ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

২০২৩ : মধ্যপ্রাচ্যে বিভাজন ও ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব

  • সূর্যোদয় ডেস্ক:
  • আপডেট সময় ০৯:৪৫:০৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৪ জানুয়ারী ২০২৩
  • ১৩৫৭ বার পড়া হয়েছে

২০২২ সাল শেষেও বিশ্বের যে ক’টি অঞ্চলে অস্থির পরিস্থিতি বজায় থাকার ইঙ্গিত রয়েছে তার মধ্যে একটি হলো মধ্যপ্রাচ্য। এই অঞ্চলে বিশ শতকের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশজুড়ে যে ভারসাম্য ছিল তা ভেঙে পড়ে নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকে। দ্বিতীয় দশকে সম্পর্কের নতুন সমীকরণ তৈরি হতে থাকে। তৃতীয় দশকের প্রথম দুই বছর ছিল নতুন এক মধ্যপ্রাচ্যের ভিত্তি তৈরির সময়। ২০২৩ সাল এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নতুন এক সময়কালের সূচনার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বছর হতে পারে।

নতুন বছরের শুরুতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন কট্টরপন্থী নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি পশ্চিম তীর ও জেরুসালেমকে ইহুদিকরণের যে প্রক্রিয়া আগের শাসনের সময় শুরু করেছিলেন সেটিকে আরো এগিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। জর্দানের বাদশাহ ব্যতিক্রমীভাবে ইসরাইলের এই নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন যাতে ওআইসি তার পাশে থাকবে বলে উল্লেখ করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের নতুন ভারসাম্যে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত তুরস্কে চ্যালেঞ্জমুখর নির্বাচন এই বছরের মাঝামাঝি।

সৌদি আরবে মুহাম্মদ বিন সালমানের ক্ষমতা গ্রহণের জন্য ২০২৩ হতে পারে এক গুরুত্বপূর্ণ বছর। লিবিয়া ঐক্যবদ্ধ দেশ থেকে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এই সালটি হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ সময়। সিরিয়ায় শান্তি ও স্থিতি আর শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনে ২০২৩ সালে গুরুত্বপূর্ণ কিছু হতে পারে। ইরানের সাথে উপসাগরীয় দেশগুলো এবং তুরস্কের সম্পর্কে যে উত্তেজনা ও টানাপড়েন রয়েছে তার মধ্যে একটি নতুন মেরুকরণও হতে পারে এই সময়ে। এর বাইরে মিসর ইয়েমেন লেবানন তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক পরিবেশে নতুন এক পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে এ সময়।

লিবিয়ার ঐক্যের শেষ সুযোগ
২০২০ সালে লিবিয়ার যুদ্ধবিরতির পর নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও, দেশটির দুই প্রতিদ্ব›দ্বী প্রশাসনের মধ্যে বিভাজন এখনো শক্তিশালী হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে চলমান জাতীয় বিভাজন এবং পরবর্তী মতবিরোধের কারণে ‘আসন্ন নির্বাচন’ এখনো অনুষ্ঠিত হয়নি। দেশটিতে শুধু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াই স্থবির হয়ে পড়েনি, বরং ক্রমেই সঙ্ঘাতের প্রত্যাবর্তন ঘটছে, ত্রিপোলিতে প্রতিদ্ব›দ্বী মিলিশিয়াদের সংঘর্ষে লিবিয়ার পূর্বাঞ্চল থেকে বাহিনী রাজধানীতে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেছে।

লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় পার্লামেন্টে সৃষ্ট রাজনৈতিক সঙ্কটের প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ ফাতি বাশাঘাকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আবদুল হামিদ দেবীবেহ নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানানো নতুন সঙ্কটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই সঙ্ঘাত এমন এক ভঙ্গুরতার ইঙ্গিত দেয় যাতে সহজে দেশটি আবার গৃহযুদ্ধে ফিরে যেতে পারে।

জাতিসঙ্ঘ যখন সব রাজনৈতিক পক্ষের চুক্তিতে নির্বাচন প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে তখন পূর্ব লিবিয়ার কার্যত শাসক খলিফা হাফতার গত সপ্তাহে সতর্ক করে দেন যে, এই প্রক্রিয়াটির প্রচেষ্টার জন্য এটিই হবে ‘চূড়ান্ত সুযোগ’। পশ্চিম লিবিয়ায় নতুন করে আক্রমণ শুরুর কথা খোলাখুলিভাবে উল্লেখ না করলেও হাফতারের সতর্কতাকে অনেকে তার নেতৃত্বে দেশকে একত্রিত করার চেষ্টা করার জন্য সামরিক শক্তি ব্যবহারের একটি গোপন হুমকি হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। যদি তা না হয়, তবে এর একটি সম্ভাব্য বিকল্প হতে পারে, দেশটি দু’টি প্রতিদ্বন্দ্বী সরকারের মধ্যে বিচ্ছেদে পড়বে।

লিবিয়ার স্বাধীনতা দিবসে যে বক্তৃতায় তিনি এই সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন তার আগে, রাজনৈতিক ও সাংবাদিক বলয়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে হাফতার আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব লিবিয়ার বিচ্ছিন্নতা এবং একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেবেন। এই গুজব অবশ্যই মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে, তবে এর বেশ বাস্তব সম্ভাবনা রয়েছে যে, বিদ্যমান বিচ্ছিন্নতাবাদী আওয়াজ ২০২৩ সালে আবারো নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে এবং বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা আরো খারাপ হলে সমর্থন লাভ করতে পারে।

তুর্কিয়ে প্রজাতন্ত্রের শত বর্ষে এরদোগানের চ্যালেঞ্জ
২০২৩ সাল হবে আধুনিক তুর্কিয়ে প্রজাতন্ত্রের ১০০তম জন্মদিন। এক শতাব্দী আগে অটোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের ওপর দেশটি সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে এখন পরিস্থিতি অনেক বেশি উত্তেজনাপূর্ণ। কঠোরভাবে ধর্মনিরপেক্ষ পশ্চিমমুখী প্রজাতন্ত্র থেকে বিবর্তিত হয়ে একটি পুনরুজ্জীবিত আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত হয়ে কঠোর সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত সংস্কারের একটি সিরিজ শুরু হয় তুরস্কে। দেশটির আধিপত্যবাদী প্রভাব বিস্তার এবং আরো আত্মবিশ্বাসী স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি নিয়েছে এরদোগানের বর্তমান সরকার।

গত কয়েক বছর ধরে তুরস্কে অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং সিরিয়ার সঙ্ঘাত থেকে লক্ষাধিক শরণার্থীর চলমান উপস্থিতি সামাজিক অস্থিরতা এবং অতি জাতীয়তাবাদী মনোভাবকে জাগিয়ে তুলছে। জনমত জরিপ অনুসারে, এক বছর আগে রাষ্ট্রপতি রজব তৈয়ব এরদোগানের জন্য অনুমোদনের রেটিং সর্বনিম্ন ছিল এবং বছরের ব্যবধানে তার জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে ভোটারদের কাছে আবেদন সৃষ্টির প্রচেষ্টা সত্তে¡ও দেশটিতে ব্যাপক অসন্তোষ রয়ে গেছে। তুর্কিয়ে জনগণের একটি বড় অংশ পরিবর্তন চাইছে।

২০২৩ সালে বিরোধী পক্ষের জন্য এই পরিবর্তনের একটি সুযোগ আসতে পারে, দেশের শতবর্ষের সময়ই জুনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এটি তুরস্কের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জটিল নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এরদোগান এবং তার ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একেপি) চ্যালেঞ্জময় সময়ের একটি ঘটনা বিরোধী দল এবং প্রার্থীদের জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এই মাসে ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোগ্লুকে দুই বছরেরও বেশি মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তার ওপর আরোপিত রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার শাস্তিতে অনেকে বিশ্বাস করে যে, এটি নির্বাচনে এরদোগানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বিরোধিতা জাগিয়ে তুলবে। বিরোধী দলগুলোর পেছনে একত্রিত হওয়ার জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রার্থী হিসেবে মনে করা ইমামোগ্লুকে রাজনীতি থেকে কার্যত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ঠিক দুই দশক আগে এরদোগানের বিরুদ্ধে এমন একটি পদক্ষেপ বর্তমান রাষ্ট্রপতির জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তুলেছিল। এখন এটা কি এরদোগানের পতন ঘটাতে পারে, তা নিয়ে অনেকে নানামুখী বিশ্লেষণ করছেন। ইমামোগ্লু নিষেধাজ্ঞা এবং তুরস্কে উদ্বেগজনক বিভিন্ন সঙ্কটের ঝুঁকি থাকা সত্তে¡ও, এরদোগান এখনো বিরোধীদের সামনে একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হয়ে আছেন। একেপি এখনো বর্তমান নির্বাচনে সর্বোচ্চ জনপ্রিয় দল আর জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পার্টির (এমএইচপি) সাথে তারা জোট বজায় রেখেছে। গত নির্বাচনের পর থেকে এমএইচপির র‌্যাংকিংয়ের পতন হয়েছে, কিন্তু উভয় দলই একসাথে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে।

তুর্কিয়ে সরকারের ‘ভিশন ২০২৩’-এর বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এটি গত দশকে ঘোষণা করা উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যগুলোর একটি সেট। এর অগ্রগতি অবশ্যই নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচন চলাকালীন সময়ে মূল্যায়ন করা হবে, যা ২০২৩ একেপির টিকে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে। তুরস্কে সাধারণভাবে জাতীয় নিরাপত্তা ও অগ্রগতির জন্য এরদোগানকে বিকল্পহীনভাবে দেশের অনেক মানুষ। তিনি তুরস্ককে আঞ্চলিক পরাশক্তি করেন এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে গেছেন। অর্থনৈতিকভাবে দেশটিকে ইউরোপের রুগ্ণ দেশের অবস্থান থেকে প্রতিশ্রুতিশীল দেশে রূপান্তরের নায়কও তিনি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনীতির নানা দিকে দুর্বল অবস্থা বিশেষত লিরার দাম অবনয়ন এবং উচ্চ হারের মূল্যস্ফীতি এরদোগানের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তিনি অনেক পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন। আগামী ৫-৬ মাসে এ ক্ষেত্রে সাফল্যের পাশাপাশি সিরিয়ার সাথে রুশ মধ্যস্থতায় যে আলোচনা আঙ্কারা শুরু করেছে তার সাফল্যের পথ ধরে সিরীয় শরণার্থীদের স্বদেশে পুনর্বাসন করতে পারলে এটি আবারো এরদোগানের জন্য বিজয়ের ভিত তৈরি করে দিতে পারে।

তুর্কিয়ে ও ইরান কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা
নাগরনো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মধ্যে নতুন করে সঙ্ঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে, তুরস্ক এবং ইরানের মধ্যে একটি বিস্তৃত পরিসরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যাচ্ছে। আঙ্কারা যখন যুদ্ধে বাকুকে তার ড্রোন এবং সামরিক সহায়তা দিয়ে সমর্থন করেছিল, তখন তেহরান গোপনে ইয়েরেভানকে সমর্থন করে চুপচাপ অস্ত্র হস্তান্তর করে। আর্মেনিয়ার প্রতি ইরানের সমর্থন একটি সুস্পষ্ট এবং প্রত্যাশিত নীতি, এটি শুধু উত্তর-পশ্চিম ইরানে তার আজেরি জনসংখ্যার মধ্যে জাতীয়তাবাদী অনুভূতিকে প্রশমিত করার প্রচেষ্টা হিসাবে নয়, তবে প্রাথমিক কারণ এটি বাকুকে মোকাবেলা করার জন্য তেহরানের ভ‚-রাজনৈতিক স্বার্থের মধ্যে রয়েছে।

দু’দেশের মধ্যে সমস্যা আঞ্চলিক কৌশলগত সুবিধাকে কেন্দ্র করে। এর একটি মূল উদাহরণ হলো জাঙ্গেজুর করিডোরকে ঘিরে সমস্যা, এটি একটি আর্মেনিয়ান ভ‚খণ্ড যা আজারবাইজানের মূল ভ‚খণ্ড এবং এর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল নাখিচেভানকে আলাদা করে রেখেছে। আঙ্কারা এবং বাকু, উভয়ই আজারবাইজানীয় রাজধানী থেকে তুর্কিয়ে শহর কার্স পর্যন্ত একটি পরিবহন রুট স্থাপন এবং প্রসারিত করতে চায়। এই রুটটি জাঙ্গেজুর করিডোরের ওপর দিয়ে যায়। এর প্রবক্তারা বলেন যে, এই ধরনের একটি প্রকল্প দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলের জন্য অনেক অর্থনৈতিক সুযোগ ও দীর্ঘমেয়াদি শান্তি উন্মুক্ত করবে। আর এটি প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে সবচেয়ে ছোট স্থল পরিবহন রুট হিসেবে কাজ করবে, সেই সাথে এশিয়ার মধ্যে ইউরোপের সাথে একটি নতুন সংযোগ সৃষ্টি করবে।

তুরস্কের জন্য, এটি অবশ্যই হবে একটি উল্লেখযোগ্য সুবিধা। আঙ্কারা এর মাধ্যমে কাস্পিয়ান সাগরের প্রবেশদ্বার হিসেবে এবং মধ্য এশিয়ার রাজ্যগুলোর সাথে সংযোগের একটি সংক্ষিপ্ত রুট পাবে। তারা ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের মধ্যে ইউরোপে প্রবেশের জন্য একটি অতিরিক্ত রুট খুঁজছে। এটি দৃশ্যত এত গুরুত্বপূর্ণ যে, আঙ্কারা ইয়েরেভানের সাথে তার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য এটিকে একটি মূল শর্ত বানিয়েছে।

এ দিকে তেহরান ব্যাপকভাবে এর বিরোধিতা করে চলেছে; কারণ এটি সরাসরি তুরস্ককে মূল ভ‚খণ্ড আজারবাইজানের সাথে সংযুক্ত করবে, আজারবাইজানিদের আর নাখিচিভানে যাতায়াতের জন্য ইরানের মধ্য দিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না এবং ইরান-আর্মেনিয়ান সীমান্তটি একধরনের অবরুদ্ধতার মধ্যে পড়ার আশঙ্কা থাকবে। ইরানের জন্য এটি নেতিবাচক হলেও তুরস্কের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক অগ্রগতি হবে এবং এর প্রভাবকে বাড়িয়ে তুলবে দক্ষিণ ককেশাসে।

সিরিয়ায় তুর্কিয়ে-সমর্থিত বাহিনী এবং ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্য ও সঙ্ঘাতের সাথে এটি দু’দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে আরো গভীর করতে পারে। যদিও এর অর্থ আঙ্কারা এবং তেহরানের মধ্যে সামরিক সঙ্ঘাত নয়, তবে এর অর্থ হতে পারে, দুই আঞ্চলিক শক্তির নেতৃত্বে প্রভাব বিস্তারে বৃহত্তর অক্ষের গঠন।

জিসিসি পরিবারের পুনর্মিলন
সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ যারা কাতারকে ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২১ সালের প্রথম পর্যন্ত অবরোধ করেছিল, তারা ২০২২ জুড়ে দোহার সাথে তাদের সম্পর্ক উন্নত করেছে। জিসিসি পরিবারের দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কের এই সামগ্রিক উষ্ণতা ২০২৩ সালেও অব্যাহত থাকতে পারে। রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্র এবং মানুষ থেকে মানুষ স্তরে এই সম্পর্ক বাড়তে পারে। কাতারে শেষ হওয়া বিশ্বকাপটি একটি উদ্দীপক হিসেবে কাজ করার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিশ্বকাপ চলাকালে সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান- এমবিএস এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ-এমবিজেড যেভাবে দোহায় কাতারের আমিরের সাথে দেখা করেছিলেন তা তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২১ সালের শুরুর দিকে কাতারের অবরোধের সময় দোহায় এই তিন নেতার মধ্যে এ ধরনের আনন্দদায়ক বৈঠক অকল্পনীয় ছিল।
নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে, ইয়েমেনে ‘কোনো যুদ্ধও নেই, শান্তিও নেই’ এর বিবর্তন জিসিসি সদস্যদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে। ২০২৩ ইয়েমেনিদের জন্য একটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং বছর ছাড়া অন্য কিছু হবে বলে আশা করার কারণ নেই। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বিশ্বাস করেন যে, শান্তির দিকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির সম্ভাবনা ক্ষীণ।

কিছু বিশ্লেষক উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, ইয়েমেনে স্থায়ী শান্তি আনার একমাত্র বাস্তবসম্মত উপায় উত্তর-দক্ষিণ লাইনে দেশকে বিভক্ত করা এবং ১৯৯০ সালের পুনঃএকত্রীকরণের আশা ছেড়ে দেয়া যদিও বিভাজন অগণিত চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে এবং এর সমস্যাযুক্ত নানা দিক রয়েছে।

নতুন বছরেও ইয়েমেনে হুথিরা সম্ভবত প্রভাবশালী থাকবে। এ সময় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার তার ঐক্য বাড়াতে ব্যর্থ হবে এবং তাই একটি শক্তিশালী হুথি বিরোধী ফ্রন্ট গড়ে তুলতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে, সৌদি আরব ক্রমবর্ধমানভাবে তার ব্যয়বহুল হস্তক্ষেপের চাপ অনুভব করবে যা ২০২৩ সালের মার্চ মাসে তার নবম বছরে প্রবেশ করবে।

এই সময়ে সৌদি আরব এবং আমিরাত কিভাবে ইয়েমেনে তাদের বিরোধপূর্ণ স্বার্থের মোকাবেলা করে তা দেখা গুরুত্বপূর্ণ হবে। বিশেষ করে যদি ২০২৩ সালে রিয়াদ এবং আবুধাবির পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত দলগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে আরো লড়াইয়ে লিপ্ত হয় তখন পরিস্থিতি জটিল হবে। এখন পর্যন্ত, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত বেশির ভাগ ইয়েমেনে তাদের মতবিরোধ নিষ্পত্তি করতে সফল হয়েছে। তবুও, এটি সম্ভবত আগামী বছর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরোধের একটি উৎস থেকে যাবে।

ইরানে অস্থিরতা জিসিসির জন্য মিশ্র বার্তা
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ইরানের ‘নৈতিকতা পুলিশ’ হেফাজতে থাকাকালীন মাহসা জিনা আমিনির মৃত্যু দেশব্যাপী বিক্ষোভ শুরু করে যা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বৈধতার জন্য একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও কেউ যুক্তি দিতে পারে যে, ইরান রাষ্ট্রের পতন দেখতে কোনো একক আরব রাষ্ট্রের আগ্রহ নেই, তবে জিসিসির ইরান-বিরোধী দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন তাদের পারস্য প্রতিবেশী দেশজুড়ে অস্থিরতাকে সম্ভবত এক অর্থে লাভজনক হিসেবে দেখছে। তেহরানের নেতৃত্বকে ২০২৩ সালের পুরোটা না হলেও, আঞ্চলিক অ্যাডভেঞ্চার থেকে দূরে সরে গিয়ে বিক্ষোভ দমন করার ঘরোয়া প্রচেষ্টার দিকে অনেকটাই শক্তি ব্যয় করতে হতে পারে।
উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলো ইরানের বিক্ষোভকে একই সাথে আশা ও ভয়ের সাথে দেখে। এক দিকে, এটা স্পষ্ট যে, ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো তাদের প্রধান প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে যেটা তাদের জন্য হতে পারে স্বাগত জানানোর মতো। অন্য দিকে, যেকোনো তৃণমূল জনপ্রিয় আন্দোলন যা স্বৈরাচারকে উৎখাত করতে চায় তা হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উপরন্তু, ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের পতনের দৃশ্যকল্প এখন পর্যন্ত অনুমেয়। এ ছাড়া আসন্ন না হলেও পারস্য উপসাগর জুড়ে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতার আভাস দেয় যা একটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতিও।

২০২২ সালজুড়ে, ইরান এবং তিনটি জিসিসি রাষ্ট্র-কুয়েত, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত আলোচনার মাধ্যমে এবং তেহরানে কুয়েত ও আমিরাতের রাষ্ট্রদূতদের প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে তাদের সম্পর্কের উন্নতি করেছে। তবে ইরানে চলমান অস্থিরতা এবং সৌদি অর্থায়িত পারস্য নেটওয়ার্ক এটিকে অনেকাংশে উৎসাহিত করছে মর্মে তেহরানের বিশ্বাস, ইরান-সৌদি সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় আলোচনাকে স্থবির করেছে।

উপসাগরীয় ভূ-রাজনীতির প্রবণতা
২০২২ জুড়ে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোর প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং অন্যান্য পশ্চিমা নেতারা যখন সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স ও যুবরাজ মন্ত্রী মুহাম্মদ বিন সালমানের সাথে সাক্ষাত করেছেন, তখন অনেক ইউরোপীয় দেশ ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনে সৃষ্ট জ্বালানি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহায়তার জন্য উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) সদস্যদের দিকে ফিরেছে।

উভয় প্রবণতা হাইলাইট করে যে, কীভাবে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অনেক উপসাগরীয় আরব দেশকে বিশ্বব্যাপী অভিনেতাদের তাদের গুরুত্বের কথা মনে করিয়ে দিতে সক্ষম করেছিল। গত ১২ মাসে, জিসিসি দেশগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে স্পষ্ট করে তুলতে চাইছে যে, তারা স্বাধীন খেলোয়াড়। এই দেশগুলো তাদের নিজস্ব স্বার্থ অনুসরণ করে; কারণ তারা ক্রমবর্ধমান শক্তির প্রতিযোগিতার মধ্যে ক্রমেই বাইরের বিশ্বে নেভিগেট করতে ব্যস্ত।

এই মাসের শুরুতে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের রিয়াদ সফর এবং ইউক্রেন যুদ্ধে তুলনামূলকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখার পটভূমিতে সৌদি আরব ও রাশিয়া জ্বালানি নীতিতে যেভাবে পরস্পরকে সহযোগিতা করেছে তা ওয়াশিংটনের কাছ থেকে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার জন্য রিয়াদের সংকল্পকে তুলে ধরে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সৌদি নেতৃত্বের হতাশা বাড়ছে, এটি তারও প্রমাণ দেয়। স্বাভাবিকভাবেই, ২০২৩ সালে উপসাগরীয় ‘উন্নয়ন’গুলো কিভাবে কার্যকর হবে সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। তবুও, ২০২২ সাল শেষে বিবেচনা করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা এবং সম্ভাব্য পরিস্থিতি রয়ে গেছে।

ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক
২০২৩ সালে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দিকে আরব অঞ্চলের সামগ্রিক প্রবণতা পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ হবে। ‘আব্রাহাম চুক্তি’তে আরো আরব-মুসলিম দেশগুলোর প্রবেশে বাইডেন প্রশাসন তার কার্ড খেলতে চায় কি না সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। নেতানিয়াহু প্রধানমন্ত্রী হবার পর এটিকে সামনে এগিয়ে নিতে চাইতে পারেন। তবে এখনো সৌদি আরবের মতো দেশ এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে, এমন ইঙ্গিত দেয়নি। ওমান সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রস্তাবকে নাকচ করে দিয়েছে।

আরব রাষ্ট্রগুলো কিভাবে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারের নেতৃত্বে অতি-ডানপন্থী উপাদানগুলোর সাথে মোকাবেলা করে তার ওপর গভীর নজর রাখতে হবে। বিশেষ করে যদি আল-আকসা মসজিদ নিয়ে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় বা গাজা এবং পশ্চিমতীরে ব্যাপক রক্তপাত হয় সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি জটিল হবে। জর্দানের বাদশাহ আবদুল্লাহ এ ধরনের পরিস্থিতির ব্যাপারে ইসরাইলের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, প্রয়োজনে তিনি দেশটির সাথে যুদ্ধে জড়াবেন যাতে ওআইসি দেশগুলোর সমর্থন থাকবে। অবশ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইনের মতো দেশগুলোর ইসরাইলের সাথে নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে যাকে তারা ফিলিস্তিনিদের সাথে সম্পর্কহীন ভাবতে চায়। তবুও ২০২৩ সালে উন্নয়নগুলো কিভাবে উন্মোচিত হয় তার ওপর নির্ভর করে আব্রাহাম চুক্তিতে থাকা বিষয়গুলোর প্রভাবিত করতে পারে সে বিষয়ে সচেতন জিসিসি রাজ্যগুলোর জন্য বিশ্বব্যাপী খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি অতসুদানের মতো অন্যান্য আরব/আফ্রিকান দেশগুলো যদি গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় যেগুলোর মোকাবেলায় জিসিসি রাজ্যগুলোর সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে।

২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপী খাদ্য মূল্যের বৃদ্ধি সিরিয়া, লিবিয়া এবং তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার একটি কারণ ছিল। একই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ২০২৩ সালের শেষের দিকে দেখা দিতে পারে। বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি হওয়ায় খাদ্যের দাম কতটা বৃদ্ধি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে সে বিষয়ে সচেতন থাকা জিসিসি দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

২০২৩ : মধ্যপ্রাচ্যে বিভাজন ও ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব

আপডেট সময় ০৯:৪৫:০৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৪ জানুয়ারী ২০২৩

২০২২ সাল শেষেও বিশ্বের যে ক’টি অঞ্চলে অস্থির পরিস্থিতি বজায় থাকার ইঙ্গিত রয়েছে তার মধ্যে একটি হলো মধ্যপ্রাচ্য। এই অঞ্চলে বিশ শতকের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশজুড়ে যে ভারসাম্য ছিল তা ভেঙে পড়ে নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকে। দ্বিতীয় দশকে সম্পর্কের নতুন সমীকরণ তৈরি হতে থাকে। তৃতীয় দশকের প্রথম দুই বছর ছিল নতুন এক মধ্যপ্রাচ্যের ভিত্তি তৈরির সময়। ২০২৩ সাল এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নতুন এক সময়কালের সূচনার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বছর হতে পারে।

নতুন বছরের শুরুতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন কট্টরপন্থী নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি পশ্চিম তীর ও জেরুসালেমকে ইহুদিকরণের যে প্রক্রিয়া আগের শাসনের সময় শুরু করেছিলেন সেটিকে আরো এগিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। জর্দানের বাদশাহ ব্যতিক্রমীভাবে ইসরাইলের এই নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন যাতে ওআইসি তার পাশে থাকবে বলে উল্লেখ করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের নতুন ভারসাম্যে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত তুরস্কে চ্যালেঞ্জমুখর নির্বাচন এই বছরের মাঝামাঝি।

সৌদি আরবে মুহাম্মদ বিন সালমানের ক্ষমতা গ্রহণের জন্য ২০২৩ হতে পারে এক গুরুত্বপূর্ণ বছর। লিবিয়া ঐক্যবদ্ধ দেশ থেকে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এই সালটি হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ সময়। সিরিয়ায় শান্তি ও স্থিতি আর শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনে ২০২৩ সালে গুরুত্বপূর্ণ কিছু হতে পারে। ইরানের সাথে উপসাগরীয় দেশগুলো এবং তুরস্কের সম্পর্কে যে উত্তেজনা ও টানাপড়েন রয়েছে তার মধ্যে একটি নতুন মেরুকরণও হতে পারে এই সময়ে। এর বাইরে মিসর ইয়েমেন লেবানন তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক পরিবেশে নতুন এক পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে এ সময়।

লিবিয়ার ঐক্যের শেষ সুযোগ
২০২০ সালে লিবিয়ার যুদ্ধবিরতির পর নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও, দেশটির দুই প্রতিদ্ব›দ্বী প্রশাসনের মধ্যে বিভাজন এখনো শক্তিশালী হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে চলমান জাতীয় বিভাজন এবং পরবর্তী মতবিরোধের কারণে ‘আসন্ন নির্বাচন’ এখনো অনুষ্ঠিত হয়নি। দেশটিতে শুধু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াই স্থবির হয়ে পড়েনি, বরং ক্রমেই সঙ্ঘাতের প্রত্যাবর্তন ঘটছে, ত্রিপোলিতে প্রতিদ্ব›দ্বী মিলিশিয়াদের সংঘর্ষে লিবিয়ার পূর্বাঞ্চল থেকে বাহিনী রাজধানীতে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটেছে।

লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় পার্লামেন্টে সৃষ্ট রাজনৈতিক সঙ্কটের প্রত্যক্ষ ফলস্বরূপ ফাতি বাশাঘাকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আবদুল হামিদ দেবীবেহ নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানানো নতুন সঙ্কটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই সঙ্ঘাত এমন এক ভঙ্গুরতার ইঙ্গিত দেয় যাতে সহজে দেশটি আবার গৃহযুদ্ধে ফিরে যেতে পারে।

জাতিসঙ্ঘ যখন সব রাজনৈতিক পক্ষের চুক্তিতে নির্বাচন প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে তখন পূর্ব লিবিয়ার কার্যত শাসক খলিফা হাফতার গত সপ্তাহে সতর্ক করে দেন যে, এই প্রক্রিয়াটির প্রচেষ্টার জন্য এটিই হবে ‘চূড়ান্ত সুযোগ’। পশ্চিম লিবিয়ায় নতুন করে আক্রমণ শুরুর কথা খোলাখুলিভাবে উল্লেখ না করলেও হাফতারের সতর্কতাকে অনেকে তার নেতৃত্বে দেশকে একত্রিত করার চেষ্টা করার জন্য সামরিক শক্তি ব্যবহারের একটি গোপন হুমকি হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। যদি তা না হয়, তবে এর একটি সম্ভাব্য বিকল্প হতে পারে, দেশটি দু’টি প্রতিদ্বন্দ্বী সরকারের মধ্যে বিচ্ছেদে পড়বে।

লিবিয়ার স্বাধীনতা দিবসে যে বক্তৃতায় তিনি এই সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন তার আগে, রাজনৈতিক ও সাংবাদিক বলয়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে হাফতার আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব লিবিয়ার বিচ্ছিন্নতা এবং একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেবেন। এই গুজব অবশ্যই মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে, তবে এর বেশ বাস্তব সম্ভাবনা রয়েছে যে, বিদ্যমান বিচ্ছিন্নতাবাদী আওয়াজ ২০২৩ সালে আবারো নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থ হলে এবং বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা আরো খারাপ হলে সমর্থন লাভ করতে পারে।

তুর্কিয়ে প্রজাতন্ত্রের শত বর্ষে এরদোগানের চ্যালেঞ্জ
২০২৩ সাল হবে আধুনিক তুর্কিয়ে প্রজাতন্ত্রের ১০০তম জন্মদিন। এক শতাব্দী আগে অটোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের ওপর দেশটি সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে এখন পরিস্থিতি অনেক বেশি উত্তেজনাপূর্ণ। কঠোরভাবে ধর্মনিরপেক্ষ পশ্চিমমুখী প্রজাতন্ত্র থেকে বিবর্তিত হয়ে একটি পুনরুজ্জীবিত আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত হয়ে কঠোর সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত সংস্কারের একটি সিরিজ শুরু হয় তুরস্কে। দেশটির আধিপত্যবাদী প্রভাব বিস্তার এবং আরো আত্মবিশ্বাসী স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি নিয়েছে এরদোগানের বর্তমান সরকার।

গত কয়েক বছর ধরে তুরস্কে অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং সিরিয়ার সঙ্ঘাত থেকে লক্ষাধিক শরণার্থীর চলমান উপস্থিতি সামাজিক অস্থিরতা এবং অতি জাতীয়তাবাদী মনোভাবকে জাগিয়ে তুলছে। জনমত জরিপ অনুসারে, এক বছর আগে রাষ্ট্রপতি রজব তৈয়ব এরদোগানের জন্য অনুমোদনের রেটিং সর্বনিম্ন ছিল এবং বছরের ব্যবধানে তার জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে ভোটারদের কাছে আবেদন সৃষ্টির প্রচেষ্টা সত্তে¡ও দেশটিতে ব্যাপক অসন্তোষ রয়ে গেছে। তুর্কিয়ে জনগণের একটি বড় অংশ পরিবর্তন চাইছে।

২০২৩ সালে বিরোধী পক্ষের জন্য এই পরিবর্তনের একটি সুযোগ আসতে পারে, দেশের শতবর্ষের সময়ই জুনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এটি তুরস্কের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে জটিল নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এরদোগান এবং তার ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একেপি) চ্যালেঞ্জময় সময়ের একটি ঘটনা বিরোধী দল এবং প্রার্থীদের জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এই মাসে ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোগ্লুকে দুই বছরেরও বেশি মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তার ওপর আরোপিত রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞার শাস্তিতে অনেকে বিশ্বাস করে যে, এটি নির্বাচনে এরদোগানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বিরোধিতা জাগিয়ে তুলবে। বিরোধী দলগুলোর পেছনে একত্রিত হওয়ার জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রার্থী হিসেবে মনে করা ইমামোগ্লুকে রাজনীতি থেকে কার্যত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ঠিক দুই দশক আগে এরদোগানের বিরুদ্ধে এমন একটি পদক্ষেপ বর্তমান রাষ্ট্রপতির জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তুলেছিল। এখন এটা কি এরদোগানের পতন ঘটাতে পারে, তা নিয়ে অনেকে নানামুখী বিশ্লেষণ করছেন। ইমামোগ্লু নিষেধাজ্ঞা এবং তুরস্কে উদ্বেগজনক বিভিন্ন সঙ্কটের ঝুঁকি থাকা সত্তে¡ও, এরদোগান এখনো বিরোধীদের সামনে একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হয়ে আছেন। একেপি এখনো বর্তমান নির্বাচনে সর্বোচ্চ জনপ্রিয় দল আর জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পার্টির (এমএইচপি) সাথে তারা জোট বজায় রেখেছে। গত নির্বাচনের পর থেকে এমএইচপির র‌্যাংকিংয়ের পতন হয়েছে, কিন্তু উভয় দলই একসাথে আধিপত্য বিস্তার করতে পারে।

তুর্কিয়ে সরকারের ‘ভিশন ২০২৩’-এর বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এটি গত দশকে ঘোষণা করা উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যগুলোর একটি সেট। এর অগ্রগতি অবশ্যই নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচন চলাকালীন সময়ে মূল্যায়ন করা হবে, যা ২০২৩ একেপির টিকে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে। তুরস্কে সাধারণভাবে জাতীয় নিরাপত্তা ও অগ্রগতির জন্য এরদোগানকে বিকল্পহীনভাবে দেশের অনেক মানুষ। তিনি তুরস্ককে আঞ্চলিক পরাশক্তি করেন এবং বৈশ্বিক রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে গেছেন। অর্থনৈতিকভাবে দেশটিকে ইউরোপের রুগ্ণ দেশের অবস্থান থেকে প্রতিশ্রুতিশীল দেশে রূপান্তরের নায়কও তিনি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনীতির নানা দিকে দুর্বল অবস্থা বিশেষত লিরার দাম অবনয়ন এবং উচ্চ হারের মূল্যস্ফীতি এরদোগানের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তিনি অনেক পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন। আগামী ৫-৬ মাসে এ ক্ষেত্রে সাফল্যের পাশাপাশি সিরিয়ার সাথে রুশ মধ্যস্থতায় যে আলোচনা আঙ্কারা শুরু করেছে তার সাফল্যের পথ ধরে সিরীয় শরণার্থীদের স্বদেশে পুনর্বাসন করতে পারলে এটি আবারো এরদোগানের জন্য বিজয়ের ভিত তৈরি করে দিতে পারে।

তুর্কিয়ে ও ইরান কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা
নাগরনো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে আজারবাইজান এবং আর্মেনিয়ার মধ্যে নতুন করে সঙ্ঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে, তুরস্ক এবং ইরানের মধ্যে একটি বিস্তৃত পরিসরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যাচ্ছে। আঙ্কারা যখন যুদ্ধে বাকুকে তার ড্রোন এবং সামরিক সহায়তা দিয়ে সমর্থন করেছিল, তখন তেহরান গোপনে ইয়েরেভানকে সমর্থন করে চুপচাপ অস্ত্র হস্তান্তর করে। আর্মেনিয়ার প্রতি ইরানের সমর্থন একটি সুস্পষ্ট এবং প্রত্যাশিত নীতি, এটি শুধু উত্তর-পশ্চিম ইরানে তার আজেরি জনসংখ্যার মধ্যে জাতীয়তাবাদী অনুভূতিকে প্রশমিত করার প্রচেষ্টা হিসাবে নয়, তবে প্রাথমিক কারণ এটি বাকুকে মোকাবেলা করার জন্য তেহরানের ভ‚-রাজনৈতিক স্বার্থের মধ্যে রয়েছে।

দু’দেশের মধ্যে সমস্যা আঞ্চলিক কৌশলগত সুবিধাকে কেন্দ্র করে। এর একটি মূল উদাহরণ হলো জাঙ্গেজুর করিডোরকে ঘিরে সমস্যা, এটি একটি আর্মেনিয়ান ভ‚খণ্ড যা আজারবাইজানের মূল ভ‚খণ্ড এবং এর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল নাখিচেভানকে আলাদা করে রেখেছে। আঙ্কারা এবং বাকু, উভয়ই আজারবাইজানীয় রাজধানী থেকে তুর্কিয়ে শহর কার্স পর্যন্ত একটি পরিবহন রুট স্থাপন এবং প্রসারিত করতে চায়। এই রুটটি জাঙ্গেজুর করিডোরের ওপর দিয়ে যায়। এর প্রবক্তারা বলেন যে, এই ধরনের একটি প্রকল্প দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলের জন্য অনেক অর্থনৈতিক সুযোগ ও দীর্ঘমেয়াদি শান্তি উন্মুক্ত করবে। আর এটি প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে সবচেয়ে ছোট স্থল পরিবহন রুট হিসেবে কাজ করবে, সেই সাথে এশিয়ার মধ্যে ইউরোপের সাথে একটি নতুন সংযোগ সৃষ্টি করবে।

তুরস্কের জন্য, এটি অবশ্যই হবে একটি উল্লেখযোগ্য সুবিধা। আঙ্কারা এর মাধ্যমে কাস্পিয়ান সাগরের প্রবেশদ্বার হিসেবে এবং মধ্য এশিয়ার রাজ্যগুলোর সাথে সংযোগের একটি সংক্ষিপ্ত রুট পাবে। তারা ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধের মধ্যে ইউরোপে প্রবেশের জন্য একটি অতিরিক্ত রুট খুঁজছে। এটি দৃশ্যত এত গুরুত্বপূর্ণ যে, আঙ্কারা ইয়েরেভানের সাথে তার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য এটিকে একটি মূল শর্ত বানিয়েছে।

এ দিকে তেহরান ব্যাপকভাবে এর বিরোধিতা করে চলেছে; কারণ এটি সরাসরি তুরস্ককে মূল ভ‚খণ্ড আজারবাইজানের সাথে সংযুক্ত করবে, আজারবাইজানিদের আর নাখিচিভানে যাতায়াতের জন্য ইরানের মধ্য দিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না এবং ইরান-আর্মেনিয়ান সীমান্তটি একধরনের অবরুদ্ধতার মধ্যে পড়ার আশঙ্কা থাকবে। ইরানের জন্য এটি নেতিবাচক হলেও তুরস্কের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক অগ্রগতি হবে এবং এর প্রভাবকে বাড়িয়ে তুলবে দক্ষিণ ককেশাসে।

সিরিয়ায় তুর্কিয়ে-সমর্থিত বাহিনী এবং ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্য ও সঙ্ঘাতের সাথে এটি দু’দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে আরো গভীর করতে পারে। যদিও এর অর্থ আঙ্কারা এবং তেহরানের মধ্যে সামরিক সঙ্ঘাত নয়, তবে এর অর্থ হতে পারে, দুই আঞ্চলিক শক্তির নেতৃত্বে প্রভাব বিস্তারে বৃহত্তর অক্ষের গঠন।

জিসিসি পরিবারের পুনর্মিলন
সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ যারা কাতারকে ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২১ সালের প্রথম পর্যন্ত অবরোধ করেছিল, তারা ২০২২ জুড়ে দোহার সাথে তাদের সম্পর্ক উন্নত করেছে। জিসিসি পরিবারের দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কের এই সামগ্রিক উষ্ণতা ২০২৩ সালেও অব্যাহত থাকতে পারে। রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্র এবং মানুষ থেকে মানুষ স্তরে এই সম্পর্ক বাড়তে পারে। কাতারে শেষ হওয়া বিশ্বকাপটি একটি উদ্দীপক হিসেবে কাজ করার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিশ্বকাপ চলাকালে সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান- এমবিএস এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ-এমবিজেড যেভাবে দোহায় কাতারের আমিরের সাথে দেখা করেছিলেন তা তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২১ সালের শুরুর দিকে কাতারের অবরোধের সময় দোহায় এই তিন নেতার মধ্যে এ ধরনের আনন্দদায়ক বৈঠক অকল্পনীয় ছিল।
নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে, ইয়েমেনে ‘কোনো যুদ্ধও নেই, শান্তিও নেই’ এর বিবর্তন জিসিসি সদস্যদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে। ২০২৩ ইয়েমেনিদের জন্য একটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং বছর ছাড়া অন্য কিছু হবে বলে আশা করার কারণ নেই। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বিশ্বাস করেন যে, শান্তির দিকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির সম্ভাবনা ক্ষীণ।

কিছু বিশ্লেষক উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, ইয়েমেনে স্থায়ী শান্তি আনার একমাত্র বাস্তবসম্মত উপায় উত্তর-দক্ষিণ লাইনে দেশকে বিভক্ত করা এবং ১৯৯০ সালের পুনঃএকত্রীকরণের আশা ছেড়ে দেয়া যদিও বিভাজন অগণিত চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে এবং এর সমস্যাযুক্ত নানা দিক রয়েছে।

নতুন বছরেও ইয়েমেনে হুথিরা সম্ভবত প্রভাবশালী থাকবে। এ সময় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার তার ঐক্য বাড়াতে ব্যর্থ হবে এবং তাই একটি শক্তিশালী হুথি বিরোধী ফ্রন্ট গড়ে তুলতে হবে। এই প্রেক্ষাপটে, সৌদি আরব ক্রমবর্ধমানভাবে তার ব্যয়বহুল হস্তক্ষেপের চাপ অনুভব করবে যা ২০২৩ সালের মার্চ মাসে তার নবম বছরে প্রবেশ করবে।

এই সময়ে সৌদি আরব এবং আমিরাত কিভাবে ইয়েমেনে তাদের বিরোধপূর্ণ স্বার্থের মোকাবেলা করে তা দেখা গুরুত্বপূর্ণ হবে। বিশেষ করে যদি ২০২৩ সালে রিয়াদ এবং আবুধাবির পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত দলগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে আরো লড়াইয়ে লিপ্ত হয় তখন পরিস্থিতি জটিল হবে। এখন পর্যন্ত, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত বেশির ভাগ ইয়েমেনে তাদের মতবিরোধ নিষ্পত্তি করতে সফল হয়েছে। তবুও, এটি সম্ভবত আগামী বছর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিরোধের একটি উৎস থেকে যাবে।

ইরানে অস্থিরতা জিসিসির জন্য মিশ্র বার্তা
সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ইরানের ‘নৈতিকতা পুলিশ’ হেফাজতে থাকাকালীন মাহসা জিনা আমিনির মৃত্যু দেশব্যাপী বিক্ষোভ শুরু করে যা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বৈধতার জন্য একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও কেউ যুক্তি দিতে পারে যে, ইরান রাষ্ট্রের পতন দেখতে কোনো একক আরব রাষ্ট্রের আগ্রহ নেই, তবে জিসিসির ইরান-বিরোধী দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন তাদের পারস্য প্রতিবেশী দেশজুড়ে অস্থিরতাকে সম্ভবত এক অর্থে লাভজনক হিসেবে দেখছে। তেহরানের নেতৃত্বকে ২০২৩ সালের পুরোটা না হলেও, আঞ্চলিক অ্যাডভেঞ্চার থেকে দূরে সরে গিয়ে বিক্ষোভ দমন করার ঘরোয়া প্রচেষ্টার দিকে অনেকটাই শক্তি ব্যয় করতে হতে পারে।
উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলো ইরানের বিক্ষোভকে একই সাথে আশা ও ভয়ের সাথে দেখে। এক দিকে, এটা স্পষ্ট যে, ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো তাদের প্রধান প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে যেটা তাদের জন্য হতে পারে স্বাগত জানানোর মতো। অন্য দিকে, যেকোনো তৃণমূল জনপ্রিয় আন্দোলন যা স্বৈরাচারকে উৎখাত করতে চায় তা হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উপরন্তু, ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের পতনের দৃশ্যকল্প এখন পর্যন্ত অনুমেয়। এ ছাড়া আসন্ন না হলেও পারস্য উপসাগর জুড়ে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতার আভাস দেয় যা একটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতিও।

২০২২ সালজুড়ে, ইরান এবং তিনটি জিসিসি রাষ্ট্র-কুয়েত, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত আলোচনার মাধ্যমে এবং তেহরানে কুয়েত ও আমিরাতের রাষ্ট্রদূতদের প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে তাদের সম্পর্কের উন্নতি করেছে। তবে ইরানে চলমান অস্থিরতা এবং সৌদি অর্থায়িত পারস্য নেটওয়ার্ক এটিকে অনেকাংশে উৎসাহিত করছে মর্মে তেহরানের বিশ্বাস, ইরান-সৌদি সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় আলোচনাকে স্থবির করেছে।

উপসাগরীয় ভূ-রাজনীতির প্রবণতা
২০২২ জুড়ে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোর প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং অন্যান্য পশ্চিমা নেতারা যখন সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স ও যুবরাজ মন্ত্রী মুহাম্মদ বিন সালমানের সাথে সাক্ষাত করেছেন, তখন অনেক ইউরোপীয় দেশ ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনে সৃষ্ট জ্বালানি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহায়তার জন্য উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) সদস্যদের দিকে ফিরেছে।

উভয় প্রবণতা হাইলাইট করে যে, কীভাবে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অনেক উপসাগরীয় আরব দেশকে বিশ্বব্যাপী অভিনেতাদের তাদের গুরুত্বের কথা মনে করিয়ে দিতে সক্ষম করেছিল। গত ১২ মাসে, জিসিসি দেশগুলো ক্রমবর্ধমানভাবে স্পষ্ট করে তুলতে চাইছে যে, তারা স্বাধীন খেলোয়াড়। এই দেশগুলো তাদের নিজস্ব স্বার্থ অনুসরণ করে; কারণ তারা ক্রমবর্ধমান শক্তির প্রতিযোগিতার মধ্যে ক্রমেই বাইরের বিশ্বে নেভিগেট করতে ব্যস্ত।

এই মাসের শুরুতে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের রিয়াদ সফর এবং ইউক্রেন যুদ্ধে তুলনামূলকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখার পটভূমিতে সৌদি আরব ও রাশিয়া জ্বালানি নীতিতে যেভাবে পরস্পরকে সহযোগিতা করেছে তা ওয়াশিংটনের কাছ থেকে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করার জন্য রিয়াদের সংকল্পকে তুলে ধরে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সৌদি নেতৃত্বের হতাশা বাড়ছে, এটি তারও প্রমাণ দেয়। স্বাভাবিকভাবেই, ২০২৩ সালে উপসাগরীয় ‘উন্নয়ন’গুলো কিভাবে কার্যকর হবে সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। তবুও, ২০২২ সাল শেষে বিবেচনা করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা এবং সম্ভাব্য পরিস্থিতি রয়ে গেছে।

ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক
২০২৩ সালে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের দিকে আরব অঞ্চলের সামগ্রিক প্রবণতা পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ হবে। ‘আব্রাহাম চুক্তি’তে আরো আরব-মুসলিম দেশগুলোর প্রবেশে বাইডেন প্রশাসন তার কার্ড খেলতে চায় কি না সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। নেতানিয়াহু প্রধানমন্ত্রী হবার পর এটিকে সামনে এগিয়ে নিতে চাইতে পারেন। তবে এখনো সৌদি আরবের মতো দেশ এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে, এমন ইঙ্গিত দেয়নি। ওমান সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রস্তাবকে নাকচ করে দিয়েছে।

আরব রাষ্ট্রগুলো কিভাবে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারের নেতৃত্বে অতি-ডানপন্থী উপাদানগুলোর সাথে মোকাবেলা করে তার ওপর গভীর নজর রাখতে হবে। বিশেষ করে যদি আল-আকসা মসজিদ নিয়ে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় বা গাজা এবং পশ্চিমতীরে ব্যাপক রক্তপাত হয় সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি জটিল হবে। জর্দানের বাদশাহ আবদুল্লাহ এ ধরনের পরিস্থিতির ব্যাপারে ইসরাইলের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, প্রয়োজনে তিনি দেশটির সাথে যুদ্ধে জড়াবেন যাতে ওআইসি দেশগুলোর সমর্থন থাকবে। অবশ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইনের মতো দেশগুলোর ইসরাইলের সাথে নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে যাকে তারা ফিলিস্তিনিদের সাথে সম্পর্কহীন ভাবতে চায়। তবুও ২০২৩ সালে উন্নয়নগুলো কিভাবে উন্মোচিত হয় তার ওপর নির্ভর করে আব্রাহাম চুক্তিতে থাকা বিষয়গুলোর প্রভাবিত করতে পারে সে বিষয়ে সচেতন জিসিসি রাজ্যগুলোর জন্য বিশ্বব্যাপী খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি অতসুদানের মতো অন্যান্য আরব/আফ্রিকান দেশগুলো যদি গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় যেগুলোর মোকাবেলায় জিসিসি রাজ্যগুলোর সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে।

২০০৮ সালের বিশ্বব্যাপী খাদ্য মূল্যের বৃদ্ধি সিরিয়া, লিবিয়া এবং তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার একটি কারণ ছিল। একই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ২০২৩ সালের শেষের দিকে দেখা দিতে পারে। বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি হওয়ায় খাদ্যের দাম কতটা বৃদ্ধি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে সে বিষয়ে সচেতন থাকা জিসিসি দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।