প্রতিটি ব্যক্তিই সফল হওয়ার স্বপ্ন দেখে। সফল হওয়ার জন্য বিভিন্ন পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করে। সফল হওয়ার ইচ্ছায় নিজের প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। সফল হওয়ার চেষ্টায় অবিরাম সাধনা চালায়। সর্ববিধ উপায়ে চেষ্টা চালায় যেন সফল হওয়া যায়। কিন্তু এর পরও মানুষ অনেক সময় ব্যর্থ হয়। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছতে সক্ষম হয় না। সফল হতে পারে না। মাঝপথেই তাকে থমকে দাঁড়াতে হয়। ভুল পথে জীবন যাপনই সফল হওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তাই কুরআন-হাদিসে সফল হওয়ার বেশ কিছু উপায় বর্ণনা করা হয়েছে। যদি কোনো ব্যক্তি সেই উপায়গুলো অবলম্বন করে, তাহলে শতভাগ সফল হবে ইনশাআল্লাহ। তাই আসুন! সফল হওয়ার কুরআন-হাদিস সমর্থিত কিছু উপায় জেনে নিই।
আল্লøাহর সন্তুষ্টি অর্জন : সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। তার আনুকূল্য ও সন্তুষ্টি পাওয়া গেলে সফলতার পথে আর কোনো বাধা থাকবে না। তাই যারা সফল হতে চায় তাদের জন্য করণীয় হলো পরাক্রমশালী আল্লাহ তায়ালাকে রাজি ও সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করা। যদি কোনো ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে রাজি ও খুশি করতে পারে, তাহলে ইহ ও পরকালে সাফল্য তার পদচুম্বন করবে! আল্লাহর সন্তুষ্টিতে মহা সফলতা রয়েছে মর্মে আল কুরআনে এসেছে- ‘আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট। তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট! এটিই মহা সফলতা’ (সূরা মায়িদা-১১৯)। অন্য একটি আয়াতে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টিকে সবচেয়ে বড় বিষয় আখ্যায়িত করে বলা হয়েছে- ‘আল্লাহ ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কানন-কুঞ্জের, যার তলদেশে প্রবাহিত হয় প্রস্র্রবণ। তারা সেগুলোরই মধ্যে থাকবে। আর এসব কানন-কুঞ্জে থাকবে পরিচ্ছন্ন থাকার ঘর। বস্তুত এ সমুদয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি। এটিই হলো মহাসফলতা’ (সূরা তওবা-৭২)।
আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য : আল্লাহ তায়ালা ও তার রাসূল সা: যেসব কাজ করার আদেশ করেছেন সেগুলোর সবই কল্যাণকর। আর তারা যেগুলো করতে বারণ করেছেন সেগুলোর সবই অকল্যাণকর। বান্দাদের কল্যাণকামী ও স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা কোনো বান্দাকে অকল্যাণের পথ প্রদর্শন করতে পারেন না। মন্দ কোনো কাজ করার আদেশ দিতে পারেন না। অনুরূপভাবে মহানবী সা:ও উম্মাহর প্রতিটি সদস্যের কল্যাণ কামনা করেন। তিনিও অকল্যাণকর কোনো নির্দেশ দিতে পারেন না। অতএব, যারা আল্লাহ তায়ালা ও রাসূলুল্লাহ সা:-এর আনুগত্য করে তাদের নির্দেশিত পথ ও পন্থা অনুযায়ী কল্যাণের পথে চলবে তারা সফল হবে। পবিত্র কুরআনে এসেছে- ‘তিনি তোমাদের আমল-আচরণ সংশোধন করবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন। যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই মহা সাফল্য অর্জন করবে’ (সূরা আহজাব-৭১)। আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল সা:-এর আনুগত্যে সাফল্য রয়েছে মর্মে আল-কুরআনের অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, তিনি তাকে জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন, যেগুলোর তলদেশ দিয়ে স্রোতঃস্বিনী প্রবাহিত হবে। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। এ হলো বিরাট সাফল্য’ (সূরা নিসা-১৩)।
আল্লাহর পথে সংগ্রাম : এই পৃথিবীতে বহু ধর্মমত, চিন্তাধারা ও মতবাদ রয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্য ধর্ম হলো একমাত্র ইসলাম। যারা পৃথিবীর বুকে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার জন্য জান-মাল নিয়ে জিহাদ, সংগ্রাম ও লড়াই করবে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী তারা সফল হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘কিন্তু রাসূল এবং সেসব লোক যারা ঈমান এনেছে, তাঁর সাথে তারা যুদ্ধ করেছে নিজেদের জান ও মাল দিয়ে। তাদেরই জন্য নির্ধারিত রয়েছে কল্যাণসমূহ ও তারাই সফল।
আল্লাহ তাদের জন্য তৈরি করে রেখেছেন কানন-কুঞ্জ, যার তলদেশে প্রবাহিত রয়েছে প্রস্রবণ। তারা তাতে বাস করবে অনন্তকাল। এটিই হলো বিরাট সফলতা’ (সূরা তওবা : ৮৮-৮৯)। জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে লড়াই করায় সফলতা রয়েছে মর্মে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- ‘আল্লাহ ক্রয় করে নিয়েছেন মুসলমানদের থেকে তাদের জান ও মাল এই মূল্যে যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাহে অতঃপর মারে ও মরে। তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে তিনি এ সত্য প্রতিশ্রুতিতে অবিচল। আর আল্লাহর চেয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কে অধিক? সুতরাং তোমরা আনন্দিত হও সে লেনদেনের ওপর, যা তোমরা করছ তাঁর সাথে। আর এ হলো মহা সাফল্য’ (সূরা তওবা, আয়াত-১১১)।
শাহাদতবরণ করা : আল্লাহ তায়ালা মানুষকে জীবন দান করেছেন। এই জীবন আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক প্রদত্ত। যদি কোনো ব্যক্তি তার জীবনকে আল্লাহর পথে বিলিয়ে দিতে পারে, তাহলে এটি তার জন্য সফলতা বলে গণ্য। বনু আমের গোত্রের জনৈক ব্যক্তি হজরত হারাম ইবনে মিলহান রা:-কে শহীদ করে দেয়! তিনি শাহাদতবরণ করার আগে আল্লাহর কসম করে বলেছিলেন, আমি সফল হয়ে গেছি। হজরত আনাস রা: বলেন, মহানবী সা: বনু সুলাইমের ৭০ জন লোকের একটি দলকে কুরআন শিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে বনু আমিরের কাছে পাঠান। দলটি সেখানে পৌঁছলে আমার মামা হারাম ইবনু মিলহান তাদের বললেন, আমি সর্বাগ্রে বনু আমিরের কাছে যাব। যদি তারা আমাকে নিরাপত্তা দেয় আর আমি তাদের কাছে আল্লাহর রাসূল সা:-এর বাণী পৌঁছাতে পারি, (তবে তো ভালো) অন্যথায় তোমরা আমার কাছেই থাকবে। অতঃপর তিনি এগিয়ে গেলেন। কাফিররা তাকে নিরাপত্তা দিলো, কিন্তু তিনি যখন আল্লাহর রাসূল সা:-এর বাণী শোনাতে লাগলেন, সেই সময় আমির গোত্রীয়রা এক ব্যক্তিকে ইঙ্গিত করল। আর সেই ব্যক্তি তার প্রতি তীর মারল এবং তীর শরীর ভেদ করে বের হয়ে গেল। তখন তিনি বললেন, আল্লাহু আকবার, কাবার রবের কসম! আমি সফল হয়ে গেছি’ (সহিহ বুখারি-২৮০১)।
জাহান্নাম থেকে মুক্তি : যেসব লোক দোজখে যাবে তাদের দুর্ভোগের অন্ত থাকবে না। কখনো তাদেরকে দোজখের আগুনে প্রজ্বলিত হতে হবে। কখনো তাদেরকে দোজখিদের রক্ত ও পুঁজ পান করানো হবে। কখনো ফুটন্ত পানি পান করতে দেয়া হবে। কণ্টকপূর্ণ ঝাড় ব্যতীত তাদের জন্য কোনো খাবার থাকবে না। এটি তাদেরকে তৃপ্ত করবে না ও ক্ষুধায়ও উপকার করবে না। এমন দুর্দশাপূর্ণ অবস্থাসমূহে যারা নিপতিত হবে তাদের নিশ্চয়ই সফল বলা যায় না। সফল ব্যক্তি তারাই যাদের দোজখ থেকে সরিয়ে রাখা হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যাকে দোজখ থেকে দূরে রাখা হবে ও জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সে সফল হবে’ (সূরা আলে-ইমরান-১৮৫)। যে ব্যক্তিকে দোজখের শাস্তি হতে পরিত্রাণ দেয়া হবে সে সফল হবে মর্মে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- ‘যার কাছ থেকে ওই দিন এ শাস্তি সরিয়ে নেয়া হবে, তার প্রতি আল্লাহর অনুকম্পা হবে। এটিই বিরাট সাফল্য’ (সূরা আনআম-১৬)।
জান্নাত লাভ : জান্নাত আরাম-আয়েশ, ভোগ বিলাস ও সুখ শান্তির স্থান। যারা জান্নাত লাভ করবে তাদের এমন কোনো মনোবাঞ্ছা থাকবে না যা পূরণ করা হবে না। পরজীবনে বিশ্বাসী এমন কোনো ব্যক্তি নেই যে জান্নাত লাভ করার আকাক্সক্ষা পোষণ করে না। তবে আকাক্সক্ষা পোষণ করলেই জান্নাত পাওয়া যাবে না। এর জন্য ঈমান আনয়ন ও সৎকর্ম সম্পাদন করে যেতে হবে। ঈমান আনয়ন ও সৎকর্ম সম্পাদন করার মাধ্যমে যারা জান্নাত লাভ করবে তারাই সফল মানুষ। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যার তলদেশে প্রবাহিত হয় নির্ঝরিণীসমূহ। এটিই মহাসাফল্য’ (সূরা বুরুজ-১১)। জান্নাতের অধিবাসীরা সফল। তারা জাহান্নামের অধিবাসীদের মতো বিফল নয়। জান্নাতের অধিবাসীদের সফল বলে আখ্যা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘জাহান্নামের অধিবাসী এবং জান্নাতের অধিবাসী সমান হতে পারে না। যারা জান্নাতের অধিবাসী, তারাই সফলকাম’ (সূরা হাশর-২০)।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া, ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা