তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ ঘোষণা দিয়েছে, আসন্ন বাজেটেই নিজস্ব অর্থায়নে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ঘোষণা দিতে হবে। উজানে খাল খনন প্রকল্প বন্ধসহসহ ছয় দফা বাস্তবায়ন করা না হলে কঠোর আন্দোলনে যাবে তিস্তাপাড়ের মানুষ।
শনিবার বিকেলে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের গণসমাবেশে এ ঘোষণা দেয় বক্তারা।
গণ-সমাবেশে বক্তরা বলেন, দাবি আদায়ে তিস্তার দুই তীরসহ রংপুর বিভাগ জুড়ে ১ জুন স্তব্ধ কর্মসূচি পালন করা হবে। ওই দিন সব গাড়ি-ঘোড়া, দোকানপাট বন্ধ করে যে যেখানেই আছে সেখানেই স্তব্ধ হবে।
গণসমাবেশের উদ্বোধন করেন তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের উপদেষ্টা, রংপুর সিটি মেয়র ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানীর সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক সাফিয়ার রহমানের সঞ্চলনায় গণসমাবেশে বক্তব্য রাখেন ওয়ার্কার্স পাটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি, সাবেক তথ্যমন্ত্রী মন্ত্রী ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু, জাতীয় পার্টির অতিরিক্ত মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপি, জাসদের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি নাজমুল হক প্রধান, তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য গেরিলা লিডার বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম কানু প্রমুখ।
মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, ‘পদ্মা সেতু যদি দেশের টাকায় নির্মাণ করা সম্ভব হয়, তাহলে তিস্তা মহাপরিকল্পনাও বায়স্তবায়ন করা সম্ভব। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাহসী পদক্ষেপের কারণে আমাদের দেশের মানুষের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হয়েছে। ওই পদ্মা সেতুতে রংপুর বিভাগের মানুষের ট্যাক্স ও ভ্যাটের টাকা দেয়া রয়েছে। বর্তমানে দেশে অনেকগুলো মেগা প্রকল্প চলমান রয়েছে। কিন্তু উত্তরের মানুষের জন্য কোনো মেগাপ্রকল্প নেই। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার ঘোষিত তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন চাই।’
সংসদে রংপুর অঞ্চলের এমপি-মন্ত্রীরা মনোনয়ন হারানো ভয়ে তিস্তা নিয়ে কথা বলেন না বলে অভিযোগ তুলে সিটি মেয়র মোস্তাফিজার বলেন, ‘আমরা চীন-ভারত বুঝি না। পদ্মা সেতুর মতো আমরা নিজস্ব অর্থায়নে তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন দেখতে চাই। এটি গণমানুষের দাবিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমাদের এমপি-মন্ত্রীরা সংসদে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিস্তার দাবি তুলে ধরতে ভয় পায়। কারণ তারা মনোনয়ন হারানোর ভয় করে। যারা জনগণের গণ দাবি নিয়ে কথা বলতে চান না তাদেরকে রংপুরের মানুষ আগামীতে লাল কার্ড দেখাবে।’
রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিজেই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমরা তার উদ্যোগে আনন্দিত হয়েছিলাম। কিন্তু আফসোস ওই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। আজ তিস্তা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চরের ওপর চর পড়েছে। আর ভাঙনের পর ভাঙনে তিস্তাপাড়ের মানুষ আজ নিঃস্ব।’
সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ‘তিস্তা আমার নদী, আমাদের নদী। তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন আমাদের সবার দাবি, এটা আমাদের প্রাণের দাবি। এর মধ্যে যারা নিরাপত্তা, ভূ-রাজনীতি ও চীন-ভারতের সম্পর্কের প্রশ্ন খুঁজে, আমি তাদের বলবো যে এই খেলা আমাদের নিয়ে খেলবেন না। তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন নিয়ে নতুন কোনো চক্রান্ত, বাঁধা আমরা মানব না। আগামী জাতীয় বাজেট অধিবেশন আমরা সংসদেও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ চাইব।’
জাসদ সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে উত্তরবঙ্গের মঙ্গা দূর হয়েছে। আপনার (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) হাত ধরেই আপনার ঘোষিত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এবারের বাজেটে টাকা চাই। এবারের বাজেটে আমাদের এক নম্বর দাবি হবে তিস্তা মহাপরিকল্পনার জন্য টাকা।’
তিনি বলেন, ‘তিস্তার পানি ভারত থেকে আসে। সেটা নিয়ে পানি চুক্তির ব্যাপার রয়েছে। ২০১২ সালে ভারত-বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে তা নিয়ে সমঝোতা হয়েছে। তিস্তার পানি চুক্তি হবে বলে একমত হয়েছে ভারত। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। প্রতিবছর সরকার তাগাদা দিচ্ছে কিন্তু হচ্ছে হচ্ছে করেও হচ্ছে না। আমরা শুধু তিস্তার পানি চুক্তি চাই না, আমরা চাই তিস্তা মহাপরিকল্পনারও বাস্তবায়ন হোক।’
সভাপতির বক্তব্যে পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর বসবাস রংপুরে। নেই বিশেষ কোনো বরাদ্দ ও ব্যবস্থা। রংপুরকে পিছিয়ে রাখার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে মোট বরাদ্দের এক শতাংশের চেয়ে কম বরাদ্দ রংপুর বিভাগের জন্য দেয়া হয়। দেশে চলমান তিন লাখ কোটি টাকার মেগাপ্রকল্প চললেও রংপুর বিভাগের জন্য কোনো মেগাপ্রকল্প নেই। তিস্তা সুরক্ষায় মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার কথা বলা হয়েছে। অথচ তিস্তা নদীর ভাঙন ও বন্যায় প্রতিবছর যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, তার পরিমাণ নিঃসন্দেহে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার বহুগুণ বেশি। সরকারের উচিত হবে, সাড়ে আট হাজার কোট টাকা ব্যয় করে বিজ্ঞানসম্মতভাবে তিস্তার পরিচর্যা নিশ্চিত করা। এটি হলে প্রতিবছর ভাঙন ও বন্যা থেকে রক্ষা পাবে হাজার হাজার কোটি টাকা। রংপুরের সাথে সারাদেশের বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্যও তিস্তা সুরক্ষার কোনো বিকল্প নেই।’
গণসমাবেশে তিস্তা অববাহিকার রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও গাইবান্ধা জেলা থেকে আগত তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের পাশাপাশি সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন তিস্তা সংশ্লিষ্ট উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এবং রাজনৈতিক সংগঠনের নেতারা।
তারা ছয় দফা তুলে তিস্তার ভাঙন, বন্যা ও খরায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ, ভাঙনের শিকার ভূমিমিহীন ও গৃহহীনদের পুনর্বাসন, তিস্তা নদী সুরক্ষায় বিজ্ঞানসম্মত খনন, মহাপরিকল্পনায় তিস্তা নদী ও নদী তীরবর্তী কৃষকের স্বার্থ সুরক্ষায় ‘কৃষক সমবায় ও কৃষিভিত্তিক শিল্পকলকারখানা’ স্থাপন, তিস্তা নদীর শাখা-প্রশাখা ও উপ-নদীগুলোর সাথে পূর্বের সংযোগ স্থাপন, দখল-দূষণ মুক্তকরণ এবং নৌ চলাচল পুনরায় চালু ও মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদানসহ প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির দাবি জানান।
তিস্তা অবববাহিকার হাজার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের উপস্থিতিতে পাবলিক লাইব্রেরি মাঠের গণসমাবেশ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। গণসমাবেশে দাবি আদায়ে তিস্তার ২৩০ কিলোমিটারসহ রংপুর বিভাগের প্রতিটি হাটবাজারে ১ জুন সকাল ১০টা থেকে ১০টা ৫ মিনিট পর্যন্ত পাঁচ মিনিটের স্তব্ধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন পরিষদ সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী। ওই সময় গাড়ি-ঘোড়া, অফিস-আদালত সব জায়গায় সবাইকে সব কাজ বন্ধ করে পাঁচ মিনিট স্তব্ধ হয়ে থাকার আহ্বান জানান তিনি।
এছাড়া দাবি আদায়ের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে প্রতিটি জেলায় সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়া হয়।