বরিশালের একসময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী নেতা মজিবর রহমান সরোয়ার ধীরে ধীরে রাজনৈতিকভাবে একা হয়ে পড়ছেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্মদিন উপলক্ষ্যে সরোয়ার আলোচনা সভার আয়োজন করেন। কিন্তু সভায় জেলা ও মহানগর বিএনপির বর্তমান পদধারী নেতাদের কেউই অংশ নেননি। অথচ তাদের প্রায় সবাইকে তিনি নিজে ফোন করে দাওয়াত দিয়েছিলেন।
বৃহস্পতিবার রাতে বরিশাল নগরের বাসভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শেষ পর্যন্ত কেবল তার-ই অনুসারীরা উপস্থিত ছিলেন। ঘটনার এমন ধারাবাহিকতায় বিএনপির রাজনীতিতে সাবেক হুইপ ও টানা পাঁচবারের সাবেক এমপি সরোয়ারের অবস্থান এখন কোন পর্যায়ে সেটিই প্রশ্ন তৃণমূলের নেতাকর্র্মীদের। বরিশালের রাজনীতি থেকে সাবেক মেয়র সরোয়ারকে নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে কিনা তাই নিয়েও চলছে জল্পনা-কল্পনা।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জেলা ও মহানগর বিএনপির একাধিক নেতা যুগান্তরকে বলেন, কমিটি থেকে বাদ পড়ার পর থেকেই মূলত স্থানীয় রাজনীতিতে কোণঠাসা হতে শুরু করেছেন মজিবর রহমান সরোয়ার এবং তার অনুসারীরা। অনেকের ধারণা হাইকমান্ডের গুড বুক থেকে ছিটকে পড়ার কারণেই নিজের পুরোনো অবস্থান হারিয়েছেন সরোয়ার।
এছাড়া নয়া কমিটি ঘোষণার পর সরোয়ার বিরোধী অনেকেই এখন এমপি-মেয়র হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। সেই লক্ষ্যে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতিও চলছে। এরকম পরিস্থিতিতে তারা হয়তো চাইছেন না-স্থানীয় রাজনীতিতে আবার সরোয়ারের আধিপত্য ফিরে আসুক। সেজন্যই হয়তো তাকে ছেড়ে যাচ্ছেন বর্তমান পদধারী নেতারা।
সরোয়ারের দাওয়াত পেয়েও আয়োজনে যোগ না দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক বলেন, আমি কোনো দাওয়াত পাইনি। পেলে অবশ্যই যেতাম। শুনেছি তিনি (সরোয়ার) সবাইকে ব্যক্তিগতভাবে ফোন দিয়ে নিমন্ত্রণ করেছেন। কিন্তু আমাকে তিনি কোনো ফোন দেননি।
মহানগরের সদস্যসচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদ বলেন, তিনি (সরোয়ার) আমাকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। আমি ব্যক্তিগত কারণে যেতে পারিনি। অবশ্য তিনি আমাদের আহ্বায়ককে দাওয়াত দেননি। আমায় বলেছিলেন আহ্বায়ককে দাওয়াত দিতে। এখন তার দাওয়াত যদি আমি দেই-তাহলে কি তা দাওয়াত হয়? আহ্বায়ককে যেখানে তিনি দাওয়াত দেননি সেখানে আমি গেলে নিজেদের ভুল বোঝাবুঝিও হতে পারত।
বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাবেক এমপি আবুল হোসেন খান বলেন, আমাকে সরোয়ার ভাই দাওয়াত দিয়েছিলেন। আমি ঢাকায় থাকায় থাকতে পারিনি। সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট আবুল কালাম শাহিন বলেন, বৃহস্পতিবার সারাদিন অনেক কাজ ছিল। সে কারণে ক্লান্ত ছিলাম বলে যেতে পারিনি। এছাড়া প্রচণ্ড শীত এবং বিয়ের দাওয়াত থাকায় যেতে পারেননি বলে জানান দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবায়েদুল হক চাঁন এবং সাবেক এমপি মেজবাহউদ্দিন ফরহাদ।
যুগান্তরের সঙ্গে আলাপকালে মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। সবাইকে নিজে ফোন করে দাওয়াত দিয়েছি। এরপরও তারা কেন আসলেন না সেটা তারাই ভালো বলতে পারবেন। আয়োজনটা ছিল শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্ম বার্ষিকীর। এখানে তো গ্রুপ কিংবা বিতর্কেরও কোনো অবকাশ নেই। তাদের না আসাটা সত্যিকার অর্থেই দুঃখজনক। দলের যুগ্ম মহাসচিব হিসাবে কেন্দ্রের দেওয়া দায়িত্ব পালনে সারা দেশে যেতে হয় আমাদের। বরিশালে ঠিকমতো থাকা হয় না। এবার ভেবেছিলাম সবাইকে নিয়ে দলের প্রতিষ্ঠাতার জন্মদিন পালন করব। আয়োজন সফলভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। যারা আসেননি তারা থাকলে হয়তো আরো ভালো হতো।
সরোয়ার টানা প্রায় ৩০ বছর ধরে বরিশাল বিএনপির রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন। সংসদ-সদস্য, হুইপ, সিটি মেয়র এমনকি বিএনপি শাসনামলে জেলা মন্ত্রী পর্যন্ত ছিলেন তিনি। ধারাবাহিকভাবে একের পর এক ছিলেন বরিশাল জেলা ও মহানগর বিএনপির সভাপতির দায়িত্বে।
অবস্থাটা এমন ছিল-বিএনপি বলতে সরোয়ারই ছিলেন শেষ কথা। মূল দল থেকে শুরু করে অঙ্গ সহযোগী প্রতিষ্ঠান, সর্বত্রই ছিল তার একক আধিপত্য। টানা আড়াই যুগের একক নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটে ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর। ওইদিন একসঙ্গে বরিশাল জেলা উত্তর-দক্ষিণ ও মহানগর বিএনপির নয়া কমিটি ঘোষিত হয়। তিন কমিটির আহ্বায়ক, যুগ্ম আহ্বায়কসহ সদস্যসচিবের পদে সরোয়ার বিরোধীদের আসীন করা হয়। খোদ সরোয়ারও বাদ পড়েন পদবি থেকে।
অবশ্য সেসময় বলা হয়-এক নেতার একাধিক পদে থাকার রীতি থেকে বেরিয়ে এসেছে বিএনপি। সরোয়ার যেহেতু দলের যুগ্ম মহাসচিব পদে আছেন তাই তাকে রাখা হয়নি। এরপর গত বছরের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে বরিশালের তিন সাংগঠনিক ইউনিট।
ঘোষিত কমিটির পদগুলোতেও বলতে গেলে রাখা হয়নি সরোয়ার অনুসারীদের। পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পর বিএনপির রাজনীতিতে সরোয়ার সাম্রাজ্যের অবসানের অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে যায়। এরপর স্থানীয় বিএনপির কর্মকাণ্ডেও অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন সরোয়ার। একের পর এক দলীয় কর্মসূচি পালিত হলেও তাতে তার উপস্থিতি ছিল না। এমনকি এসব কর্মসূচিতে তার অনুসারী নেতাকর্মীদেরও গড় হাজির দেখা যায়। অবশ্য এ নিয়ে দুপক্ষের অভিযোগ পালটা অভিযোগও রয়েছে।
সরোয়ার অনুসারীদের অভিযোগ-কোনো আয়োজনে দায়িত্বপ্রাপ্ত নতুন নেতারা তাদের আমন্ত্রণ জানান না। অপরদিকে নয়া নেতারা বলেন, কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচিতে কাউকে আলাদা করে আমন্ত্রণ করতে হবে কেন? যারা দল করেন তাদের তো দলের সব কর্মসূচিই জানা থাকার কথা। এছাড়া ধরে ধরে দাওয়াত দিয়ে তো আর কর্মসূচি পালন সম্ভব নয়। এভাবে দলীয় কর্মসূচি থেকে সরোয়ার ও তার অনুসারীরা বিচ্ছিন্ন হতে থাকেন। সূত্র: যুগান্তর