পশ্চিম এশিয়াকে এখনো অনেকেই ‘মধ্যপ্রাচ্য’ নামে ডাকেন। ১৯ শতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী থেকে এই অভিধার সৃষ্টি, তবে গত শতকের গোড়ায় মার্কিন নৌবাহিনীর সমরকুশলীরা নামটিকে প্রসিদ্ধি দেন। অতঃপর পাশ্চাত্যের অধীশ্বরদের এই প্রাচ্য-দর্শন বিশ্ব রাজনীতির পরিসরে নিরঙ্কুশ আধিপত্য জারি করে। গত কয়েক দশকে আন্তর্জাতিক ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটেছে, সোভিয়েট-উত্তর একমেরু দুনিয়া আজ আর নেই। কিন্তু পশ্চিম এশিয়ায় কিছুকাল আগে পর্যন্ত ব্রিটেন এবং পশ্চিম ইউরোপের আনুগত্যে পরিপুষ্ট ওয়াশিংটনের দাপট প্রবল ছিল। বিশেষত, এই অঞ্চলের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বিবাদ বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্ব ছিল প্রশ্নাতীত। কী আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষায়, কী সহিংসতা, দ্বন্দ্ব এবং সংঘাতের সৃষ্টি ও লালনে, তার প্রাধান্য বজায় থেকেছে। রাশিয়ার প্রতিস্পর্ধী ভূমিকা আজও গুরুতর, কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিন যথার্থ কোনো কূটনৈতিক বিকল্প রচনা করতে হয়েছেন ব্যর্থ, বিশেষত পশ্চিম এশিয়ায়।
এই বিকল্প রচনার কাজটিতেই সম্প্রতি একটি বড় রকমের সাফল্য অর্জন করলেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ২০১৬ সালে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে তীব্র বিবাদের পরিণামে দুই রাষ্ট্র কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। সাত বছর পরে তারা সেই বিচ্ছেদের অবসান ঘটাতে সম্মত হয়েছে। এবং তেহরান ও রিয়াদের ছেঁড়া তার জোড়া লাগানোর এই কাজটিতে মধ্যস্থতা করেছে চীন। এ-কাজ সহজ ছিল না। পশ্চিম এশিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে ইরান ও সৌদি আরব বরাবর প্রতিদ্বন্দ্বী, শিয়া-সুন্নি বিভাজন সেই রেষারেষির একটি অঙ্গ। বিশেষত সাড়ে চার দশক আগে তেহরানে খোমেনির অভ্যুত্থানের পরে দ্বন্দ্ব প্রবল হয়ে ওঠে। সাত বছর আগে সৌদি আরবে এক শিয়া ধর্মনায়কের মৃত্যুদণ্ডকে কেন্দ্র করে কূটনৈতিক বিচ্ছেদ। ইতিমধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জমানায় আমেরিকা ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তার প্রতিক্রিয়ায় এক দিকে পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি জটিলতর হয়, অন্য দিকে সৌদি আরব এবং ইরানের বিবাদে মধ্যস্থতার কোনো সুযোগ আমেরিকার হাতে থাকে না। এই পরিস্থিতিতেই চীন গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে মধ্যস্থতার চেষ্টা চালিয়ে এসেছে। শেষ পর্যন্ত সাফল্য এসেছে।
পশ্চিম এশিয়ার কূটনীতিতে চীন কার্যত এই প্রথম কোনো বড় ভূমিকা নিলো। এবং, এই গোটা বোঝাপড়া ও চুক্তির পর্বটিতে আমেরিকার কোনো ভূমিকা ছিল না। এই দুই ঘটনাকে মেলালে পশ্চিম এশিয়ার কূটনৈতিক মঞ্চে পালাবদলের সম্ভাবনা প্রকট হয়ে ওঠে। আমেরিকা পশ্চিম এশিয়ায় তার গুরুত্ব অচিরে ছাড়বে না, হারাবেও না। কিন্তু এই অঞ্চলে চীনও যে অতঃপর একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে কাজ করবে, সেই সত্যও সুস্পষ্ট।
তবে এ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সৌদি আরবের সাথে চীনের সংযোগ দ্রুত বাড়ছে। অন্য দিকে, সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন-এ সহযোগী সদস্য হতে চলেছে ইরান। আন্তর্জাতিক কূটনীতির বৃহত্তর মঞ্চেও বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার পথে চীন দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। গত বছরেই ‘গ্লোবাল সিকিয়োরিটি ইনিশিয়েটিভ’ ঘোষণা করেছেন শি জিনপিং, উদ্দেশ্য সহজবোধ্য। ঘরে-বাইরে বহু সমস্যায় নাজেহাল প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কিভাবে এই নতুন সমীকরণের মোকাবিলা করবেন, তা তিনি জানেন কি?
মনে পড়তে পারে, তার এক পূর্বসূরি সাড়ে তিন দশক আগে ‘নয়া বিশ্ব ব্যবস্থা’র কথা ঘোষণা করেছিলেন। এখন তিনি আর এক নয়া বিশ্ব ব্যবস্থার মুখোমুখি। ওই ব্যবস্থা পৃথিবীর পক্ষে শুভ হবে কি না, বলা কঠিন- পার্টি-শাসিত চীন এবং তার এক-নায়ক শি জিনপিং-এর দুনিয়াদারির উদ্যোগ বড় রকমের আশঙ্কা জাগায়। কিন্তু ক্ষমতাবান পশ্চিম বিশ্ব আপন খেয়ালে প্রাচ্য পৃথিবীকে নানা ভাগে বিভাজিত করে দেখবে আর অবশিষ্ট দুনিয়া সেই দর্শন মেনে নেবে, তে হি নো দিবসা গতাঃ।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা