ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

বাংলাদেশের সাগরসীমায় ভারতীয় জেলেদের বেপরোয়া ইলিশ শিকার

  • সূর্যোদয় ডেস্ক:
  • আপডেট সময় ১০:০৫:৪৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৮ জুলাই ২০২৩
  • ১১৫১ বার পড়া হয়েছে

-সাগরে বাংলাদেশের জেলেদের জন্য নিষেধাজ্ঞা
– ভারতীয় জেলেরা ব্যবহার করছে কারেন্ট জালসহ ৫ ধরনের জাল

মাছের সুষ্ঠু প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে ও বংশবিস্তার বাড়াতে দেশের সমুদ্রসীমায় মাছ ধরার ওপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলছে। ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন সাগরে সব ধরনের মাছ ধরা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। তবে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এই নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলেরা। তাদের দাবি, সাগরের বাংলাদেশ অংশে জেলদের জন্য নিষেধাজ্ঞার সময় মাছ শিকার করে নিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় জেলেরা। ভারতীয় জেলেরা কারেন্ট জালসহ পাঁচ ধরনের অত্যাধুনিক জাল দিয়ে ইলিশ শিকার করছে। কাজেই ভারতে আর বাংলাদেশে একই সময়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা উচিত। এতে দুই দেশের কেউই সমুদ্রে মাছ ধরতে পারবে না। ভারতে বাংলা ১ বৈশাখ থেকে ৩০ জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। আমাদের এখানে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা ৬ জ্যৈষ্ঠ থেকে ১০ শ্রাবণ। বঙ্গোপসাগর তো একটাই। আর সাগরে তো কোনো দেয়াল দেয়া নেই যে এপারের ইলিশ মাছ ওপারে যাবে না। কাজেই ভারত ও বাংলাদেশে একই সময় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হোক। একই সাগরে দুই রকম আইন কী করে হয়!

এর আগে সাগরে মাছ ধরা বন্ধে সরকারের এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে উপকূলীয় মৎস্যজীবী ও মৎস্য ব্যবসার সাথে জড়িত হাজার হাজার শ্রমিক মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছিলেন তারা। বাংলাদেশের জলসীমায় ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা দিলেও পার্শ্ববর্তী দেশের জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় অবৈধভাবে ঢুকে মাছ শিকার করে। এমন অভিযোগ তুলে সরকারের কাছে এগুলো বন্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন জেলেরা।

জেলেরা বলছেন, বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে বিভিন্ন ধাপে ১৪৭ দিন নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ায় লাখো জেলে ও ব্যবসায়ীর মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। জেলেরা যে সরকারি সহায়তা পান তা অপ্রতুল। ফলে তাদের জীবন কাটে চরম দুর্দশায়। প্রথমে মা ইলিশ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা, এরপর মার্চ-এপ্রিল ৬০ দিনের অভয়াশ্রম, আবার সেটা শেষ হতে না হতেই আবার ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা। এই দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। এমনিতে করোনাকালে রোজগারের টান পড়ায় তারা ঋণ আর ধারদেনায় জর্জরিত।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, প্রতি বছর আশ্বিন মাসে (৭-২৮ অক্টোবর) গভীর সাগর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মা ইলিশ উপকূলের দিকে এসে ডিম ছাড়ে। ইলিশের ডিম থেকে জাটকা এবং পরে জাটকা বড় ইলিশে পরিণত হয়। কয়েক বছর ধরে প্রজনন মৌসুমে ইলিশ আহরণ বন্ধ থাকায় ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। এর সুফল জেলে থেকে ইলিশ ব্যবসায়ী, ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই পাচ্ছেন। দেশে আমিষের ঘাটতি মেটাতে ইলিশ সহায়ক ভূমিকা রাখছে।

এদিকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে মৎস্য বন্দর আলীপুর, মহিপুর ও কুয়াকাটায় জেলেসহ মৎস্যজীবীরা শুরুতে কয়েক দফায় মানববন্ধন ও মিছিল করেছেন। পরে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে স্মারকলিপিও দেয়া হয়েছে। কোনো কিছুতেই সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেননি জেলেরা।
শুধু ইলিশ নয়, বঙ্গোপসাগরে ৪৩৫ প্রজাতির গুরুত্বপূর্ণ মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও নিষ্কণ্টক প্রজননের স্বার্থে এবং সমুদ্র নির্ভরশীল অর্থনীতির লাগসই বাস্তবায়নে সরকার বঙ্গোপসাগরের জলসীমায় নিরঙ্কুশ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৬৫ দিনের জন্য সব ধরনের মৎস্য শিকার নিষিদ্ধ করেছে। সাগরে ৬৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ রাখার বিষয়টি ২০১৫ সাল থেকে শুরু হলেও চলতি বছর সবচেয়ে বেশি কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। জেলা মৎস্য অফিস জানায়, কলাপাড়া উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও দু’টি পৌরসভার নিবন্ধন করা জেলের সংখ্যা ১৮ হাজার ৩০৫ জন। এদের মধ্যে চলমান (ভিজিএফ) সুবিধাভোগী জেলের সংখ্যা রয়েছে ১০ হাজার ৫৯৩ জন। শুধু জীবিকার তাগিদেই নয় প্রতি মুহূর্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ শিকার করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছেন পেশাদার জেলেরা। উত্তাল সাগর ও বন্যার সময় জীবনযুদ্ধে হার না মানা এসব সাহসী আত্মনির্ভরশীল মানুষ ছুটে যান গভীর সাগর ও নদ-নদীতে।

বাংলাদেশের জলসীমায় অবৈধভাবে প্রবেশ করে ভারতীয় জেলেদের মাছ শিকারের অভিযোগ বেশ পুরনো। এসব জেলে প্রতি বছরই বাংলাদেশের বিপুল টাকার মাছ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে বাংলাদেশের জলসীমার পুরোপুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়ায় গভীর সমুদ্রে ভারতীয় জেলেদের অবাধ বিচরণ চলছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। চলতি ইলিশ মৌসুমেও ভারতীয় জেলেরা বেপরোয়াভাবে মাছ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশী জেলেরা বলছেন, ভারতীয় জেলেদের কারণে দেশী জেলেদের মাছ শিকার ব্যাহত হচ্ছে। জেলেদের দাবির সত্যতাও মিলছে ভারতীয় জেলে আটক হওয়ার খবরে। সর্বশেষ গত বছর (৩ সেপ্টেম্বর) অবৈধভাবে বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে মাছ শিকারের সময় বিপুল পরিমাণ ইলিশ ও সামুদ্রিক মাছসহ ১৩ ভারতীয় জেলেকে আটক করে কোস্টগার্ড। এর আগে গত ৮ আগস্ট একই অপরাধে আরো ১৩ জন, ২৯ জানুয়ারি ২৮ জন ও গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর ১৬ জন, ২ ডিসেম্বর ১৭ জন ভারতীয় জেলে নৌবাহিনীর হাতে আটক হয়। প্রতি বছরই এ ঘটনা ঘটে চলেছে।
এদিকে আটক ভারতীয় জেলেদের সমুদ্রসীমা লঙ্ঘনের অপরাধে ১৯৮৩ সালের সমুদ্রসীমা আইনের ২২ ধারায় মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠানো হয়।

উপকূলের জেলে ইউছুফ, বাহাউদ্দিন, সফিকুল ও আব্দুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের জলসীমা শেষে ভারতের কাকদ্বীপ এলাকা কাছে। সেখানকার শত শত জেলে এ দেশের জলসীমায় মাছ ধরতে আসে। মাছ ধরার অত্যাধুনিক সরঞ্জাম থাকায় তারা অনেক বেশি মাছ আহরণ করতে পারে। সাগরে অধিকাংশ সময়ই ভারতীয় জেলেদের উৎপাত বেশি থাকে উল্লেখ করে জেলে খালেক হাওলাদার বলেন, ভারতীয় জেলেরা কারেন্ট জালসহ পাঁচ ধরনের অত্যাধুনিক জাল ব্যবহার করে। তাদের কাছে রয়েছে জিপিএস (বিশেষ সঙ্কেত) নামক বিশেষ ধরনের যন্ত্র। এ যন্ত্রের মাধ্যমে তারা যে পথ দিয়ে আসে, আবার সে পথ দিয়েই ফিরে যায়। গত বছর ৭ জুলাই পটুয়াখালীর কলাপাড়ার বঙ্গোপসাগরের মোহনা রামনাবাদ চ্যানেল থেকে ৩২টি ভারতীয় ট্রলারসহ পাঁচ শতাধিক জেলেকে আটক করেছেন উপকূলীয় কোস্টগার্ড সদস্যরা।

অভিযোগ আছে, ভারতীয় জেলেরা ইচ্ছে করেই বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে প্রতিনিয়ত মাছ শিকার করে। তারা এ সময় উন্নতমানের ফিশিং বোট নিয়ে মাছ শিকারের সময় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বাইনোকুলার দিয়ে ট্রলারে বসে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের তৎপরতায় নজর রাখে। এসব বাহিনীর তৎপরতা দেখলেই দ্রুত নিজেদের জলসীমায় পালিয়ে যায়।
ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি বিভাগের মাধ্যমে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর বাংলাদেশের জলসীমা বৃদ্ধি পেয়েছে আরো ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার। পূর্ণ অধিকারে থাকা বিশাল বিস্তৃত এ জলসীমা অরক্ষিত না হলেও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এখনো সেখানে পুরোপুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এ সুযোগে প্রতি বছর ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশে ঢুকে লাখ লাখ টন মাছ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে।

ফিশারিজ বিভাগ থেকে আরো জানা যায়, বিদেশী জেলেরা যেভাবে মাছ শিকার করে তাতে এদেশের মৎস্যসম্পদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে যারা আটক হচ্ছে, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া দরকার। তা ছাড়া দেশের মৎস্যসম্পদ রক্ষায় বঙ্গোপসাগরে নিরাপত্তাব্যবস্থা আরো জোরদার করতে হবে।
উপজেলার আলীপুর, মহিপুর, লালুয়া, কুয়াকাটা, ধুলাসার, ধানখালী, বাবলাতলার ঢোস, নিজামপুর, গঙ্গমতি জেলেপল্লী ঘুরে জেলেদের সাথে কথা বললে তারা ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার দুর্দশার কথা জানান।
কুয়াকাটা গ্রামের জেলে জুয়েল বলেন, এই এলাকার ৯০ শতাংশ মানুষ মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে। এখন ঠিকমতো পরিবারের খাবার জোগাড় করতে কষ্ট হচ্ছে।

আলীপুর মৎস্য আড়ত ব্যবসায়ী জলিলুর রহমান জলিল বলেন, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ অংশে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন নিষেধাজ্ঞা। আর প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা ১৫ এপ্রিল থেকে ৪৫ দিন পর্যন্ত। বঙ্গোপসাগর একটাই। সাগরে তো কোনো ওয়াল দেয়া নেই যে ইলিশ মাছ ওপাশে যাবে না। তাই ভারত ও বাংলাদেশের সাথে একই সময় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হোক। একই সাগরে দুই রকম আইন হয় কী করে। আমরা মহিপুর-আলীপুর মৎস্য আড়ত ব্যবসায়ীরা সরকারে কাছে এ দাবি জানায়।
এ ব্যাপারে উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, ৬৫ দিন ইলিশ শিকার বন্ধ রাখার জন্য মৎস্য বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশী জেলেদের অভিযোগ, ভারতীয় জেলেরা ইলিশ শিকার করে নিয়ে যাচ্ছে-তা নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব নৌবাহিনীর। তারা বহিরাগতদের নিয়ন্ত্রণ করবে। আমরা আমাদের মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। তারা আবার অন্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দিয়েছে।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

বাংলাদেশের সাগরসীমায় ভারতীয় জেলেদের বেপরোয়া ইলিশ শিকার

আপডেট সময় ১০:০৫:৪৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৮ জুলাই ২০২৩

-সাগরে বাংলাদেশের জেলেদের জন্য নিষেধাজ্ঞা
– ভারতীয় জেলেরা ব্যবহার করছে কারেন্ট জালসহ ৫ ধরনের জাল

মাছের সুষ্ঠু প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে ও বংশবিস্তার বাড়াতে দেশের সমুদ্রসীমায় মাছ ধরার ওপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলছে। ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন সাগরে সব ধরনের মাছ ধরা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। তবে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এই নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলেরা। তাদের দাবি, সাগরের বাংলাদেশ অংশে জেলদের জন্য নিষেধাজ্ঞার সময় মাছ শিকার করে নিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় জেলেরা। ভারতীয় জেলেরা কারেন্ট জালসহ পাঁচ ধরনের অত্যাধুনিক জাল দিয়ে ইলিশ শিকার করছে। কাজেই ভারতে আর বাংলাদেশে একই সময়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা উচিত। এতে দুই দেশের কেউই সমুদ্রে মাছ ধরতে পারবে না। ভারতে বাংলা ১ বৈশাখ থেকে ৩০ জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। আমাদের এখানে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা ৬ জ্যৈষ্ঠ থেকে ১০ শ্রাবণ। বঙ্গোপসাগর তো একটাই। আর সাগরে তো কোনো দেয়াল দেয়া নেই যে এপারের ইলিশ মাছ ওপারে যাবে না। কাজেই ভারত ও বাংলাদেশে একই সময় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হোক। একই সাগরে দুই রকম আইন কী করে হয়!

এর আগে সাগরে মাছ ধরা বন্ধে সরকারের এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে উপকূলীয় মৎস্যজীবী ও মৎস্য ব্যবসার সাথে জড়িত হাজার হাজার শ্রমিক মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপিও দিয়েছিলেন তারা। বাংলাদেশের জলসীমায় ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা দিলেও পার্শ্ববর্তী দেশের জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় অবৈধভাবে ঢুকে মাছ শিকার করে। এমন অভিযোগ তুলে সরকারের কাছে এগুলো বন্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন জেলেরা।

জেলেরা বলছেন, বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে বিভিন্ন ধাপে ১৪৭ দিন নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ায় লাখো জেলে ও ব্যবসায়ীর মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। জেলেরা যে সরকারি সহায়তা পান তা অপ্রতুল। ফলে তাদের জীবন কাটে চরম দুর্দশায়। প্রথমে মা ইলিশ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা, এরপর মার্চ-এপ্রিল ৬০ দিনের অভয়াশ্রম, আবার সেটা শেষ হতে না হতেই আবার ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা। এই দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। এমনিতে করোনাকালে রোজগারের টান পড়ায় তারা ঋণ আর ধারদেনায় জর্জরিত।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, প্রতি বছর আশ্বিন মাসে (৭-২৮ অক্টোবর) গভীর সাগর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মা ইলিশ উপকূলের দিকে এসে ডিম ছাড়ে। ইলিশের ডিম থেকে জাটকা এবং পরে জাটকা বড় ইলিশে পরিণত হয়। কয়েক বছর ধরে প্রজনন মৌসুমে ইলিশ আহরণ বন্ধ থাকায় ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। এর সুফল জেলে থেকে ইলিশ ব্যবসায়ী, ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই পাচ্ছেন। দেশে আমিষের ঘাটতি মেটাতে ইলিশ সহায়ক ভূমিকা রাখছে।

এদিকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবিতে মৎস্য বন্দর আলীপুর, মহিপুর ও কুয়াকাটায় জেলেসহ মৎস্যজীবীরা শুরুতে কয়েক দফায় মানববন্ধন ও মিছিল করেছেন। পরে স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে স্মারকলিপিও দেয়া হয়েছে। কোনো কিছুতেই সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেননি জেলেরা।
শুধু ইলিশ নয়, বঙ্গোপসাগরে ৪৩৫ প্রজাতির গুরুত্বপূর্ণ মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ ও নিষ্কণ্টক প্রজননের স্বার্থে এবং সমুদ্র নির্ভরশীল অর্থনীতির লাগসই বাস্তবায়নে সরকার বঙ্গোপসাগরের জলসীমায় নিরঙ্কুশ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ৬৫ দিনের জন্য সব ধরনের মৎস্য শিকার নিষিদ্ধ করেছে। সাগরে ৬৫ দিন মাছ ধরা বন্ধ রাখার বিষয়টি ২০১৫ সাল থেকে শুরু হলেও চলতি বছর সবচেয়ে বেশি কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। জেলা মৎস্য অফিস জানায়, কলাপাড়া উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও দু’টি পৌরসভার নিবন্ধন করা জেলের সংখ্যা ১৮ হাজার ৩০৫ জন। এদের মধ্যে চলমান (ভিজিএফ) সুবিধাভোগী জেলের সংখ্যা রয়েছে ১০ হাজার ৫৯৩ জন। শুধু জীবিকার তাগিদেই নয় প্রতি মুহূর্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ শিকার করে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছেন পেশাদার জেলেরা। উত্তাল সাগর ও বন্যার সময় জীবনযুদ্ধে হার না মানা এসব সাহসী আত্মনির্ভরশীল মানুষ ছুটে যান গভীর সাগর ও নদ-নদীতে।

বাংলাদেশের জলসীমায় অবৈধভাবে প্রবেশ করে ভারতীয় জেলেদের মাছ শিকারের অভিযোগ বেশ পুরনো। এসব জেলে প্রতি বছরই বাংলাদেশের বিপুল টাকার মাছ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে বাংলাদেশের জলসীমার পুরোপুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়ায় গভীর সমুদ্রে ভারতীয় জেলেদের অবাধ বিচরণ চলছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। চলতি ইলিশ মৌসুমেও ভারতীয় জেলেরা বেপরোয়াভাবে মাছ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশী জেলেরা বলছেন, ভারতীয় জেলেদের কারণে দেশী জেলেদের মাছ শিকার ব্যাহত হচ্ছে। জেলেদের দাবির সত্যতাও মিলছে ভারতীয় জেলে আটক হওয়ার খবরে। সর্বশেষ গত বছর (৩ সেপ্টেম্বর) অবৈধভাবে বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে মাছ শিকারের সময় বিপুল পরিমাণ ইলিশ ও সামুদ্রিক মাছসহ ১৩ ভারতীয় জেলেকে আটক করে কোস্টগার্ড। এর আগে গত ৮ আগস্ট একই অপরাধে আরো ১৩ জন, ২৯ জানুয়ারি ২৮ জন ও গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর ১৬ জন, ২ ডিসেম্বর ১৭ জন ভারতীয় জেলে নৌবাহিনীর হাতে আটক হয়। প্রতি বছরই এ ঘটনা ঘটে চলেছে।
এদিকে আটক ভারতীয় জেলেদের সমুদ্রসীমা লঙ্ঘনের অপরাধে ১৯৮৩ সালের সমুদ্রসীমা আইনের ২২ ধারায় মামলা দিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠানো হয়।

উপকূলের জেলে ইউছুফ, বাহাউদ্দিন, সফিকুল ও আব্দুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের জলসীমা শেষে ভারতের কাকদ্বীপ এলাকা কাছে। সেখানকার শত শত জেলে এ দেশের জলসীমায় মাছ ধরতে আসে। মাছ ধরার অত্যাধুনিক সরঞ্জাম থাকায় তারা অনেক বেশি মাছ আহরণ করতে পারে। সাগরে অধিকাংশ সময়ই ভারতীয় জেলেদের উৎপাত বেশি থাকে উল্লেখ করে জেলে খালেক হাওলাদার বলেন, ভারতীয় জেলেরা কারেন্ট জালসহ পাঁচ ধরনের অত্যাধুনিক জাল ব্যবহার করে। তাদের কাছে রয়েছে জিপিএস (বিশেষ সঙ্কেত) নামক বিশেষ ধরনের যন্ত্র। এ যন্ত্রের মাধ্যমে তারা যে পথ দিয়ে আসে, আবার সে পথ দিয়েই ফিরে যায়। গত বছর ৭ জুলাই পটুয়াখালীর কলাপাড়ার বঙ্গোপসাগরের মোহনা রামনাবাদ চ্যানেল থেকে ৩২টি ভারতীয় ট্রলারসহ পাঁচ শতাধিক জেলেকে আটক করেছেন উপকূলীয় কোস্টগার্ড সদস্যরা।

অভিযোগ আছে, ভারতীয় জেলেরা ইচ্ছে করেই বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে প্রতিনিয়ত মাছ শিকার করে। তারা এ সময় উন্নতমানের ফিশিং বোট নিয়ে মাছ শিকারের সময় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বাইনোকুলার দিয়ে ট্রলারে বসে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের তৎপরতায় নজর রাখে। এসব বাহিনীর তৎপরতা দেখলেই দ্রুত নিজেদের জলসীমায় পালিয়ে যায়।
ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি বিভাগের মাধ্যমে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর বাংলাদেশের জলসীমা বৃদ্ধি পেয়েছে আরো ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার। পূর্ণ অধিকারে থাকা বিশাল বিস্তৃত এ জলসীমা অরক্ষিত না হলেও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এখনো সেখানে পুরোপুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এ সুযোগে প্রতি বছর ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশে ঢুকে লাখ লাখ টন মাছ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে।

ফিশারিজ বিভাগ থেকে আরো জানা যায়, বিদেশী জেলেরা যেভাবে মাছ শিকার করে তাতে এদেশের মৎস্যসম্পদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে যারা আটক হচ্ছে, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া দরকার। তা ছাড়া দেশের মৎস্যসম্পদ রক্ষায় বঙ্গোপসাগরে নিরাপত্তাব্যবস্থা আরো জোরদার করতে হবে।
উপজেলার আলীপুর, মহিপুর, লালুয়া, কুয়াকাটা, ধুলাসার, ধানখালী, বাবলাতলার ঢোস, নিজামপুর, গঙ্গমতি জেলেপল্লী ঘুরে জেলেদের সাথে কথা বললে তারা ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার দুর্দশার কথা জানান।
কুয়াকাটা গ্রামের জেলে জুয়েল বলেন, এই এলাকার ৯০ শতাংশ মানুষ মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে। এখন ঠিকমতো পরিবারের খাবার জোগাড় করতে কষ্ট হচ্ছে।

আলীপুর মৎস্য আড়ত ব্যবসায়ী জলিলুর রহমান জলিল বলেন, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ অংশে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন নিষেধাজ্ঞা। আর প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা ১৫ এপ্রিল থেকে ৪৫ দিন পর্যন্ত। বঙ্গোপসাগর একটাই। সাগরে তো কোনো ওয়াল দেয়া নেই যে ইলিশ মাছ ওপাশে যাবে না। তাই ভারত ও বাংলাদেশের সাথে একই সময় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হোক। একই সাগরে দুই রকম আইন হয় কী করে। আমরা মহিপুর-আলীপুর মৎস্য আড়ত ব্যবসায়ীরা সরকারে কাছে এ দাবি জানায়।
এ ব্যাপারে উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, ৬৫ দিন ইলিশ শিকার বন্ধ রাখার জন্য মৎস্য বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশী জেলেদের অভিযোগ, ভারতীয় জেলেরা ইলিশ শিকার করে নিয়ে যাচ্ছে-তা নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব নৌবাহিনীর। তারা বহিরাগতদের নিয়ন্ত্রণ করবে। আমরা আমাদের মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। তারা আবার অন্য মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দিয়েছে।