ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

তত্ত্বাবধায়কের ঘোষণা এলে সংলাপে বসবে বিএনপি

নির্বাচনী সঙ্কট সমাধানে ফের সংলাপের সুর বেজে উঠেছে। গত দুই দিনে সরকারি দলের শীর্ষ স্থানীয় কমপক্ষে তিনজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা নির্বাচন ইস্যুতে সংলাপ কিংবা আলোচনার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধীদের কঠোর মনোভাব, সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকি এবং পর্দার অন্তরালে চলমান নানা তৎপরতার মধ্যেই সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মুখ থেকে এমন বক্তব্য নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত বলে মনে করছেন অনেকে। তবে সংলাপের ‘অভিজ্ঞতা তিক্ত’ হওয়ায় বিএনপি এজেন্ডাবিহীন কোনো সংলাপে আগ্রহী নয়। দলটির নীতিগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে এমন ঘোষণা এলেই তারা কেবল সংলাপে বসবেন, এর আগে নয়।

এ দিকে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি পাচ্ছেন এমন গুঞ্জনও রাজনীতিতে চাউর হয়েছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে যে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে, বেগম জিয়ার মুক্তির আলোচনাটি তারই অংশ বলে কেউ কেউ মনে করছেন। যদিও এ বিষয়ে বিএনপির নেতৃস্থানীয় কেউ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। গতকাল বিকেলে দলের এক নেতা আলাপকালে বলেন, ‘যেকোনো কিছুই হতে পারে’।

বেগম খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের এক বছর আগে কারাবন্দী হন। প্রায় ২ বছর কারাভোগের পর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তযুক্ত সাময়িক মুক্তি পান তিনি। মুক্তির পর ৬ মাস অন্তর অন্তর কারাগারের বদলে তার বাসায় থাকার মেয়াদ বাড়ছে। শারীরিক নানা জটিলতা থাকলেও বেগম জিয়া এখন অপেক্ষাকৃত সুস্থ আছেন বলে জানা গেছে।

নানামুখী তৎপরতা ও সংলাপ : বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে চলতি বছরের মার্চ থেকে পুরোদমে আন্দোলনের মাঠে নামে বিএনপি। তাদের সাথে যোগ দেয় সরকারবিরোধী আরো বেশ কয়েকটি জোট। দলটির নানামুখী আন্দোলন কর্মসূচি চলমান রয়েছে। সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে তারা। এরকম অবস্থায় বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতে গত ২৪ মে মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর ঢাকাস্থ কূটনীতিকপাড়ায় রাজনৈতিক দলের নেতাদের দৌড়ঝাঁপ আরো বেড়ে যায়। একই সঙ্গে বেড়ে যায় ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের তৎপরতাও।

ভিসানীতি ঘোষণার পরের দিন গত ২৫ মে গুলশানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সাথে একত্রে বৈঠক করেন। জানা যায়, ওই বৈঠকে বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে সংলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। বৈঠক শেষে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে সব দলের সংলাপ আয়োজন ছাড়া সমাধানের পথ দেখছি না। মার্কিন রাষ্ট্রদূতও সে কথাই বলেছেন।

এর পর সিরিজ বৈঠক হয়েছে। গত রোববার পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করেন সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন পিটার হাস। সেখানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিজি উপস্থিত ছিলেন। একই দিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গেও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠক হয়। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি, নির্বাচন ও আন্দোলন নিয়ে বিএনপির অবস্থান জানতে চাইলে তা পিটার হাসকে অবহিত করেন দলের মহাসচিব। মির্জা ফখরুল এ প্রসঙ্গে বলেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না বলে তারা মনে করেন। এ বক্তব্যই তিনি তুলে ধরেন পিটার হাসের কাছে। এ ছাড়া বৈঠকে সংলাপ নিয়ে বিএনপির অবস্থানও মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে অবহিত করা হয় বলে জানা গেছে।

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এমন তৎপরতার মধ্যে গত মঙ্গলবার ১৪ দলের এক সভায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, বিএনপির এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে লাভ নেই। প্রয়োজনে জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় আমরা তাদের সঙ্গে মুখোমুখি সংলাপ করতে চাই। তবে গতকাল বুধবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতা বা হস্তক্ষেপ করতে হবে- এমন কোনো রাজনৈতিক সঙ্কট দেশে এখনো তৈরি হয়নি। আমাদের দেশে আমরা আলোচনা করব- এটা নিজেদের সমস্যা, নিজেরাই সমাধান করব।

অন্য দিকে বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘সংলাপের মাধ্যমে সব কিছু সমাধান হতে পারে। আলোচনার কোনো বিকল্প নেই।’
সংলাপ নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা বিএনপির : বিএনপি মনে করে, সংলাপ নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা তিক্ত। তাই আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে এবার এজেন্ডাবিহীন কোনো সংলাপে যাবে না তারা। সংলাপ ইস্যুতে দলটির অবস্থান হচ্ছে, সরকারকে আগে পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ঘোষণা দিতে হবে। তার পর নির্বাচনকালীন সেই নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের ফরম্যাট কী হবে- সেটা নিয়ে সংলাপ হতে পারে। কেবল এই ইস্যুতে সংলাপের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দেয়া হলে তাতে সাড়া দেবে বিএনপি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকেও নিজেদের এই অবস্থান জানিয়েছে দলটি। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসঙ্ঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্যরা। ওই বৈঠকগুলোতে কেন এই সরকারের অধীনে বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যেতে চায় না- তা ব্যাখ্যা করেছে দলটি। এর সপক্ষে দলীয় সরকারের অধীনে বিগত দুটি নির্বাচন কেমন হয়েছে এবং এর মধ্য দিয়ে কীভাবে নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে- লিখিত ও অলিখিত ফরম্যাটে সেগুলো তুলে ধরেন নেতারা। বিএনপি যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না, সেটিও স্পষ্ট করেছে। একই সঙ্গে দলটির পক্ষ থেকে কূটনীতিকদের জানানো হয়, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা কী হবে সে বিষয়ে সংলাপের আহ্বান আসলে তাতে সাড়া দেবে বিএনপি।

গত ৮ মে জাতিসঙ্ঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইসের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি। বৈঠকে বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে জাতিসঙ্ঘ যে বারবার উদ্যোগ নিয়েছে সেটা উল্লেখ করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরেও বিশ্ব সংস্থাটি বিশেষ ভূমিকা পালন করবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন দলটির নেতারা। এ সময় তারা বাংলাদেশে দশম সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে জাতিসঙ্ঘের তৎকালীন সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর ভূমিকার কথা তুলে ধরেন।

তারানকো ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় এসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা এবং সুশীল সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধির সাথে পৃথকভাবে বৈঠক করেন। তবে সঙ্কট নিরসনে তিনি সফল হননি। এ ছাড়া ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপে অংশ নেয় বিএনপি। ওই সংলাপ প্রসঙ্গে বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, সংলাপে প্রধানমন্ত্রী সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, নির্বাচনে কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই, প্রার্থীদের শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, গায়েবি মামলা দিয়ে নির্বাচনী মাঠ ফাঁকা করে ফেলা হয়েছে, নির্বাচনের আগের রাতে ভোট ডাকাতি করা হয়েছে। ওই তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে তারা এবার সরকারের সঙ্গে এজেন্ডাবিহীন কোনো সংলাপে যেতে আগ্রহী নয়।

সংলাপ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কোথায় কোন সমাবেশে কে কী বলছেন- সেটার জবাব দেয়া আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। আমরা রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন করছি। আমাদের কাছে কেউ লিখিত প্রস্তাব দিলে সেটার জবাব দেয়ার জন্য ভাববো।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে দলের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, সরকার যদি চায় যে সঙ্ঘাত এড়িয়ে সামনের দিকে যাবে, তাহলে প্রথম কাজটা করতে হবে বিরোধী দলগুলোর দাবি পূরণ করা। অর্থাৎ সরকারকে পদত্যাগ করে আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে। তারা যদি বলে আমরা পদত্যাগ করব, তত্ত্বাবধায়ক বিষয়ে কথা বলব, তাহলে হয়ে যাবে। সরকার পদত্যাগ না করে সংলাপের আহ্বান করলে তাতে বিশ্বাস করার কোনো সুযোগ নেই। আগে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে অথবা ঘোষণা দিতে হবে যে আমরা পদত্যাগ করব। মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ কূটনীতিকদের সাম্প্রতিক দৌড়ঝাঁপের কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন রয়েছে, প্রকাশ্যে না হলেও সঙ্কট নিরসনে পর্দার অন্তরালে সংলাপ চলছে।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

তত্ত্বাবধায়কের ঘোষণা এলে সংলাপে বসবে বিএনপি

আপডেট সময় ০৯:৪৫:০৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৮ জুন ২০২৩

নির্বাচনী সঙ্কট সমাধানে ফের সংলাপের সুর বেজে উঠেছে। গত দুই দিনে সরকারি দলের শীর্ষ স্থানীয় কমপক্ষে তিনজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা নির্বাচন ইস্যুতে সংলাপ কিংবা আলোচনার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধীদের কঠোর মনোভাব, সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকি এবং পর্দার অন্তরালে চলমান নানা তৎপরতার মধ্যেই সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মুখ থেকে এমন বক্তব্য নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত বলে মনে করছেন অনেকে। তবে সংলাপের ‘অভিজ্ঞতা তিক্ত’ হওয়ায় বিএনপি এজেন্ডাবিহীন কোনো সংলাপে আগ্রহী নয়। দলটির নীতিগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে এমন ঘোষণা এলেই তারা কেবল সংলাপে বসবেন, এর আগে নয়।

এ দিকে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি পাচ্ছেন এমন গুঞ্জনও রাজনীতিতে চাউর হয়েছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে যে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে, বেগম জিয়ার মুক্তির আলোচনাটি তারই অংশ বলে কেউ কেউ মনে করছেন। যদিও এ বিষয়ে বিএনপির নেতৃস্থানীয় কেউ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। গতকাল বিকেলে দলের এক নেতা আলাপকালে বলেন, ‘যেকোনো কিছুই হতে পারে’।

বেগম খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের এক বছর আগে কারাবন্দী হন। প্রায় ২ বছর কারাভোগের পর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তযুক্ত সাময়িক মুক্তি পান তিনি। মুক্তির পর ৬ মাস অন্তর অন্তর কারাগারের বদলে তার বাসায় থাকার মেয়াদ বাড়ছে। শারীরিক নানা জটিলতা থাকলেও বেগম জিয়া এখন অপেক্ষাকৃত সুস্থ আছেন বলে জানা গেছে।

নানামুখী তৎপরতা ও সংলাপ : বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে চলতি বছরের মার্চ থেকে পুরোদমে আন্দোলনের মাঠে নামে বিএনপি। তাদের সাথে যোগ দেয় সরকারবিরোধী আরো বেশ কয়েকটি জোট। দলটির নানামুখী আন্দোলন কর্মসূচি চলমান রয়েছে। সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে তারা। এরকম অবস্থায় বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতে গত ২৪ মে মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর ঢাকাস্থ কূটনীতিকপাড়ায় রাজনৈতিক দলের নেতাদের দৌড়ঝাঁপ আরো বেড়ে যায়। একই সঙ্গে বেড়ে যায় ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের তৎপরতাও।

ভিসানীতি ঘোষণার পরের দিন গত ২৫ মে গুলশানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সাথে একত্রে বৈঠক করেন। জানা যায়, ওই বৈঠকে বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে সংলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। বৈঠক শেষে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে সব দলের সংলাপ আয়োজন ছাড়া সমাধানের পথ দেখছি না। মার্কিন রাষ্ট্রদূতও সে কথাই বলেছেন।

এর পর সিরিজ বৈঠক হয়েছে। গত রোববার পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করেন সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন পিটার হাস। সেখানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিজি উপস্থিত ছিলেন। একই দিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গেও মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বৈঠক হয়। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি, নির্বাচন ও আন্দোলন নিয়ে বিএনপির অবস্থান জানতে চাইলে তা পিটার হাসকে অবহিত করেন দলের মহাসচিব। মির্জা ফখরুল এ প্রসঙ্গে বলেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না বলে তারা মনে করেন। এ বক্তব্যই তিনি তুলে ধরেন পিটার হাসের কাছে। এ ছাড়া বৈঠকে সংলাপ নিয়ে বিএনপির অবস্থানও মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে অবহিত করা হয় বলে জানা গেছে।

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এমন তৎপরতার মধ্যে গত মঙ্গলবার ১৪ দলের এক সভায় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, বিএনপির এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে লাভ নেই। প্রয়োজনে জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় আমরা তাদের সঙ্গে মুখোমুখি সংলাপ করতে চাই। তবে গতকাল বুধবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতা বা হস্তক্ষেপ করতে হবে- এমন কোনো রাজনৈতিক সঙ্কট দেশে এখনো তৈরি হয়নি। আমাদের দেশে আমরা আলোচনা করব- এটা নিজেদের সমস্যা, নিজেরাই সমাধান করব।

অন্য দিকে বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘সংলাপের মাধ্যমে সব কিছু সমাধান হতে পারে। আলোচনার কোনো বিকল্প নেই।’
সংলাপ নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা বিএনপির : বিএনপি মনে করে, সংলাপ নিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা তিক্ত। তাই আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে এবার এজেন্ডাবিহীন কোনো সংলাপে যাবে না তারা। সংলাপ ইস্যুতে দলটির অবস্থান হচ্ছে, সরকারকে আগে পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ঘোষণা দিতে হবে। তার পর নির্বাচনকালীন সেই নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের ফরম্যাট কী হবে- সেটা নিয়ে সংলাপ হতে পারে। কেবল এই ইস্যুতে সংলাপের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দেয়া হলে তাতে সাড়া দেবে বিএনপি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকেও নিজেদের এই অবস্থান জানিয়েছে দলটি। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসঙ্ঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্যরা। ওই বৈঠকগুলোতে কেন এই সরকারের অধীনে বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যেতে চায় না- তা ব্যাখ্যা করেছে দলটি। এর সপক্ষে দলীয় সরকারের অধীনে বিগত দুটি নির্বাচন কেমন হয়েছে এবং এর মধ্য দিয়ে কীভাবে নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে- লিখিত ও অলিখিত ফরম্যাটে সেগুলো তুলে ধরেন নেতারা। বিএনপি যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না, সেটিও স্পষ্ট করেছে। একই সঙ্গে দলটির পক্ষ থেকে কূটনীতিকদের জানানো হয়, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা কী হবে সে বিষয়ে সংলাপের আহ্বান আসলে তাতে সাড়া দেবে বিএনপি।

গত ৮ মে জাতিসঙ্ঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইসের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি। বৈঠকে বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে জাতিসঙ্ঘ যে বারবার উদ্যোগ নিয়েছে সেটা উল্লেখ করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরেও বিশ্ব সংস্থাটি বিশেষ ভূমিকা পালন করবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন দলটির নেতারা। এ সময় তারা বাংলাদেশে দশম সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে জাতিসঙ্ঘের তৎকালীন সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর ভূমিকার কথা তুলে ধরেন।

তারানকো ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় এসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা এবং সুশীল সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধির সাথে পৃথকভাবে বৈঠক করেন। তবে সঙ্কট নিরসনে তিনি সফল হননি। এ ছাড়া ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপে অংশ নেয় বিএনপি। ওই সংলাপ প্রসঙ্গে বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, সংলাপে প্রধানমন্ত্রী সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, নির্বাচনে কোনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই, প্রার্থীদের শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, গায়েবি মামলা দিয়ে নির্বাচনী মাঠ ফাঁকা করে ফেলা হয়েছে, নির্বাচনের আগের রাতে ভোট ডাকাতি করা হয়েছে। ওই তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে তারা এবার সরকারের সঙ্গে এজেন্ডাবিহীন কোনো সংলাপে যেতে আগ্রহী নয়।

সংলাপ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কোথায় কোন সমাবেশে কে কী বলছেন- সেটার জবাব দেয়া আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। আমরা রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন করছি। আমাদের কাছে কেউ লিখিত প্রস্তাব দিলে সেটার জবাব দেয়ার জন্য ভাববো।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে দলের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, সরকার যদি চায় যে সঙ্ঘাত এড়িয়ে সামনের দিকে যাবে, তাহলে প্রথম কাজটা করতে হবে বিরোধী দলগুলোর দাবি পূরণ করা। অর্থাৎ সরকারকে পদত্যাগ করে আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে। তারা যদি বলে আমরা পদত্যাগ করব, তত্ত্বাবধায়ক বিষয়ে কথা বলব, তাহলে হয়ে যাবে। সরকার পদত্যাগ না করে সংলাপের আহ্বান করলে তাতে বিশ্বাস করার কোনো সুযোগ নেই। আগে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে অথবা ঘোষণা দিতে হবে যে আমরা পদত্যাগ করব। মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ কূটনীতিকদের সাম্প্রতিক দৌড়ঝাঁপের কারণে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন রয়েছে, প্রকাশ্যে না হলেও সঙ্কট নিরসনে পর্দার অন্তরালে সংলাপ চলছে।