ঢাকা , মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

আরাভ খানকে নিয়ে ব্যস্ত দেশ চাপা পড়ছে মূল ইস্যু

কথায় বলে, হুজুগে বাঙালি। সামনে যা পায় তা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সংবাদের শিরোনাম হিসেবে কখনো আসে ‘হিরো আলম’ কখনো বা আরাভ খানরা। বাংলাদেশের যেকোনো সংবাদ মাধ্যম তো আছেই উপরন্তু বিদেশী অনেক নামী-দামি সংবাদমাধ্যমেও তাদের নিয়ে আলোচনা করে অজাত থেকে জাতে তুলে নিয়ে আসে। সোশ্যাল মিডিয়া তো আছেই। এখন আলোচনার টপে আছে আরাভ খান। পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার আসামি আরাভ খানকে নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে আলোচনা-সমালোচনার পারদ এতটাই ওঠানামা করছে যে, সেই স্রোতে বাংলাদেশের আলোচনার মূল ইস্যু চাপা পড়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের আলোচনার মূল ইস্যু কী, সেই ব্যাপারে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু একটি শেষ না হতেই ভিন্ন আরেকটি ইস্যু তৈরি করে মূল বিষয়টিকে আড়াল করার এক ধরনের কৌশল চলছে বলেই মনে হচ্ছে। পুলিশ হত্যাসহ ৯ মামলার আসামি দেশ থেকে কীভাবে পালিয়ে গেল, তার পালিয়ে যাওয়ার পেছনে যাদের নাম আসছে তাদের মুখোশ উন্মোচন না করে আরাভ খানের মতো একজন সামান্যকে নিয়ে সর্বমহলে আলোচনা করে তার অজাত পরিচিতিকে জাতে তোলা হচ্ছে। কার্যত তার কিছু হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ রাষ্ট্রযন্ত্রের কারো না কারো আশীর্বাদে এমন আরাভ খান প্রতিদিনই কতজন জন্ম নিচ্ছে তার হিসাব নেই। তাদের শেকড় অনেক গভীরে।

এক মাসে তিনবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। দ্রব্যমূল্যের প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমা অতিক্রম করছে অনেক আগেই। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। মানুষ তার ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে কিনা, নাকি আবারো ২০১৪ এবং ২০১৮-এর দানবীয় দৈত্য তাদের ভোটের অধিকার হরণ করে নেবে সেই চিন্তায় জাতি যখন মগ্ন ঠিক তখনই কখনো অগ্নিকাণ্ড, কখনো আরাভ খানদের সামনে এনে জনগণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়া হচ্ছে। বিএনপিসহ মাঠের সব বিরোধী রাজনৈতিক দল একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণকে যখন একত্রিত করার চেষ্টা করছে তখনই এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। আর এ কারণেই এত উন্নত বাংলাদেশকে জাতিসঙ্ঘ কেন এশিয়ার দ্বিতীয় দরিদ্রতম দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করল সেই আলোচনা জায়গায়ই পেল না। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে খুব একটা আসতে পারল না ২০১৮ সালের নির্বাচন, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণ নিয়ে তুলে ধরা মার্কিন প্রতিবেদনটি। সংবাদ মাধ্যম পড়ে আছে কোথাকার কোন রবিউল ইসলাম রবিউল ওরফে আরাভ খানকে নিয়ে। কিছু দিন আগে হিরো আলম ছিল মিডিয়া জগতে আলোচনার শীর্ষে। কী অদ্ভুত রুচি আমাদের!

এই সমাজ ও সমাজের লোকদের ভুলে গেলে চলবে না, সমাজ থেকে অপরাধ বন্ধ করতে হলে এবং যারা আরাভ খানদের তৈরি করে তাদেরকে পাকড়াও করতে হলে বর্তমান রাষ্ট্রযন্ত্রকে মেরামত করতে হবে। আর এই রাষ্ট্রযন্ত্র মেরামত করতে হলে প্রথমেই বর্তমান অগণতান্ত্রিক সরকারকে সরিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এনে অগণতান্ত্রিক সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ফ্যাসিবাদী কায়দায় গড়ে তোলা হয়েছে তা ঠিক করে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। আর এই কাজে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে মিডিয়াজগতকে। মিডিয়া যদি এই মূল ইস্যু ভুলে গিয়ে আরাভ খানদের নিয়ে পড়ে থাকে তাহলে সমাজের সাধারণ মানুষ তাদের অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার হওয়ার সাহস পাবে না।

অধিকার আদায়ের আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোর যেমন ইতিবাচক ভ‚মিকা থাকতে হবে তেমনি অধিকার হারানো জনগণেরও দায়বদ্ধতা রয়েছে আন্দোলনে শরিক হওয়ার। এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, জনগণ ভোটের অধিকার হারিয়েছে। অধিকার নিয়ে কথা বলার অধিকারও হারিয়েছে। এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে- এটিই আজকের দিনের বাস্তবতা। আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না। কারণ বর্তমান সরকার সেই পথে হাঁটলে তাদের বেশির ভাগের জামানত যে বাঁচবে না সেই উপলব্ধি তাদের আছে। অতিসম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন প্রমাণ করেছে- ২০২৩ সালের নির্বাচনের ধরন কেমন হবে। এই শঙ্কা শুধু এই দেশের কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের কিংবা সাধারণ জনগণেরই নয়; আন্তর্জাতিক বিশ্বও আগামী নির্বাচন যে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হবে না সে ব্যাপারে শঙ্কিত।

এ কারণেই সদ্য বিদায়ী বাংলাদেশে নিয়োজিত জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে বৈশ্বিক মতামতের একটি গুরুত্ব আছে। জাপান ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরপর উদ্বেগ জানিয়েছিল। আমরা নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার কথা শুনেছি, যা পৃথিবীর আর কোথাও শুনিনি। আমি আশা করব, এবার তেমন সুযোগ থাকবে না বা এমন ঘটনা ঘটবে না।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আমি শুনেছি, পুলিশ নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে ফেলেছে। আমি অন্য কোনো দেশে এ ধরনের উদাহরণ শুনিনি।’ এটি এই দেশ ও দেশের মানুষের জন্য চরম লজ্জাকর ব্যাপার। আমাদের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার জায়গা দাতা দেশগুলোর কাছে কতটা হীন তা উপরিউক্ত বক্তব্যে স্পষ্ট।

যে দেশের নির্বাচনে জনগণের ভোট চুরির কাজে পুলিশের ভূমিকা থাকে মুখ্য সেই দেশে আরাভ খানদের মতো লোকদের নিচু থেকে উপরে তোলার কাজে কারা জড়িত তা খুঁজে বের করতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। একজন পুলিশ খুনের আসামি ধরা পড়ার পর পুলিশের ঊর্র্ধ্বতন কর্মকর্তার ফোনে ছেড়ে দেয়া হয়। বিদেশে পালিয়ে যায়, কয়েকবার করে দেশে আসা-যাওয়া করে, মাত্র কয়েক বছরে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যায়, দুবাইয়ের মতো দেশে স্বর্ণের দোকান দেয়, তা উদ্বোধন করার জন্য আবার দেশসেরা ক্রিকেটারসহ অনেক শিল্পীকে ভাড়া করে নিয়ে যায়। এটি কিভাবে সম্ভব?

সম্ভব এ কারণে যে, এর পেছনের শক্তি অনেক বেশি। এই শক্তিকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে না পারলে এর পেছনে পড়ে থেকে কোনো লাভ নেই। জনগণের মনে প্রশ্নের উদয় হয়েছে, আরাভ খানের সাথে যে পুলিশ কর্মকর্তার নাম এসেছে তাকে কেন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে না? জনগণও জানে তাকে ধরা হবে না। কারণ আরাভ খানের ইস্যু একটি ওসিলা মাত্র। এই ওসিলার জের জনগণকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আরাভ খান এমন বিখ্যাত কেউ নন যে, তাকে ধরে এনে জেলে পুরে রাখলে বা তাকে ধরে এনে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের মাধ্যমে সে কিভাবে এত টাকার মালিক হলো সেই রহস্য উদ্ঘাটন করলে জাতি মহা দুর্নীতির হাত থেকে বেঁচে যাবে বা তার শাস্তি দেখে আর কেউ দুর্নীতি, চুরি, ডাকাতি করবে না।

আরাভ খান একজন পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার আসামি। যেকোনো হত্যাই বড় অপরাধ, তাই তার বিচার হওয়াও জরুরি। কিন্তু যারা দেশের কোটি কোটি মানুষের ভোটের অধিকার, স্বাধীন মতের অধিকার কেড়ে নিয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করেছে তারা কি অপরাধী নয়?

মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের উদ্ধৃত করে ‘দ্য-২০২২ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিস’ প্রতিবেদনে বলেছে, ‘২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছে, নির্বাচনে জাল ভোট দেয়া হয়েছে এবং বিরোধী দলীয় পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের ভয় দেখানোসহ গুরুতর অনিয়ম হয়েছে।’ বলা হয়েছে, ‘২০১৮ সালে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ এবং তার নির্বাচনী জোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয় লাভ করেছে। যেখানে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তার নির্বাচনী জোট জয়ী হয়েছে সাতটি আসনে। নির্বাচনের আগে প্রচারণার সময় হয়রানি, ভয় দেখানো, নির্বিচারে গ্রেফতার ও সহিংসতার অনেক বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন ছিল। এর ফলে অনেক বিরোধীদলীয় প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের ভোটারদের সাথে দেখা করা, সমাবেশ করা বা অবাধে প্রচারণা চালানো কঠিন হয়ে উঠেছিল।’

মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সরকার বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনে মামলা করেছে।’ ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ অব বাংলাদেশ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২০২০-এর জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ফেব্রæয়ারির মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮৯০টি মামলায় অন্তত দুই হাজার ২৪৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রাজনীতিবিদ, এরপরই আছেন সাংবাদিক।’

বিভিন্ন প্রতিবেদনের সারমর্ম হচ্ছে, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি গণতন্ত্রের পরিপন্থী। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে না পারলে সঙ্কট বাড়তেই থাকবে, আর এর খেসারত দিতে হবে জনগণকে। তাই বলতে চাই, আমরা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর ভয়ের রাজ্যে বাস করতে চাই না। আমরা এ থেকে মুক্তি চাই। এই মুক্তির জন্য এক আরাভ খানকে নিয়ে মশগুল না থেকে বর্তমানের গোটা সঙ্কট পরিস্থিতির চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। জনগণ সচেতন হলেই অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

আরাভ খানকে নিয়ে ব্যস্ত দেশ চাপা পড়ছে মূল ইস্যু

আপডেট সময় ১২:৫৯:৫৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ এপ্রিল ২০২৩

কথায় বলে, হুজুগে বাঙালি। সামনে যা পায় তা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সংবাদের শিরোনাম হিসেবে কখনো আসে ‘হিরো আলম’ কখনো বা আরাভ খানরা। বাংলাদেশের যেকোনো সংবাদ মাধ্যম তো আছেই উপরন্তু বিদেশী অনেক নামী-দামি সংবাদমাধ্যমেও তাদের নিয়ে আলোচনা করে অজাত থেকে জাতে তুলে নিয়ে আসে। সোশ্যাল মিডিয়া তো আছেই। এখন আলোচনার টপে আছে আরাভ খান। পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার আসামি আরাভ খানকে নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে আলোচনা-সমালোচনার পারদ এতটাই ওঠানামা করছে যে, সেই স্রোতে বাংলাদেশের আলোচনার মূল ইস্যু চাপা পড়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের আলোচনার মূল ইস্যু কী, সেই ব্যাপারে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু একটি শেষ না হতেই ভিন্ন আরেকটি ইস্যু তৈরি করে মূল বিষয়টিকে আড়াল করার এক ধরনের কৌশল চলছে বলেই মনে হচ্ছে। পুলিশ হত্যাসহ ৯ মামলার আসামি দেশ থেকে কীভাবে পালিয়ে গেল, তার পালিয়ে যাওয়ার পেছনে যাদের নাম আসছে তাদের মুখোশ উন্মোচন না করে আরাভ খানের মতো একজন সামান্যকে নিয়ে সর্বমহলে আলোচনা করে তার অজাত পরিচিতিকে জাতে তোলা হচ্ছে। কার্যত তার কিছু হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ রাষ্ট্রযন্ত্রের কারো না কারো আশীর্বাদে এমন আরাভ খান প্রতিদিনই কতজন জন্ম নিচ্ছে তার হিসাব নেই। তাদের শেকড় অনেক গভীরে।

এক মাসে তিনবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। দ্রব্যমূল্যের প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমা অতিক্রম করছে অনেক আগেই। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। মানুষ তার ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে কিনা, নাকি আবারো ২০১৪ এবং ২০১৮-এর দানবীয় দৈত্য তাদের ভোটের অধিকার হরণ করে নেবে সেই চিন্তায় জাতি যখন মগ্ন ঠিক তখনই কখনো অগ্নিকাণ্ড, কখনো আরাভ খানদের সামনে এনে জনগণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়া হচ্ছে। বিএনপিসহ মাঠের সব বিরোধী রাজনৈতিক দল একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণকে যখন একত্রিত করার চেষ্টা করছে তখনই এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। আর এ কারণেই এত উন্নত বাংলাদেশকে জাতিসঙ্ঘ কেন এশিয়ার দ্বিতীয় দরিদ্রতম দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করল সেই আলোচনা জায়গায়ই পেল না। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে খুব একটা আসতে পারল না ২০১৮ সালের নির্বাচন, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণ নিয়ে তুলে ধরা মার্কিন প্রতিবেদনটি। সংবাদ মাধ্যম পড়ে আছে কোথাকার কোন রবিউল ইসলাম রবিউল ওরফে আরাভ খানকে নিয়ে। কিছু দিন আগে হিরো আলম ছিল মিডিয়া জগতে আলোচনার শীর্ষে। কী অদ্ভুত রুচি আমাদের!

এই সমাজ ও সমাজের লোকদের ভুলে গেলে চলবে না, সমাজ থেকে অপরাধ বন্ধ করতে হলে এবং যারা আরাভ খানদের তৈরি করে তাদেরকে পাকড়াও করতে হলে বর্তমান রাষ্ট্রযন্ত্রকে মেরামত করতে হবে। আর এই রাষ্ট্রযন্ত্র মেরামত করতে হলে প্রথমেই বর্তমান অগণতান্ত্রিক সরকারকে সরিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এনে অগণতান্ত্রিক সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ফ্যাসিবাদী কায়দায় গড়ে তোলা হয়েছে তা ঠিক করে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। আর এই কাজে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে মিডিয়াজগতকে। মিডিয়া যদি এই মূল ইস্যু ভুলে গিয়ে আরাভ খানদের নিয়ে পড়ে থাকে তাহলে সমাজের সাধারণ মানুষ তাদের অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার হওয়ার সাহস পাবে না।

অধিকার আদায়ের আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোর যেমন ইতিবাচক ভ‚মিকা থাকতে হবে তেমনি অধিকার হারানো জনগণেরও দায়বদ্ধতা রয়েছে আন্দোলনে শরিক হওয়ার। এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, জনগণ ভোটের অধিকার হারিয়েছে। অধিকার নিয়ে কথা বলার অধিকারও হারিয়েছে। এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে- এটিই আজকের দিনের বাস্তবতা। আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না। কারণ বর্তমান সরকার সেই পথে হাঁটলে তাদের বেশির ভাগের জামানত যে বাঁচবে না সেই উপলব্ধি তাদের আছে। অতিসম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন প্রমাণ করেছে- ২০২৩ সালের নির্বাচনের ধরন কেমন হবে। এই শঙ্কা শুধু এই দেশের কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের কিংবা সাধারণ জনগণেরই নয়; আন্তর্জাতিক বিশ্বও আগামী নির্বাচন যে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হবে না সে ব্যাপারে শঙ্কিত।

এ কারণেই সদ্য বিদায়ী বাংলাদেশে নিয়োজিত জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে বৈশ্বিক মতামতের একটি গুরুত্ব আছে। জাপান ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরপর উদ্বেগ জানিয়েছিল। আমরা নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার কথা শুনেছি, যা পৃথিবীর আর কোথাও শুনিনি। আমি আশা করব, এবার তেমন সুযোগ থাকবে না বা এমন ঘটনা ঘটবে না।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আমি শুনেছি, পুলিশ নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে ফেলেছে। আমি অন্য কোনো দেশে এ ধরনের উদাহরণ শুনিনি।’ এটি এই দেশ ও দেশের মানুষের জন্য চরম লজ্জাকর ব্যাপার। আমাদের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার জায়গা দাতা দেশগুলোর কাছে কতটা হীন তা উপরিউক্ত বক্তব্যে স্পষ্ট।

যে দেশের নির্বাচনে জনগণের ভোট চুরির কাজে পুলিশের ভূমিকা থাকে মুখ্য সেই দেশে আরাভ খানদের মতো লোকদের নিচু থেকে উপরে তোলার কাজে কারা জড়িত তা খুঁজে বের করতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। একজন পুলিশ খুনের আসামি ধরা পড়ার পর পুলিশের ঊর্র্ধ্বতন কর্মকর্তার ফোনে ছেড়ে দেয়া হয়। বিদেশে পালিয়ে যায়, কয়েকবার করে দেশে আসা-যাওয়া করে, মাত্র কয়েক বছরে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যায়, দুবাইয়ের মতো দেশে স্বর্ণের দোকান দেয়, তা উদ্বোধন করার জন্য আবার দেশসেরা ক্রিকেটারসহ অনেক শিল্পীকে ভাড়া করে নিয়ে যায়। এটি কিভাবে সম্ভব?

সম্ভব এ কারণে যে, এর পেছনের শক্তি অনেক বেশি। এই শক্তিকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে না পারলে এর পেছনে পড়ে থেকে কোনো লাভ নেই। জনগণের মনে প্রশ্নের উদয় হয়েছে, আরাভ খানের সাথে যে পুলিশ কর্মকর্তার নাম এসেছে তাকে কেন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে না? জনগণও জানে তাকে ধরা হবে না। কারণ আরাভ খানের ইস্যু একটি ওসিলা মাত্র। এই ওসিলার জের জনগণকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আরাভ খান এমন বিখ্যাত কেউ নন যে, তাকে ধরে এনে জেলে পুরে রাখলে বা তাকে ধরে এনে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের মাধ্যমে সে কিভাবে এত টাকার মালিক হলো সেই রহস্য উদ্ঘাটন করলে জাতি মহা দুর্নীতির হাত থেকে বেঁচে যাবে বা তার শাস্তি দেখে আর কেউ দুর্নীতি, চুরি, ডাকাতি করবে না।

আরাভ খান একজন পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলার আসামি। যেকোনো হত্যাই বড় অপরাধ, তাই তার বিচার হওয়াও জরুরি। কিন্তু যারা দেশের কোটি কোটি মানুষের ভোটের অধিকার, স্বাধীন মতের অধিকার কেড়ে নিয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েম করেছে তারা কি অপরাধী নয়?

মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের উদ্ধৃত করে ‘দ্য-২০২২ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিস’ প্রতিবেদনে বলেছে, ‘২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছে, নির্বাচনে জাল ভোট দেয়া হয়েছে এবং বিরোধী দলীয় পোলিং এজেন্ট ও ভোটারদের ভয় দেখানোসহ গুরুতর অনিয়ম হয়েছে।’ বলা হয়েছে, ‘২০১৮ সালে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ এবং তার নির্বাচনী জোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয় লাভ করেছে। যেখানে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তার নির্বাচনী জোট জয়ী হয়েছে সাতটি আসনে। নির্বাচনের আগে প্রচারণার সময় হয়রানি, ভয় দেখানো, নির্বিচারে গ্রেফতার ও সহিংসতার অনেক বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন ছিল। এর ফলে অনেক বিরোধীদলীয় প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের ভোটারদের সাথে দেখা করা, সমাবেশ করা বা অবাধে প্রচারণা চালানো কঠিন হয়ে উঠেছিল।’

মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সরকার বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনে মামলা করেছে।’ ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ অব বাংলাদেশ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২০২০-এর জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ফেব্রæয়ারির মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮৯০টি মামলায় অন্তত দুই হাজার ২৪৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রাজনীতিবিদ, এরপরই আছেন সাংবাদিক।’

বিভিন্ন প্রতিবেদনের সারমর্ম হচ্ছে, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি গণতন্ত্রের পরিপন্থী। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে না পারলে সঙ্কট বাড়তেই থাকবে, আর এর খেসারত দিতে হবে জনগণকে। তাই বলতে চাই, আমরা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর ভয়ের রাজ্যে বাস করতে চাই না। আমরা এ থেকে মুক্তি চাই। এই মুক্তির জন্য এক আরাভ খানকে নিয়ে মশগুল না থেকে বর্তমানের গোটা সঙ্কট পরিস্থিতির চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে। জনগণ সচেতন হলেই অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।