ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

১৫৮ কোটি টাকা নিয়ে দুবাই পালিয়েছে এমডি

  • সূর্যোদয় ডেস্ক:
  • আপডেট সময় ০১:০৫:০২ অপরাহ্ন, রবিবার, ১ জানুয়ারী ২০২৩
  • ১৩৭৭ বার পড়া হয়েছে

শেয়ারবাজারে চার মিউচুয়াল ফান্ডের ১৫৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করেছে ইউনিভার্সাল ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশন (ইউএফএস) নামের একটি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি।

এই টাকা নিয়ে ১৩ অক্টোবর দুবাই পাড়ি জমিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ হামজা আলমগীর। বর্তমানে তিনি সিঙ্গাপুরে রয়েছেন। ২০১৮ সাল থেকে তহবিল সরানোর প্রক্রিয়া শুরু করে চক্রটি।

এক্ষেত্রে ব্যাংকের প্রতিবেদন জালিয়াতি এবং ভুয়া এফডিআর (ফিক্সড ডিপোজিড রেট) দেখিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) অন্ধকারে রাখা হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ৪ বছর নিষ্ক্রিয় ছিল ফান্ডের ট্রাস্টি ও কাস্টডিয়ান (গ্যারান্টি দেওয়া প্রতিষ্ঠান) আইসিবি। অডিট কোম্পানিও ভুয়া রিপোর্টকে বৈধতা দিয়েছে। বিএসইসির প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে এই তথ্য।

ইতোমধ্যে কোম্পানিটির সঙ্গে কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেন না করার নির্দেশ দিয়েছে কমিশন। বিএসইসি সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন। এর ফলে মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যাবে।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, মিউচুয়াল ফান্ডের কাজ মানুষের টাকা নিয়ে ব্যবসা করে শেয়ার হোল্ডারদের মুনাফা দেওয়া। এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে তা নজিরবিহীন। এর ফলে মিউচুয়াল ফান্ডের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরও কমবে। ফলে বিষয়টি তদন্ত করে দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

ইউএফএস একটি সম্পদ ব্যবস্থাপক (অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট) কোম্পানি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির অনুমতি নিয়ে এই কোম্পানি বিভিন্ন গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে। এই প্রক্রিয়াকে শেয়ারবাজারে পরিভাষায় মিউচুয়াল ফান্ড বলা হয়। নিয়ম অনুসারে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগে কোনো অনিয়ম হলে, ট্রাস্টি ও কাস্টডিয়ান প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে রিপোর্ট করতে হয়। কিন্তু ট্রাস্টি ও কাস্টডিয়ানের সামনেই এই জালিয়াতি করেছে ইউএফএস। ভুয়া সম্পদ দেখানো এবং অস্তিত্বহীন ব্যাংক ব্যালেন্স দেখিয়েছে। এসব বিষয়ে অভিযোগ এলে ১৯ জুন তদন্ত কমিটি গঠন করে কমিশন। ৪ মাস ১০ দিন পর ৩০ অক্টোবর প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি বিদেশে অর্থ পাচার করছে। এক্ষেত্রে ৪টি মিউচুয়াল ফান্ড থেকে ১৫৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা আত্মসাতের তথ্য মিলেছে। আবার তদন্তকালীন সময়ে পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে আরও অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। শেয়ার বিক্রির এই তথ্য যোগ হলে আত্মসাতের অর্থের অঙ্ক আরও বাড়বে। এক্ষেত্রে কমিশন ধারণা করছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এ চক্র।

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ৫টি মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনা করছে ইউএফএস। এসব তহবিলের আকার ৪৪০ কোটি টাকা। এই ফান্ডগুলোর ট্রাস্টি ও কাস্টডিয়ান (গ্যারান্টি দেওয়া প্রতিষ্ঠান) হিসাবে রয়েছে সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)।

বিএসইসির তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত ১৫৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা লুটে নেওয়ার তথ্য মিলেছে। এক্ষেত্রে প্রতিবছর ইউএফএস তাদের যে রিপোর্ট দিয়েছে, তার অধিকাংশ ভুয়া। এরমধ্যে তহবিল থেকে সরাসরি নগদ নেওয়া হয়েছে ১২৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এই টাকার সুদ আয় দেখানো হয়েছে ৩১ কোটি ৭৬ লাখ, ব্যবস্থাপনা ফির নামে অতিরিক্ত নেওয়া হয়েছে ৭ কোটি ৯০ লাখ এবং ট্রাস্টি ফি বাবদ অতিরিক্ত নেওয়া হয়েছে ৫৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

এতে সবমিলিয়ে টাকা পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। তবে কোম্পানির সম্পদ ও বিনিয়োগ দেখানো হয়েছে ৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আর সম্পদ বাদ দিলে মোট হাতিয়ে নেওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৫৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।

২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোম্পানির সম্পদ দেখানো হয়েছে, ২৮১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এরমধ্যে ১২৫ কোটি ২৮ লাখ লুটে নিয়েছে এই চক্র। এক্ষেত্রে ভুয়া ব্যাংক ব্যালেন্স দেখিয়েছে ৭৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা এবং এফডিআর ৪৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে কোনো এফডিআর খুঁজে পায়নি কমিশন। অর্থাৎ ব্যাংক ব্যালেন্সের যে তথ্য দিয়েছে, তার পুরোটাই অস্তিত্বহীন।

আবার গত বছরের ২১ আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকে ব্যালেন্স দেখানো হয়, ১০৮ কোটি ২০ লাখ ৭৫ হাজার ৫২৩ টাকা। কিন্তু বাস্তবে ব্যালেন্স ছিল ২৭ লাখ ৯৩ হাজার ৯৮০ টাকা। অর্থাৎ ১০৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকার তথ্য ভুয়া। এক্ষেত্রে ব্যাংকের ভুয়া স্টেটমেন্ট করে কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। যে সব ফান্ডের অর্থ লুটে নেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো-আইবিবিএল শরিয়াহ ইউনিট ফান্ড, পপুলার লাইফ ইউনিট ফান্ড, ব্যাংক এশিয়া ইউনিট ফান্ড এবং পদ্মা লাইফ ইউনিট ফান্ড।

এছাড়াও মিউচুয়াল ফান্ডের টাকা থেকে ৪টি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে হামজা আলমগীর। এগুলো হলো-আর আই এন্টারপ্রাইজ, নেত্রকোনা এক্সেসরিস লিমিটেড, ভেনগার্ড ট্রেডার্স লিমিটেড এবং তানজিল ফ্যাশন লিমিটেড এবং মাল্টি ম্যাক্স ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানা হামজা আলমগীর এবং তার নিকটাত্মীয়দের। স্বাভাবিক এ বিষয়ে অডিটে ধরা পড়ার কথা। কিন্তু দুটি অডিট কোম্পানি আহমেদ জাকের অ্যান্ড কো এবং রহমান মোস্তফা আলম অ্যান্ড কো এসব ভুয়া আর্থিক রিপোর্টের বৈধতা দিয়েছে।

জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় আইন অনুসারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে কমিশন।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ইউএফএস’র ফান্ডগুলোর মধ্যে-আইবিবিএল ২শ কোটি টাকা, ব্যাংক এশিয়া ১০০ কোটি, পপুলার লাইফ ৮০ কোটি, পদ্মা লাইফ ৫০ কোটি এবং প্রগতি লাইফ ইউনিট ফান্ডের ১০ কোটি টাকার তহবিল পরিচালনা করছে এই প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও সানলাইফ ইউনিট ফান্ডের ১০ কোটি এবং ইউএফএস ইউনিট ফান্ডের ১০ কোটি টাকার তহবিল প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এরমধ্যে ১৫৮ কোটি টাকা নিয়ে গত বছরের ১৩ অক্টোবর দুবাই পালিয়েছে কোম্পানির এমডি হামজা আলমগীর। এর আগে দুবাই এবং ঢাকায় বারবার আসা-যাওয়া করলেও, তদন্তের শেষ দিকে তিনি আর দেশে ফেরেননি।

জানতে চাইলে ইউএফএস’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হামজা আলমগীর সিঙ্গাপুর থেকে মুঠোফোনে যুগান্তরকে বলেন, কিছু অনিয়ম হয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চেষ্টা করছি। আশা করি, জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে পুরো বিষয়টি সুরাহার পথে যাবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউএফএস একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি। এই ধরনের কোম্পানি মূলত বাজারে মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে আসে। উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি এই তহবিলের একটি অংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নেওয়া হয়। এই তহবিলের বড় অংশই সেকেন্ডারি মার্কেটে শেয়ার কেনায় ব্যবহার হয়। এই মিউচুয়াল ফান্ডকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বলা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনীতির অত্যন্ত টেকনিক্যাল খাত শেয়ারবাজার। না জেনে এখানে বিনিয়োগ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এক্ষেত্রে একজন সাধারণ মানুষ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে চাইলে মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগ করা সুবিধাজনক। সাধারণ মানুষ এই মিউচুয়াল ফান্ডের শেয়ার কিনবে, মিউচুয়াল ফান্ডগুলো সেই টাকা দিয়ে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার কিনে থাকে। যেহেতু মিউচুয়াল ফান্ডের রিসার্স টিম রয়েছে, তাই তারা বিনিয়োগে মুনাফা করলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেবে। বিশ্বব্যাপী এই ধারণা থেকে মিউচুয়াল ফান্ডের জন্ম। কিন্তু বাংলাদেশে মিউচুয়াল ফান্ডের টাকা নিয়ে সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি পালিয়ে গেছে। এটি নজিরবিহীন ঘটনা।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

১৫৮ কোটি টাকা নিয়ে দুবাই পালিয়েছে এমডি

আপডেট সময় ০১:০৫:০২ অপরাহ্ন, রবিবার, ১ জানুয়ারী ২০২৩

শেয়ারবাজারে চার মিউচুয়াল ফান্ডের ১৫৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করেছে ইউনিভার্সাল ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশন (ইউএফএস) নামের একটি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি।

এই টাকা নিয়ে ১৩ অক্টোবর দুবাই পাড়ি জমিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ হামজা আলমগীর। বর্তমানে তিনি সিঙ্গাপুরে রয়েছেন। ২০১৮ সাল থেকে তহবিল সরানোর প্রক্রিয়া শুরু করে চক্রটি।

এক্ষেত্রে ব্যাংকের প্রতিবেদন জালিয়াতি এবং ভুয়া এফডিআর (ফিক্সড ডিপোজিড রেট) দেখিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) অন্ধকারে রাখা হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ৪ বছর নিষ্ক্রিয় ছিল ফান্ডের ট্রাস্টি ও কাস্টডিয়ান (গ্যারান্টি দেওয়া প্রতিষ্ঠান) আইসিবি। অডিট কোম্পানিও ভুয়া রিপোর্টকে বৈধতা দিয়েছে। বিএসইসির প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে এই তথ্য।

ইতোমধ্যে কোম্পানিটির সঙ্গে কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেন না করার নির্দেশ দিয়েছে কমিশন। বিএসইসি সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন। এর ফলে মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যাবে।

জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, মিউচুয়াল ফান্ডের কাজ মানুষের টাকা নিয়ে ব্যবসা করে শেয়ার হোল্ডারদের মুনাফা দেওয়া। এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকলে তা নজিরবিহীন। এর ফলে মিউচুয়াল ফান্ডের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা আরও কমবে। ফলে বিষয়টি তদন্ত করে দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

ইউএফএস একটি সম্পদ ব্যবস্থাপক (অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট) কোম্পানি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির অনুমতি নিয়ে এই কোম্পানি বিভিন্ন গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করে। এই প্রক্রিয়াকে শেয়ারবাজারে পরিভাষায় মিউচুয়াল ফান্ড বলা হয়। নিয়ম অনুসারে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগে কোনো অনিয়ম হলে, ট্রাস্টি ও কাস্টডিয়ান প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে রিপোর্ট করতে হয়। কিন্তু ট্রাস্টি ও কাস্টডিয়ানের সামনেই এই জালিয়াতি করেছে ইউএফএস। ভুয়া সম্পদ দেখানো এবং অস্তিত্বহীন ব্যাংক ব্যালেন্স দেখিয়েছে। এসব বিষয়ে অভিযোগ এলে ১৯ জুন তদন্ত কমিটি গঠন করে কমিশন। ৪ মাস ১০ দিন পর ৩০ অক্টোবর প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি বিদেশে অর্থ পাচার করছে। এক্ষেত্রে ৪টি মিউচুয়াল ফান্ড থেকে ১৫৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা আত্মসাতের তথ্য মিলেছে। আবার তদন্তকালীন সময়ে পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে আরও অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। শেয়ার বিক্রির এই তথ্য যোগ হলে আত্মসাতের অর্থের অঙ্ক আরও বাড়বে। এক্ষেত্রে কমিশন ধারণা করছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এ চক্র।

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ৫টি মিউচুয়াল ফান্ড পরিচালনা করছে ইউএফএস। এসব তহবিলের আকার ৪৪০ কোটি টাকা। এই ফান্ডগুলোর ট্রাস্টি ও কাস্টডিয়ান (গ্যারান্টি দেওয়া প্রতিষ্ঠান) হিসাবে রয়েছে সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)।

বিএসইসির তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত ১৫৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা লুটে নেওয়ার তথ্য মিলেছে। এক্ষেত্রে প্রতিবছর ইউএফএস তাদের যে রিপোর্ট দিয়েছে, তার অধিকাংশ ভুয়া। এরমধ্যে তহবিল থেকে সরাসরি নগদ নেওয়া হয়েছে ১২৫ কোটি ২৮ লাখ টাকা। এই টাকার সুদ আয় দেখানো হয়েছে ৩১ কোটি ৭৬ লাখ, ব্যবস্থাপনা ফির নামে অতিরিক্ত নেওয়া হয়েছে ৭ কোটি ৯০ লাখ এবং ট্রাস্টি ফি বাবদ অতিরিক্ত নেওয়া হয়েছে ৫৯ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

এতে সবমিলিয়ে টাকা পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। তবে কোম্পানির সম্পদ ও বিনিয়োগ দেখানো হয়েছে ৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আর সম্পদ বাদ দিলে মোট হাতিয়ে নেওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৫৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।

২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোম্পানির সম্পদ দেখানো হয়েছে, ২৮১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। এরমধ্যে ১২৫ কোটি ২৮ লাখ লুটে নিয়েছে এই চক্র। এক্ষেত্রে ভুয়া ব্যাংক ব্যালেন্স দেখিয়েছে ৭৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা এবং এফডিআর ৪৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে কোনো এফডিআর খুঁজে পায়নি কমিশন। অর্থাৎ ব্যাংক ব্যালেন্সের যে তথ্য দিয়েছে, তার পুরোটাই অস্তিত্বহীন।

আবার গত বছরের ২১ আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকে ব্যালেন্স দেখানো হয়, ১০৮ কোটি ২০ লাখ ৭৫ হাজার ৫২৩ টাকা। কিন্তু বাস্তবে ব্যালেন্স ছিল ২৭ লাখ ৯৩ হাজার ৯৮০ টাকা। অর্থাৎ ১০৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকার তথ্য ভুয়া। এক্ষেত্রে ব্যাংকের ভুয়া স্টেটমেন্ট করে কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। যে সব ফান্ডের অর্থ লুটে নেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো-আইবিবিএল শরিয়াহ ইউনিট ফান্ড, পপুলার লাইফ ইউনিট ফান্ড, ব্যাংক এশিয়া ইউনিট ফান্ড এবং পদ্মা লাইফ ইউনিট ফান্ড।

এছাড়াও মিউচুয়াল ফান্ডের টাকা থেকে ৪টি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে হামজা আলমগীর। এগুলো হলো-আর আই এন্টারপ্রাইজ, নেত্রকোনা এক্সেসরিস লিমিটেড, ভেনগার্ড ট্রেডার্স লিমিটেড এবং তানজিল ফ্যাশন লিমিটেড এবং মাল্টি ম্যাক্স ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানা হামজা আলমগীর এবং তার নিকটাত্মীয়দের। স্বাভাবিক এ বিষয়ে অডিটে ধরা পড়ার কথা। কিন্তু দুটি অডিট কোম্পানি আহমেদ জাকের অ্যান্ড কো এবং রহমান মোস্তফা আলম অ্যান্ড কো এসব ভুয়া আর্থিক রিপোর্টের বৈধতা দিয়েছে।

জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় আইন অনুসারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে কমিশন।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ইউএফএস’র ফান্ডগুলোর মধ্যে-আইবিবিএল ২শ কোটি টাকা, ব্যাংক এশিয়া ১০০ কোটি, পপুলার লাইফ ৮০ কোটি, পদ্মা লাইফ ৫০ কোটি এবং প্রগতি লাইফ ইউনিট ফান্ডের ১০ কোটি টাকার তহবিল পরিচালনা করছে এই প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও সানলাইফ ইউনিট ফান্ডের ১০ কোটি এবং ইউএফএস ইউনিট ফান্ডের ১০ কোটি টাকার তহবিল প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এরমধ্যে ১৫৮ কোটি টাকা নিয়ে গত বছরের ১৩ অক্টোবর দুবাই পালিয়েছে কোম্পানির এমডি হামজা আলমগীর। এর আগে দুবাই এবং ঢাকায় বারবার আসা-যাওয়া করলেও, তদন্তের শেষ দিকে তিনি আর দেশে ফেরেননি।

জানতে চাইলে ইউএফএস’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হামজা আলমগীর সিঙ্গাপুর থেকে মুঠোফোনে যুগান্তরকে বলেন, কিছু অনিয়ম হয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চেষ্টা করছি। আশা করি, জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে পুরো বিষয়টি সুরাহার পথে যাবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউএফএস একটি সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি। এই ধরনের কোম্পানি মূলত বাজারে মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে আসে। উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি এই তহবিলের একটি অংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নেওয়া হয়। এই তহবিলের বড় অংশই সেকেন্ডারি মার্কেটে শেয়ার কেনায় ব্যবহার হয়। এই মিউচুয়াল ফান্ডকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী বলা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনীতির অত্যন্ত টেকনিক্যাল খাত শেয়ারবাজার। না জেনে এখানে বিনিয়োগ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এক্ষেত্রে একজন সাধারণ মানুষ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে চাইলে মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগ করা সুবিধাজনক। সাধারণ মানুষ এই মিউচুয়াল ফান্ডের শেয়ার কিনবে, মিউচুয়াল ফান্ডগুলো সেই টাকা দিয়ে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার কিনে থাকে। যেহেতু মিউচুয়াল ফান্ডের রিসার্স টিম রয়েছে, তাই তারা বিনিয়োগে মুনাফা করলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেবে। বিশ্বব্যাপী এই ধারণা থেকে মিউচুয়াল ফান্ডের জন্ম। কিন্তু বাংলাদেশে মিউচুয়াল ফান্ডের টাকা নিয়ে সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি পালিয়ে গেছে। এটি নজিরবিহীন ঘটনা।