ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

ব্যাংক খাতে পরিবর্তন : উদ্যোগ ভালো, দেখতে হবে বাস্তবায়ন

  • সূর্যোদয় ডেস্ক:
  • আপডেট সময় ০২:২৩:২৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ মার্চ ২০২৪
  • ১১০১ বার পড়া হয়েছে

ব্যাংক খাত সংস্কারে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী বছরের শুরুর দিকে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত করার কাজ শুরু হবে।

ব্যাংক একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় এক্সিম ব্যাংকের সাথে দুর্বল পদ্মা ব্যাংক একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী রোববার দুই ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হবে বলে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। পদ্মা ব্যাংককে অধিগ্রহণ করবে এক্সিম ব্যাংক।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই উদ্যোগ গুলোর সুফল পেতে হলে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। নয়তো সবল ব্যাংকও দুবর্ল হয়ে যেতে পারে। আবার প্রকৃত স্বেচ্ছা ঋণ খেলাপিরা রেহাই পেয়ে যেতে পারে। আর ব্যাংকগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা না করে শুধু পরীক্ষা দিয়ে এমডি নিয়োগ করলেই ফল আসবে না।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আগামী ৯ এপ্রিলের মধ্যে ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহিতা সনাক্তকরণ ইউনিট’ গঠন করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনের শর্ত যদি কোনো ব্যাংক ভঙ্গ করে তাহলে ওই ব্যাংককে ৫০ লাখ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা জরিমানা করা হবে।

কারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি
‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা সনাক্তকরণ ইউনিটের’ কাজ হলো ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি খোঁজা। যারা ঋণ খেলাপি তাদের মধ্য থেকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি খোঁজার সাথে সাথে নতুন করে কেউ খেলাপি হলে ৩০ দিনের মধ্যে সে ইচ্ছকৃত খেলাপি কিনা তা বের করতে হবে। এই ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি চিহ্নিত করার নীতিমালাও দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপনে বলেছে, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ না করলে এবং জালিয়াতি, প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে কেউ ঋণ নিলে তা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবে। এছাড়া যে উদ্দেশে ঋণ নেয়া হয়েছে, তার বাইরে অন্য কাজে ঋণের অর্থ ব্যবহার করলেও তা চিহ্নিত হবে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে।’

ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপির শাস্তি কী?
আর যারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবে, তার কোনো ধরনের সুদ মওকুফ বা ঋণ পুনঃতফসিল করা যাবে না। ঋণ পুরোপুরি শোধ না হওয়া পর্যন্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশ ভ্রমণ ও ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা দিতে পদক্ষেপ নেবে। তারা যাতে নতুন করে কোনো কোম্পানি খুলতে না পারেন, এ জন্যও পদক্ষেপ নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা সম্মাননা পাবেন না তারা। তাদের তালিকা গাড়ি, বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাটের নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ইচ্ছাকৃত খেলাপি গ্রাহককে টাকা ফেরত দেয়ার জন্য দুই মাসের নোটিশ দেবে ব্যাংক এবং টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে ফৌজদারি মামলা করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে এখন মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। তবে বাস্তবে অপলোপ করা, দুর্দশাগ্রস্ত ও মামলায় আটকে থাকা ঋণের হিসাব মিলিয়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ তিন লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং তারল্য সঙ্কট কাটাতে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে।

আরো উদ্যোগ
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত করার জন্য দুর্বল ব্যাংকের তালিকা করেছে। তার দেশের ৫৪টি ব্যাংকের সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে ৩৪টি ব্যাংককে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্য থেকে আগামী বছরের শুরুর দিকে ১০ ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত করার কথা ভাবছে তারা।

৫৪টি ব্যাংকের মধ্যে ১২টি ব্যাংক খুব নাজুক অবস্থায় আছে। তার নয়টি রেড জোনে চলে গেছে। ইয়েলো জোনে থাকা ২৯টি ব্যাংকের মধ্যে তিনটি ব্যাংক আবার রেড জোনের খুব কাছাকাছি অবস্থানে আছে। মাত্র ১৬টি ব্যাংক গ্রিন জোনে আছে। এর মধ্যে আটটিই বিদেশী ব্যাংক। গ্রিন জোনে দেশীয় ব্যাংকের সংখ্যা মাত্র আটটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ‘আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলো চাইলে স্বেচ্ছায় একীভূত হতে পারবে। সেটি না হলে আগামী বছরের মার্চে নীতিমালা অনুযায়ী যারা দুর্বল তালিকায় পড়বে, তাদের একীভূত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো ব্যাংক একীভূত হলেও তার আমানতকারীদের স্বার্থের কোনো হানি হবে না।’

তবে ব্যাংকের এই শ্রেণীকরণ এখনো চূড়ান্ত কিছু নয় বলে জানান তিনি। আর ব্যাংক একীভূত হলে দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালকেরা ভালো ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না।

এদিকে ফেব্রুয়ারি শেষ সপ্তাহে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এমডি নিয়োগে নতুন নীতি জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডিদের নিয়োগ হবে সর্বোচ্চ তিন বছরের জন্য। ব্যাংক ও আর্থিক খাতে ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। বয়স হতে হবে ৪৫ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে। এমডি হতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়োগ কমিটির কাছে মৌখিক পরীক্ষা দিতে হবে। কেউ হঠাৎ করেই এমডির পদ ছাড়তে পারবেন না। আবার কোনো ব্যাংক চাইলেই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া অপসারণ করতে পারবে না। দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কমিটির কাছে ব্যাখ্যা দিতে হবে। কমিটি যে সিদ্ধান্ত দেবে তাই চূড়ান্ত হবে।

এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ অবলোপন ও আদায়ে পারদর্শিতা দেখবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এর আগে ১০ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য বা পরিচালক হওয়ার নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিচালক হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স করা হয় ৩০ বছর। আগে ২২ বছর বয়সে ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার উদাহরণ আছে। এছাড়া ব্যবসা বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকা এবং ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে কোনো অভিজ্ঞতা বিবেচনায় না নেয়া, কর খেলাপি, ঋণ খেলাপি না হওয়া, আর্থিক অপরাধে দণ্ডিত না হওয়া- এই বিষয়গুলো আছে। কিন্তু যেটা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আপত্তি সেই একই পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের মোট পাঁচজন পরিচালক হওয়ার বিধান বহাল আছে।

উদ্যোগের সুফল পাওয়া যাবে?
যমুনা ব্যাংকের সাবেক এমডি নুরুল আমিন মনে করেন, ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি চিহ্নিত করার জন্য যে একটি কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। ওই কমিটির স্বচ্ছতার ওপর নির্ভর করবে যে ইচ্ছকৃত খেলাপিরা চিহ্নিত হবে কি হবে না। তাই ওই কমিটি হতে হবে স্বচ্ছ আর যোগ্য। ব্যাংক একীভূত করার ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা দরকার হবে। এর নীতিমালা একদম স্বচ্ছ হতে হবে। আর গ্রাহকদের স্বার্থ সর্বাধিক বিবেচনায় নিতে হবে। ভালো ও খারাপ ব্যাংক এক হলে তার ঝুঁকি আগে হিসাব করতে হবে। দেখতে হবে কেউ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘উদ্যোগ যাই নেয়া হোক তার সুফল পেতে এই খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কারণ এখানে দুই-একটি উদ্যোগ নিলে সমস্যা কেটে যাবে না। এর সমস্যা অনেক গভীরে। এখানে দ্বৈত শাসন চলছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থনৈতিক বিভাগের মধ্যে। বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আইনে অনেক ফাঁক-ফোকর আছে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্যদের গঠন পদ্ধতি সুশাসনের অন্তরায়। এখনো এক পরিবার ও তাদের প্রতিষ্ঠানের পাঁচজন বোর্ডের সদস্য হতে পারেন। এখানে নানা গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক স্বার্থ আছে। তাই আমি বলছি যে উদ্যোগগুলো ভালো, কিন্তু কতটা কার্যকর করা যায় সেটাই দেখার বিষয়।’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘খেলাাপি ঋণের এখন যা অবস্থা তা গত ২০-২৫ বছরেরর পুঞ্জিভূত অনিয়মের ফল। আগেই দরকার ছিল, তারপরও দেরিতে হলেও যদি ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করা যায় তাহলে ভালো। তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আর এটা করতে হবে স্বচ্ছতার সাথে। কোনো ধরনের চাপ বা রাজনীতির কাছে যেন নতি স্বীকার করা না হয়।’

তিনি বেলন, ‘এখন দুর্বল ব্যাংকের কথা বলা হচ্ছে। এই ব্যাংকগুলোকে লাইসেন্স দেয়ার সময়ই আমরা বলেছিলাম যে আমাদের যে ইকোনমি তাতে কয়টি ব্যাংকের প্রয়োজন তা বিবেচনা করতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। আবার নানা আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে অনেক সবল ব্যাংককে দুর্বল করা হয়েছে। শুধু সবল ব্যাংকের সাথে দুর্বল ব্যাংক একীভূত নয়, যারা ব্যাংক দুর্বল করার জন্য দায়ী তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

তার মতে, ‘খেয়াল রাখতে হবে এটা করতে গিয়ে আর সবল ব্যাংককে যেন দুর্বল করে ফেলা না হয়। একীভূত করলেই যে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়। সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি এসবের কারণে ব্যাংক দুর্বল হয়েছে, সেই সমস্যা বহাল থাকলে একীভূত করেও লাভ হবে না।’
সূত্র : ডয়চে ভেলে

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

ব্যাংক খাতে পরিবর্তন : উদ্যোগ ভালো, দেখতে হবে বাস্তবায়ন

আপডেট সময় ০২:২৩:২৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ মার্চ ২০২৪

ব্যাংক খাত সংস্কারে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী বছরের শুরুর দিকে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত করার কাজ শুরু হবে।

ব্যাংক একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় এক্সিম ব্যাংকের সাথে দুর্বল পদ্মা ব্যাংক একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী রোববার দুই ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হবে বলে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। পদ্মা ব্যাংককে অধিগ্রহণ করবে এক্সিম ব্যাংক।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই উদ্যোগ গুলোর সুফল পেতে হলে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। নয়তো সবল ব্যাংকও দুবর্ল হয়ে যেতে পারে। আবার প্রকৃত স্বেচ্ছা ঋণ খেলাপিরা রেহাই পেয়ে যেতে পারে। আর ব্যাংকগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা না করে শুধু পরীক্ষা দিয়ে এমডি নিয়োগ করলেই ফল আসবে না।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আগামী ৯ এপ্রিলের মধ্যে ‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহিতা সনাক্তকরণ ইউনিট’ গঠন করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনের শর্ত যদি কোনো ব্যাংক ভঙ্গ করে তাহলে ওই ব্যাংককে ৫০ লাখ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা জরিমানা করা হবে।

কারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি
‘ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা সনাক্তকরণ ইউনিটের’ কাজ হলো ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি খোঁজা। যারা ঋণ খেলাপি তাদের মধ্য থেকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি খোঁজার সাথে সাথে নতুন করে কেউ খেলাপি হলে ৩০ দিনের মধ্যে সে ইচ্ছকৃত খেলাপি কিনা তা বের করতে হবে। এই ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি চিহ্নিত করার নীতিমালাও দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপনে বলেছে, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ না করলে এবং জালিয়াতি, প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে কেউ ঋণ নিলে তা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবে। এছাড়া যে উদ্দেশে ঋণ নেয়া হয়েছে, তার বাইরে অন্য কাজে ঋণের অর্থ ব্যবহার করলেও তা চিহ্নিত হবে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে।’

ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপির শাস্তি কী?
আর যারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হবে, তার কোনো ধরনের সুদ মওকুফ বা ঋণ পুনঃতফসিল করা যাবে না। ঋণ পুরোপুরি শোধ না হওয়া পর্যন্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশ ভ্রমণ ও ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা দিতে পদক্ষেপ নেবে। তারা যাতে নতুন করে কোনো কোম্পানি খুলতে না পারেন, এ জন্যও পদক্ষেপ নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা সম্মাননা পাবেন না তারা। তাদের তালিকা গাড়ি, বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাটের নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ইচ্ছাকৃত খেলাপি গ্রাহককে টাকা ফেরত দেয়ার জন্য দুই মাসের নোটিশ দেবে ব্যাংক এবং টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে ফৌজদারি মামলা করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে এখন মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। তবে বাস্তবে অপলোপ করা, দুর্দশাগ্রস্ত ও মামলায় আটকে থাকা ঋণের হিসাব মিলিয়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ তিন লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং তারল্য সঙ্কট কাটাতে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে।

আরো উদ্যোগ
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত করার জন্য দুর্বল ব্যাংকের তালিকা করেছে। তার দেশের ৫৪টি ব্যাংকের সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে ৩৪টি ব্যাংককে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্য থেকে আগামী বছরের শুরুর দিকে ১০ ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত করার কথা ভাবছে তারা।

৫৪টি ব্যাংকের মধ্যে ১২টি ব্যাংক খুব নাজুক অবস্থায় আছে। তার নয়টি রেড জোনে চলে গেছে। ইয়েলো জোনে থাকা ২৯টি ব্যাংকের মধ্যে তিনটি ব্যাংক আবার রেড জোনের খুব কাছাকাছি অবস্থানে আছে। মাত্র ১৬টি ব্যাংক গ্রিন জোনে আছে। এর মধ্যে আটটিই বিদেশী ব্যাংক। গ্রিন জোনে দেশীয় ব্যাংকের সংখ্যা মাত্র আটটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ‘আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলো চাইলে স্বেচ্ছায় একীভূত হতে পারবে। সেটি না হলে আগামী বছরের মার্চে নীতিমালা অনুযায়ী যারা দুর্বল তালিকায় পড়বে, তাদের একীভূত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো ব্যাংক একীভূত হলেও তার আমানতকারীদের স্বার্থের কোনো হানি হবে না।’

তবে ব্যাংকের এই শ্রেণীকরণ এখনো চূড়ান্ত কিছু নয় বলে জানান তিনি। আর ব্যাংক একীভূত হলে দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালকেরা ভালো ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না।

এদিকে ফেব্রুয়ারি শেষ সপ্তাহে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এমডি নিয়োগে নতুন নীতি জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডিদের নিয়োগ হবে সর্বোচ্চ তিন বছরের জন্য। ব্যাংক ও আর্থিক খাতে ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। বয়স হতে হবে ৪৫ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে। এমডি হতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়োগ কমিটির কাছে মৌখিক পরীক্ষা দিতে হবে। কেউ হঠাৎ করেই এমডির পদ ছাড়তে পারবেন না। আবার কোনো ব্যাংক চাইলেই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া অপসারণ করতে পারবে না। দুই ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কমিটির কাছে ব্যাখ্যা দিতে হবে। কমিটি যে সিদ্ধান্ত দেবে তাই চূড়ান্ত হবে।

এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ অবলোপন ও আদায়ে পারদর্শিতা দেখবে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এর আগে ১০ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য বা পরিচালক হওয়ার নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিচালক হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স করা হয় ৩০ বছর। আগে ২২ বছর বয়সে ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার উদাহরণ আছে। এছাড়া ব্যবসা বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকা এবং ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে কোনো অভিজ্ঞতা বিবেচনায় না নেয়া, কর খেলাপি, ঋণ খেলাপি না হওয়া, আর্থিক অপরাধে দণ্ডিত না হওয়া- এই বিষয়গুলো আছে। কিন্তু যেটা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আপত্তি সেই একই পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের মোট পাঁচজন পরিচালক হওয়ার বিধান বহাল আছে।

উদ্যোগের সুফল পাওয়া যাবে?
যমুনা ব্যাংকের সাবেক এমডি নুরুল আমিন মনে করেন, ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি চিহ্নিত করার জন্য যে একটি কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। ওই কমিটির স্বচ্ছতার ওপর নির্ভর করবে যে ইচ্ছকৃত খেলাপিরা চিহ্নিত হবে কি হবে না। তাই ওই কমিটি হতে হবে স্বচ্ছ আর যোগ্য। ব্যাংক একীভূত করার ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা দরকার হবে। এর নীতিমালা একদম স্বচ্ছ হতে হবে। আর গ্রাহকদের স্বার্থ সর্বাধিক বিবেচনায় নিতে হবে। ভালো ও খারাপ ব্যাংক এক হলে তার ঝুঁকি আগে হিসাব করতে হবে। দেখতে হবে কেউ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘উদ্যোগ যাই নেয়া হোক তার সুফল পেতে এই খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কারণ এখানে দুই-একটি উদ্যোগ নিলে সমস্যা কেটে যাবে না। এর সমস্যা অনেক গভীরে। এখানে দ্বৈত শাসন চলছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থনৈতিক বিভাগের মধ্যে। বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আইনে অনেক ফাঁক-ফোকর আছে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্যদের গঠন পদ্ধতি সুশাসনের অন্তরায়। এখনো এক পরিবার ও তাদের প্রতিষ্ঠানের পাঁচজন বোর্ডের সদস্য হতে পারেন। এখানে নানা গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক স্বার্থ আছে। তাই আমি বলছি যে উদ্যোগগুলো ভালো, কিন্তু কতটা কার্যকর করা যায় সেটাই দেখার বিষয়।’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘খেলাাপি ঋণের এখন যা অবস্থা তা গত ২০-২৫ বছরেরর পুঞ্জিভূত অনিয়মের ফল। আগেই দরকার ছিল, তারপরও দেরিতে হলেও যদি ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের চিহ্নিত করা যায় তাহলে ভালো। তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আর এটা করতে হবে স্বচ্ছতার সাথে। কোনো ধরনের চাপ বা রাজনীতির কাছে যেন নতি স্বীকার করা না হয়।’

তিনি বেলন, ‘এখন দুর্বল ব্যাংকের কথা বলা হচ্ছে। এই ব্যাংকগুলোকে লাইসেন্স দেয়ার সময়ই আমরা বলেছিলাম যে আমাদের যে ইকোনমি তাতে কয়টি ব্যাংকের প্রয়োজন তা বিবেচনা করতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। আবার নানা আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে অনেক সবল ব্যাংককে দুর্বল করা হয়েছে। শুধু সবল ব্যাংকের সাথে দুর্বল ব্যাংক একীভূত নয়, যারা ব্যাংক দুর্বল করার জন্য দায়ী তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

তার মতে, ‘খেয়াল রাখতে হবে এটা করতে গিয়ে আর সবল ব্যাংককে যেন দুর্বল করে ফেলা না হয়। একীভূত করলেই যে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়। সুশাসনের অভাব, দুর্নীতি এসবের কারণে ব্যাংক দুর্বল হয়েছে, সেই সমস্যা বহাল থাকলে একীভূত করেও লাভ হবে না।’
সূত্র : ডয়চে ভেলে