ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

পাঠ্যপুস্তক কাইজ্যা সরি কহিলেই মাফ!

  • গওহার নঈম ওয়ারা
  • আপডেট সময় ০৯:৪৯:৫৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ জানুয়ারী ২০২৩
  • ১১৪০ বার পড়া হয়েছে

লেখাপড়ার মিডিয়াম বা ভার্সন- যা-ই হোক না কেন। শিশুর কোনো গুস্তাখি দেখলেই বড়রা বলতে থাকেন- ‘সরি বলো, সরি বলো। শিশু অমনি চটপট ‘সরি’ বলে দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেয়। সরির চলের এখন বড়ই বারবাড়ন্ত। ভয় হয়, কবে না জানি চুরি করে চোর সরি বলে সটকে পড়ে। সম্প্রতি প্রকাশিত স্কুলের পাঠ্যবইয়ে চৌর্যবৃত্তির কথা দেশের মুখ্য আলোচনায় পরিণত হয়েছে। বামাল ধরা পড়ার পর এক খেতাবি ’চোর’ নানা ধানাই-পানাই করে এক চিঠি লিখছেন আকাশের ঠিকানায়। না, সেখানে সরির কোনো বালাই নেই। পরিষ্কার বাংলায় লিখেছেন, ‘পরের বার পুষিয়ে’ দেবেন।

পরের বার পুষিয়ে দেব মার্কা চিঠি দেখে একজন পাঠক লিখেছেন, ‘শুধু দায় স্বীকার করলে হবে? আপনারা যে এ কাজের জন্য অযোগ্য, সেটিও স্বীকার করুন এবং পরবর্তীকালে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কাজে যুক্ত হবেন না- তার মুচলেকা দিন। দায় স্বীকার যখন করলেন, তখন ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল।’

অনেকেই শুধু ক্ষমা নয়, দায়িত্বে অবহেলার কারণে পদ ছেড়ে দেওয়া এবং এই বাবদ সরকারের যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা সংশ্লিষ্টদের পকেট থেকে ফেরত দেওয়ার দাবি তুলেছেন।

অন্যের লেখা বিনা অনুমতিতে নিজের নামে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টাকে ইংরেজিতে প্লেজারি (প্লাগিয়ারিজম) বললেও এটা নির্জলা চৌর্যবৃত্তি বা চুরি। অনেকে পেঁচানো বাংলায় বলেন ‘কুম্ভিলক’। নাম যা-ই হোক, চুরি চুরিই। মসজিদের জুতা চুরি, ফেরিওয়ালার আপেল চুরি, ক্ষেতের বেগুন চুরি বা গেরস্তের গরু চুরির চেয়েও ভয়ঙ্কর এই জ্ঞান চুরি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণির শিক্ষকের চুরি করা গবেষণাপত্র আর নকল পিএইচডির কথা অনেক আগেই প্রমাণিত হয়েছে। কারও নরম শাস্তি হয়েছে, কেউ আদালতে গিয়েছেন। ভালো মামা না থাকায় দুই-একজনের চাকরি ঝুলছে। সবচেয়ে কষ্টের কথা, উচ্চআদলত গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি রোধে ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট যে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন, সেই কমিটিরই একজন এখন চৌর্যবৃত্তির দায়ে অভিযুক্ত।

আদালত কেন এগিয়ে এসেছিল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপকের পিএইচডি গবেষণার হুবহু নকলের অভিযোগ তুলেছিলেন সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোনাস নিলসন। এই মর্মে তিনি এক চিঠিও দিয়েছিলেন। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে শোরগোল শুরু হলে হাইকোর্টে একটি রিট মামলা করা হয়। মামলার শুনানিতে বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ উল্লিখিত কমিটি গঠন করে দেন। এর পাশাপাশি এ কমিটিকে তিন মাসের মধ্যে পিএইচডি গবেষণা জালিয়াতি রোধে নীতিমালা তৈরি করে আদালতে জমা দিতে বলা হয়। আদালত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সচিব ড. ফেরদৌস জামানকে সদস্য সচিব করে যে কমিটি গঠন করেন- এর সদস্যরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, ঢাবির কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সাইফুদ্দিন মো. তারেক, ঢাবির আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. নাকিব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ, ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান, বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাজনীন ও একই বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোস্তফা আকবর।

লেখা চুরি বা লেখা নিয়ে চৌর্যবৃত্তি কি নতুন কিছু

এই বৌদ্ধিক ব্যাধি বা লেখালেখিতে চৌর্যবৃত্তি এতই প্রাচীন যে, কেউ এটাকে পাপ বলে ভাবতেই ভুলে গেছে। বিশিষ্ট মার্কিন কবি টিএস এলিয়ট চৌর্যবৃত্তি নিয়ে বলেছেন, ওসসধঃঁৎব ঢ়ড়বঃ রসরঃধঃব; সধঃঁৎব ঢ়ড়বঃং ংঃবধষ। কাঁচা কবিরা অনুকরণ করে পাক্কুরা করে চুরি। মরহুম হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ খোদ আহমদ ছফা, এমনকি সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হকেরও ছিল। আগে যখন লেখা চুরি ধরার কৌশল জানা ছিল না, তখন কারও প্রকাশিত লেখা থেকে টুকে টাকে নিজের বলে চালিয়ে দেওয়ার সাহস যে কেউ দেখাতে পারত। অপ্রকাশিত লেখা থেকে তো হরদম এমন হতো। তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান ঢাকার একজন পিয়ন নাকি রীতিমতো গীতিকার হয়ে গিয়েছিলেন ডাকযোগে আসা গানের বদৌলতে। আসল গীতিকার কান পেতে থাকতেন তার ডাকের অপেক্ষায়। এমন অভিযোগ স্বাধীনতার পর একেবারে উবে যায়নি। এখন ইংরেজিতে লেখা চুরি ধরার সফটওয়্যারের পাশাপাশি বাংলায় লেখা গবেষণাপত্র, অ্যাসাইনমেন্ট, টার্ম পেপারসহ বিভিন্ন প্রবন্ধে ‘সিমিলারিটি চেকিং’ (চৌর্যবৃত্তি) নিরূপণের সফটওয়্যার পাওয়া যাচ্ছে। এত জানার পরও যারা পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু চুরি করে পার পেতে চান, তাদের দুঃসাহসের তারিফ করতে হয়।

চুরি কি শুধু এ দেশেই হয় : বৌদ্ধিক ব্যাধি সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে গেছে। এ তো গত সেপ্টেম্বরে রোমানিয়ার শিক্ষামন্ত্রীকে পদ-পদবি ছেড়ে বাড়ি চল যেতে হলো চৌর্যবৃত্তির আভিযোগ মাথায় নিয়ে। অন্যের লেখা নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। পরম প্রতাপশালী জার্মান চ্যান্সেলার অ্যাঙ্গেলা মেরকেল তার দুইজন প্রিয় মন্ত্রীকে (প্রতিরক্ষা ও শিক্ষামন্ত্রী) মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেন একই অপরাধে। শিক্ষামন্ত্রীর পিএইচডি তো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বাতিল করে। চুরি আছে। তবে চুরির বিচার আছে, লাজ লজ্জা আছে।

ধ্বংসের দরজায় শিক্ষাব্যবস্থা : এর মধ্যে বর্তমান গদিনশীন কৃষিমন্ত্রী শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে খুল্লাম খুল্লা বাতচিত করেছেন প্রকাশ্য সভায়। তার মতে, শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। তিনি নিত্যনতুন আমদানি করা ‘আইডিয়া’ দিয়ে এ দেশের শিক্ষার্থীদের ‘গিনিপিগ’ বানানোর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অহেতুক হুজ্জতি বন্ধ করতে বলেছেন।

অন্যদিকে শিক্ষামন্ত্রী মনে করেন, শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া ভালো শিক্ষার্থী পাওয়া অসম্ভব। ‘রোট লার্নিং’ কার্যকর হচ্ছে না। এ জন্য আমরা শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনের চেষ্টা করছি। আমরা কাজ করে শেখার উৎসাহিত করার চেষ্টা করছি। একজন শিক্ষক গাইডের ভূমিকা পালন করবেন। মন্ত্রীদের মধ্যে ভিন্নমত থাকতেই পারে। এটা মন্ত্রিসভায় আলোচনা করে সমাধান করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীরা কেন এসব বিতর্কের মূল্য দেবে।

কৃষিমন্ত্রী নিশ্চয় জানেন, শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করা আর দেশ ধ্বংস করার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আফ্রিকার সবচেয়ে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম ইউনির্ভাসিটি অব সাউথ আফ্রিকা। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢোকার পথে লেখা আছে রয়েছে, ‘কোনো জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক হামলা কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের দরকার নেই। …শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মানে হলো একটি জাতির অবলুপ্তি।’ বছর কয়েক আগে চিটাগাং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান তৌহিদ সামাদ একই কথার প্রতিধ্বনি করে বলেছিলেন, একটি দেশকে ধ্বংস করতে হলে মানহীন শিক্ষাই যথেষ্ট। কারণ প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমেই সব সেক্টরে দক্ষ জনবল গড়ে ওঠে।

চৌর্যবৃত্তি ছাড়াও ভুল তথ্য আর অসঙ্গতির জোরালো আভিযোগ আছে : স্কুল ও মাদ্রাসার নতুন পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে। বিশেষ করে নিম্নমাধ্যমিকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সমাজ বই নিয়ে বিতর্ক এখন তুঙ্গে। এখন প্রশ্ন, ভুল বইয়ের কী হবে? গত ১৭ জানুয়ারি নবম-দশম শ্রেণির ৩টি বইয়ের বেশকিছু সংশোধনী দেয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।

এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম মতে, ভুল তথ্যের দায়ভার এনসিটিবির ওপরেও যায়। তবে এ জন্য তিনি লেখকের ‘অনৈতিকতাকেও’ দায়ী করছেন। নৈতিকতাবিবর্জিত কাজের অভিযোগে পরে কতিপয় লেখককে হয়তো কাজ দেওয়া হবে না। কিন্তু এখনকার সমস্যা কীভাবে সমাধান হবে? আবারও কি সংশোধিত নতুন বই ছাপাতে হবে? এনসিটিবি চেয়্যারম্যান ফরহাদুল ইসলাম বিবিসিকে জানিয়েছেন- এখন যে ভুলগুলো পাওয়া যাচ্ছে, তা দ্রুততার সঙ্গে অনলাইনেই সংশোধন করা হচ্ছে। তার মতে, চলতি বছর নতুন করে বই ছাপানোর প্রয়োজন নেই। এনসিটিবি এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে ভুলের সংশোধনী দেওয়া হয়েছে। এসব ওয়েবসাইটের সঙ্গে দেশের সব স্কুলের প্রধান শিক্ষক যুক্ত আছেন। প্রধান শিক্ষকদের মাধ্যমে সংশোধনী সব স্কুলের শিক্ষকদের কাছে পৌঁছে যাবে। এর পর শ্রেণিশিক্ষকরা হাতে লিখে সংশ্লিষ্ট বইয়ের ভুলগুলো সংশোধন করেন দেবেন। তবে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই এবার পরীক্ষামূলকভাবে দেওয়া হয়েছে বলে জানান ফরহাদুল ইসলাম। এ বছর মাঠপর্যায়ে সবার মতামতের পর ব্যাপক পরিমার্জন করে আগামী বছর দেওয়া হবে বইগুলোর প্রথম সংস্করণ।

পাঠ্যপুস্তক নিয়ে আমাদের যে গাফলতি ও অবহেলা আছে, তাতে সন্দেহ নেই। কোনো অবস্থাতেই আমাদের আর উদাসীন থাকা চলবে না। অবহেলা ও গাফলতির বিচার না হলে, গাফেলদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে না পারলে এসব ঘটতেই থাকবে।

গওহার নঈম ওয়ারা : গবেষক

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

পাঠ্যপুস্তক কাইজ্যা সরি কহিলেই মাফ!

আপডেট সময় ০৯:৪৯:৫৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ জানুয়ারী ২০২৩

লেখাপড়ার মিডিয়াম বা ভার্সন- যা-ই হোক না কেন। শিশুর কোনো গুস্তাখি দেখলেই বড়রা বলতে থাকেন- ‘সরি বলো, সরি বলো। শিশু অমনি চটপট ‘সরি’ বলে দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেয়। সরির চলের এখন বড়ই বারবাড়ন্ত। ভয় হয়, কবে না জানি চুরি করে চোর সরি বলে সটকে পড়ে। সম্প্রতি প্রকাশিত স্কুলের পাঠ্যবইয়ে চৌর্যবৃত্তির কথা দেশের মুখ্য আলোচনায় পরিণত হয়েছে। বামাল ধরা পড়ার পর এক খেতাবি ’চোর’ নানা ধানাই-পানাই করে এক চিঠি লিখছেন আকাশের ঠিকানায়। না, সেখানে সরির কোনো বালাই নেই। পরিষ্কার বাংলায় লিখেছেন, ‘পরের বার পুষিয়ে’ দেবেন।

পরের বার পুষিয়ে দেব মার্কা চিঠি দেখে একজন পাঠক লিখেছেন, ‘শুধু দায় স্বীকার করলে হবে? আপনারা যে এ কাজের জন্য অযোগ্য, সেটিও স্বীকার করুন এবং পরবর্তীকালে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কাজে যুক্ত হবেন না- তার মুচলেকা দিন। দায় স্বীকার যখন করলেন, তখন ক্ষমা চাওয়া উচিত ছিল।’

অনেকেই শুধু ক্ষমা নয়, দায়িত্বে অবহেলার কারণে পদ ছেড়ে দেওয়া এবং এই বাবদ সরকারের যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা সংশ্লিষ্টদের পকেট থেকে ফেরত দেওয়ার দাবি তুলেছেন।

অন্যের লেখা বিনা অনুমতিতে নিজের নামে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টাকে ইংরেজিতে প্লেজারি (প্লাগিয়ারিজম) বললেও এটা নির্জলা চৌর্যবৃত্তি বা চুরি। অনেকে পেঁচানো বাংলায় বলেন ‘কুম্ভিলক’। নাম যা-ই হোক, চুরি চুরিই। মসজিদের জুতা চুরি, ফেরিওয়ালার আপেল চুরি, ক্ষেতের বেগুন চুরি বা গেরস্তের গরু চুরির চেয়েও ভয়ঙ্কর এই জ্ঞান চুরি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণির শিক্ষকের চুরি করা গবেষণাপত্র আর নকল পিএইচডির কথা অনেক আগেই প্রমাণিত হয়েছে। কারও নরম শাস্তি হয়েছে, কেউ আদালতে গিয়েছেন। ভালো মামা না থাকায় দুই-একজনের চাকরি ঝুলছে। সবচেয়ে কষ্টের কথা, উচ্চআদলত গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি রোধে ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট যে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন, সেই কমিটিরই একজন এখন চৌর্যবৃত্তির দায়ে অভিযুক্ত।

আদালত কেন এগিয়ে এসেছিল : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপকের পিএইচডি গবেষণার হুবহু নকলের অভিযোগ তুলেছিলেন সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোনাস নিলসন। এই মর্মে তিনি এক চিঠিও দিয়েছিলেন। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে শোরগোল শুরু হলে হাইকোর্টে একটি রিট মামলা করা হয়। মামলার শুনানিতে বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ উল্লিখিত কমিটি গঠন করে দেন। এর পাশাপাশি এ কমিটিকে তিন মাসের মধ্যে পিএইচডি গবেষণা জালিয়াতি রোধে নীতিমালা তৈরি করে আদালতে জমা দিতে বলা হয়। আদালত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সচিব ড. ফেরদৌস জামানকে সদস্য সচিব করে যে কমিটি গঠন করেন- এর সদস্যরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, ঢাবির কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সাইফুদ্দিন মো. তারেক, ঢাবির আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. নাকিব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ, ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান, বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাজনীন ও একই বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোস্তফা আকবর।

লেখা চুরি বা লেখা নিয়ে চৌর্যবৃত্তি কি নতুন কিছু

এই বৌদ্ধিক ব্যাধি বা লেখালেখিতে চৌর্যবৃত্তি এতই প্রাচীন যে, কেউ এটাকে পাপ বলে ভাবতেই ভুলে গেছে। বিশিষ্ট মার্কিন কবি টিএস এলিয়ট চৌর্যবৃত্তি নিয়ে বলেছেন, ওসসধঃঁৎব ঢ়ড়বঃ রসরঃধঃব; সধঃঁৎব ঢ়ড়বঃং ংঃবধষ। কাঁচা কবিরা অনুকরণ করে পাক্কুরা করে চুরি। মরহুম হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ খোদ আহমদ ছফা, এমনকি সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হকেরও ছিল। আগে যখন লেখা চুরি ধরার কৌশল জানা ছিল না, তখন কারও প্রকাশিত লেখা থেকে টুকে টাকে নিজের বলে চালিয়ে দেওয়ার সাহস যে কেউ দেখাতে পারত। অপ্রকাশিত লেখা থেকে তো হরদম এমন হতো। তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান ঢাকার একজন পিয়ন নাকি রীতিমতো গীতিকার হয়ে গিয়েছিলেন ডাকযোগে আসা গানের বদৌলতে। আসল গীতিকার কান পেতে থাকতেন তার ডাকের অপেক্ষায়। এমন অভিযোগ স্বাধীনতার পর একেবারে উবে যায়নি। এখন ইংরেজিতে লেখা চুরি ধরার সফটওয়্যারের পাশাপাশি বাংলায় লেখা গবেষণাপত্র, অ্যাসাইনমেন্ট, টার্ম পেপারসহ বিভিন্ন প্রবন্ধে ‘সিমিলারিটি চেকিং’ (চৌর্যবৃত্তি) নিরূপণের সফটওয়্যার পাওয়া যাচ্ছে। এত জানার পরও যারা পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু চুরি করে পার পেতে চান, তাদের দুঃসাহসের তারিফ করতে হয়।

চুরি কি শুধু এ দেশেই হয় : বৌদ্ধিক ব্যাধি সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে গেছে। এ তো গত সেপ্টেম্বরে রোমানিয়ার শিক্ষামন্ত্রীকে পদ-পদবি ছেড়ে বাড়ি চল যেতে হলো চৌর্যবৃত্তির আভিযোগ মাথায় নিয়ে। অন্যের লেখা নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। পরম প্রতাপশালী জার্মান চ্যান্সেলার অ্যাঙ্গেলা মেরকেল তার দুইজন প্রিয় মন্ত্রীকে (প্রতিরক্ষা ও শিক্ষামন্ত্রী) মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেন একই অপরাধে। শিক্ষামন্ত্রীর পিএইচডি তো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বাতিল করে। চুরি আছে। তবে চুরির বিচার আছে, লাজ লজ্জা আছে।

ধ্বংসের দরজায় শিক্ষাব্যবস্থা : এর মধ্যে বর্তমান গদিনশীন কৃষিমন্ত্রী শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে খুল্লাম খুল্লা বাতচিত করেছেন প্রকাশ্য সভায়। তার মতে, শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। তিনি নিত্যনতুন আমদানি করা ‘আইডিয়া’ দিয়ে এ দেশের শিক্ষার্থীদের ‘গিনিপিগ’ বানানোর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অহেতুক হুজ্জতি বন্ধ করতে বলেছেন।

অন্যদিকে শিক্ষামন্ত্রী মনে করেন, শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া ভালো শিক্ষার্থী পাওয়া অসম্ভব। ‘রোট লার্নিং’ কার্যকর হচ্ছে না। এ জন্য আমরা শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তনের চেষ্টা করছি। আমরা কাজ করে শেখার উৎসাহিত করার চেষ্টা করছি। একজন শিক্ষক গাইডের ভূমিকা পালন করবেন। মন্ত্রীদের মধ্যে ভিন্নমত থাকতেই পারে। এটা মন্ত্রিসভায় আলোচনা করে সমাধান করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীরা কেন এসব বিতর্কের মূল্য দেবে।

কৃষিমন্ত্রী নিশ্চয় জানেন, শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করা আর দেশ ধ্বংস করার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আফ্রিকার সবচেয়ে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম ইউনির্ভাসিটি অব সাউথ আফ্রিকা। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢোকার পথে লেখা আছে রয়েছে, ‘কোনো জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক হামলা কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের দরকার নেই। …শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার মানে হলো একটি জাতির অবলুপ্তি।’ বছর কয়েক আগে চিটাগাং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান তৌহিদ সামাদ একই কথার প্রতিধ্বনি করে বলেছিলেন, একটি দেশকে ধ্বংস করতে হলে মানহীন শিক্ষাই যথেষ্ট। কারণ প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমেই সব সেক্টরে দক্ষ জনবল গড়ে ওঠে।

চৌর্যবৃত্তি ছাড়াও ভুল তথ্য আর অসঙ্গতির জোরালো আভিযোগ আছে : স্কুল ও মাদ্রাসার নতুন পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে তুমুল বিতর্ক চলছে। বিশেষ করে নিম্নমাধ্যমিকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সমাজ বই নিয়ে বিতর্ক এখন তুঙ্গে। এখন প্রশ্ন, ভুল বইয়ের কী হবে? গত ১৭ জানুয়ারি নবম-দশম শ্রেণির ৩টি বইয়ের বেশকিছু সংশোধনী দেয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।

এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম মতে, ভুল তথ্যের দায়ভার এনসিটিবির ওপরেও যায়। তবে এ জন্য তিনি লেখকের ‘অনৈতিকতাকেও’ দায়ী করছেন। নৈতিকতাবিবর্জিত কাজের অভিযোগে পরে কতিপয় লেখককে হয়তো কাজ দেওয়া হবে না। কিন্তু এখনকার সমস্যা কীভাবে সমাধান হবে? আবারও কি সংশোধিত নতুন বই ছাপাতে হবে? এনসিটিবি চেয়্যারম্যান ফরহাদুল ইসলাম বিবিসিকে জানিয়েছেন- এখন যে ভুলগুলো পাওয়া যাচ্ছে, তা দ্রুততার সঙ্গে অনলাইনেই সংশোধন করা হচ্ছে। তার মতে, চলতি বছর নতুন করে বই ছাপানোর প্রয়োজন নেই। এনসিটিবি এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে ভুলের সংশোধনী দেওয়া হয়েছে। এসব ওয়েবসাইটের সঙ্গে দেশের সব স্কুলের প্রধান শিক্ষক যুক্ত আছেন। প্রধান শিক্ষকদের মাধ্যমে সংশোধনী সব স্কুলের শিক্ষকদের কাছে পৌঁছে যাবে। এর পর শ্রেণিশিক্ষকরা হাতে লিখে সংশ্লিষ্ট বইয়ের ভুলগুলো সংশোধন করেন দেবেন। তবে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই এবার পরীক্ষামূলকভাবে দেওয়া হয়েছে বলে জানান ফরহাদুল ইসলাম। এ বছর মাঠপর্যায়ে সবার মতামতের পর ব্যাপক পরিমার্জন করে আগামী বছর দেওয়া হবে বইগুলোর প্রথম সংস্করণ।

পাঠ্যপুস্তক নিয়ে আমাদের যে গাফলতি ও অবহেলা আছে, তাতে সন্দেহ নেই। কোনো অবস্থাতেই আমাদের আর উদাসীন থাকা চলবে না। অবহেলা ও গাফলতির বিচার না হলে, গাফেলদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে না পারলে এসব ঘটতেই থাকবে।

গওহার নঈম ওয়ারা : গবেষক