ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

বরিশালের ২৪০ বছরের পুরনো ‘দুর্গাসাগর’ এখন আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র

বরিশালে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের যেসব নিদর্শন রয়েছে, এর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী দুর্গাসাগর অন্যতম। দিন যত যাচ্ছে, ততই পাল্টে যাচ্ছে দুর্গাসাগর দিঘির চিত্র। পর্যটক আকৃষ্টে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দিঘি ও চারপাশ এলাকাকে প্রাকৃতিক আলপনা দিয়ে সাজানোর কাজ চলছে। ঐতিহাসিক এ স্থানটিকে দর্শনার্থীদের কাছে উপভোগ্য করে তুলতে বরিশাল জেলা প্রশাসন ইতোমধ্যে নানামুখী পদক্ষেপ হাতে নিয়েছেন। এর মধ্যে অনেকাংশ বাস্তবায়নও করেছেন।

এক সময়কার অবহেলিত ২৪০ বছরের পুরনো এ দিঘিটি এখন আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। দিনের বেশিরভাগ সময় দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত থাকে। দীঘি দেখতে প্রতিদিন দেশ-বিদেশ থেকে সহস্রাধিক মানুষের সমাগম হয়। জনশ্রুতি ও স্থানীয় তথ্যানুসারে জানা গেছে, জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশায় ইউনিয়নে বরিশাল-বানারীপাড়া সড়কের পাশে জনগণের পানি সঙ্কট নিরসনের লক্ষ্যে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে এ দীঘিটি খনন করেন তৎকালীন চন্দ্রদ্বীপের পরগনার রাজা শিবনারায়ণ।

তার স্ত্রী রানী দুর্গাবতী একবারে যতদূর পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলেন ততদূর পর্যন্ত এ দিঘি খনন করা হয়। আর রানী দুর্গাবতীর নামেই দিঘীটির নামকরণ করা হয় দুর্গাসাগর। এক রাতে রানী প্রায় ৬১ কানি জমি হেঁটেছিলেন। চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের বিভিন্ন গ্রাম হতে প্রজারা দিঘি খননে অংশ নেয়। দীঘি খনন কাজ শেষ করতে সময় লাগে প্রায় ছয় মাস। দিঘি খননে ব্যয় হয় তৎকালীন প্রায় তিন লাখ টাকা।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দীঘিটি ৪৫ একর ৪২ শতাংশ জমিতে অবস্থিত। এর ২৭ একর ৩৮ শতাংশ জলাশয় এবং ১৮ একর চার শতাংশ পাড়। এ ছাড়া, দীঘির চারপাশ দিয়ে ১.৬ কিলোমিটার হাঁটার রাস্তা রয়েছে। পাড়টি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা ১৪৯০ ফুট এবং প্রশস্ত পূর্ব-পশ্চিমে ১৩৬০ ফুট। দিঘিটির মাঝখানেই রয়েছে ছোট্ট একটি দ্বীপ, যা এ দিঘির সৌন্দর্য আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলেছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দিঘিটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় ইংরেজ শাসনামলে তৎকালীন জেলা বোর্ড এটি সংস্কার করে। স্বাধীনতা উত্তরকালে ১৯৭৪ সালেও দিঘিটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখনকার জেলা বোর্ড দিঘিটি পরিষ্কার করে। সে সময়েই দিঘির মাঝামাঝি স্থানে অবকাশযাপন কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ছোট দ্বীপের ন্যায় তৈরি করা হয়।

দীঘির চারপাশে নারিকেল, সুপারি, শিশু, মেহগনি প্রভৃতি বৃক্ষ রোপণ করে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়, যা বর্তমানে দিঘিটির শোভাবর্ধন করেছে। দিঘির চারপাশে বাঁধানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বিনোদনের নতুনমাত্রা খুঁজে পায় প্রকৃতিপ্রেমীরা। আর চিরচেনা গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে এ দিঘি যেন গ্রামীণ নিসর্গে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়া।

এ দিঘি সর্বশেষ ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সংস্কার করা হয়। দিঘির চারপাশে চারটি সুদৃশ্য বাঁধানো ঘাট থাকলেও পূর্ব দক্ষিণ পাশের ঘাট দুটি বিলীন হয়ে গেছে। পশ্চিম পাড়ে ঘাট সংলগ্ন স্থানে রয়েছে জেলা পরিষদের ডাক বাংলো। ইচ্ছা করলে ভ্রমণকারীরা এখানে রাত কাটাতে পারেন।

২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর থেকে এখানকার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। স্থানীয়দের মতে, সিডরের সময় ত্রাণ নিয়ে বড় বড় হেলিকপ্টারের বিচরণের কারণে ভয়ে চলে গেছে অতিথি পাখিগুলো। তবে পাখিপ্রেমীরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে মেহগনি গাছ লাগানোয় এখানে পাখির বিচরণ কমেছে।

তাদের মতে, মেহগনি এমন একটি গাছ, এ গাছের নিচে বা কাছাকাছি অন্য কোনও গাছ যেমন হতে চায় না, তেমনি এর ফলও পাখিরা খেতে চায় না। তবে, যে কারণেই হোক ২০০৭-০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আর এ দিঘিতে অতিথি পাখির বিচরণ দেখা যায়নি।

স্থানীয়রা জানান, এরপর থেকে দিন যত গেছে, দুর্গাসাগর ততই নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল। অনেকটাই পর্যটকশূন্য দুর্গাসাগরে বখাটে-মাদকসেবীদের বিচরণ ঘটতে শুরু করে। নজরদারির অভাবে এখানকার অবকাঠামোর ভঙ্গুর দশার সৃষ্টি হলে জরাজীর্ণ এক বিনোদন কেন্দ্রে রূপ নেয় ঐতিহ্যবাহী দুর্গাসাগর। তারপর বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসে জেলা প্রশাসন।

জনপ্রতিনিধি, প্রকৃতিপ্রেমী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ২০১৬-১৭ সালের দিকে দুর্গাসাগরের অবকাঠামো ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়ানোর কাজে হাত দেয় জেলা প্রশাসন। তৎকালীন জেলা প্রশাসকের বদলি হয়ে যাওয়ায় সে কাজ আর বেশিদূর এগোতে পারেনি। এরপর জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান দায়িত্ব নেওয়ার পরই বরিশালের যেসব দিকের উন্নয়নের চিন্তা করেন, তার মধ্যে পর্যটন ছিল অন্যতম। ফলে দুর্গাসাগরের আমূল পরিবর্তন ঘটে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০ টাকার টিকিটে বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী দুর্গাসাগর দিঘির সৌন্দর্য অবলোকন করতে গড়ে প্রতিদিন সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ জন মানুষ আসছেন। কিন্তু কয়েক বছর আগেও এখানে গড়ে অর্ধশত দর্শনার্থীও টিকিট কেটে প্রবেশ করতেন না।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, দুর্গাসাগর দিঘিকে দর্শনীয় করে তুলতে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ ও প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে দুর্গাসাগরের প্রাকৃতিক ও অবকাঠামোগত সৌন্দর্যের প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটছে। গত বছরের সংস্কার ও সংযোজনের মধ্য দিয়ে দিঘিতে বর্তমানে রয়েছে সুপরিসর ও দৃষ্টিনন্দন দুটি ঘাট, পিকনিক বা অনুষ্ঠানের জন্য মঞ্চ, দিঘির পানিতে ঘুরে বেড়ানোর জন্য প্যাডেল বোট ও নৌকা।

এ ছাড়া, রয়েছে বড়শি দিয়ে মাছ শিকারের ব্যবস্থা, দীঘির পাড়ে বসার জন্য ছাউনিযুক্ত বেঞ্চ, পাবলিক টয়লেট, ওয়াশরুম, রেস্ট হাউজ। সার্বক্ষণিক সিসি টিভির আওতায় থাকা দিঘি এলাকায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়ানোর লক্ষ্যে তৈরি করা হয়েছে বাগান। রয়েছে দিঘির স্বচ্ছ পানিতে শাপলা ও পদ্মফুলের সমারোহ এবং হরিণ, হাঁস, বানর, কবুতর ও বিভিন্ন প্রজাতির সৌখিন পাখি সরবরাহ করার পাশাপাশি স্থাপন করা হয়েছে বাঘ-হরিণের ম্যুরাল।

এ ছাড়াও, দুর্গাসাগরের পশ্চিমপাড়ের গেটসংলগ্ন চত্বর সংস্কার, ঐতিহ্যবাহী বটমূলের সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়েছে। পাশাপাশি নতুন একটি পিকনিক সেড নির্মাণ, বিভিন্ন প্রজাতির হাঁসের সংখ্যা বাড়ানো, ঘর ও খাঁচা নির্মাণ পূর্বক বানর, কবুতরসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি সংযোজন, প্রবেশ গেট মেরামত এবং সৌন্দর্য বর্ধন, ইলেকট্রনিক নাম ফলক স্থাপন, দিঘিতে বিভিন্ন প্রজাতির মৎস্য অবমুক্তকরণ, দুর্গাসাগরের চারিপাশের সকল এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া, সৌরবিদ্যুৎ সুবিধা সংযোজন, ওয়াকওয়ের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য মাটি ভরাট করার মতো কাজগুলো করা হয়েছে। পর্যটকরা বলছেন, ধীরে ধীরে পর্যটক মুখর হয়ে উঠছে দুর্গাসাগর। ফলে বাণিজ্যের প্রসারসহ স্থানীয়রাও সুফল পেতে শুরু করেছে। এ বছর এখানে কিছু অতিথি পাখির আনাগোনা দেখা যাচ্ছে।

জেলা প্রশাসক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, দুর্গাসাগরকে আকর্ষণীয় করে তুলতে আরও বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী এ দিঘির সার্বিক উন্নয়নে আমাদের পক্ষ থেকে যথাসাধ্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এটিকে, পরিবেশবান্ধব পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হবে।

দিঘি উন্নয়নে জেলা প্রশাসনের সঠিক সিদ্ধান্তের কারণেই দীর্ঘ একযুগ পর এখানে এ বছরই অতিথি পাখির আগমন ঘটেছে দাবি করে তিনি বলেন, দিঘিতে বিপুল পরিমাণে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ছাড়া হয়েছে। এ ছাড়া, এখানে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় সাত শ’ হাঁস ও কয়েক শ’ কবুতর রয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে পাখিদের আকৃষ্ট করতে ফলজ গাছের বনায়নও করা হয়েছে। এ ছাড়া, ভাসমান কৃষি কাজের প্রদর্শনীও করা হবে।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

বরিশালের ২৪০ বছরের পুরনো ‘দুর্গাসাগর’ এখন আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র

আপডেট সময় ০৬:৩১:১০ অপরাহ্ন, সোমবার, ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

বরিশালে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের যেসব নিদর্শন রয়েছে, এর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী দুর্গাসাগর অন্যতম। দিন যত যাচ্ছে, ততই পাল্টে যাচ্ছে দুর্গাসাগর দিঘির চিত্র। পর্যটক আকৃষ্টে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দিঘি ও চারপাশ এলাকাকে প্রাকৃতিক আলপনা দিয়ে সাজানোর কাজ চলছে। ঐতিহাসিক এ স্থানটিকে দর্শনার্থীদের কাছে উপভোগ্য করে তুলতে বরিশাল জেলা প্রশাসন ইতোমধ্যে নানামুখী পদক্ষেপ হাতে নিয়েছেন। এর মধ্যে অনেকাংশ বাস্তবায়নও করেছেন।

এক সময়কার অবহেলিত ২৪০ বছরের পুরনো এ দিঘিটি এখন আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। দিনের বেশিরভাগ সময় দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত থাকে। দীঘি দেখতে প্রতিদিন দেশ-বিদেশ থেকে সহস্রাধিক মানুষের সমাগম হয়। জনশ্রুতি ও স্থানীয় তথ্যানুসারে জানা গেছে, জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশায় ইউনিয়নে বরিশাল-বানারীপাড়া সড়কের পাশে জনগণের পানি সঙ্কট নিরসনের লক্ষ্যে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে এ দীঘিটি খনন করেন তৎকালীন চন্দ্রদ্বীপের পরগনার রাজা শিবনারায়ণ।

তার স্ত্রী রানী দুর্গাবতী একবারে যতদূর পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলেন ততদূর পর্যন্ত এ দিঘি খনন করা হয়। আর রানী দুর্গাবতীর নামেই দিঘীটির নামকরণ করা হয় দুর্গাসাগর। এক রাতে রানী প্রায় ৬১ কানি জমি হেঁটেছিলেন। চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের বিভিন্ন গ্রাম হতে প্রজারা দিঘি খননে অংশ নেয়। দীঘি খনন কাজ শেষ করতে সময় লাগে প্রায় ছয় মাস। দিঘি খননে ব্যয় হয় তৎকালীন প্রায় তিন লাখ টাকা।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দীঘিটি ৪৫ একর ৪২ শতাংশ জমিতে অবস্থিত। এর ২৭ একর ৩৮ শতাংশ জলাশয় এবং ১৮ একর চার শতাংশ পাড়। এ ছাড়া, দীঘির চারপাশ দিয়ে ১.৬ কিলোমিটার হাঁটার রাস্তা রয়েছে। পাড়টি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা ১৪৯০ ফুট এবং প্রশস্ত পূর্ব-পশ্চিমে ১৩৬০ ফুট। দিঘিটির মাঝখানেই রয়েছে ছোট্ট একটি দ্বীপ, যা এ দিঘির সৌন্দর্য আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলেছে।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দিঘিটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় ইংরেজ শাসনামলে তৎকালীন জেলা বোর্ড এটি সংস্কার করে। স্বাধীনতা উত্তরকালে ১৯৭৪ সালেও দিঘিটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখনকার জেলা বোর্ড দিঘিটি পরিষ্কার করে। সে সময়েই দিঘির মাঝামাঝি স্থানে অবকাশযাপন কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ছোট দ্বীপের ন্যায় তৈরি করা হয়।

দীঘির চারপাশে নারিকেল, সুপারি, শিশু, মেহগনি প্রভৃতি বৃক্ষ রোপণ করে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়, যা বর্তমানে দিঘিটির শোভাবর্ধন করেছে। দিঘির চারপাশে বাঁধানো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বিনোদনের নতুনমাত্রা খুঁজে পায় প্রকৃতিপ্রেমীরা। আর চিরচেনা গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে এ দিঘি যেন গ্রামীণ নিসর্গে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়া।

এ দিঘি সর্বশেষ ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সংস্কার করা হয়। দিঘির চারপাশে চারটি সুদৃশ্য বাঁধানো ঘাট থাকলেও পূর্ব দক্ষিণ পাশের ঘাট দুটি বিলীন হয়ে গেছে। পশ্চিম পাড়ে ঘাট সংলগ্ন স্থানে রয়েছে জেলা পরিষদের ডাক বাংলো। ইচ্ছা করলে ভ্রমণকারীরা এখানে রাত কাটাতে পারেন।

২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর থেকে এখানকার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। স্থানীয়দের মতে, সিডরের সময় ত্রাণ নিয়ে বড় বড় হেলিকপ্টারের বিচরণের কারণে ভয়ে চলে গেছে অতিথি পাখিগুলো। তবে পাখিপ্রেমীরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে মেহগনি গাছ লাগানোয় এখানে পাখির বিচরণ কমেছে।

তাদের মতে, মেহগনি এমন একটি গাছ, এ গাছের নিচে বা কাছাকাছি অন্য কোনও গাছ যেমন হতে চায় না, তেমনি এর ফলও পাখিরা খেতে চায় না। তবে, যে কারণেই হোক ২০০৭-০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আর এ দিঘিতে অতিথি পাখির বিচরণ দেখা যায়নি।

স্থানীয়রা জানান, এরপর থেকে দিন যত গেছে, দুর্গাসাগর ততই নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল। অনেকটাই পর্যটকশূন্য দুর্গাসাগরে বখাটে-মাদকসেবীদের বিচরণ ঘটতে শুরু করে। নজরদারির অভাবে এখানকার অবকাঠামোর ভঙ্গুর দশার সৃষ্টি হলে জরাজীর্ণ এক বিনোদন কেন্দ্রে রূপ নেয় ঐতিহ্যবাহী দুর্গাসাগর। তারপর বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসে জেলা প্রশাসন।

জনপ্রতিনিধি, প্রকৃতিপ্রেমী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ২০১৬-১৭ সালের দিকে দুর্গাসাগরের অবকাঠামো ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়ানোর কাজে হাত দেয় জেলা প্রশাসন। তৎকালীন জেলা প্রশাসকের বদলি হয়ে যাওয়ায় সে কাজ আর বেশিদূর এগোতে পারেনি। এরপর জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান দায়িত্ব নেওয়ার পরই বরিশালের যেসব দিকের উন্নয়নের চিন্তা করেন, তার মধ্যে পর্যটন ছিল অন্যতম। ফলে দুর্গাসাগরের আমূল পরিবর্তন ঘটে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০ টাকার টিকিটে বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী দুর্গাসাগর দিঘির সৌন্দর্য অবলোকন করতে গড়ে প্রতিদিন সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ জন মানুষ আসছেন। কিন্তু কয়েক বছর আগেও এখানে গড়ে অর্ধশত দর্শনার্থীও টিকিট কেটে প্রবেশ করতেন না।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, দুর্গাসাগর দিঘিকে দর্শনীয় করে তুলতে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ ও প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এর ফলে দুর্গাসাগরের প্রাকৃতিক ও অবকাঠামোগত সৌন্দর্যের প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটছে। গত বছরের সংস্কার ও সংযোজনের মধ্য দিয়ে দিঘিতে বর্তমানে রয়েছে সুপরিসর ও দৃষ্টিনন্দন দুটি ঘাট, পিকনিক বা অনুষ্ঠানের জন্য মঞ্চ, দিঘির পানিতে ঘুরে বেড়ানোর জন্য প্যাডেল বোট ও নৌকা।

এ ছাড়া, রয়েছে বড়শি দিয়ে মাছ শিকারের ব্যবস্থা, দীঘির পাড়ে বসার জন্য ছাউনিযুক্ত বেঞ্চ, পাবলিক টয়লেট, ওয়াশরুম, রেস্ট হাউজ। সার্বক্ষণিক সিসি টিভির আওতায় থাকা দিঘি এলাকায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাড়ানোর লক্ষ্যে তৈরি করা হয়েছে বাগান। রয়েছে দিঘির স্বচ্ছ পানিতে শাপলা ও পদ্মফুলের সমারোহ এবং হরিণ, হাঁস, বানর, কবুতর ও বিভিন্ন প্রজাতির সৌখিন পাখি সরবরাহ করার পাশাপাশি স্থাপন করা হয়েছে বাঘ-হরিণের ম্যুরাল।

এ ছাড়াও, দুর্গাসাগরের পশ্চিমপাড়ের গেটসংলগ্ন চত্বর সংস্কার, ঐতিহ্যবাহী বটমূলের সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়েছে। পাশাপাশি নতুন একটি পিকনিক সেড নির্মাণ, বিভিন্ন প্রজাতির হাঁসের সংখ্যা বাড়ানো, ঘর ও খাঁচা নির্মাণ পূর্বক বানর, কবুতরসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি সংযোজন, প্রবেশ গেট মেরামত এবং সৌন্দর্য বর্ধন, ইলেকট্রনিক নাম ফলক স্থাপন, দিঘিতে বিভিন্ন প্রজাতির মৎস্য অবমুক্তকরণ, দুর্গাসাগরের চারিপাশের সকল এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া, সৌরবিদ্যুৎ সুবিধা সংযোজন, ওয়াকওয়ের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য মাটি ভরাট করার মতো কাজগুলো করা হয়েছে। পর্যটকরা বলছেন, ধীরে ধীরে পর্যটক মুখর হয়ে উঠছে দুর্গাসাগর। ফলে বাণিজ্যের প্রসারসহ স্থানীয়রাও সুফল পেতে শুরু করেছে। এ বছর এখানে কিছু অতিথি পাখির আনাগোনা দেখা যাচ্ছে।

জেলা প্রশাসক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, দুর্গাসাগরকে আকর্ষণীয় করে তুলতে আরও বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী এ দিঘির সার্বিক উন্নয়নে আমাদের পক্ষ থেকে যথাসাধ্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এটিকে, পরিবেশবান্ধব পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হবে।

দিঘি উন্নয়নে জেলা প্রশাসনের সঠিক সিদ্ধান্তের কারণেই দীর্ঘ একযুগ পর এখানে এ বছরই অতিথি পাখির আগমন ঘটেছে দাবি করে তিনি বলেন, দিঘিতে বিপুল পরিমাণে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ছাড়া হয়েছে। এ ছাড়া, এখানে বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় সাত শ’ হাঁস ও কয়েক শ’ কবুতর রয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে পাখিদের আকৃষ্ট করতে ফলজ গাছের বনায়নও করা হয়েছে। এ ছাড়া, ভাসমান কৃষি কাজের প্রদর্শনীও করা হবে।