কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্রশাসন ও অর্থ উইংয়ের ভারপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক (অর্থ) তাইজুল ইসলামের বদলি ঠেকাতে তুঘলকি কাণ্ডে জড়িয়েছেন তার অনুসারীরা। তাকে মূল পদে বদলি করায় খামারবাড়িতে প্রায় তিন ঘণ্টা বিক্ষোভ করা হয়। বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে বদলি আদেশ বাতিল করতে খামারবাড়িতে মহাপরিচালককে অবরোধ করেন তারা।
এর আগে দুপুর পৌনে ২টা থেকে প্রশাসন ও অর্থ উইংয়ের দুই গেটে তালা মেরে তাইজুলের বদলি আটকাতে স্লোগান দিতে থাকেন তার অনুসারীরা। তখন কৃষি সম্প্রসারন অধিদফতরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস খামারবাড়ির বাইরে ছিলেন। তাইজুল ও তার অনুসারীরা প্রশাসন উইংয়ের পাশাপাশি মহাপরিচালকের দফতরের সামনেও অবস্থান নেন। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মহাপরিচালক খামারবাড়িতে তার রুমে প্রবেশ করার মুখে বাধার মুখে পড়েন। তাইজুলের লোকজন তাকে বদলি আটকাতে চাপ দিতে থাকেন।
এর আগে আজ রোববার সকালে খামারবাড়ির প্রভাবশালী কর্মকর্তা তাইজুল ইসলামকে অর্থ উইংয়ের ভারপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক থেকে সরিয়ে বাজেট অফিসারের মূল পদে বদলির আদেশ জারি করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। বিষয়টি জানাজানি হলে তাইজুলের অনুসারীরা বিক্ষোভ শুরু করেন।
প্রভাবশালী তাইজুল খামারবাড়ি নন-গেজেটেড কর্মচারী সমিতির সাবেক সভাপতি। অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসন উইন্ডোজ একাধিক কর্মকর্তা তাইজুলের সহযোগীর ভূমিকায় রয়েছেন। বিক্ষোভকারীদের বড় অংশ গাড়ি চালক।
বিকেল ৫টায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মহাপরিচালকের রুমে এ নিয়ে বৈঠক চলছিল।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাসকে ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
‘জালিয়াতি করে ষষ্ঠ গ্রেডের কর্মকর্তার চেয়ারে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী’ শিরোনামে গত ২১ ডিসেম্বর দৈনিক নয়া দিগন্তে একটি খবর প্রকাশিত হয়। এই খবরে বলা হয়-
‘তাইজুল ইসলামের চাকরির শুরু কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অ্যাগ্রিকালচার সাপোর্ট সার্ভিসেস প্রজেক্ট বা এএসএসপি প্রকল্পে। এই প্রকল্পে তার পদ ছিল জ্যেষ্ঠ হিসাবরক্ষক। ২০০৪ সাল থেকে এ প্রকল্পটি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের জন্য ভূতাপেক্ষ মঞ্জুরি প্রদান করা হয়। এক্ষেত্রে ২০০৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির বিরতিকাল হিসেবে ধরা হয়েছিল। এই চাকরির বিরতিকালকে নিয়মিত চাকরিকাল দেখিয়ে বেতন-ভাতা উত্তোলন করেন তাইজুল, যা পরে অডিটে ধরা পড়ে।
রাজস্ব খাতে আসার পরও জ্যেষ্ঠ হিসাবরক্ষকের পদ না থাকায় জনপ্রশাসন, অর্থ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের নথি জাল করে ১২তম গ্রেড বাগিয়ে নেন তাইজুল। কৃষি মন্ত্রণালয়ের বেশ কয়েকটি নথিতে এমন জালিয়াতি উঠে আসার প্রমাণ রয়েছে এই প্রতিবেদকের কাছে।
এসব নথি থেকে জানা যায়, তাইজুল ইসলামের পদবি জ্যেষ্ঠ হিসাবরক্ষক এবং বেতন গ্রেড-১৩ অনুমোদিত/স্থানান্তরিত হয়েছে। তিনি জ্যেষ্ঠ হিসাবরক্ষক পদে ও বেতন গ্রেড-১৩ তে ডিএইতে স্থানান্তর আদেশ মোতাবেক যোগদান করেছেন। এএসএসপি প্রকল্পের জনবল নিয়মিতকরণ/পদ স্থায়ীকরণ/পদ সংরক্ষণ সংক্রান্ত আদেশে এক এক আদেশে এক এক ধরনের পদবি ও বেতন গ্রেড দেখানো হয়েছে। সঠিক আদেশগুলোতে জ্যেষ্ঠ হিসাবরক্ষক পদবি ও বেতন গ্রেড ১৩। বাকি আদেশগুলোর স্বাক্ষর জাল বা কাটাছেঁড়া করা। এসব আদেশে তিন ধরনের পদবি (জ্যেষ্ঠ হিসাবরক্ষক/সিনিয়র হিসাবরক্ষক/ঊর্ধ্বতন হিসাবরক্ষক) দেখা যায়। এই পদবিগুলোর কোনো পদবিটি সঠিক তা নির্ধারণ করা হয়নি।
তাইজুল ইসলামের পদবি ও বেতন গ্রেডে বড় ধরনের গরমিল রয়েছে বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হলে তা আমলে নিয়ে তার বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ তদন্তপূর্বক বিভাগীয় মামলা রুজু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর ও অভিযোগ দাখিল করা হলে ২০১৮ সালের ৬ নভেম্বর আদেশগুলোর সঠিকতা যাচাইয়ের জন্য মতামত চেয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে একটি পত্র দেয়া হয়।
আদেশগুলো ভুয়া প্রমাণিত হলেও তার জবাব অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি। ২০১৯ সালে সিভিল অডিট অধিদফতরের স্মারকে তাইজুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৫ লাখ ৩ হাজার ৫৪৫ টাকার সরকারি আর্থিক ক্ষতির একটি অডিট আপত্তি উত্থাপিত হয়।
অডিট আপত্তিতে দেখা যায়, তাইজুল ২০০৪ সালের এপ্রিল থেকে ২০০৯ সালের ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত বিএসআর পার্ট-১ এর বিধি ৩০২ মোতাবেক অনুমোদিত বিরতিকালের বেতন-ভাতাদি এবং বেতন গ্রেড-১৩-এর পরিবর্তে অবৈধভাবে উত্তোলন করেছেন ১২ গ্রেডে। ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই অবৈধভাবে উত্তোলিত সমুদয় অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার জন্য আদেশ জারি করা হয়।
সূত্র জানায়, ২০০৪ সালের এপ্রিল থেকে ২০০৯ সালের ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত তাইজুল ইসলামের হাজিরা খাতায় নাম/স্বাক্ষর ও বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন (এসিআর) নেই। ২০১৭ সালের ৩১ মে অডিট অধিদফতর আপত্তিটি গুরুতর আর্থিক অনিয়ম হিসেবে চিহ্নিত করে জরুরিভিত্তিতে আপত্তিকৃত সমুদয় অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার জন্য পত্র দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আজ অবধি তা জমা পড়েনি। তাইজুল ইসলামের পদবি বেতন গ্রেড ও অডিট আপত্তি বিরতিকালে অতিরিক্ত উত্তোলিত অর্থ জমা না দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে তৎকালীন মহাপরিচালক মোহাম্মদ মহসীন একটি অভিযোগ দাখিল করার নির্দেশ প্রদান করেন।
পদবি, বেতন গ্রেড ও বিরতিকালে অতিরিক্ত উত্তোলিত অর্থের অডিট আপত্তি বিষয়ে ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তাইজুলের বিরুদ্ধে অভিযোগনামা দাখিলে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। ৯ জুলাই তাইজুল ইসলামের পদবি, বেতন গ্রেড জালিয়াতি ও বিরতিকালে বেতন-ভাতাদি উত্তোলন বিষয়টি প্রমাণিত হয় বিধায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজুসহ অতিরিক্ত উত্তোলিত অর্থ আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। ২০১৯ সালের ১৪ জানুয়ারি তার পদবি, বেতন গ্রেড অবৈধ উল্লেখ করে কৃষি মন্ত্রণালয়ে একটি পত্র দেয়া হয়। কিন্তু অদৃশ্য কারণে এসব অভিযোগ ফাইলচাপা পড়ে আছে।
খামারবাড়ি সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একজন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা (৯ম গ্রেড) থাকা সত্ত্বেও হিসাব শাখার প্রধান হিসেবে আর্থিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন, যা মোটেই আইন ও বিধিমতে বৈধ নয়। চাকরি সংক্রান্ত সব তথ্য গোপন করে তাইজুল অবৈধভাবে সহকারী পরিচালক (অর্থ), ডিএইর হিসাব শাখার প্রধানের পদটি বাগিয়ে নিয়ে মাঠপর্যায়ের অফিসে অর্থ বরাদ্দসহ বিল/ভাউচারের কমিশন বাণিজ্য চালু করেছেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অর্থ তছরূপের অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ে অবৈধ পদোন্নতি/অর্থ বরাদ্দ/বিল ভাউচারের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ কমিশন বাণিজ্য করে আসছেন। প্রশাসন উইংয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে এসব অপকর্ম করছেন।
অভিযোগ রয়েছে, তাইজুলের অবৈধ বিল/ভাউচার পাসে বাধা দেয়ায় গেজেটেড পদমর্যাদার আয়ন ও ব্যয়ন কর্মকর্তাকে অন্যত্র বদলি করা হয়। তার স্থলে নন-গেজেটেড তৃতীয় শ্রেণীর (১৩ গ্রেড) একজন আজ্ঞাবহ কর্মচারীকে আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তার দায়িত্বে নিয়ে আসা হয়। গত কয়েক বছরে কৃষি সম্প্রসারণে যে কয়েকটি নিয়োগ হয়েছে, তার প্রতিটিতেই তাইজুলের নেতৃত্বে কর্মচারী সিন্ডিকেট কাজ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।