আল-মাসজিদুল আকসা। যাকে আল কুদস, বাইতুল মাকদিস বা বাইতুল মুকাদ্দাসও বলা হয়। প্রায় ১৪ হেক্টর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত আল-আকসা কমপ্লেক্স একক কোনো স্থাপনা নয়। চার দেয়ালবেষ্টিত এ কমপ্লেক্সে মসজিদ, মিনার মেহরাব ইত্যাদি মিলিয়ে ছোট-বড় প্রায় ২০০ ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে। পৃথিবীর বরকতময় ও স্মৃতিবিজড়িত ফিলিস্তিনের সুন্দর সুশোভিত প্রাচীনতম জেরুসালেম শহরে অবস্থিত মসজিদে আকসা মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ। মুসলিম জাতির প্রথম কিবলা ও পৃথিবীর বুকে অবস্থিত সব জাতি-বর্ণের মুসলমানদের প্রাণস্পন্দন। প্রতিটি ধর্মে কিছু পবিত্র বিষয় ও স্থান আছে, যেগুলোকে তার অনুসারীরা সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখে। আর তা রক্ষা করাকে নিজের দায়িত্ব মনে করে। ইসলাম ধর্মেও এমন কিছু পবিত্র স্থান রয়েছে, যার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ও সম্মান রক্ষাকে মুসলমানরা তাদের ঈমানি দায়িত্ব মনে করে। মসজিদুল আকসা সেগুলোর একটি। পবিত্র মক্কা ও মদিনার পর মসজিদুল আকসা মুসলমানদের কাছে তৃতীয় পবিত্রতম স্থান।
কুরআনে আল-আকসার বৈশিষ্ট্য : পবিত্র কুরআনে আল-আকসা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ব্যাপারে যা বলা হয়েছে-
পবিত্র ভূমি : আল্লাহ মসজিদুল আকসা ও তার আশপাশের অঞ্চলকে পবিত্র ভূমি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে- ‘হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহ তোমাদের জন্য যে পবিত্র ভূমি নির্দিষ্ট করেছেন তাতে তোমরা প্রবেশ করো এবং পশ্চাদপসারণ করো না, করলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে’ (সূরা মায়িদা-২১)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: বলেন, আয়াতে পবিত্র ভূমি দ্বারা বায়তুল মুকাদ্দাস উদ্দেশ্য। সেখানে বনি ইসরাইলকে প্রবেশ করতে বলা হয়েছিল (তাফসিরে ইবনে কাসির)।
বরকতময় ভূমি : মহান আল্লাহ মসজিদুল আকসাসহ পুরো ফিলিস্তিন ভূমিকে বরকতময় করেছেন। তিনি বলেন- ‘যে সম্প্রদায়কে দুর্বল গণ্য করা হতো তাদেরকে আমি আমার কল্যাণপ্রাপ্ত রাজ্যের পূর্ব ও পশ্চিমের উত্তরাধিকারী করি’ (সূরা আরাফ-১৩৭)।
মহানবী সা:-এর স্মৃতিধন্য ভূমি : ইসরা ও মিরাজের রাতে আল্লাহ রাসূলুল্লাহ সা:-কে মসজিদুল আকসা পরিভ্রমণ করান। ইরশাদ হয়েছে- ‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (সূরা বনি ইসরাইল-১)।
মুক্তিকামীদের ভূমি : আল্লাহ যুগে যুগে মুক্তিকামী মানুষকে ফিলিস্তিন ভূমিতে আশ্রয় দিয়েছেন। যেমন- লুত আ: সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘এবং আমি তাকে ও লুতকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলাম সেই দেশে, যেখানে আমি কল্যাণ রেখেছি বিশ্ববাসীর জন্য’ (সূরা আম্বিয়া-৭১।
কল্যাণময় রাজ্য ও রাজত্বের ভূমি : আল্লাহ ফিলিস্তিন ভূমিকে কল্যাণময় করেছিলেন। ইরশাদ হয়েছে- ‘এবং সুলাইমানের বশীভূত করে দিয়েছিলাম উদ্দাম বায়ুকে; তা তার আদেশক্রমে প্রবাহিত হতো সেই দেশের দিকে, যেখানে আমি কল্যাণ রেখেছি; প্রত্যেক বিষয় সম্পর্কে আমিই সম্যক অবগত’ (সূরা আম্বিয়া-৮১)।
মধ্যবর্তী ভূমি : প্রাচীন শামের সাথে আরবরা যে পথগুলো ব্যবহার করত তার মধ্যভাগে ছিল ফিলিস্তিন ভূমি, যাকে আল্লাহ ভ্রমণকারীদের জন্য নিরাপদ করেছিলেন। ইরশাদ হয়েছে- ‘তাদের ও যেসব জনপদের প্রতি আমি অনুগ্রহ করেছিলাম সেগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে দৃশ্যমান বহু জনপদ স্থাপন করেছিলাম এবং সেসব জনপদে ভ্রমণের যথাযথ ব্যবস্থা করেছিলাম ও তাদেরকে বলেছিলাম, তোমরা এসব জনপদে নিরাপদে ভ্রমণ করো দিনে ও রাতে’ (সূরা সাবা-১৮)।
জলপাই ও ডুমুরের ভূমি : আল্লাহ সূরা ত্বিনে জলপাই, ডুমুর ও সিনাই উপত্যকার শপথ করেছেন, যা স্পষ্টতই ফিলিস্তিন ভূমিকে বোঝায়। ইরশাদ হয়েছে- ‘শপথ ত্বিন (জলপাই) ও জাইতুনের (ডুমুরের), শপথ সিনাই পর্বতের’ (সূরা ত্বিন : ১-২)।
হাদিসে আল-আকসার বৈশিষ্ট্য : পবিত্র কুরআনের মতো হাদিসেও আল-আকসার মর্যাদাপূর্ণ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। এর কয়েকটি হলো-
যে মসজিদ ভ্রমণে সওয়াব মেলে : হাদিসে সওয়াবের নিয়তে তিনটি মসজিদ ভ্রমণের অনুমতি দেয়া হয়েছে। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেছেন, ‘মসজিদুল হারাম, মসজিদুল রাসূল (মসজিদে নববী) এবং মসজিদুল আকসা- এই তিন মসজিদ ছাড়া অন্য কোনো মসজিদের উদ্দেশে সফর করা যাবে না (বুখারি-১১৮৯)।
দাজ্জাল থেকে নিরাপদ : আল্লাহ তায়ালা মসজিদুল আকসাকে দাজ্জালের হাত থেকে রক্ষা করবেন। হাদিসে এসেছে, ‘দাজ্জাল পৃথিবীতে ৪০ দিন অবস্থান করবে। তার রাজত্ব সর্বত্র বিস্তার লাভ করবে। তবে চার মসজিদ তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকবে। তা হলো কাবা, মসজিদে রাসূল, মসজিদুল আকসা ও মসজিদে তুর’ (মুসনাদে আহমাদ-২৩১৩৯)।
এক আমলে হাজার আমলের সওয়াব : মাইমুনা বিনতে সাদ রা: থেকে বর্ণিত- আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! বায়তুল মাকদিস সম্পর্কে আমাকে ফতোয়া দিন। তিনি বলেন, ‘এটি হাশরের মাঠ এবং সবার একত্র হওয়ার ময়দান। তোমরা তাতে নামাজ আদায় করবে। কেননা, সেখানে এক ওয়াক্ত নামাজ পড়া অন্যান্য স্থানের তুলনায় এক হাজার গুণ উত্তম। আমি বললাম, আপনি কি মনে করেন, যদি আমি সেখানে যেতে সমর্থ না হই? তিনি বলেন, তুমি তাতে বাতি জ্বালানোর জন্য জলপাইয়ের তেল হাদিয়া পাঠাও। যে ব্যক্তি তা করল, সে যেন সেখানে উপস্থিত হলো’ (সুনানে ইবনে মাজাহ-১৪০৭)।
সত্যের পথে সংগ্রামের ভূমি : আল্লাহ ফিলিস্তিন ভূমিকে সত্যের পথে সংগ্রামের দৃষ্টান্ত বানিয়েছেন। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আমার উম্মতের একটি দল দামেস্কের প্রবেশপথগুলোতে এবং তার আশপাশে সংগ্রাম করতে এবং বায়তুল মুকাদ্দাস ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সর্বদা (সত্যের পক্ষে) সংগ্রামরত থাকবে। কিয়ামত পর্যন্ত সত্যের শত্রুরা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না’ (মুসান্নাফে আবি ইয়ালা-৬৪১৭)।
কিয়ামতের আলামত : আল্লাহ বায়তুল মুকাদ্দাসকে কিয়ামতের আলামত বানিয়েছেন। আউফ বিন মালিক রা: বলেন, আমি তাবুক যুদ্ধে আল্লাহর রাসূল সা:-এর কাছে গেলাম। তিনি তখন একটি চামড়ার তৈরি তাঁবুতে ছিলেন। আল্লাহর রাসূল সা: বললেন, ‘কিয়ামতের আগের ছয়টি নিদর্শন গণনা করে রাখো- ১. আমার মৃত্যু; ২. বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়; ৩. তোমাদের মধ্যে ঘটবে মহামারী, বকরির পালের মতো মহামারী; ৪. সম্পদের প্রাচুর্য, এমনকি এক ব্যক্তিকে ১০০ দিনার দেয়ার পরও সে অসন্তুষ্ট থাকবে; ৫. এমন এক ফিতনা আসবে, যা আরবের প্রতিটি ঘরে প্রবেশ করবে; ৬. যুদ্ধবিরতির চুক্তি, যা তোমাদের ও বনি আসফার বা রোমকদের মধ্যে সম্পাদিত হবে। অতঃপর তারা বিশ্বাসঘাতকতা করবে এবং ৮০টি পতাকা উড়িয়ে তোমাদের বিপক্ষে আসবে; প্রত্যেক পতাকার নিচে থাকবে ১২ হাজার সৈন্য’ (বুখারি-৩১৭৬)।
লেখক :
- আবুল মায়ামীন আশরাফী
মুহাদ্দিস, জামিয়া গাফুরিয়া মাখযানুল উলুম টঙ্গী, গাজীপুর।