‘সুবহানাল্লাহ’ হলো, আল্লাহর তাসবিহ বা পবিত্রতা বর্ণনা করা। তাসবিহ বলতে সকাল-বিকাল, সালাতে, প্রাত্যহিক কথাবার্তায় আল্লাহর তাসবিহ ‘সুবহানাল্লাহ’ তথা আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করা। এই পবিত্রতা বর্ণনা করার অর্থ কি আর কেনই বা আমরা সকাল-সাঁঝে, সালাতে, প্রাত্যহিক জীবনে আমাদের কথাবার্তায় ‘সুবহানাল্লাহ বলে থাকি? এই তাসবিহের হাকিকত আমাদেরকে জানতে হবে। অবচেতন মনে সারাক্ষণ তাসবিহমালা জপ করা হলে সেই তাসবিহ প্রাণ পায় না। আর জেনে বুঝে এর মর্মার্থ অনুধাবন করে পাঠ করলে অবশ্যই আমাদের জীবনে এর ইতিবাচক ও ফলপ্রসূ প্রভাব পড়বে।
‘সুবহানা’ শব্দটি নামবাচক শব্দ, সাবাহা মূল শব্দ থেকে নির্গত বা রূপান্তরিত। সুবহানাল্লাহ কালিমাতু তানজিহুহ ও তাকদিসুন। তাকদিসুন কুদ্দুসুন থেকে। মূল ধাতুর অর্থ হলো-সব রকম মন্দ বৈশিষ্ট্যমুক্ত ও পবিত্র হওয়া। সে আলোকে সুবহান আল্লাহ অর্থ হলো, আল্লাহ তায়ালার পবিত্র সত্তা কোনো প্রকার দোষত্রুটি অথবা অপূর্ণতা কিংবা কোনো মন্দ বৈশিষ্ট্যের অনেক ঊর্ধ্বে; বরং তা এক অতি পবিত্র সত্তা যার মন্দ হওয়ার ধারণাও করা যায় না। আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হবে, চরম পবিত্রতা প্রকৃতপক্ষে সার্বভৌমত্বের প্রাথমিক অপরিহার্য বিষয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত যে সত্তা দুষ্ট, দুশ্চরিত্র এবং বদনিয়ত পোষণকারী, যার মধ্যে মানব চরিত্রের মন্দ বৈশিষ্ট্যসমূহ বিদ্যমান এবং যার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভের অধীনস্থরা কল্যাণ লাভের প্রত্যাশী হওয়ার পরিবর্তে অকল্যাণের ভয়ে ভীত হয়ে উঠে এমন সত্তা সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে তা মানুষের স্বাভাবিক বিবেক বুদ্ধি ও স্বভাব-প্রকৃতি মেনে নিতে অস্বীকার করে। কারণ পবিত্রতা ছাড়া নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অকল্পনীয়।
আল-কুরআনের অসংখ্য জায়গায় তাসবিহ ও তার প্রতিশব্দ কুদ্দুসুন শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ ছাড়া তার সৃষ্টিলোকে যত কিছু আছে সেসব সৃষ্টির মধ্যে যত প্রকার দুর্বলতা আছে, মহান আল্লাহ সেসব দুর্বলতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘আল্লাহ সেসব শিরক থেকে পবিত্র যা লোকেরা করে থাকে।’ (সূরা হাশর-২৩) ‘যারাই আল্লাহর ক্ষমতা, ইখতিয়ার ও গুণাবলিতে কিংবা তাঁর সত্তায় অন্য কোনো সৃষ্টিকে অংশীদার বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে প্রকৃতপক্ষে তারা অতি বড় এক মিথ্যা বলছে। কোনো অর্থেই কেউ আল্লাহ তায়ালা শরিক বা অংশীদার নয়। তিনি তা থেকে পবিত্র।’ (সূরা মায়েদা-১১৬)
আমাদের প্রতিটি সালাতে নিজেদের অভিজাত্যের সব অহংবোধ, অযথা সব মর্যাদা, গর্ব-অহঙ্কার, হিংসা-বিদ্বেষ, মান-অভিমানকে এক পাশে ঠেলে দিয়ে সারা জাহানের প্রভু, পরম দয়ালু মনিব, সার্বভৌম ক্ষমতার নিরঙ্কুশ মালিক, পরাক্রমশালী রাজাধিরাজ, ইজ্জত-অপমানের একমাত্র মালিকের সামনে মর্যাদার প্রতীক তথা মাথা, কপাল ও নাক মাটিতে লুটিয়ে দেই। যা পৃথিবীর আর কোনো শক্তির সামনে নত করে দেই না। সিজদা নামক সেই কর্মে আমরা বলি, সুবহানা আল্লাহ রাব্বিয়াল আলা অর্থাৎ ‘তুমি সব প্রকার দুর্বলতা, অক্ষমতা, অপারগতা, অংশীদারিত্ব থেকে পবিত্র। আমি দুনিয়ার সব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে একমাত্র তোমারই সামনে নিজেকে লুটিয়ে দিয়ে আমি তোমার মহানত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের পবিত্রতা ঘোষণা করছি।’
পৃথিবীর তামাম সৃষ্টিকুলের কেউ যদি তাঁর তাসবিহ, তাহলিল, তাহমিদ ও তাকবির না করে তবু তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতার এতটুকু কিছুই যায় আসে না। কারণ তিনি মুখাপেক্ষিহীন এক প্রবল পরাক্রান্ত সত্তা। তিনি নিজে নিজেই প্রশংসিত। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘এবং অধিক মাত্রায় আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো। আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে।’ (সূরা জুময়া-১০) আল্লাহ তায়ালা বলেন- আমি লোকমানকে সূক্ষ্ম জ্ঞান দান করেছিলাম যাতে সে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়। যে ব্যক্তি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে সে তার কৃতজ্ঞ হবে তার নিজের জন্য লাভজনক। আর যে ব্যক্তি কুফরি করবে, সে ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ অমুখাপেক্ষী এবং নিজে নিজেই প্রশংসিত’ (সূরা লোকমান-১২)।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তিনি ঘুমান না এবং তন্দ্রাও তাঁকে স্পর্শ করে না’ (সূরা বাকারা-২৫৫)। মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর সত্তাকে যারা নিজেদের দুর্বল অস্তিত্বেও সদৃশ মনে করে এবং যাবতীয় মানবিক দুর্বলতাকে আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত করে, এখানে তাদের চিন্তা ও ধারণার প্রতিবাদ করা হয়েছে। কেউ সকাল-বিকাল আল্লাহর তাসবিহ করল কী করল না তাতে আল্লাহর কিছুই যায়-আসে না। তিনি মুখাপেক্ষীহীন সত্তা। তাসবিহ করলেও তিনি পবিত্র না করলেও তিনি পবিত্র। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আল্লাহুস সামাদ’ অর্থাৎ- আল্লাহ কারোর ওপর নির্ভরশীল নন এবং সবাই তাঁর ওপর নির্ভরশীল। তিনি বেনিয়াজ, অমুখাপেক্ষী। তাঁর কোনো সন্তান নেই এবং তিনি কারোর সন্তান নন’ (সূরা ইখলাস : ২-৩)। মুশরিকরা যুগে যুগে ধারণা করে এসেছে, মানুষের মতো আল্লাহর একটি জাতি বা শ্রেণী আছে। তার সদস্য সংখ্যাও অনেক। তাদের মধ্যেও বিয়ে-শাদি এবং বংশবিস্তারের কাজও চলে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘এবং সকাল সাঁঝে তাঁর মহিমা ঘোষণা করতে থাকো’ (সূরা আহজাব-৪২)। সকাল সাঁঝে আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করার অর্থ হচ্ছে সর্বক্ষণ তাঁর তাসবিহ করা। আর তাসবিহ করা মানে আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করা, নিছক তাসবিহর দানা হাতে নিয়ে গুনতে থাকা নয়; বরং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে পরিচালিত অপপ্রচার, বিদ্রƒপ ও নিন্দা ইত্যাদি সব কিছু থেকে আল্লাহ পবিত্র। এই চিন্তা-চেতনা মনে প্রাণে ধারণ করা। অন্যথায় শত্রুদের ছড়ানো সন্দেহ সংশয় জড়িয়ে পড়তে হবে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আসমানে যা আছে এবং জমিনে যা আছে সবই আল্লাহ তাসবিহ করছে। তিনি বাদশাহ, অতি পবিত্র এবং মহাপরাক্রমশালী ও জ্ঞানময়’ (সূরা জুময়া-১)। প্রথম আয়াত থেকে পরবর্তী কয়েকটি আয়াত মক্কার ইহুদিদের ব্যাপারে নাজিল হয়েছে। তাদের মতে কোনো অইসরাইলি নবীর মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকেও কোনো শিক্ষা এসে থাকলে তা মেনে নিতে তারা আদৌ প্রস্তুত নয়। এই আচরণের কারণে পরবর্তী আয়াতে তিরস্কার করা হয়েছে। প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, বিশ্বজাহানের প্রতিটি বস্তু আল্লাহর তাসবিহ করছে। অর্থাৎ গোটা বিশ্বজাহান এ সাক্ষ্য দিচ্ছে, যেসব অপূর্ণতা ও দুর্বলতার ভিত্তিতে ইহুদিরা তাদের বংশীয় শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা কায়েম ও বদ্ধমূল করে রেখেছে আল্লাহ তা থেকে মুক্ত ও পবিত্র। তিনি কারো আত্মীয় নন। তাঁর কাছে পক্ষপাতিত্বমূলক কোনো কাজ নেই। তিনি নিজের সব সৃষ্টির সাথে সমানভাবে ইনসাফ, রহমত ও প্রতিপালকসুলভ আচরণ করেন। তিনি বাদশাহ। বিশ্বজাহানের কোনো শক্তিই তাঁর ক্ষমতাকে খর্ব বা সীমিত করতে পারে না। সবাই তাঁর দাস ও প্রজা। মানুষের সৎপথ প্রদর্শনের জন্য তিনি কাকে নবী বানাবেন, একান্তই তাঁর ইচ্ছাধীন। তিনি মহাপবিত্র। অর্থাৎ তাঁর সিদ্ধান্তে ভুল-ত্রুটির কোনো সম্ভাবনা থাকতে পারে না। তিনি ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত ও পবিত্র, তা থেকে অনেক ঊর্ধ্বে।
লেখক :
- জাফর আহমাদ
শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট