ঢাকা , মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা যেখানে ভেঙে পড়ে

  • ড. এন এন তরুণ
  • আপডেট সময় ০৩:৩৭:৪২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ মার্চ ২০২৩
  • ১১৪৬ বার পড়া হয়েছে

নোবেল প্রাপ্তি একজন মানুষের উৎকর্ষের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি বলা যায়। অবশ্য উৎকর্ষের একেবারে উঁচু সিঁড়িতে উঠেও অনেকে নোবেল না-ও পেতে পারেন। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারীদের নোবেল প্রাপ্তির গল্প বলা তাঁদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানানোর একটি পন্থা হতে পারে। যদিও আমরা পুরুষেরা অনেকেই শুধু নারী দিবসে এই শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানানো সীমাবদ্ধ রাখি। এর পরে ভুলে যাই। ভুলে যাই সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা বিধান ছাড়া একটি আধুনিক সমাজ ও উন্নত রাষ্ট্র গঠন অসম্ভব। নারী-পুরুষের সমতা বিধান তথা নারীর ক্ষমতায়ন উন্নয়নের একটি প্রধান সূচক। বাংলাদেশে এই নারীর ক্ষমতায়নের কারণেই সম্ভব হয়েছে উন্নয়নের অন্যান্য সূচকে উল্লম্ফন ঘটানো। তবে নারীর ক্ষমতায়ন এখনও সীমিত। ক্ষমতায়ন সেই দিনই পূর্ণতা পাবে, যেদিন নারী পরিবার ও রাষ্ট্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সমান ক্ষমতা অর্জন করবেন এবং ইচ্ছেমতো জীবন পরিচালনার সুযোগ পাবেন।

নারীর নোবেল প্রাপ্তির গল্পে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা নিশ্চিতভাবে খান খান হয়ে ভেঙে পড়বে এবং এ জন্যই এ গল্পের অবতারণা। ১৯০১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত নারীরা ৬২ বার নোবেল পান। মারি কুরি দু’বার নোবেল পান। এ হিসাবে ৬১ জন নারী নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। নোবেল প্রাইজের সূচনা হয় ১৯০১ সালে। মারি কুরি নোবেল পেয়ে যান ঠিক দুই বছর পর, অর্থাৎ ১৯০৩ সালে। তাঁর উৎকর্ষের গল্প এখানেই শেষ নয়। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পাওয়ার পর তিনি আবার নোবেল পেলেন ১৯১১ সালে রসায়নে। দুই বিষয়েই গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। মারি কুরি ছাড়া আর মাত্র তিনজন নোবেল পান দু’বার করে। তাঁদের মধ্যে লিনুস পলিং ১৯৫৪ সালে রসায়নে ও ১৯৬২ সালে শান্তিতে নোবেল। জন বার্ডিন নোবেল পান পদার্থবিদ্যারই দুটি ক্ষেত্রে। ফ্রেডেরিক সাঙ্গার নোবেল পান দু’বারই রসায়নে। মারি কুরিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি গবেষণাভিত্তিক নোবেল পান দুটি ভিন্ন বিষয়ে এবং এত আগে।

নোবেল কমিটি ‘পৃথিবীকে পাল্টে দিয়েছেন যে নারীরা’ এবং ‘ইন্সপাইরেশনাল উইমেন তথা প্রেরণদায়ী নারীরা’ শিরোনামে দুটি ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। প্রথমটিতে কানাডার ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড, পোল্যান্ডের মারি কুরি, প্রাগের গার্টি কোরি, আমেরিকান ঔপন্যাসিক টনি মরিসন, ইরানের মানবাধিকারকর্মী শিরিন এবাদি ও ফ্রান্সের অর্থনীতিবিদ এশথার ডুফলোর নাম উল্লেখ করে। ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড ২০১৮ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পাওয়ার পর এক সাক্ষাৎকারে স্মরণ করেন যে তাঁর বাবা-মা ও শিক্ষকরা সারাক্ষণ তাঁর কানের কাছে বলতেন– ‘মেয়ে, তোমার পক্ষে যে কোনো কিছু করা সম্ভব। যার ফলে আমি কিছু পারব না– এ রকম ধারণাই আমার কখনও হয়নি।’ বরং লেজার পালসের গবেষণা করে ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটান।

মারি কুরির অবদানের কথা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু যা বলা হয়নি, তা হলো– তাঁকে দারিদ্র্যের সঙ্গে কঠিন লড়াই করতে হয়েছে। টিউশনি করে, গভর্নেসের কাজ করে খরচ চালাতে হয়েছে। গ্রামে গিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে থাকতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, মেয়ে হওয়ার কারণে তিনি নিয়মিত ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারেননি। পড়তে হয়েছে ‘ফ্লোটিং ইউনিভার্সিটিতে’ গোপনে। তিনি অবশ্য পিতার কাছ থেকে গভীর প্রেরণা ও সহযোগিতা পান। গার্টি কোরি ১৬ বছর বয়সে ইউনিভার্সিটিতে মেডিকেল সায়েন্স পড়ার উদ্দেশ্যে এক বছরের মধ্যেই লাতিন, সায়েন্স ও ম্যাথমেটিকসে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করে ফেললেন বাড়িতে পড়াশোনা করেই। ১৯১৪ সালে তিনি যখন প্রাগের একটা মেডিকেলে স্কুলে ভর্তি হলেন, ওই সময়ের জন্য এটা ছিল একটি বিরল ঘটনা। ১৯৪৭ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান।

শ্রমজীবী পরিবারে জন্ম নেওয়া টনি মরিসন নিজের জীবন ও সমাজের ভয়াবহ অবস্থা চিত্রিত করেন এবং আমেরিকান সমাজকে মারাত্মক এক ঝাঁকুনি মারেন। প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে তিনি প্রথম সাহিত্যে নোবেল লাভ করেন ১৯৯৩ সালে। ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানে নারীদের অবস্থা খুবই সঙ্গিন হয়ে পড়ে। এ রকম একটি অবস্থায় মানবাধিকারকর্মী শিরিন এবাদির পক্ষে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারী ও শিশু অধিকার এবং শরণার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাওয়া খুবই দুরূহ ছিল। এর স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় ২০১৭ সালে। তিনিই প্রথম মুসলিম নারী, যিনি এ পুরস্কারে ভূষিত হন। শিরিন এবাদি অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন আমাদের সবার জন্য। এশথার ডুফলো সবচেয়ে কম বয়সে অর্থনীতিতে নোবেল পান। মাত্র ৪৬ বছর বয়সে ২০১৯ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পেয়ে তিনি পৃথিবীকে চমকে দেন। এশথার ডুফলোর বিশেষত্ব হলো, তিনি কেবল গবেষণা করেই তাঁর দায়িত্ব শেষ করেননি। তিনি তাঁর এক্সপেরিমেন্টাল গবেষণার ফলাফল দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন ও হতদরিদ্রদের সক্ষমতা সৃষ্টিতে সরাসরি অবদান রাখেন।

‘ইন্সপাইরেশনাল উইমেন’ ক্রোড়পত্রেও ছয়জন নারীর যুগান্তকারী অবদানের কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তাঁর মধ্যে আছেন মারিয়া গোপার্ট মেয়ের পদার্থবিদায় ১৯৬৩ সালে, জেনিফার এ ডোউডনা রসায়নে ২০২০ সালে, ক্যারোল ডব্লিউ গ্রেইডার ২০০৯ সালে মেডিসিনে, এলফ্রিয়েডে জেলিনেক ২০০৪ সালে সাহিত্যে, মেইরেড কোরিগান শান্তিতে ১৯৭৭ সালে এবং প্রথম নারী হিসেবে অর্থনীতিতে নোবেল পান এলিনোর অসট্রম ২০০৯ সালে। বলার অপেক্ষা রাখে না, পদার্থবিদ্যা,  রসায়ন, মেডিসিন ও অর্থনীতিতে তাঁদের মৌলিক অবদান মানবজাতিকে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে। সাহিত্যেও এলফ্রিয়েডে জেলিনেক আমাদের সামনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁর গল্প ও নাটকে তিনি যেন স্বর আর প্রতিস্বরের সংগীতের মূর্ছনা তোলেন, সমাজের মুক্তিকামী মানুষ কীভাবে কায়েমি শক্তির কাছে হেরে যায়, তা বর্ণনা করেন। আটপৌরে জীবনের পরাবাস্তবতার ছবি আঁকেন। মেইরেড কোরিগান আমাদের শিখিয়েছেন শান্তি প্রতিষ্ঠায় কীভাবে অদম্য হতে হয়।

নারীর কর্মক্ষমতা বা শক্তি ও মেধা পুরুষের চেয়ে কম– এমন ভাবনা নারীর ক্ষমতায়নে সবচেয়ে বড় বাধা। ওপরের ওই উৎকর্ষের গল্প এমন ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে। তারপরও আমরা নারীকে দেখি বন্দি হতে– পিতার কাছে, ভাইয়ের কাছে, স্বামীর কাছে, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর হবে যদি তিনি নিজের কাছেই বন্দি হন। নিজের কাছে বন্দি হওয়ার অর্থ হলো, নারী যদি নিজেই নিজের চেয়ে পুরুষকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন। নিজের কাছে বন্দি হলে সেই কারাগার থেকে কেউ তাঁকে মুক্ত করতে পারবে না।

সুখের বিষয়, আমাদের দেশে নারীবাদী চেতনা ও আন্দোলন অন্য অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে। উদাহরণস্বরূপ আফ্রিকার দেশগুলোতে নারীবাদী চেতনার তেমন প্রসার ঘটেনি। তার কারণ বোধহয়, আমাদের একজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন, একজন বেগম রোকেয়া ছিলেন, একজন হুমায়ুন আজাদ ছিলেন। একজন তসলিমা নাসরিন আছেন।

নারীবাদী সাহিত্য আমাদের এখনও অপ্রতুল। কবিতায় তা আরও কম।  ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’– নজরুলের মতো এভাবে উচ্চকণ্ঠ হতে আর কোনো কবিকে আমরা দেখি না। বিস্ময় লাগে যখন দেখি মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্যে কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যের নায়ক শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমতি রাধাকে বলছেন:

স্মর-গরল খণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনং

দেহি পদপ্ললব মুদারং, শ্রীরাধে

অর্থাৎ কাম-উত্থিত বিষের প্রভাব খণ্ডন করে আমার মস্তক মুণ্ডন করে তোমার পায়ের ধূলি আমাকে দাও। ‘নারীই পুরুষকে প্রণাম করবে, তাঁর পদধূলি নেবে’– এর বিপরীতে কবি জয়দেব কৃষ্ণকে দিয়ে শ্রীরাধার পদধূলি যাচনা করাচ্ছেন। বিস্ময় লাগে বলেছি কারণ, মধ্যযুগের কবি জয়দেব যা পেরেছিলেন, আমরা আজও তা পারছি না।

ড. এন এন তরুণ: ইউনিভার্সিটি অব বাথ, ইংল্যান্ড। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা যেখানে ভেঙে পড়ে

আপডেট সময় ০৩:৩৭:৪২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ মার্চ ২০২৩

নোবেল প্রাপ্তি একজন মানুষের উৎকর্ষের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি বলা যায়। অবশ্য উৎকর্ষের একেবারে উঁচু সিঁড়িতে উঠেও অনেকে নোবেল না-ও পেতে পারেন। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারীদের নোবেল প্রাপ্তির গল্প বলা তাঁদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানানোর একটি পন্থা হতে পারে। যদিও আমরা পুরুষেরা অনেকেই শুধু নারী দিবসে এই শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানানো সীমাবদ্ধ রাখি। এর পরে ভুলে যাই। ভুলে যাই সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা বিধান ছাড়া একটি আধুনিক সমাজ ও উন্নত রাষ্ট্র গঠন অসম্ভব। নারী-পুরুষের সমতা বিধান তথা নারীর ক্ষমতায়ন উন্নয়নের একটি প্রধান সূচক। বাংলাদেশে এই নারীর ক্ষমতায়নের কারণেই সম্ভব হয়েছে উন্নয়নের অন্যান্য সূচকে উল্লম্ফন ঘটানো। তবে নারীর ক্ষমতায়ন এখনও সীমিত। ক্ষমতায়ন সেই দিনই পূর্ণতা পাবে, যেদিন নারী পরিবার ও রাষ্ট্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সমান ক্ষমতা অর্জন করবেন এবং ইচ্ছেমতো জীবন পরিচালনার সুযোগ পাবেন।

নারীর নোবেল প্রাপ্তির গল্পে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা নিশ্চিতভাবে খান খান হয়ে ভেঙে পড়বে এবং এ জন্যই এ গল্পের অবতারণা। ১৯০১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত নারীরা ৬২ বার নোবেল পান। মারি কুরি দু’বার নোবেল পান। এ হিসাবে ৬১ জন নারী নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। নোবেল প্রাইজের সূচনা হয় ১৯০১ সালে। মারি কুরি নোবেল পেয়ে যান ঠিক দুই বছর পর, অর্থাৎ ১৯০৩ সালে। তাঁর উৎকর্ষের গল্প এখানেই শেষ নয়। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পাওয়ার পর তিনি আবার নোবেল পেলেন ১৯১১ সালে রসায়নে। দুই বিষয়েই গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। মারি কুরি ছাড়া আর মাত্র তিনজন নোবেল পান দু’বার করে। তাঁদের মধ্যে লিনুস পলিং ১৯৫৪ সালে রসায়নে ও ১৯৬২ সালে শান্তিতে নোবেল। জন বার্ডিন নোবেল পান পদার্থবিদ্যারই দুটি ক্ষেত্রে। ফ্রেডেরিক সাঙ্গার নোবেল পান দু’বারই রসায়নে। মারি কুরিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি গবেষণাভিত্তিক নোবেল পান দুটি ভিন্ন বিষয়ে এবং এত আগে।

নোবেল কমিটি ‘পৃথিবীকে পাল্টে দিয়েছেন যে নারীরা’ এবং ‘ইন্সপাইরেশনাল উইমেন তথা প্রেরণদায়ী নারীরা’ শিরোনামে দুটি ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। প্রথমটিতে কানাডার ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড, পোল্যান্ডের মারি কুরি, প্রাগের গার্টি কোরি, আমেরিকান ঔপন্যাসিক টনি মরিসন, ইরানের মানবাধিকারকর্মী শিরিন এবাদি ও ফ্রান্সের অর্থনীতিবিদ এশথার ডুফলোর নাম উল্লেখ করে। ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড ২০১৮ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পাওয়ার পর এক সাক্ষাৎকারে স্মরণ করেন যে তাঁর বাবা-মা ও শিক্ষকরা সারাক্ষণ তাঁর কানের কাছে বলতেন– ‘মেয়ে, তোমার পক্ষে যে কোনো কিছু করা সম্ভব। যার ফলে আমি কিছু পারব না– এ রকম ধারণাই আমার কখনও হয়নি।’ বরং লেজার পালসের গবেষণা করে ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটান।

মারি কুরির অবদানের কথা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু যা বলা হয়নি, তা হলো– তাঁকে দারিদ্র্যের সঙ্গে কঠিন লড়াই করতে হয়েছে। টিউশনি করে, গভর্নেসের কাজ করে খরচ চালাতে হয়েছে। গ্রামে গিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে থাকতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, মেয়ে হওয়ার কারণে তিনি নিয়মিত ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারেননি। পড়তে হয়েছে ‘ফ্লোটিং ইউনিভার্সিটিতে’ গোপনে। তিনি অবশ্য পিতার কাছ থেকে গভীর প্রেরণা ও সহযোগিতা পান। গার্টি কোরি ১৬ বছর বয়সে ইউনিভার্সিটিতে মেডিকেল সায়েন্স পড়ার উদ্দেশ্যে এক বছরের মধ্যেই লাতিন, সায়েন্স ও ম্যাথমেটিকসে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করে ফেললেন বাড়িতে পড়াশোনা করেই। ১৯১৪ সালে তিনি যখন প্রাগের একটা মেডিকেলে স্কুলে ভর্তি হলেন, ওই সময়ের জন্য এটা ছিল একটি বিরল ঘটনা। ১৯৪৭ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান।

শ্রমজীবী পরিবারে জন্ম নেওয়া টনি মরিসন নিজের জীবন ও সমাজের ভয়াবহ অবস্থা চিত্রিত করেন এবং আমেরিকান সমাজকে মারাত্মক এক ঝাঁকুনি মারেন। প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে তিনি প্রথম সাহিত্যে নোবেল লাভ করেন ১৯৯৩ সালে। ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানে নারীদের অবস্থা খুবই সঙ্গিন হয়ে পড়ে। এ রকম একটি অবস্থায় মানবাধিকারকর্মী শিরিন এবাদির পক্ষে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারী ও শিশু অধিকার এবং শরণার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাওয়া খুবই দুরূহ ছিল। এর স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় ২০১৭ সালে। তিনিই প্রথম মুসলিম নারী, যিনি এ পুরস্কারে ভূষিত হন। শিরিন এবাদি অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন আমাদের সবার জন্য। এশথার ডুফলো সবচেয়ে কম বয়সে অর্থনীতিতে নোবেল পান। মাত্র ৪৬ বছর বয়সে ২০১৯ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পেয়ে তিনি পৃথিবীকে চমকে দেন। এশথার ডুফলোর বিশেষত্ব হলো, তিনি কেবল গবেষণা করেই তাঁর দায়িত্ব শেষ করেননি। তিনি তাঁর এক্সপেরিমেন্টাল গবেষণার ফলাফল দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন ও হতদরিদ্রদের সক্ষমতা সৃষ্টিতে সরাসরি অবদান রাখেন।

‘ইন্সপাইরেশনাল উইমেন’ ক্রোড়পত্রেও ছয়জন নারীর যুগান্তকারী অবদানের কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তাঁর মধ্যে আছেন মারিয়া গোপার্ট মেয়ের পদার্থবিদায় ১৯৬৩ সালে, জেনিফার এ ডোউডনা রসায়নে ২০২০ সালে, ক্যারোল ডব্লিউ গ্রেইডার ২০০৯ সালে মেডিসিনে, এলফ্রিয়েডে জেলিনেক ২০০৪ সালে সাহিত্যে, মেইরেড কোরিগান শান্তিতে ১৯৭৭ সালে এবং প্রথম নারী হিসেবে অর্থনীতিতে নোবেল পান এলিনোর অসট্রম ২০০৯ সালে। বলার অপেক্ষা রাখে না, পদার্থবিদ্যা,  রসায়ন, মেডিসিন ও অর্থনীতিতে তাঁদের মৌলিক অবদান মানবজাতিকে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে। সাহিত্যেও এলফ্রিয়েডে জেলিনেক আমাদের সামনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁর গল্প ও নাটকে তিনি যেন স্বর আর প্রতিস্বরের সংগীতের মূর্ছনা তোলেন, সমাজের মুক্তিকামী মানুষ কীভাবে কায়েমি শক্তির কাছে হেরে যায়, তা বর্ণনা করেন। আটপৌরে জীবনের পরাবাস্তবতার ছবি আঁকেন। মেইরেড কোরিগান আমাদের শিখিয়েছেন শান্তি প্রতিষ্ঠায় কীভাবে অদম্য হতে হয়।

নারীর কর্মক্ষমতা বা শক্তি ও মেধা পুরুষের চেয়ে কম– এমন ভাবনা নারীর ক্ষমতায়নে সবচেয়ে বড় বাধা। ওপরের ওই উৎকর্ষের গল্প এমন ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে। তারপরও আমরা নারীকে দেখি বন্দি হতে– পিতার কাছে, ভাইয়ের কাছে, স্বামীর কাছে, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর হবে যদি তিনি নিজের কাছেই বন্দি হন। নিজের কাছে বন্দি হওয়ার অর্থ হলো, নারী যদি নিজেই নিজের চেয়ে পুরুষকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন। নিজের কাছে বন্দি হলে সেই কারাগার থেকে কেউ তাঁকে মুক্ত করতে পারবে না।

সুখের বিষয়, আমাদের দেশে নারীবাদী চেতনা ও আন্দোলন অন্য অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে। উদাহরণস্বরূপ আফ্রিকার দেশগুলোতে নারীবাদী চেতনার তেমন প্রসার ঘটেনি। তার কারণ বোধহয়, আমাদের একজন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন, একজন বেগম রোকেয়া ছিলেন, একজন হুমায়ুন আজাদ ছিলেন। একজন তসলিমা নাসরিন আছেন।

নারীবাদী সাহিত্য আমাদের এখনও অপ্রতুল। কবিতায় তা আরও কম।  ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’– নজরুলের মতো এভাবে উচ্চকণ্ঠ হতে আর কোনো কবিকে আমরা দেখি না। বিস্ময় লাগে যখন দেখি মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্যে কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যের নায়ক শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমতি রাধাকে বলছেন:

স্মর-গরল খণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনং

দেহি পদপ্ললব মুদারং, শ্রীরাধে

অর্থাৎ কাম-উত্থিত বিষের প্রভাব খণ্ডন করে আমার মস্তক মুণ্ডন করে তোমার পায়ের ধূলি আমাকে দাও। ‘নারীই পুরুষকে প্রণাম করবে, তাঁর পদধূলি নেবে’– এর বিপরীতে কবি জয়দেব কৃষ্ণকে দিয়ে শ্রীরাধার পদধূলি যাচনা করাচ্ছেন। বিস্ময় লাগে বলেছি কারণ, মধ্যযুগের কবি জয়দেব যা পেরেছিলেন, আমরা আজও তা পারছি না।

ড. এন এন তরুণ: ইউনিভার্সিটি অব বাথ, ইংল্যান্ড। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ।