয়ে ৪২ কোটি টাকা লাগবে।
প্রকল্পের খরচ দফায় দফায় ১৯৫ কোটি টাকা থেকে এখন ৬৭১ কোটি টাকায় কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথম যখন সংশোধন করা হয় তখন মাত্র চারটি হর্টিকালচার সেন্টার নির্মাণের জন্য হয়েছিল। পরের সংশোধনে আরো দু’টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর আবার চারটি অন্তর্ভুক্ত হয়। ইতোমধ্যে ১০টি হর্টিকালচার সেন্টার নির্মাণ হয়েছে। এগুলো হলো- দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ, কাশিয়ানী, সিলেট, সাতক্ষীরা, নড়াইল, পঞ্চগড়, নেত্রকোনা ইত্যাদি। তিনি বলেন, যেহেতু নতুন নিতে গেলে সময়সাপেক্ষ ব্যাপার তাই এই চলমান প্রকল্পে যুক্ত করা হয়েছে। আর প্রকল্পে জনবলও আছে।
বিদেশ সফর প্রসঙ্গে বলেন, বিদেশ সফরের ওই ১০ কোটি টাকা আমরা সারেন্ডার করেছি। ফলে এখন প্রকল্পের কোনো বিদেশ সফর বা প্রশিক্ষণ নেই।