রহমত, বরকত, নেয়ামত ও ক্ষমার মাস রমজানুল মোবারক। আল্লাহ তায়ালার কাছে এ মাসের মর্যাদাই অনন্য। রমজান ও কুরআনুল কারিমের সাথে রয়েছে গভীর সম্পর্ক। এ বরকতময় মাসে আল্লাহ তায়ালা মহাগ্রন্থ কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। মহানবী সা: নিজেও এ মাসে জিবরাঈল আ:-কে কুরআন মাজিদ শোনাতেন আর জিবরাঈল শোনাতেন নবীজিকে। এ মাসে দয়াময় আল্লাহ হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ মহিমান্বিত রজনী শবে কদর দান করেছেন। মুমিন-মুসলমানের জন্য যা বিরাট নেয়ামত।
এ মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বোঝা যায় নবীজি সা:-এর এ হাদিসে-‘যখন রমজান আগমন করে তখন আসমানের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানকে শিকলে আবদ্ধ করে রাখা হয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩২৭৭) কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, রমজানে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৭৯১)
রমজানের ফজিলত এবং তার দাবি হলো, আল্লাহ তায়ালা এ মোবারক মাসকে বিশেষভাবে নিজের দিকে সম্বন্ধ করেছেন। এ বরকতময় মাস অন্যান্য মাস থেকে আলাদা এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এ মাসের রোজা আল্লাহ তায়ালা ফরজ করেছেন এবং রাতের তারাবির নামাজকে নফল ইবাদত সাব্যস্থ করেছেন। নফল ইবাদত কিন্তু সওয়াব অনেক। নবীজি সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমান ও সওয়াবের আশায় কিয়ামুল লাইল (তারাবির নামাজ) করবে তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৭)।
নামাজ ইসলাম ধর্মের মৌলিক স্তম্ভ। কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম নামাজের হিসাব নেয়া হবে। নামাজের হিসাব সহজ হলে বাকি সব সহজ। আর এ হিসাবে আটকে গেল সবই হয়ে যাবে তার জন্য কঠিন।
একমাত্র নামাজের মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়। আবু হুরাইরা রা: থেকে বর্ণিত হাদিসে নবী সা: বলেছেন, ‘বান্দা তার প্রভুর সবচেয়ে বেশি নৈকট্য অর্জন করে সেজদা অবস্থায়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৮২)
মোটকথা, আল্লাহ তায়ালার বিধিবিধানগুলো পালন করলে এবং বিশেষ করে নামাজের গুরুত্ব দিলে আল্লাহর সাথে বান্দার অভূতপূর্ব সম্পর্ক গড়ে উঠে। তাই এ ফজিলতপূর্ণ মাসে সর্বপ্রথম ফরজ নামাজের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে আদায় করা। আজান হলে দেরি না করে মসজিদে রওয়ানা হয়ে যাওয়া। নামাজে য্ত্নবান লোকদের প্রশংসা করেছেন মহান আল্লাহ। পবিত্র কুরআনে তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘ওইসব মুমিন সফলকাম, যারা তাদের নামাজে বিনম্র।’ (সুরা মুমিন, আয়াত : ১-২) তাছাড়া এ মাসে একেকটা ফরজ নামাজের সওয়াব হবে ৭০টা ফরজ নামাজের সমান।
শুধু ফরজ নয় আমল সংগ্রহের এ মাসে নফল নামাজের প্রতিও গুরুত্ব দিতে হবে। মহানবী সা: নফল নামাজের জন্য খুব উৎসাহিত করেছেন। এতে রয়েছে অনেক উপকারিতা। এতে ফরজের ঘাটতি পূরণ হয়। ফরজ আদায়ে আরো সতর্ক থাকা যায়। আল্লাহর পক্ষ থেকে অঢেল নেকি অর্জন করা যায়। সাহাবি বেলাল রা: সবসময় অজুর পর কিছু নফল নামাজ পড়তেন। এ কারণে তিনি অর্জন করেছিলেন বিশাল মর্যাদা। আবু হুরাইরা রা: থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, ‘নবী সা: বেলালকে লক্ষ্য করে বললেন, হে বেলাল, ইসলাম গ্রহণ করার পর তুমি সবচেয়ে সুন্দর আমল কি করেছ বলো, জান্নাতে আমার সামনে তোমার জুতোর আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। বেলাল বলল, আমি তেমন কোনো ভালো আমল করিনি, তবে দিনে বা রাতে যখনই পবিত্রতা অর্জন করেছি ওই পবিত্রতা দিয়ে সাধ্যমতো কিছু নামাজ পড়ার চেষ্টা করেছি।’ (বুখারি, হাদিস : ১১৪৯)।
সারাবছর তাহাজ্জুদ পড়ার অভ্যাস না হলেও এখন থেকে তা আরম্ভ করা যায়। সাহরি খাওয়ার জন্য যেহেতু উঠতেই হয় সে হিসেবে কয়েক রাকাত তাহাজ্জুদের জন্য সময় রাখা কোনো কঠিন বিষয় নয়। অল্প পরিশ্রমের মাধ্যমে লাভ করা যাবে বেশি প্রতিদান। একেক রাকাত নামাজের সওয়াব হবে সত্তর রাকাতের সমান। এতো লোভনীয় আমল থেকে কি বিরত থাকা যায়!
মহানবীর সাহাবায়ে কেরাম তো সারাবছর নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়তেন। রাতের একভাগ আল্লাহর ইবাদতে অতিবাহিত করতেন। অবশ্য রমজানে প্রায় পুরো রাত নফল ইবাদতে ব্যয় করতেন। নফল নামাজে দীর্ঘ তেলাওয়াত করতেন। এক তৃতীয়াংশ, অর্ধেক কিংবা রাতের বেশিরভাগ সময় তেলাওয়াতে কুরআন, নামাজ, জিকির-আজকার ও ইস্তিগফারে ব্যয় করতেন। আর রমজানের শেষ দশকের ইবাদতে তাদের আগ্রহ-উদ্দীপনা অনেক বেড়ে যেত। নিজেও ইবাদতে থাকতেন এবং পরিবার-পরিজনকেও রাতে জাগিয়ে দিতেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা:-এর ব্যাপারে বলা হয়েছে তিনি শেষ দশকে পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের এমন অনেক লোক আছে যারা আমলের এ বসন্তকালেও ফরজ নামাজের প্রতি গুরুত্ব দেয় না। গভীর রাত জাগার কারণে ফজর ছুটে। জোহর যায় ঘুমে। আসর চলে যায় বাজারে ইফতারি কেনাকাটায়। আর এশা ও তারাবিহ ছুটে যায় হোটেল-রেস্টুরেন্ট ও মার্কেটে। এ অবহেলা ও উদাসীনতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। সারাবছর নামাজ না পড়ে থাকলে এখন থেকে আরম্ভ করি এবং এ অভ্যাস বছরজুড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করি। অতীতে যে নামাজগুলো কাজা হয়েছে নিয়ম করে সময়ে সময়ে তা আদায় করতে থাকি। ইনশাআল্লাহ আমাদের এ ত্যাগ-কুরবানির প্রতিদান আল্লাহ অবশ্যই দান করবেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে এ রমজানে পাক্কা নামাজি হয়ে যাওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক :
- নূর মুহাম্মদ রাহমানী
শিক্ষাসচিব ও মুহাদ্দিস জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম বাগে জান্নাত, চাষাঢ়া, নারায়ণগঞ্জ