কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে হঠাৎ করেই উদ্যোগী হয়েছে মিয়ানমার। চলতি এপ্রিল মাসেই বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা নেয়ার শুরুর কথা প্রচার করছে মিয়ানমারের সামরিক সরকার। বলা হচ্ছে, প্রায় ১ হাজার ৫০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়ার পাইলট প্রকল্পও চালাচ্ছে মিয়ানমার। এর অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে এসে যাচাই-বাছাইয়ের কাজও করে গেছেন মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ১২ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে ১ হাজার ৫০০ ফেরত নেয়ার কথা বলা মিয়ানমারের সরকারের দায় ও চাপ এড়ানোর কৌশল ছাড়া কিছুই নয়। বিশেষত এপ্রিল মাসে আন্তর্জাতিক বিচার ট্রাইব্যুনালের শুনানিতে সুবিধাজনক অবস্থান পেতেই এই ‘লোক দেখানো তৎপরতা’ শুরু করেছে মিয়ানমারের সামরিক সরকার।
মিয়ানমারের সামরিক সরকারপন্থী গণমাধ্যমগুলোর খবর, রাখাইন রাজ্যের জান্তা প্রধান হিতিন লিন জানিয়েছেন, মিয়ানমারের সরকার আগামী মাসে বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ৫০০ রোহিঙ্গা ফেরত নেয়ার পরিকল্পনা করছে। তাদের আবাসন ব্যবস্থার জন্য ১৫টি নতুন গ্রাম তৈরি করতে একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নিয়েছে তারা। ৭৫০টি প্লটের ওপর গ্রামগুলো প্রতিষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ ফেরত রোহিঙ্গাদের প্রথমে দু‘মাসের জন্য হ্লা ফো খাউং অন্তর্বর্তী শিবিরে রাখা হবে। এর আগে মংডু শহরের তাউং পিয়ো লেটওয়ে ও নাগার খু ইয়া শরণার্থী শিবিরে তাদের যাচাই করা হবে। পরে তাদের নতুন গ্রামে পাঠানো হবে।
জান্তা সরকারের তথ্য উপমন্ত্রী মেজর জেনারেল জাও মিন তুন এএফপিকে বলেন, পুরোটা একটি পাইলট কর্মসূচির আওতায় হচ্ছে। এপ্রিলের মাঝামাঝিই এটি শুরু হতে পারে। পাইলট প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে আরো ৫ হাজার রোহিঙ্গা ফেরত নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
মিয়ানমারের জান্তা সরকারের এই পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর প্রক্রিয়ায় আস্থা নেই বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের, রোহিঙ্গাদের দেখভাল করা জাতিসঙ্ঘসহ পশ্চিমা দাতা দেশগুলোর এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোরও। বাংলাদেশ সরকার প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কিছু না বললেও টেকসই প্রত্যাবাসন ছাড়া রোহিঙ্গাদের ইচ্ছার বাইরে কোনো ধরনের জোর না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কূটনীতিকরা বলছেন, চীনের মধ্যস্থতায় প্রায় তিন বছর আগে নির্দিষ্ট গ্রাম ধরে পরিবারভিত্তিক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু করোনা মহামারী ও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের জেরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া একেবারেই থেমে গিয়েছিল।
দীর্ঘ বিরতির পর এখন মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে তৎপর হতে দেখা গেল। এ তৎপরতার আসল উদ্দেশ্য কী বা এই প্রক্রিয়ায় প্রত্যাবাসন শুরু আদৌ সম্ভব কি না, এসব প্রশ্ন চলে এসেছে। চীন হঠাৎ কেন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টিতে এত জোর দিচ্ছে, সেই প্রশ্নও উঠছে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, প্রত্যাবাসন শুরু হলে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ কমবে বলে মনে করছে চীন। পাশাপাশি জান্তা সরকারের কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হতে পারে বলে মনে করছে চীন। সেই সাথে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলায় মিয়ানমারের পাল্টা যুক্তি উপস্থাপনের সময়সীমা আগামী ২৪ এপ্রিল নির্ধারণ করা হয়েছে। মিয়ানমারের জান্তা সরকারের হঠাৎ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে তোড়জোড়ের সাথে এ বিষয়ের কোনো সম্পর্ক রয়েছে কি না, এমন প্রশ্নও উঠছে।
সূত্র জানায়, মিয়ানমারের এটা পুরনো কৌশল। বহুদিন ধরেই মিয়ানমারকে চাপ দেয়ার পরও কাজ হয় না, কিন্তু আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতের শুনানির দিনক্ষণ এলেই এ ধরনের লোক দেখানো তৎপরতা মিয়ানমার আগেও দেখিয়েছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতেও এমন হয়েছিল। তখন হঠাৎ করেই বাংলাদেশের সাথে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে খুব আগ্রহ দেখিয়ে চলে এসেছিল মিয়ানমার। সেখানেও এই প্রত্যাবাসন শুরুর কথা নিয়ে আলোচনা করে এবং সেই কথা আদালতে উপস্থাপন করে।
এবারও ২৪ এপ্রিল আইসিজে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা নির্যাতনে গাম্বিয়ার করা মামলার শুনানি হবে। আর এর আগে আদালতের মনোভাব নিজেদের পক্ষে রাখতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় মিয়ানমার। কারণ গত জুলাই মাসে মিয়ানমারের চারটি আপিলই খারিজ করে দিয়ে মামলা চালু করার রায় দিয়েছিলেন আদালত। এবার প্রত্যাবাসন শুরু করে আদালতকে মিয়ানমার দেখাতে চায় তারা খুবই ইতিবাচক। যেন আদালতের মনোভাবও মিয়ানমারের দিকে নরম হয়।
কূটনীতিকরা বলছেন, প্রথম ব্যাচ নেয়ার প্রস্তুতি রাখলেও দ্বিতীয় ব্যাচ কবে নেবে, কাদের নেবে বা কবে যাচাই-বাছাই শেষ করবে, তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই মিয়ানমারের পক্ষ থেকে। আসলেই প্রত্যাবাসন চাইলে শুরুতে একত্রে কয়েক হাজার রোহিঙ্গার বাছাই সম্পন্ন করে রাখত দেশটি। যাতে সুনির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধান ১ থেকে ২ মাস অন্তর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করা যায়। ফলে আদালতকে দেখাতে প্রত্যাবাসন শুরু হলেও এটি নিয়মিত হচ্ছে না।
জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়ার প্রস্তুতি হিসেবে গত মাসে ঢাকা ঘুরে গেছে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দল।
১৭ সদস্যের ওই প্রতিনিধি দল রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ করছে। চুক্তি অনুযায়ী, প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ সর্বশেষ আসা ৮ লাখের বেশি রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারের কাছে পাঠিয়েছে। ওই তালিকা থেকে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রাথমিকভাবে ১ হাজার ১৪০ জনকে বাছাই করা হয়। এর মধ্যে ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়ায় মিয়ানমারের সম্মতি মিললেও বাকি ৪২৯ জনের বিষয়ে আপত্তি ছিল দেশটির। মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলটি ওই ৪২৯ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই করে গেছে।
রাজি নয় জাতিসঙ্ঘ : ওই প্রতিনিধি দলের সফরের মধ্যেই জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী সংস্থা-ইউএনএইচসিআর বলেছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরানোর বিষয়ে ইউএনএইচসিআরের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বর্তমান অবস্থা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের টেকসই প্রত্যাবাসনে সহায়ক নয়।
ইউএনএইচসিআর বলেছে, জেনেশুনে নেয়া সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে স্ভূমিতে ফেরার অধিকার আছে প্রত্যেক শরণার্থীর, কিন্তু কাউকেই জোর করা যাবে না। ‘টেকসই প্রত্যাবাসনের’ বিষয়ে বাংলাদেশের আন্তরিকতার কথাও বলা হয়েছে জাতিসঙ্ঘ সংস্থাটির বিবৃতিতে। রোহিঙ্গারা যাতে বুঝেশুনে নিজ দেশে ফেরার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সেক্ষেত্রে যে কোনো আলোচনা ও সংলাপের বিষয়ে যেকোনো পক্ষকে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে ইউএনএইচসিআর।
এদিকে রোহিঙ্গা ফেরাতে মিয়ানমার সরকারের প্রস্তাবিত পাইলট প্রকল্পে বাংলাদেশকে সাড়া না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সংস্থাটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের উচিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা স্থগিত করা।
রোহিঙ্গারা এইচআরডব্লিউকে জানিয়েছে, সাক্ষাৎকার কাদের সাথে হবে কিংবা কোন দেশে প্রত্যাবাসন করা হবে, এসব বিষয়ে প্রথমে তাদের সঠিক তথ্য দেয়া হয়নি। তৃতীয় কোনো দেশে প্রত্যাবাসন করা হবে বলেও ভুল বোঝানো হয়েছে অনেককে।
এইচআরডব্লিউর দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেন, রোহিঙ্গারা তখনই নিরাপদে ফিরতে পারবে, যখন দেশটিতে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালায় মিয়ানমার সামরিক বাহিনী। ফলে ৭ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা আরো ক্ষীণ হয়েছে। কারণ গণহত্যায় নেতৃত্ব দেয়া সামরিক নেতারাই এখন ক্ষমতায়। গত পাঁচ বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।