ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একটি সংসদীয় আসনের উপ-নির্বাচনকে ঘিরে যে রাজনৈতিক নাটকীয়তা তৈরি হয়েছে তা সাধারণ মানুষের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই অভিযোগ করেছেন যে একজন বিশেষ প্রার্থীকে এই নির্বাচনে জিতিয়ে দেয়ার জন্যই নানা ধরনের কৌশল নিচ্ছে আওয়ামী লীগ।
আর আওয়ামী লীগ এমন অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে, নির্বাচন যাতে কেউ ‘প্রতিহত’ করতে না পারে তার জন্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছেন তারা।
গত ১১ ডিসেম্বর বিএনপির আন্দোলনের অংশ হিসেবে দলটির সাতজন সংসদ সদস্য দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পদত্যাগ করেন। এর অংশ হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনটিকে শূন্য ঘোষণা করার পর সেখানে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
পহেলা ফেব্রুয়ারির এই উপ-নির্বাচনে লড়তে ১৩ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিলেও নির্বাচন কমিশন আটজনের মনোনয়ন বৈধ ঘোষণা করে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতা হয়েও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন এমন তিনজনসহ মোট চারজন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। ফলে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী নেই।
শেষ পর্যন্ত যে চারজন প্রার্থী এই উপ-নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন তারা হলেন সাবেক বিএনপি নেতা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুস সাত্তার ভূঁইয়া, জাতীয় পার্টির আব্দুল হামিদ ভাষানী, জাকের পার্টির জহিরুল ইসলাম এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু আসিফ আহমেদ।
বুধবার যে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে সেখানে যে চারজন প্রার্থী রয়েছেন তাদের মধ্যে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুস সাত্তার ভূইয়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনটি শূন্য হওয়ার আগে তিনিই এখানকার নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন।
বিএনপির সাংসদ হিসেবে পদত্যাগের পর, বিএনপি থেকেও পদত্যাগ করেন তিনি। এখন নিজের আসনের উপ-নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিচ্ছেন তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এই প্রার্থীকে জয়ী করতে সেখানকার আওয়ামী লীগ নির্বাচনে কোন প্রার্থী দেয়নি। উল্টো আওয়ামী লীগের তিনজন নেতা স্বতন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পর তা আবার প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
প্রথম সারির একটি সংবাদ মাধ্যম দ্য ডেইলি স্টারের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রতিনিধি মাসুক হৃদয় বিবিসি বাংলাকে বলেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতা দলটির স্থানীয় অন্য নেতাদের সাথে মিলে সরাইল ও আশুগঞ্জের অনেক এলাকায় গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুস সাত্তার ভূঁইয়ার পক্ষে ভোট চেয়েছেন।
হৃদয় মঙ্গলবারই অন্তত সাত-আটটি গ্রামে ঘুরেছেন এবং সেখানকার বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে, উপনির্বাচন নিয়ে তাদের মতামত জানার চেষ্টা করেছেন।
তার মতে, সরাইল ও আশুগঞ্জ উপজেলা, যেখানে এই ভোট হচ্ছে, সেখানকার বাসিন্দারা মনে করেন, ওই এলাকায় বিএনপিকে দ্বিখণ্ডিত করার জন্য এবং এই দলটিকে আরো দুর্বল করে দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগের এটা এক ধরনের ‘কুট-কৌশল’।
আব্দুল সাত্তার ভূঁইয়াকে সমর্থন দেয়ার কথা স্বীকার করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে ঐক্যমতের ভিত্তিতে তাকে সমর্থন দেয়া হচ্ছে। যেহেতু আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী নেই, তাই নিরুপায় হয়ে তারা সাত্তার ভূইয়াকে সমর্থন দিচ্ছেন বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘তিনি এলাকার প্রবীণ মানুষ, তাই তাকে সমর্থন করেছি, (আওয়ামী লীগের) প্রার্থী না থাকার কারণে।’
এখানে উল্লেখ্য যে এরইমধ্যে আওয়ামী লীগের তিনজন স্বতন্ত্র প্রার্থী তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন। প্রার্থী না থাকলে তারা কিভাবে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন এবং কেনই বা তা আবার প্রত্যাহার করলেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে এই নেতা বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা, উপজেলা এবং গ্রাম পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে তিনটি ভাগ দেখা দিয়েছে।
যারা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এই ভাঙন আরো প্রকট হতো বিধায় তা ঠেকাতে তাদেরকে মনোনয়পত্র প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়।
তিনি বলেন, মহাজোটের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা আওয়ামী লীগ।
‘প্রার্থী নিখোঁজ’
দ্বিতীয়ত, এই আসনের একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু আসিফ আহমেদ ২৭ জানুয়ারি থেকে ‘নিখোঁজ’ রয়েছেন বলে তার পরিবার জানিয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক এবং রিটার্নিং অফিসার বরাবর দেয়া এক চিঠিতে ওই প্রার্থীর স্ত্রী মেহেরুন নিছা মেহেরীন, তার স্বামীর সন্ধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
অবশ্য, নির্বাচনের আগের দিন মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেছেন, ‘নিখোঁজ’ ওই স্বতন্ত্র প্রার্থী আসলে আত্মগোপনে রয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের করা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন থেকে তারা এমন তথ্য জানতে পেরেছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থানীয় সংবাদকর্মী মাসুক হৃদয় বলেন, এই আসনের ভোটার সংখ্যার একটি কৌশলগত দিক রয়েছে। সরাইল ও আশুগঞ্জ উপজেলা নিয়ে এই আসন। নির্বাচনে যে চার প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন, তাদের মধ্যে তিনজনের বাড়িই সরাইল উপজেলায়।
অন্যদিকে ‘নিখোঁজ’ স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু আসিফ আহমেদ আশুগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা এবং সেখানে আর কোন প্রার্থী নেই। পাশাপাশি সেখানকার ভোটার সংখ্যা এক লাখ ৩২ হাজারের মতো। ফলে আঞ্চলিকতার কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা তাকে ভোট দিলে তার জয়ের একটি বড় সম্ভাবনা রয়েছে।
‘এ কারণে প্রতিপক্ষ তাকে হুমকি হিসেবে দেখছে’ উল্লেখ করে হৃদয় বলেন, এই নির্বাচন নিয়ে নাটক শুরু হয়েছে বলে এলাকার মানুষ মনে করে। এ কারণে তারা এই নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।
‘তারা বলছে যে, সরকারের মানুষ (আওয়ামী লীগ) একটা ফ্রেম কইরা সাত্তার ভূঁইয়াকে জিতাতে চাইছে, এই ভোটে আমরা যাবো না,’ বলেন হৃদয়।
‘মানুষ বলছে, কার জন্য ভোট দিতে যাব? কোনো প্রার্থীকে ধইরা নিয়া যায়, কোনো প্রার্থীকে ইলেকশন করতে দেয় না, বসায় দেয়।’
এর আগে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে তা প্রত্যাহার না করলেও ফেসবুকে এক ঘোষণার মাধ্যমে তা প্রত্যাহারের কথা জানান জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়াউল হক মৃধা। অভিযোগ রয়েছে যে, নানা ধরনের চাপের কারণে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন দুই বারের সাবেক এই এমপি।
তবে মৃধা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন কোন ধরনের চাপের মুখে নয় বরং স্বেচ্ছায় মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন তিনি।
কী বলছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি?
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার বলেন, বিএনপি নেতা রুমিন ফারহানা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়ে সাবেক বিএনপি নেতা আব্দুস সাত্তারকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছিলেন। সেইসাথে তাকে ‘প্রতিহত’ করতে বিএনপির নেতাকর্মীদের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
এ কারণে তার বিরুদ্ধে এলাকায় এক ধরনের ‘সেন্টিমেন্ট’ বা আবেগ তৈরি হয় এবং এর অংশ হিসেবে বিএনপির সাবেক নেতা আব্দুস সাত্তার ভূইয়াকে সমর্থন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগ।
একই সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিএনপি নেতা রুমিন ফারহানাকেও অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়।
এ বিষয়ে রুমিন ফারহানা বলেন, নির্বাচনে বিএনপি যেহেতু অংশ নিচ্ছে না, তাই তিনি বিএনপির কর্মী এবং সমর্থকদের এই নির্বাচনে যাওয়া এবং ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন মাত্র। কাউকে ‘প্রতিহত’ করার কথা বা এই শব্দটি উচ্চারণ করেননি বলেও তিনি জানান।
তার মতে, এই উপ-নির্বাচনে বিএনপির সাবেক নেতাকে সমর্থন দেয়ার সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগের একটি কৌশল মাত্র।
তিনি বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন কেমন হতে পারে তার একটা নমুনা সরকার দেখাচ্ছে। সরকার বোঝাতে চাইছে যে, বিএনপির কিছু লোভী মানুষ হয়তো তারা খুঁজে বের করবে যারা বিএনপি নির্বাচনে না গেলেও, তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবে। তাদেরকে জিতিয়ে আনতে সরকার যেকোনো কিছু করতেও প্রস্তুত থাকবে।
সূত্র : বিবিসি