ঢাকা , মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

রমজানে চাপে থাকবে ভোক্তা

  • সূর্যোদয় ডেস্ক:
  • আপডেট সময় ১০:০৩:৫৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৩
  • ১১২১ বার পড়া হয়েছে

আগামী মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হচ্ছে রমজান মাস। পবিত্র এ মাসকে কেন্দ্র করে ভোজ্যতেল, আটা, ময়দা, ডাল, ছোলা, চিনি, পেঁয়াজ, খেজুরের মতো অনেক ভোগ্যপণ্যের চাহিদা আগেভাগেই কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এসব পণ্যের বেশিরভাগই আমদানিনির্ভর। তাই আমদানিও অনেক বৃদ্ধি পায়। এ বছর ডলার সংকট ও এলসি (ঋণপত্র) খোলায় নানা জটিলতার কারণে এসব পণ্য আমদানির পরিমাণ অনেক কমেছে।

এদিকে ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে আমদানিকৃত পণ্যের দাম গত রমজানের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি হবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। একেই তো জোগান কম হওয়ায় দাম হবে ঊর্ধ্বমুখী। তদুপরি ৩০ শতাংশ বেশি অর্থ ব্যয়ে আমদানি করতে হচ্ছে। ফলে রমজানে নিত্যপণ্য ক্রয়ে এবার অনেক বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হবে সাধারণ ভোক্তাদের। এককথায়, আসছে রমজানে নিত্যপণ্যের অতিরিক্ত মূল্যের কারণে বাড়তি চাপে থাকতে হবে ভোক্তাদের।

ভোক্তার ওপর চাপ কমাতে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যে শুল্ক কমানোর সুপারিশ করেছে ট্যারিফ কমিশন। অন্যদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, আসন্ন রমজান মাসে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে একসঙ্গে পুরো মাসের পণ্য না কেনার জন্য। আহ্বানকালে তিনি বলেন, রোজা শুরু হওয়ার প্রথম সাত দিন পণ্য কেনায় যে উপচেপড়া ভিড় থাকে, তা দরকার নেই। সবাই ভাবে এক মাসের পণ্য কিনবেন, তারও দরকার নেই। কারণ, একসঙ্গে সবাই পণ্যক্রয় করলে বাজারে একটা কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়। বিক্রেতারা এটাকে সুযোগ মনে করে দাম বাড়িয়ে দেন। তাই একসঙ্গে পণ্যক্রয় থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে।

জানা গেছে, ডলার সংকটের কারণে বিভিন্ন ব্যাংক শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খুলতে পারছে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রমজানের প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য আমদানি। আমদানির মূল্য ডলারে পরিশোধ করতে না পারায় বন্দরে পণ্য খালাস আটকে যাচ্ছে। সময়মতো পণ্য খালাস করতে না পারায় জাহাজ ভাড়ায় বাড়তি যে অর্থ গুনতে হচ্ছে সেটি পণ্যের দামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভোক্তার ঘাড়েই চাপবে বলে

ধারণা করা হচ্ছে। অপরদিকে বিদ্যুৎ ও শিল্প গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতেও দুশ্চিন্তা বেড়েছে। এতে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে যা ঘুরেফিরে ভোক্তার কাঁধেই এসে পড়বে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি মাসে ভোজ্যতেলের চাহিদা দেড় লাখ টন, যেখানে রমজানে এই চাহিদা গিয়ে দাঁড়ায় তিন লাখ টনে। একইভাবে চিনির মাসিক চাহিদা দেড় লাখ টন থেকে বেড়ে তিন লাখ টনে গিয়ে দাঁড়ায়। মসুর ডালের মাসিক চাহিদা ৪০ হাজার টন থেকে বেড়ে ১ লাখ টন, পেঁয়াজের চাহিদা ২ লাখ টন থেকে বেড়ে ৪ লাখ টন, রমজানে ছোলার চাহিদা ১ লাখ টন এবং খেজুরের চাহিদা ৫ হাজার টন থেকে বেড়ে ৫০ হাজার টনে পৌঁছে।

বাড়তি এ চাহিদার জোগান দিতে কয়েক মাস আগে থেকেই আমদানি বাড়িয়ে দেন এসব পণ্যের আমদানিকারকরা। কিন্তু দেশের রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে আমদানিতে নানা শর্তারোপের ফলে এবার আমদানির পরিমাণ ব্যাপক কমছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত) আমদানি এলসি খোলা প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার কমেছে। জুনে এলসি খোলা হয়েছে ৮ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার এবং জুলাইয়ে খোলা হয়েছে ৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার। অক্টোবরে ৪ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন, নভেম্বরে ৪ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন এবং ডিসেম্বরে ৪ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে।

পণ্য আমদানিকারকরা বলছেন, চলমান ডলার সংকটে আমদানি বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে না। এলসি খোলায় ব্যাংকগুলো অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। পণ্য আমদানিতে প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যাংকে জমা রাখার শর্তে শতভাগ মার্জিনেও এলসি খুলতে পারা যাচ্ছে না। এমনকি কয়েক মাস আগের খোলা এলসিতেও সময়মতো ডলারে বিল পরিশোধ করতে না পারায় পণ্য খালাস বিলম্বিত হচ্ছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে পণ্যের বিপরীতে আমদানি ব্যয় বেশি হচ্ছে।

রোজার পণ্যের আমদানি বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠক করে ডলারের জোগান বৃদ্ধির পরামর্শ দিলেও এলসি খোলা বাড়েনি, উল্টো কমছে। এমন পরিস্থিতিতে রোজার পণ্য আমদানির বিষয়টি ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে অনলাইনে বিশেষভাবে তদারকি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ট্রেজারিপ্রধান ও ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারকদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছে। ওই বৈঠকেও ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলা বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যমান ডলার সংকট এবং এলসি খোলায় সমস্যা সমাধান না হলে আসন্ন রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখা অসম্ভব হবে। সাধারণ সময়ে রমজান মাসকে সামনে রেখে এমনিতেই ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম অতিরিক্ত বাড়িয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা থাকে। এবার ডলার সংকট এবং এলসি সমস্যায় আমদানি কমে যাওয়ায় বাজারে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির অজুহাত তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে এবার রোজায় নিত্যপণ্যের দাম বাড়তি থাকবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনও মনে করছে, ডলারের দাম বাড়ার কারণে আমদানি করা ভোগ্যপণ্যের দাম গত রমজানের তুলনায় এবার ৩০ শতাংশ বেশি হবে। ভোক্তার ওপর চাপ কমাতে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যে শুল্ক কমানোর সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সদস্য শাহ মো. আবু রায়হান আলবেরুনী আমাদের সময়কে বলেন, আগামী রমজানে বাজার অর্থনীতির তুলনায় পণ্যমূল্য কিছুটা বাড়বে। তবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই থাকবে বলে আশা করছি।

এদিকে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আগে থেকেই আটা, ময়দা, তেল, ডাল, চিনি, দুধ, বিদেশি ফলসহ অনেক পণ্যই সীমিত ও স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে রয়েছে। সয়াবিন তেলের দামে অনেক আগে থেকেই আগুন লেগেছে। বেড়েছে আটা-ময়দার দামও। আমনের নতুন চাল বাজারে উঠলেও দামে স্বস্তি নেই। ডালের দামও অনেক বাড়তি। আগে থেকে বাড়ন্ত চিনির বাজারেও নতুন করে দাম বাড়ছে। আমদানি কমার অজুহাতে এখনই বাড়তে শুরু করেছে খেজুরসহ বিদেশি ফলের দামও। অপরদিকে পোল্ট্রিফিডের দাম বাড়ায় বেড়েছে মুরগি ও ডিমের দামও। সামান্য সবজি কিনে খেতেও অঙ্ক কষতে হচ্ছে নিম্নআয়ের পরিবারগুলোকে। বাজারে মূল্যস্ফীতির চাপে খেই হারিয়ে ফেলছে মধ্যবিত্তরাও।

সম্প্রতি অর্থ বিভাগের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখীর কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী তেল, গ্যাস, বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য, গম, ভোজ্যতেলসহ প্রধান খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পায়। ফলে দেশে আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যায়। সিএন্ডএফের তথ্যমতে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিদেশে থেকে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৯০ কোটি মার্কিন ডলার। এটি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি।

এমন পরিস্থিতিতে রমজান মাস কেন্দ্র করে নিত্যপণ্যের দাম আরও বাড়লে তা সাধারণ মানুষের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলবে বলে মনে করছেন ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ডলার সংকটের কারণে আমদানি ব্যাহত হচ্ছে ঠিক। তার ওপর বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ায় পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে, যা ঘুরেফিরে ভোক্তার ঘাড়েই পড়বে। তবে রমজানে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও বেশকিছু পণ্যের শুল্ক কমানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) অনুরোধ করেছে। পণ্যের সরবরাহ চেইন স্বাভাবিক পর্যায়ে ধরে রাখতে পারলে আমরা আশা করি, রমজানে দামে অস্থিরতা দেখা দেবে না।

তিনি আরও বলেন, রমজান ত্যাগের মাস, ভোগের নয়। সুতরাং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আশা করব, এমন কঠিন সময়ে তারাও সহযোগিতা করবেন। অতিরিক্ত মুনাফার জন্য পণ্যের দাম অতিরিক্ত বাড়াবেন না।

সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ভোক্তা অধিদপ্তরের এক মতবিনিময়সভায় এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি আমিন হেলালী বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করলে তাদের আইনের আওতায় শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো রকম কারসাজি না করে ব্যবসায়ীদের সঠিক মূল্যে ভোক্তার কাছে পণ্য বিক্রি করতে হবে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, কিছু পণ্য হয়তো আমদানিনির্ভর, ডলারের দাম বৃদ্ধি অনুসারে দাম বাড়তে পারে। কিন্তু ডলারের বাজারের তুলনায় পণ্যের দাম বেশি বাড়ানো হচ্ছে। অপরদিকে রোজায় ফলের দামও অতিরিক্ত বাড়ানো হয়। আমরা বলছি, অতি বিলাসবহুল ফল আমদানি আপাতত বন্ধ রাখা যেতে পারে। আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বিদ্যমান শুল্ক কাঠামো পরিবর্তন করার সুপারিশ করা হয়েছে। আসন্ন রমজানে ফলের বাজার স্থিতিশীল রাখতে চায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থানে থাকব।

এদিকে রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ৮ পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। রমজানে বাড়তি চাহিদাকেন্দ্রিক অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিশেষ করে চিনির এলসি তুলনামূলক কম হয়েছে, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে সরকার নির্ধারিত মূল্যে চিনি বিক্রি হচ্ছে না; তাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজার দরের সঙ্গে স্থানীয় বাজার দরের যথাযথ সমন্বয় সব পণ্যে হচ্ছে না। তাই এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা, রমজান পর্যন্ত অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের এলসি খুলতে অগ্রাধিকার দেয়া ও চিনি আমদানিতে শুল্ক হ্রাস করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া অভিন্ন মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক কোম্পানি অনুযায়ী আলাদা আলাদা মূল্য নির্ধারণ করা, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিতকরণে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং পেঁয়াজ ও মসুর ডালের স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধিসহ উৎপাদনের যথাযথ হিসাব সংরক্ষণ করার সুপারিশ করা হয়েছে।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

রমজানে চাপে থাকবে ভোক্তা

আপডেট সময় ১০:০৩:৫৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৩

আগামী মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হচ্ছে রমজান মাস। পবিত্র এ মাসকে কেন্দ্র করে ভোজ্যতেল, আটা, ময়দা, ডাল, ছোলা, চিনি, পেঁয়াজ, খেজুরের মতো অনেক ভোগ্যপণ্যের চাহিদা আগেভাগেই কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এসব পণ্যের বেশিরভাগই আমদানিনির্ভর। তাই আমদানিও অনেক বৃদ্ধি পায়। এ বছর ডলার সংকট ও এলসি (ঋণপত্র) খোলায় নানা জটিলতার কারণে এসব পণ্য আমদানির পরিমাণ অনেক কমেছে।

এদিকে ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে আমদানিকৃত পণ্যের দাম গত রমজানের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি হবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। একেই তো জোগান কম হওয়ায় দাম হবে ঊর্ধ্বমুখী। তদুপরি ৩০ শতাংশ বেশি অর্থ ব্যয়ে আমদানি করতে হচ্ছে। ফলে রমজানে নিত্যপণ্য ক্রয়ে এবার অনেক বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হবে সাধারণ ভোক্তাদের। এককথায়, আসছে রমজানে নিত্যপণ্যের অতিরিক্ত মূল্যের কারণে বাড়তি চাপে থাকতে হবে ভোক্তাদের।

ভোক্তার ওপর চাপ কমাতে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যে শুল্ক কমানোর সুপারিশ করেছে ট্যারিফ কমিশন। অন্যদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, আসন্ন রমজান মাসে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে একসঙ্গে পুরো মাসের পণ্য না কেনার জন্য। আহ্বানকালে তিনি বলেন, রোজা শুরু হওয়ার প্রথম সাত দিন পণ্য কেনায় যে উপচেপড়া ভিড় থাকে, তা দরকার নেই। সবাই ভাবে এক মাসের পণ্য কিনবেন, তারও দরকার নেই। কারণ, একসঙ্গে সবাই পণ্যক্রয় করলে বাজারে একটা কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়। বিক্রেতারা এটাকে সুযোগ মনে করে দাম বাড়িয়ে দেন। তাই একসঙ্গে পণ্যক্রয় থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে।

জানা গেছে, ডলার সংকটের কারণে বিভিন্ন ব্যাংক শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি খুলতে পারছে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রমজানের প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য আমদানি। আমদানির মূল্য ডলারে পরিশোধ করতে না পারায় বন্দরে পণ্য খালাস আটকে যাচ্ছে। সময়মতো পণ্য খালাস করতে না পারায় জাহাজ ভাড়ায় বাড়তি যে অর্থ গুনতে হচ্ছে সেটি পণ্যের দামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভোক্তার ঘাড়েই চাপবে বলে

ধারণা করা হচ্ছে। অপরদিকে বিদ্যুৎ ও শিল্প গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতেও দুশ্চিন্তা বেড়েছে। এতে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে যা ঘুরেফিরে ভোক্তার কাঁধেই এসে পড়বে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি মাসে ভোজ্যতেলের চাহিদা দেড় লাখ টন, যেখানে রমজানে এই চাহিদা গিয়ে দাঁড়ায় তিন লাখ টনে। একইভাবে চিনির মাসিক চাহিদা দেড় লাখ টন থেকে বেড়ে তিন লাখ টনে গিয়ে দাঁড়ায়। মসুর ডালের মাসিক চাহিদা ৪০ হাজার টন থেকে বেড়ে ১ লাখ টন, পেঁয়াজের চাহিদা ২ লাখ টন থেকে বেড়ে ৪ লাখ টন, রমজানে ছোলার চাহিদা ১ লাখ টন এবং খেজুরের চাহিদা ৫ হাজার টন থেকে বেড়ে ৫০ হাজার টনে পৌঁছে।

বাড়তি এ চাহিদার জোগান দিতে কয়েক মাস আগে থেকেই আমদানি বাড়িয়ে দেন এসব পণ্যের আমদানিকারকরা। কিন্তু দেশের রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে আমদানিতে নানা শর্তারোপের ফলে এবার আমদানির পরিমাণ ব্যাপক কমছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত) আমদানি এলসি খোলা প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার কমেছে। জুনে এলসি খোলা হয়েছে ৮ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার এবং জুলাইয়ে খোলা হয়েছে ৬ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার। অক্টোবরে ৪ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন, নভেম্বরে ৪ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন এবং ডিসেম্বরে ৪ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে।

পণ্য আমদানিকারকরা বলছেন, চলমান ডলার সংকটে আমদানি বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে না। এলসি খোলায় ব্যাংকগুলো অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। পণ্য আমদানিতে প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যাংকে জমা রাখার শর্তে শতভাগ মার্জিনেও এলসি খুলতে পারা যাচ্ছে না। এমনকি কয়েক মাস আগের খোলা এলসিতেও সময়মতো ডলারে বিল পরিশোধ করতে না পারায় পণ্য খালাস বিলম্বিত হচ্ছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে পণ্যের বিপরীতে আমদানি ব্যয় বেশি হচ্ছে।

রোজার পণ্যের আমদানি বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠক করে ডলারের জোগান বৃদ্ধির পরামর্শ দিলেও এলসি খোলা বাড়েনি, উল্টো কমছে। এমন পরিস্থিতিতে রোজার পণ্য আমদানির বিষয়টি ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে অনলাইনে বিশেষভাবে তদারকি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ট্রেজারিপ্রধান ও ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারকদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছে। ওই বৈঠকেও ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলা বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যমান ডলার সংকট এবং এলসি খোলায় সমস্যা সমাধান না হলে আসন্ন রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখা অসম্ভব হবে। সাধারণ সময়ে রমজান মাসকে সামনে রেখে এমনিতেই ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম অতিরিক্ত বাড়িয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা থাকে। এবার ডলার সংকট এবং এলসি সমস্যায় আমদানি কমে যাওয়ায় বাজারে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির অজুহাত তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে এবার রোজায় নিত্যপণ্যের দাম বাড়তি থাকবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনও মনে করছে, ডলারের দাম বাড়ার কারণে আমদানি করা ভোগ্যপণ্যের দাম গত রমজানের তুলনায় এবার ৩০ শতাংশ বেশি হবে। ভোক্তার ওপর চাপ কমাতে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যে শুল্ক কমানোর সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সদস্য শাহ মো. আবু রায়হান আলবেরুনী আমাদের সময়কে বলেন, আগামী রমজানে বাজার অর্থনীতির তুলনায় পণ্যমূল্য কিছুটা বাড়বে। তবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেই থাকবে বলে আশা করছি।

এদিকে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আগে থেকেই আটা, ময়দা, তেল, ডাল, চিনি, দুধ, বিদেশি ফলসহ অনেক পণ্যই সীমিত ও স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে রয়েছে। সয়াবিন তেলের দামে অনেক আগে থেকেই আগুন লেগেছে। বেড়েছে আটা-ময়দার দামও। আমনের নতুন চাল বাজারে উঠলেও দামে স্বস্তি নেই। ডালের দামও অনেক বাড়তি। আগে থেকে বাড়ন্ত চিনির বাজারেও নতুন করে দাম বাড়ছে। আমদানি কমার অজুহাতে এখনই বাড়তে শুরু করেছে খেজুরসহ বিদেশি ফলের দামও। অপরদিকে পোল্ট্রিফিডের দাম বাড়ায় বেড়েছে মুরগি ও ডিমের দামও। সামান্য সবজি কিনে খেতেও অঙ্ক কষতে হচ্ছে নিম্নআয়ের পরিবারগুলোকে। বাজারে মূল্যস্ফীতির চাপে খেই হারিয়ে ফেলছে মধ্যবিত্তরাও।

সম্প্রতি অর্থ বিভাগের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখীর কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী তেল, গ্যাস, বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য, গম, ভোজ্যতেলসহ প্রধান খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পায়। ফলে দেশে আমদানি ব্যয়ও বেড়ে যায়। সিএন্ডএফের তথ্যমতে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিদেশে থেকে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৯০ কোটি মার্কিন ডলার। এটি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি।

এমন পরিস্থিতিতে রমজান মাস কেন্দ্র করে নিত্যপণ্যের দাম আরও বাড়লে তা সাধারণ মানুষের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলবে বলে মনে করছেন ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ডলার সংকটের কারণে আমদানি ব্যাহত হচ্ছে ঠিক। তার ওপর বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ায় পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে, যা ঘুরেফিরে ভোক্তার ঘাড়েই পড়বে। তবে রমজানে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও বেশকিছু পণ্যের শুল্ক কমানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) অনুরোধ করেছে। পণ্যের সরবরাহ চেইন স্বাভাবিক পর্যায়ে ধরে রাখতে পারলে আমরা আশা করি, রমজানে দামে অস্থিরতা দেখা দেবে না।

তিনি আরও বলেন, রমজান ত্যাগের মাস, ভোগের নয়। সুতরাং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আশা করব, এমন কঠিন সময়ে তারাও সহযোগিতা করবেন। অতিরিক্ত মুনাফার জন্য পণ্যের দাম অতিরিক্ত বাড়াবেন না।

সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ভোক্তা অধিদপ্তরের এক মতবিনিময়সভায় এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি আমিন হেলালী বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করলে তাদের আইনের আওতায় শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো রকম কারসাজি না করে ব্যবসায়ীদের সঠিক মূল্যে ভোক্তার কাছে পণ্য বিক্রি করতে হবে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, কিছু পণ্য হয়তো আমদানিনির্ভর, ডলারের দাম বৃদ্ধি অনুসারে দাম বাড়তে পারে। কিন্তু ডলারের বাজারের তুলনায় পণ্যের দাম বেশি বাড়ানো হচ্ছে। অপরদিকে রোজায় ফলের দামও অতিরিক্ত বাড়ানো হয়। আমরা বলছি, অতি বিলাসবহুল ফল আমদানি আপাতত বন্ধ রাখা যেতে পারে। আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বিদ্যমান শুল্ক কাঠামো পরিবর্তন করার সুপারিশ করা হয়েছে। আসন্ন রমজানে ফলের বাজার স্থিতিশীল রাখতে চায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থানে থাকব।

এদিকে রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে ৮ পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। রমজানে বাড়তি চাহিদাকেন্দ্রিক অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিশেষ করে চিনির এলসি তুলনামূলক কম হয়েছে, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে সরকার নির্ধারিত মূল্যে চিনি বিক্রি হচ্ছে না; তাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুপারিশ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজার দরের সঙ্গে স্থানীয় বাজার দরের যথাযথ সমন্বয় সব পণ্যে হচ্ছে না। তাই এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা, রমজান পর্যন্ত অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের এলসি খুলতে অগ্রাধিকার দেয়া ও চিনি আমদানিতে শুল্ক হ্রাস করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া অভিন্ন মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক কোম্পানি অনুযায়ী আলাদা আলাদা মূল্য নির্ধারণ করা, অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিতকরণে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং পেঁয়াজ ও মসুর ডালের স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধিসহ উৎপাদনের যথাযথ হিসাব সংরক্ষণ করার সুপারিশ করা হয়েছে।