ইউরিয়াসহ সব ধরনের সার কেজিতে ৫ টাকা করে বাড়ানোর ফলে বর্তমান বোরো মৌসুমে তেমন প্রভাব না পড়লেও আসন্ন আউশ, আমন ও পাট মৌসুমে উৎপাদনে বড় প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি একথা বলেন।
দেশের প্রবীণতম এই কৃষি অর্থনীতিবিদ বলেন, বোরো আবাদ প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। এখন ধান কাটা শুরু হচ্ছে। তাই বোরোতে সার খুব বেশি ব্যবহৃত হবে না। তবে, সামনে আউশ এবং পাট উৎপাদনের মৌসুম। এরপর আসছে আমন ধানের মৌসুম। এই দু’টি সিজন সারের দাম বাড়ায় মারত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সারের দাম এক বছরে দুইবার বাড়ালো সরকার। আগের বার ইউরিয়াতে ৬ টাকা বাড়ানো (কেজি) হয়েছিল। এবার ৫ টাকা করে সব সারের দাম বাড়ানো হলো। এতে বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কৃষি উৎপাদনে।
বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতির সাবেক এই সভাপতি বলেন, আমরা যখন বলছি, সারাবিশ্বে খাদ্য সঙ্কট। খাদ্য শস্যের দাম বেড়ে গেছে। সাপ্লাই কমে গেছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো যারা খাদ্য শস্য আমদানির উপর নির্ভরশীল, তারা এখন খুবই সমস্যার মধ্যে আছে। কারণ খাদ্য তো এখন স্বাভাবিক না। দাম তো বেড়ে গেছে। তারা এখন (উন্নয়নশীল দেশ) আমদানির বিকল্প নীতি গ্রহণ করছে এবং উৎপাদন বাড়াতে চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ সরকার বলছে যে, এক ইঞ্চি জমিও যাতে পতিত না থাকে। জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে বলা হচ্ছে। এ অবস্থায় উৎপাদনের উপকরণের দাম বাড়ানো হলো। এটা তো সাংঘর্ষিক কথা হয়ে গেল।
প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক এই মহাপরিচালক বলেন, সারের মূল্য বৃদ্ধির ফলে পরবর্তী ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃষক নিরুৎসাহিত হবে। জমি পতিত ফেলে রাখবে। যেখানে আমরা উৎপাদন বাড়াতে চাচ্ছি, সেই সময়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। তিনি বলেন, একটা সময় মোট চাহিদার ৮০ শতাংশ ইউরিয়া উৎপাদন হতো দেশে। এখন কমতে কমতে ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। একে একে কারখানা বন্ধ হচ্ছে। অপর দিকে, আমদানি বেড়ে গেছে। উচিত হবে আমদানির উপর নির্ভর না করে ইউরিয়া উৎপাদন বাড়ানো। দরকার হলে আরো একাধিক সার কারখানা করুক বিসিআইসি।
ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, গত বছর কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো, ১৮ হাজার কোটির মতো খরচ হয়েছে। সামনের বছর অন্তত ৪০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি রাখতে হবে কৃষি খাতে। আর এখন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের নগদ সহায়তা দিতে হবে। কৃষক যাতে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন, চালের দাম ভোক্তা পর্যায়ে অনেক বেশি, কিন্তু কৃষক পর্যায়ে ধানের দাম তো অতোটা না। এটা তো (লাভ) মধ্যস্বত্বভোগীরা নিয়ে যাচ্ছে। কাজেই কৃষকরা যাতে উপযুক্ত দাম পায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
পৃথিবীর সব দেশেই কৃষিতে সাবসিডি দেয়া হয় উল্লেখ করে এই কৃষি অর্থনীতিবিদ বলেন, উন্নত বিশে^র অনেক দেশ আছে যেখানে আমাদের চেয়ে বেশি সাবসিডি দেয়া হয়। কারণ কৃষি অত্যন্ত কষ্টসাধ্য বিষয়। কৃষির উপর নির্ভর খাদ্যনিরাপত্তা। সেই কারণে কৃষকদের যদি ভর্তুকি বাড়িয়ে দেয়া না হয় তাহলে কৃষক উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হবে। উৎপাদন কমে যাবে, খাদ্য সঙ্কট সৃষ্টি হবে। এ কারণে ভর্তুকি বাড়াতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হলে, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করতে হলে, দফায় দফায় উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি পরিহার করতে হবে। তিনি বলেন, কৃষি লাভজনক না হলে কৃষক ফসল ফলাবে না। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে খাদ্য সঙ্কট দেখা দেবে। খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। বিরূপ প্রভাব পড়বে কৃষি উৎপাদনে। সুতরাং সাবসিডি দিয়েই কৃষককে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
উল্লেখ্য, কেজিতে ৫ টাকা বৃদ্ধির ফলে এখন কৃষক পর্যায়ে ইউরিয়া সার ২৭ টাকায়, ডিএপি ২১ টাকায়, ডিএসপি ২৭ টাকায় এবং এমওপি সার ২০ টাকায় বিক্রি হবে।