আগুনে ভস্মীভূত বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের জমিতে নির্মাণ করা হবে দশতলা মার্কেট। এতে থাকবে প্রায় সাড়ে চার হাজার দোকান। বহুতল এ ভবনের নকশা প্রস্তুত; নিয়োগ করা হয়ে গেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও। এখন বাধা শুধু আদালতের নিষেধাজ্ঞা। এটি উঠে গেলেই বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এ তথ্য জানিয়েছেন খোদ ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। বঙ্গবাজারে আগুন লাগার পরও এক প্রতিক্রিয়ায় ডিএসসিসি মেয়র বলেছিলেন, সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল, যা মামলার কারণে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। জানা গেছে, বহুতল এ মার্কেটের পুরোটাজুড়েই থাকবে নানারকম পণ্যের দোকান।
পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজার মার্কেটটির আয়তন প্রায় ১ দশমিক ৭৯ একর। দেশে তৈরি পোশাকের বড় মার্কেট এটি। এখান থেকে সারাদেশে কাপড় সরবরাহ করা হয়। গত ৪ এপ্রিল ভোরে ভয়াবহ আগুনে মার্কেটটি পুড়ে যায়। এরপর বিভিন্ন মহলে গুঞ্জন উঠেছিল, বহুতল মার্কেট নির্মাণের জন্যই চক্রান্ত করে নাশকতামূলক এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। যদিও এ গুঞ্জনের সুস্পষ্ট কোনো ভিত্তি বা তথ্য-প্রমাণ মেলেনি। অগ্নিকা-ের পর ডিএসসিসি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, আগুনের সূত্রপাত মার্কেটের তৃতীয় তলায়। সম্ভাব্য কারণ জ্বলন্ত সিগারেট বা মশার কয়েল।
এর আগে, মোহাম্মদ সাঈদ খোকন ডিএসসিসির মেয়র থাকাকালেও বঙ্গবাজারে বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে। আমাদের সময়কে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও তিনি বলেন, আমরা নকশা প্রণয়ন করেছিলাম। টেন্ডার পর্যন্ত করেছিলাম। কিন্তু ব্যবসায়ীদের রিটের কারণে কাজটা শেষ করে আসতে পারিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসসিসির এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে জানান, বঙ্গবাজারে ১০তলা ভবন নির্মাণে নকশা প্রণয়ন এবং ঠিকাদারও নিয়োগ করা হয়েছিল। হাইকোর্টে রিট থাকায় কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি।
ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে বঙ্গবাজার মার্কেটকে কর্তৃপক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে বহুতল ভবন নির্মাণে উদ্যোগী হয়।
এরপর বঙ্গবাজার দোকান মালিক সমিতির পক্ষ থেকে হাইকোর্টে রিট করা হলে নতুন ভবন নির্মাণে স্থগিতাদেশ দেন আদালত।
মার্কেটগুলো অগ্নিকা-ের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় বিদ্যমান কাঠামো ভেঙে পাকা ভবন নির্মাণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ২০১৭ সালের ২৩ জুলাই মার্কেটগুলোর নেতৃবৃন্দ বরাবর পত্র প্রেরণের (স্মারক নং ৪৬.২০৭.০২২.১০.১৩.১৩৬৬.২০১৭;) পাশাপাশি একাধিকবার তাগাদামূলক পত্র দেয়। মার্কেটের দোকান মালিক এবং মালিক সমিতির নেতারা তখন ডিএসসিসির বিরুদ্ধে ৩টি রিট পিটিশন (নং ৪৪১৩/১৭, ১৩১৬৪/১৭, ১৩১৬৫/১৭) দায়ের করেন, যা এখনও চলমান।
ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, শুধু বঙ্গবাজার নয়, নিউমার্কেট, মৌচাক মার্কেট, নীলক্ষেত বই মার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেটসহ যেসব মার্কেট ১৯৯০ সালের মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলো অধিকাংশই ঝুঁকিপূর্ণ। এসব মার্কেট তৎকালে যে পরিমাণ মানুষের ধারণক্ষমতার কথা ভেবে করা হয়েছিল, বর্তমানে তারচেয়ে অনেক বেশি লোক সমাগম হয়।
এছাড়া অধিকাংশ মার্কেটেই নকশা না মেনে নিজেদের মতো করে করা হয়েছে; একইভাবে শীততাপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্রও বসিয়েছে। মার্কেটের ভেতর ঘুপচি আকৃতির ছোট ছোট দোকানও বানানো হয়েছে। সব মিলিয়ে, এসব ভবন যুগোপযোগী নেই। উপরন্তু ঝুঁকিপূর্ণও হয়ে পড়েছে। তাই এগুলো ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটির। অবশ্য কিছু মার্কেট আছে যেগুলো সংস্কারের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করা হতে পারে।
বঙ্গবাজারে অগ্নিকা-ে ডিএসসিসির করা তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনসূত্রে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৩ হাজার ৮৪৫। এসব ব্যবসায়ীর মধ্যে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে মোট দোকান ২ হাজার ৯৬১টি। তাছাড়া বঙ্গ ইউনিটে ৮৬৩টি, গুলিস্তান ইউনিটে ৮২৮টি, মহানগর ইউনিটে ৫৯৯টি, আদর্শ ইউনিটে ছিল ৬৭১টি, মহানগর শপিং কমপ্লেক্সে ৭৯১টি, বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটে ৫৯টি এবং বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্সে ৩৪টি দোকান।
এদিকে বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের মাত্র ১১ দিনের ব্যবধানে, গত ১৫ এপ্রিল নিউমার্কেটের নিউ সুপার মার্কেটে ভয়াবহ আগুন লাগে। এতেও বিপুলসংখ্যক ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হন। ডিএসসিসির আওতাধীন এ মার্কেটে অগ্নিকা-ের পরও নানা গুঞ্জন ডালাপালা ছড়ায়। বারবার কেন কাপড়ের মার্কেটে আগুন লাগছে- এমন প্রশ্নও সামনে চলে আসে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়- এটি নিছকই দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা, তা তদন্তের মাধ্যমে বের করার। গতকাল এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আগুন-রহস্য উদঘাটন হয়নি। তবে এদিন ডিএসসিসি গঠিত তদন্ত কমিটির এক সদস্য জানান, তারা ধারণা করছেন শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত।