মুসলমানদের পবিত্র ও শ্রেষ্ঠতম মাস রমজানুল মুবারক। গুরুত্ব ও বরকতের দিক দিয়ে রমজান মাস অন্য মাস থেকে ভিন্ন। রোজাকে রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের দিকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এবং একে আত্মিক, নৈতিক ও চারিত্রিক কল্যাণের ধারক বানানোর নিমিত্তে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রোজাকে এ উম্মতের ওপর ফরজ করেছেন। এরশাদ হয়েছে- ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হলো যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে দেয়া হয়েছিল। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে সক্ষম হও।’ (সূরা আল বাকারাহ-১৮৩)
আরো ইরশাদ হয়েছে- ‘রমজান মাস এতে মানুষের হেদায়াত এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্য ও অসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসের রোজা পালন করে।’ (সূরা বাকারাহ-১৮৫) উপরোক্ত আয়াত নাজিল হওয়ার মাধ্যমে ইসলাম অন্যান্য ইবাদতের মতো রোজার মধ্যে বেশ কিছু মৌলিক সংস্কার সাধন করেছে। সমাজের সর্বস্তরে এর সুদূরপ্রসারী সংস্কারের প্রভাব সুস্পষ্ট।
রোজার ব্যাপারে ইসলামের প্রধানতম সংস্কার হলো, ধারণাগত পরিবর্তন। অর্থাৎ ইহুদিদের দৃষ্টিতে রোজা ছিল বেদনা ও শোকের প্রতীক। পক্ষান্তরে ইসলামের দৃষ্টিতে রোজা হলো, এমন এক সার্বজনীন ইবাদত যা রোজাদারকে দান করে সজীবতা, হৃদয়ের পবিত্রতা ও চিন্তাধারার বিশুদ্ধতা। এ রোজার মাধ্যমে বান্দা লাভ করে এক রুহানি তৃপ্তি, নতুন উদ্যম ও প্রেরণা। রোজার ওপর আল্লাহ তায়ালা যে পুরস্কারের কথা ঘোষণা করেছেন তা এক মুহূর্তে মানুষকে করে তুলে ভোগে বিতৃষ্ণ, ত্যাগে উদ্বুদ্ধ এবং আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘রোজা আমার জন্য এবং আমি স্বয়ং এর পুরস্কার দান করব।’ অপর এক হাদিসে আছে, রাসূল সা: বলেছেন, ‘রোজাদার ব্যক্তি দু’টি আনন্দ লাভ করবে। একটি আনন্দ হলো ইফতারের মুহূর্ত আর অপরটি হবে তার রবের সাথে সাক্ষাতের মুহূর্তে।’
রোজার প্রকৃত গুরুত্ব এবং তাৎপর্য হচ্ছে তাকওয়া ও হৃদয়ের পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ তাকওয়া হচ্ছে হৃদয়ের এক বিশেষ অবস্থার নাম। ওই অবস্থা অর্জিত হওয়ার পর মানুষের অন্তর আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং পাপাচারের প্রতি আকর্ষণ দিন দিন কমতে থাকে। এ কারণেই ইসলাম রোজার জাহিরি বিধিবিধানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করার পাশাপাশি নিম্নোক্ত বিষয়াদির প্রতিও বিশেষ তাকিদ করেছে।
রোজা যাতে নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত না হয় এবং তা যেন একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই পালন করা হয়। এ জন্য রাসূল সা: রোজার সাথে ঈমান ও ইহতিসাব তথা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং উত্তম বিনিময় লাভের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি ঈমানসহ নেকি হাসিলের আশায় রমজানের রোজা রাখবে তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’
বস্তুত যে রোজা তাকওয়া তথা আল্লাহর ভয় ও হৃদয়ের পবিত্রতাশূন্য সে রোজা যেন প্রকৃত অর্থে কোনো রোজাই নয়। আল্লাহর কাছে এরূপ রোজার গুরুত্ব নেই। হাদিসে আছে- হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- নবী করিম সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্য বলা ও তদানুযায়ী আমল করা বন্ধ করেনি তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ (আলমগীরী, প্রথম খণ্ড)। হজরত আবু উবায়দা রা: থেকে বর্ণিত- নবী করিম সা: বলেন, ‘রোজা ঢালস্বরূপ, যদি না সে নিজেই তা বিদীর্ণ করে দেয়। মিথ্যা কথা ও গিবত দ্বারা রোজার বরকত নষ্ট হয়ে যায়।’
রোজাকে প্রাণবন্ত করতে হলে যেমনিভাবে জিহ্বার হিফাজত জরুরি অনুরূপভাবে চোখ, কান এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের হিফাজতও তেমনি জরুরি। হারাম জিনিস দেখা, নিষিদ্ধ কথা শোনা এবং হারাম কাজ করা ইত্যাদি থেকে নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে অবশ্যই বিরত রাখতে হবে। তবেই রোজার স্বাদ অনুভূত হবে এবং রোজাও প্রাণবন্ত হবে।
রোজার কাক্সিক্ষত ফায়দা অর্জন করতে হলে নিষিদ্ধ কাজগুলো পরিত্যাগ করার সাথে সাথে অন্যান্য নেক আমলের প্রতিও বিশেষভাবে যতœবান হতে হবে। তাই রোজাদার ব্যক্তিকে ইবাদত, তিলাওয়াত, জিকর ও তাসবিহে মগ্ন থেকে সহানুভূতি, সদয় আচরণ, দানশীলতা ও বদান্যতার মাধ্যমে পরকালীন কল্যাণ ও উত্তীর্ণের পথ প্রশস্ত করে নেয়ার প্রতি বিশেষ তাকিদ দেয়া হয়েছে।
নবী করিম সা: বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা রমজানের সিয়াম পালন করাকে ফরজ এবং রাতে তারাবিহ পড়াকে সুন্নাত সাব্যস্ত করেছেন। কোনো ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য রমজানে কোনো নফল আমল করলে সে রমজানের বাইরে একটি ফরজ আদায় করার সমান নেক লাভ করবে। আর রমজানে কোনো ফরজ আদায় করলে রমজানের বাইরে ৭০টি ফরজ আদায়ের সমান সাওয়াব লাভ করবে। বস্তুত রমজান হলো ধৈর্যের মাস এবং এ ধৈর্যের বিনিময় হচ্ছে জান্নাত। আর এ মাস মানুষের প্রতি সমবেদনা ও সহানুভূতি প্রকাশের মাস। (আলমগীরী প্রথম খণ্ড)।
এ জন্যই বলা হয়, রমজান হচ্ছে তিলাওয়াত, জিকর এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক বিশেষ মৌসুম। আত্মিক উৎকর্ষ ও পরকালীন মঙ্গল লাভের এক বেহেশতি সওগাত এই রমজান মাস।
লেখক :
- শাহ মোহাম্মাদ হাবিবুর রহমান
কলামিস্ট, প্রাক্তন সিনিয়র শিক্ষক