ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

ভালোবাসা বিলানো ‘গোনাহগারদের মাওলানা’

  • বেলায়েত হুসাইন
  • আপডেট সময় ০৬:৩৩:৩৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৩
  • ১৩৮২ বার পড়া হয়েছে

গত বছর মাদরাসার একটি মেধাবী শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করলাম, বড় হয়ে কী হতে চাও? সে কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্ত জবাব দিলো, ‘মাওলানা তারিক জামিল।’

লাখো-কোটি পাকিস্তানির মতো মাওলানা আমারও পছন্দের ইসলামী দাঈ (প্রচারক)। তিনি কখনো সরকারি আইনবিরোধী মন্তব্য করেন না, আবার তাকে সরকারি মহলে ধরনা দিতেও দেখা যায় না। তিনি বয়ানে কোনো বিভাজন উসকে দেন না। সবসময় শুধু ভালোবাসার প্রচার করেন, হাসি ছড়িয়ে দেন এবং তিনি তার বয়ানে শ্রোতাদের খুব বেশি কবরের আজাবের ভয়ও দেখান না।

তার বয়ান শুনুন, আপনার মনে হবে গোনাহগার থ্রিডি স্ক্রিনে জান্নাতের মনোরোম দৃশ্য উপভোগ করছে। কেয়ামত দিবসে ক্ষমার এমন প্রতিশ্রুতির কথা শোনান যে চূড়ান্ত পাপী বান্দাও নিজেকে জান্নাতি মনে করা শুরু করে।

কখনোই মাহফিলে সরাসরি তার বয়ান শোনার সৌভাগ্য আমার হয়নি। শুধু একবার এয়ারপোর্টে তাকে দেখেছিলাম। যেখানে যাত্রীরা বেল্টের ওপর ঘুরতে থাকা তাদের সুটকেসের কথা ভুলে গিয়ে মাওলানার সাথে সেলফি তুলতে ব্যস্ত ছিলেন। আমার দুর্বল মন চমৎকার এ দৃশ্য দূর থেকে দেখেই তৃপ্ত হচ্ছিল।

সেখানে ভিড় বাড়তে থাকল। কিন্তু তার চেহারায় কোনো বিরক্তিভাব লক্ষ করলাম না; বরং তার দুষ্টু-মিষ্টি হাসি আরও মোহনীয় লাগছিল এবং প্রথমবার আমার মনে হলো মাওলানা আলেমদের ‘শাহরুখ খান’। এই পরিস্থিতিতে অন্য কোনো আলেম হয়তো বিরক্ত হতেন কিন্তু আমি নিশ্চিত মাওলানা তারিক জামিল শুধুই হাসবেন।

সমালোচকদের বেশিরভাগ প্রশ্ন এই যে মাওলানা সিনেমার তারকা, ক্রিকেটার ও সম্ভ্রান্তদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রাখেন। গত বছর কেউ একজন মাওলানার বিদেশ সফরের একটি ছবি ছড়িয়ে দিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি করে, ছবিতে দেখা যায় তিনি খুব লম্বা একটি লিমুজিন কার থেকে নামছেন। এই ছবি সম্পর্কে একজন যথার্থ মন্তব্য করেছেন; বলেছেন, ‘কোন হাদিসে আছে যে লিমোজিনে আরোহণ নিষেধ?’ যদি তার আমন্ত্রণকারীরা এত বড় গাড়ি পাঠান, তাহলে কি তিনি বলবেন, এটি নিয়ে যাও, আমি তো সুজুকি আলটোতে বসব।

অনেকেই ভিন্নভাবে বলেন, মাওলানা তারিক জামিল গোনাহগার ও দুনিয়াদারদের মাওলানা। যে সৎ তার তাবলিগের প্রয়োজন কতটুকু? রাজনৈতিক হিংসায় বিভাজিত এই সমাজে মনে হয় তারিক জামিল একমাত্র আলেম, যিনি ইমরান খানের (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী) ডাইনিং রুমে ইফতারির পর নামাজের ইমামতি করেন, ফের মরহুম কুলসুম নওয়াজের (পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের স্ত্রী) জানাজায়ও শরিক হন।

বাস্তবিকপক্ষে আমাদের সমাজে এমন লোকদেরই দরকার, যারা ছোটখাটো মতপার্থক্য ভুলে সম্প্রীতি ছড়িয়ে দিতে পারেন। রাষ্ট্রেরও এই অনুভূতি থাকা উচিত যে তারা আমাদের জাতীয় সম্পদ।

মাওলানা বিভিন্ন সময় প্রতিরক্ষা ও বেসামরিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিও সম্বোধন করে বয়ান করেন। কয়েক বছর আগে ফেডারেল বোর্ড অব রেভিনিউ-এফবিআরের সব বড় বড় অফিসে তার বয়ান সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছিল। তার এই বয়ানের পর এফবিআরের অফিসারদের কাজকর্মে অথবা তাদের কমিশনের ওপর কোনো প্রভাব পড়েছে কি না সেটি মুখ্য নয়; বরং তার উদ্দেশ্য ছিল সততার বাণী পৌঁছে দেয়া। তবে আমাদের এফবিআরের ভাইয়েরা বয়ান শোনার পর বুঝতে পেরেছেন যে এমন মহৎ ব্যক্তির সান্নিধ্যে দুই ঘণ্টা অতিবাহিত হয়েছে। মানে এখন ক্ষমা পাক্কা। সুতরাং দুনিয়ার কাজে সময় নষ্ট করে কী ফায়দা?

ভক্তির এই পর্যায়ে রমজানে টেলিভিশনের একটি প্রোগ্রামে মাওলানাকে দেখলাম। তার আলোচনা শুনতে জমে বসেও পড়লাম। আলোচনা শুরুর একটু পরই দ্বীনি কথাবার্তার বদলে সাংবাদিক তাকে ইমরান খান সরকারের ভালোমন্দ সম্পর্কে প্রশ্ন ছুড়ছিলেন। মাওলানা বারবার বলছিলেন, তিনি আশা ছেড়ে দেবেন না।

আমাদের মতো গুনাহগারদের প্রতি আদেশ হচ্ছে দ্বীনের কথা শুধু আলেমরা বলবেন (যদিও মাওলানা তারিক জামিল এ কথার সমর্থক নন)। তাই আলেমরা যদি রাজনৈতিক ও ইতিহাস বিষয়ক সম্যক অবগত হয়ে দুনিয়ার বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করেন, তাহলে উম্মত বেশি উপকৃত হবে এবং আশা করা যায় আমরা সবাই ‘তারিক জামিল’ হয়ে উঠব আর আমাদের সবার আখিরাতও হবে আলোকময়।

গত বছর পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে মাওলানা তারিক জামিলকে ধর্মীয় ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখায় রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করা হয়। দেশটির রাষ্ট্রপতি ডা. আরিফ আলভী মাওলানা তারিক জামিলকে এ সম্মাননা প্রদান করেন। মাওলানা তারিক জামিল বিশ্বব্যাপী ইসলাম প্রচারের জন্য ব্যাপক জনপ্রিয়। পাকিস্তানের পাঞ্জাবে জন্ম নেওয়া এ ধর্মপ্রচারক ডাক্তারি পড়ার সময় এক বাঙ্গালী ডাক্তারের দাওয়াতে তাবলিগ জামাতের সাথে সম্পৃক্ত হন। এরপর ডাক্তারি পড়াশোনা ছেড়ে ইসলামী শিক্ষায় পড়াশোনা করেন তিনি। পাকিস্তান তাবলিগ জামাতের অন্যতম নীতি নির্ধারক এই মাওলানা অনলাইনে ব্যাপক জনপ্রিয়। দ্য মুসলিম ৫০০-এর ২০১৩/২০১৪ এডিশনে জনপ্রিয় বক্তা হিসেবে স্থান পেয়েছিলেন মাওলানা তারিক জামিল।

মাওলানা জামিলের দাওয়াতে ধর্মীয় পথ অনুসরণ করেন, এমন সেলিব্রিটিদের সংখ্যা কম নয়। পাকিস্তানের সাবেক তারকা ক্রিকেটার ইনজামাম-উল হক, শহীদ আফ্রিদিসহ ক্রীড়াঙ্গনে তার ব্যাপক ভক্ত রয়েছে।

-বিবিসি উর্দুতে প্রকাশিত পাকিস্তানি সাংবাদিক মোহাম্মদ হানিফের কলাম ও অন্যান্য ওয়েবসাইট অবলম্বনে

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

ভালোবাসা বিলানো ‘গোনাহগারদের মাওলানা’

আপডেট সময় ০৬:৩৩:৩৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৩

গত বছর মাদরাসার একটি মেধাবী শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করলাম, বড় হয়ে কী হতে চাও? সে কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্ত জবাব দিলো, ‘মাওলানা তারিক জামিল।’

লাখো-কোটি পাকিস্তানির মতো মাওলানা আমারও পছন্দের ইসলামী দাঈ (প্রচারক)। তিনি কখনো সরকারি আইনবিরোধী মন্তব্য করেন না, আবার তাকে সরকারি মহলে ধরনা দিতেও দেখা যায় না। তিনি বয়ানে কোনো বিভাজন উসকে দেন না। সবসময় শুধু ভালোবাসার প্রচার করেন, হাসি ছড়িয়ে দেন এবং তিনি তার বয়ানে শ্রোতাদের খুব বেশি কবরের আজাবের ভয়ও দেখান না।

তার বয়ান শুনুন, আপনার মনে হবে গোনাহগার থ্রিডি স্ক্রিনে জান্নাতের মনোরোম দৃশ্য উপভোগ করছে। কেয়ামত দিবসে ক্ষমার এমন প্রতিশ্রুতির কথা শোনান যে চূড়ান্ত পাপী বান্দাও নিজেকে জান্নাতি মনে করা শুরু করে।

কখনোই মাহফিলে সরাসরি তার বয়ান শোনার সৌভাগ্য আমার হয়নি। শুধু একবার এয়ারপোর্টে তাকে দেখেছিলাম। যেখানে যাত্রীরা বেল্টের ওপর ঘুরতে থাকা তাদের সুটকেসের কথা ভুলে গিয়ে মাওলানার সাথে সেলফি তুলতে ব্যস্ত ছিলেন। আমার দুর্বল মন চমৎকার এ দৃশ্য দূর থেকে দেখেই তৃপ্ত হচ্ছিল।

সেখানে ভিড় বাড়তে থাকল। কিন্তু তার চেহারায় কোনো বিরক্তিভাব লক্ষ করলাম না; বরং তার দুষ্টু-মিষ্টি হাসি আরও মোহনীয় লাগছিল এবং প্রথমবার আমার মনে হলো মাওলানা আলেমদের ‘শাহরুখ খান’। এই পরিস্থিতিতে অন্য কোনো আলেম হয়তো বিরক্ত হতেন কিন্তু আমি নিশ্চিত মাওলানা তারিক জামিল শুধুই হাসবেন।

সমালোচকদের বেশিরভাগ প্রশ্ন এই যে মাওলানা সিনেমার তারকা, ক্রিকেটার ও সম্ভ্রান্তদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রাখেন। গত বছর কেউ একজন মাওলানার বিদেশ সফরের একটি ছবি ছড়িয়ে দিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি করে, ছবিতে দেখা যায় তিনি খুব লম্বা একটি লিমুজিন কার থেকে নামছেন। এই ছবি সম্পর্কে একজন যথার্থ মন্তব্য করেছেন; বলেছেন, ‘কোন হাদিসে আছে যে লিমোজিনে আরোহণ নিষেধ?’ যদি তার আমন্ত্রণকারীরা এত বড় গাড়ি পাঠান, তাহলে কি তিনি বলবেন, এটি নিয়ে যাও, আমি তো সুজুকি আলটোতে বসব।

অনেকেই ভিন্নভাবে বলেন, মাওলানা তারিক জামিল গোনাহগার ও দুনিয়াদারদের মাওলানা। যে সৎ তার তাবলিগের প্রয়োজন কতটুকু? রাজনৈতিক হিংসায় বিভাজিত এই সমাজে মনে হয় তারিক জামিল একমাত্র আলেম, যিনি ইমরান খানের (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী) ডাইনিং রুমে ইফতারির পর নামাজের ইমামতি করেন, ফের মরহুম কুলসুম নওয়াজের (পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের স্ত্রী) জানাজায়ও শরিক হন।

বাস্তবিকপক্ষে আমাদের সমাজে এমন লোকদেরই দরকার, যারা ছোটখাটো মতপার্থক্য ভুলে সম্প্রীতি ছড়িয়ে দিতে পারেন। রাষ্ট্রেরও এই অনুভূতি থাকা উচিত যে তারা আমাদের জাতীয় সম্পদ।

মাওলানা বিভিন্ন সময় প্রতিরক্ষা ও বেসামরিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিও সম্বোধন করে বয়ান করেন। কয়েক বছর আগে ফেডারেল বোর্ড অব রেভিনিউ-এফবিআরের সব বড় বড় অফিসে তার বয়ান সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছিল। তার এই বয়ানের পর এফবিআরের অফিসারদের কাজকর্মে অথবা তাদের কমিশনের ওপর কোনো প্রভাব পড়েছে কি না সেটি মুখ্য নয়; বরং তার উদ্দেশ্য ছিল সততার বাণী পৌঁছে দেয়া। তবে আমাদের এফবিআরের ভাইয়েরা বয়ান শোনার পর বুঝতে পেরেছেন যে এমন মহৎ ব্যক্তির সান্নিধ্যে দুই ঘণ্টা অতিবাহিত হয়েছে। মানে এখন ক্ষমা পাক্কা। সুতরাং দুনিয়ার কাজে সময় নষ্ট করে কী ফায়দা?

ভক্তির এই পর্যায়ে রমজানে টেলিভিশনের একটি প্রোগ্রামে মাওলানাকে দেখলাম। তার আলোচনা শুনতে জমে বসেও পড়লাম। আলোচনা শুরুর একটু পরই দ্বীনি কথাবার্তার বদলে সাংবাদিক তাকে ইমরান খান সরকারের ভালোমন্দ সম্পর্কে প্রশ্ন ছুড়ছিলেন। মাওলানা বারবার বলছিলেন, তিনি আশা ছেড়ে দেবেন না।

আমাদের মতো গুনাহগারদের প্রতি আদেশ হচ্ছে দ্বীনের কথা শুধু আলেমরা বলবেন (যদিও মাওলানা তারিক জামিল এ কথার সমর্থক নন)। তাই আলেমরা যদি রাজনৈতিক ও ইতিহাস বিষয়ক সম্যক অবগত হয়ে দুনিয়ার বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করেন, তাহলে উম্মত বেশি উপকৃত হবে এবং আশা করা যায় আমরা সবাই ‘তারিক জামিল’ হয়ে উঠব আর আমাদের সবার আখিরাতও হবে আলোকময়।

গত বছর পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে মাওলানা তারিক জামিলকে ধর্মীয় ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখায় রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করা হয়। দেশটির রাষ্ট্রপতি ডা. আরিফ আলভী মাওলানা তারিক জামিলকে এ সম্মাননা প্রদান করেন। মাওলানা তারিক জামিল বিশ্বব্যাপী ইসলাম প্রচারের জন্য ব্যাপক জনপ্রিয়। পাকিস্তানের পাঞ্জাবে জন্ম নেওয়া এ ধর্মপ্রচারক ডাক্তারি পড়ার সময় এক বাঙ্গালী ডাক্তারের দাওয়াতে তাবলিগ জামাতের সাথে সম্পৃক্ত হন। এরপর ডাক্তারি পড়াশোনা ছেড়ে ইসলামী শিক্ষায় পড়াশোনা করেন তিনি। পাকিস্তান তাবলিগ জামাতের অন্যতম নীতি নির্ধারক এই মাওলানা অনলাইনে ব্যাপক জনপ্রিয়। দ্য মুসলিম ৫০০-এর ২০১৩/২০১৪ এডিশনে জনপ্রিয় বক্তা হিসেবে স্থান পেয়েছিলেন মাওলানা তারিক জামিল।

মাওলানা জামিলের দাওয়াতে ধর্মীয় পথ অনুসরণ করেন, এমন সেলিব্রিটিদের সংখ্যা কম নয়। পাকিস্তানের সাবেক তারকা ক্রিকেটার ইনজামাম-উল হক, শহীদ আফ্রিদিসহ ক্রীড়াঙ্গনে তার ব্যাপক ভক্ত রয়েছে।

-বিবিসি উর্দুতে প্রকাশিত পাকিস্তানি সাংবাদিক মোহাম্মদ হানিফের কলাম ও অন্যান্য ওয়েবসাইট অবলম্বনে