আজ সেই ভয়াল ২৯ এপ্রিল। বছর ঘুরে এ বিশেষ দিনটি এলেই আবেগ আপ্লুত হয়ে পরেন উপকূলের লাখ লাখ মানুষ। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে হাজার হাজার স্বজন হারানোর বেদনায় বিধুর হয়ে উঠে উপকূলের প্রতিটি পরিবার। একই কারণে প্রতিবছর বর্ষা ঘনিয়ে এলেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়তেন উপকূলবাসী। কিন্তু বর্তমানে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের প্রচেষ্টায় বাপাউবোর উদ্যোগে কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের ফলে আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে উপকূবাসী। ২,৩৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত টেকসই বেড়িবাঁধে এখন বলতে গেলে পুরো উপকূল এখন অনেকটাই সুক্ষিত।
১৯৯১-এর ভয়াল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ৩৩ বছর পরে আজ উপকূলে সুরক্ষিত। বর্তমান কাজের সাথে সঙ্গতি রেখে উপকূল সুরক্ষায় আরো তিন হাজার ৭৯১ কোটি টাকা ব্যয়ে সুরক্ষা প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ওই দিনের প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিঝড় ও ঘুর্ণিঝড়ের সাথে ২৫ থেকে ৩০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে বঙ্গোপসাগর উপকূলীয় পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রাম লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল। ওই জলোচ্ছ্বসে ও ঘূর্ণিঝড়ে তোড়ে ভেসে যায় উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা। ওই দিন বিকেলের পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত একটানা ঝড়ের তাণ্ডবে বঙ্গোপসাগর, কর্ণফুলী ও শঙ্খনদী উপকুলীয় বাঁশখালী,আনোয়ারা, পটিয়া, বোয়ালখালী, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়াসহ সাত উপজেলার অন্তত ৫০ হাজার নারী-পুরুষসহ কয়েক লাখ গবাদি পশু প্রাণ হারিয়েছিল। এ ছাড়া কয়েক লাখ ঘরবাড়ি, গাছপালা উপড়ে যায়। স্মরণকালের ভয়াবহ এ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বসে ওই দিন এ অঞ্চলের কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি সাধিত হয়েছিল।
ওই দিনের ভয়াবহ স্মৃতির কথা আজো ভুলতে পারেনি উপকূলীয় এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। তাই এ দিনটি সামনে এলে স্বজন হারানোর বেদনায় বেধুর হয়ে উঠে উপকূলীয় এলাকার হাজার হাজার হাজার পরিবার।
২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব এত ব্যাপক হয়েছিল যে ঘূর্ণিঝড় শুরু হওয়ার কয়েক ঘন্টা পর থেকে পর দিন ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ পুরো চট্টগ্রামের সাথে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি অচল হয়ে পড়েছিল। সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে টেলিফোন ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার। ফলে সরকারী-বেসরকারিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধার তৎপরতাও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়ে পড়েছিল।
২৯ এপ্রিলের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে বাঁশখালী, আনোয়ারা ও পশ্চিম পটিয়ায়। বাঁশখালী উপজেলার পুকুরিয়া, বাহারছড়া, খানখানাবাদ, ছনুয়া, শেখেরখীল, পুইছড়ি, সরল, গন্ডামারা, কালিপুর, সাধনপুর, বৈলছড়ি, চাম্বল, জলদি, শিলকুপ, আনোয়ারা উপজেলার জুইদন্ডি, রায়পুর, বারশত, চন্দনাইশের বৈলতলী, বরমা, দোহাজারী, পটিয়ার জুলধা, চরলক্ষা, শিকলবাহা, পাথরঘাটা, শোভনদন্ডী, খরনা, বোয়ালখালীর পূর্ব কালুরঘাট, গোমদন্ডী, সাতকানিয়ার কালিয়াইশ, নলুয়া, আমিলাইশ, চরতী, ধর্মপুর, খাগরিয়া, পুরো লোহাগাড়া উপজেলায় অন্তত অর্ধলক্ষ নারী, পুরুষ ও শিশু প্রাণ হারায়।
বাঁশখালীর ছনুয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল হক চৌধুরী জানান, ২৯ এপ্রিলের ঝড় ও জলোচ্ছ্বসে বাঁশখালীর প্রায় ৪০ হাজার মানুষ ও শিশু প্রাণ হারায়। আনোয়ারার রায়পুরের সাবেক চেয়ারম্যান আবু ছৈয়দ ও জুইদন্ডির সাবেক চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক হোসাইনি জানান, ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড় ও ভয়াবহ জলোচ্ছ্বসে আনোয়ারা উপকূল লণ্ডভণ্ড হয়ে ১৬ হাজারেরও অধিক নারী-পুরুষ প্রাণ হারিয়েছিল।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বসে বঙ্গোপসাগর, কর্ণফুলী ও শঙ্খনদী বেষ্টিত দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী থেকে বোয়ালখালী হয়ে পূর্ব কালুরঘাট পর্যন্ত প্রায় দু’শ’ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ অরক্ষিত। ওই সময় থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত উপকূল সুরক্ষায় বাপাউবো কাজ করলেও দৃশ্যত উপকূল ছিল অরক্ষিতই।
২০১৪ সালে জাতীয় সংসদ নিবার্চনের পরেই দক্ষিণ চট্টগ্রামের উপকূল সুরক্ষায় শত শত কোটি টাকার প্রকল্প প্রণয়ন করে বাপাউবো। পরে ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে (একনেক) উপকূল সুরক্ষায় দক্ষিণ চট্টগ্রামে বিভিন্ন প্যাকেজের কাজ অনুমোদন লাভ করে। বর্তমানে দক্ষিণ চট্টগ্রামে ভাঙ্গন ও জলোচ্ছ্বাস ঠেকাতে অনুমোদন পাওয়া ২,৩৬০ কোটি টাকার টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আর এ কারণেই টেকসই বেড়িবাঁধে আশার আলো দেখছেন একসময়ের আতঙ্কিত উপকূলবাসী। গতকাল সরেজমিনে উপকূলের কয়েকটি এলাকা পরিদর্শনকালে স্থানীয় বাসিন্দারা বলে, প্রায় ৩৩ বছর পরে এখন টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ চলছে, কোথাও কাজ শেষ হওয়ার কারণে নতুনভাবে বেঁচে থাকার আশার আলো জেগে উঠেছে উপকূলবাসীরদের মধ্যে।
বর্তমাণে ভাঙ্গন প্রতিরোধে ২৩৬০ কোটি টাকার টেকসই বেড়িবাঁধ স্থাপনের কর্মযজ্ঞের মধ্যে বাঁশখালীতে ২৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে কাজ শেষ হয়েছে, সাতকানিয়া লোহাগাড়া ও চন্দনাইশে নদী ড্রেজিংসহ ৩৩৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয়ে কাজ চলোমান রয়েছে, আনোয়ারায় ৫৭৭ কোটি টাকা ও পটিয়ায় চলছে ১১৫৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ নিষকাশন সেচ প্রকল্পের কাজও সন্তোষজনকভাবে এগিয়ে চলছে।
এসব কাজের সাথে সঙ্গতি রেখে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউপো) চলমান টেকসই কাজের পাশাপাশি অরক্ষিত উপকূল সুরক্ষায় চট্টগ্রাম জুড়ে আরো প্রায় তিন হাজার ৭৯১ কোটি টাকা ব্যয়ে (সম্ভাব্য ব্যয়) টেকসই বেড়িবাঁধ নদী ড্রেজিং ও অবকাঠামো নির্মাণে বেশ কিছু প্রকল্প প্রণয়ন করেন । চলমান কাজের সাথে সঙ্গতি রেখে চলমান কাজগুলো হচ্ছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী চন্দনাইশ আনোয়ারা বাঁশখালী ও খাগড়াছড়ি জেলার উপকূল সুরক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড গৃহীত নতুন প্রকল্প প্রোফাইল (ডিপিপি) এখন পরিকল্পনা কমিশনে ও পানি উন্নয়ন বোর্ডর সদর দফতরে রয়েছে। এর মধ্যে খাগড়াছড়ি সুরক্ষা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। অবশিষ্ট প্রকল্প কাজ অনুমোদন ক্রমে পর্যায়ক্রমে কাজ শুরু হবে বলে বাপাউবো সূত্রে জানা গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ডিভিশন-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ উজ জামান বলেন, পুরো বাশঁখালীতে এখন টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে তিনি বলেন, চলতি বছরের জুনের মধ্যে বেড়িবাঁধ স্থাপনের কাজ সম্পূর্ণ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ডিভিশন-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ঈবনে সায়ীদ জানিয়েছেন, উপকূল সুরক্ষা ও নদী ড্রেজিং কাজ সন্তোষজনক ভাবে এগিয়ে চলছে এছাড়া পটিয়ায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্পের কাজও সন্তোষজনকভাবে এগিয়ে চলছে।
আজ ২৯ এপ্রিল দিবসটি উপলক্ষে পুরো উপকূলীয় এলাকায় মসজিদ, মাদরাসা, মন্দির, প্যাগোডায় মিলাদ মাহফিল, ধর্মীয় আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগেও দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।