ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

সামুদ্রিক অর্থনীতি ও বাংলাদেশ

  • সূর্যোদয় ডেস্ক:
  • আপডেট সময় ১১:১৬:৫৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ জুন ২০২৩
  • ১১৩০ বার পড়া হয়েছে

সমুদ্র অর্থনীতির কথা যখন বলা হয়, নতুন কিছু বলা হয় না। মূল্যবান ধাতু, সামুদ্রিক প্রাণী ও মৎস্য সম্পদ আহরণের দিক থেকে সমুদ্র অর্থনীতির প্রাচীনতম এক ভাণ্ডার। সামুদ্রিক বাণিজ্য সভ্যতার অগ্রগতির পথ রচনা করেছে। বাণিজ্যের নামে সমুদ্র অভিযান ইউরোপের ইতিহাস বদলে দিয়েছিল। সমুদ্রের পথ দিয়ে আমেরিকা নিজের সম্ভাবনা উন্মোচন করেছে। পরিবহনের জন্য সমুদ্রের গুরুত্ব চিরকালই ছিল। তবে শিল্পবিপ্লবে দেখা গেলো সামুদ্রিক সম্পদ নতুন চরিত্র নিয়েছে। তখন যন্ত্রগুলোতে ব্যবহার করা হতো সামুদ্রিক প্রাণী থেকে আহরিত তেল। এরপরে সমুদ্রকে মানুষ গভীরভাবে জেনেছে প্রকৃতিকে জানার ধারায়। ফলে সমুদ্র তার বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা অব্যাহতভাবে প্রশস্ত করছে।

সমুদ্র থেকে যে সম্পদ দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়, তাকে এখন আখ্যায়িত করা হচ্ছে ব্লু ইকোনমি তথা সুনীল (সমুদ্র) অর্থনীতি। এ পরিভাষা প্রথম ব্যবহার করেন গুন্টার পউলি। তার বিখ্যাত ‘দ্য ব্লু ইকোনমি : টেন ইয়ার্স, হান্ড্রেড ইনোভেশন, হান্ড্রেড মিলিয়ন জবস’ বইয়ে সমুদ্র অর্থনীতির মডেল প্রস্তাব করেন।
এ অর্থনীতি সমুদ্র সম্পদকে স্থিতিশীলভাবে কাজে লাগাতে বলে, যা পরিবেশজনিত সমস্যার সমাধানে সহায়ক হবে; সমুদ্র থেকে সম্পদ আহরণ ও ব্যবহার হবে এমনভাবে, যা সমুদ্রকে প্রাণবন্ত ও সুস্থ রাখতে সহায়তা করবে, এর ইকো-সিস্টেমের দীর্ঘমেয়াদি সক্ষমতার সঙ্গে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ভারসাম্য নিশ্চিত করবে। এ অর্থনীতির কেন্দ্র হচ্ছে মহাসাগর, সাগর ও উপকূল। বিশ্বব্যাংক সমুদ্র অর্থনীতিকে উপস্থাপন করেছে দু’দিক থেকে। প্রথমত, সমুদ্রের সম্পদের টেকসই ব্যবহারের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, উন্নত জীবনমান, এবং স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ। দ্বিতীয়ত, সাগরের সুস্থতা ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করে কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করা। একটির সাথে আরেকটির সম্পর্ক নিবিড়। দ্বিতীয়টি রক্ষিত না হলে প্রথমটি অর্জিত হবে না। ফলে সমুদ্র অর্থনীতি সাগর ও উপকূলীয় এলাকার সাথে সম্পর্কিত আর্থিক বিষয়মাত্র নয়, বরং এর সাথে যুক্ত আছে কার্বন সংরক্ষণ, উপকূলীয় প্রতিরক্ষা, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ। এসবের মধ্য দিয়ে জ্বালানি, জাহাজ চলাচল, মৎস্য শিকার, খনি থেকে সম্পদ আহরণ এবং পর্যটন ব্যবস্থাপনার একটি গতিশীল শৃঙ্খলা কামনা করে সমুদ্র অর্থনীতি।

সামুদ্রিক ঘাস, ম্যানগ্রোভ এবং উপক‚লীয় জলাভূমির প্রতি এ অর্থনীতি যেমন দৃষ্টি রাখে, তেমনি উপকূলীয় এলাকার লবণাক্ততা, প্লাবন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, অভিযোজন, উপযোগ ইত্যাদির নকশা করে। সাগর-মহাসাগর পরিবহন, জ্বালানি, জাহাজ প্রযুক্তি, সামুদ্রিক জৈব পণ্য ইত্যাদি যেমন তার মনোযোগের বিষয়, তেমনি গভীর সামুদ্রিক খনি (বিরল ধাতু, হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধান) সামুদ্রিক নবায়নযোগ্য শক্তি, বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন, সমুদ্রের ঢেউ হতে বিদ্যুৎ উৎপাদন, জোয়ারের ঢেউ হতে শক্তি উৎপাদন, তরঙ্গ, স্রোত এবং বায়ু প্রকল্পও তার আলোচ্য। এমনতরো বিষয়ে সমস্যা, সমাধানগুলোর কার্যকারিতা, অর্থনৈতিক ফলাফল এবং অনাকাক্সিক্ষত পরিণতির আশঙ্কা পরীক্ষা করার জন্য গবেষণা ও প্রকল্প উৎপাদন করে এ জ্ঞানশাখা। এর এক দিকে রয়েছে জল ও জলনির্ভর প্রাণ, প্রকৃতি ও স্থাপনা এবং সমুদ্রভিত্তিক প্রযুক্তি-কাঠামো, অন্য দিকে টেকসই জীবিকা।
প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে পৃথিবীর ১০-১২ শতাংশ মানুষের জীবিকা সামুদ্রিক খাদ্যের ওপর নির্ভর করছে। প্রতি বছর প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ মিলিয়ন টন মাছ সাগরে ধরা পড়ে। এর মধ্যে প্রায় ২৯ মিলিয়ন টন মানুষের ব্যবহারের জন্য। প্রতি বছর তিন থেকে পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে সমুদ্র ঘিরে। বিশ্বব্যাপী ৪৩০ কোটি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। পৃথিবীর প্রায় ৭২% এবং বায়োস্ফেয়ারের প্রায় ৯৫% এলাকা ঘিরে আছে সাগর। পৃথিবী ৩০% গ্যাস ও জ্বালানি তেল লাভ করছে সমুদ্রতল থেকে। কিন্তু কেবল গ্যাস ও জ্বালানি তেল নয়, সমুদ্রে রয়েছে ম্যাঙ্গানিজ, তামা, লোহা, নিকেল, কোবাল্ট, মলিবডেনাম, জিংক, লিথিয়াম, প্লাটিনাম, ইন্ডিয়াম, জার্মেনিয়াম, সেলেনিয়াম, টেলুরিয়াম, দস্তা ইত্যাদি দু®প্রাপ্য ধাতু। এসব পদার্থ সমুদ্র থেকে আহরণের চেষ্টা ও অভিযান চলছে। বিশ্বে মোট হাইড্রোকার্বনের ৩২% সরবরাহ হয় সামুদ্রিক উৎস্য থেকে। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক পরিবহনের ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয় সমুদ্রপথে। ইউরোপের উপক‚লীয় দেশগুলো সমুদ্র অর্থনীতি থেকে প্রতি বছর ৫০০ বিলিয়ন ইউরো আয় করতে পারে, যা তাদের জিডিপির ১০ শতাংশ।

ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় আয়ে বিপুল অবদান ব্লু ইকোনমির। সমুদ্র সম্পদ নিয়ে সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন হলে সমুদ্র থেকে আহরিত সম্পদের মূল্যমান হবে সে দেশের জাতীয় বাজেটের প্রায় দশগুণ। কর্মসংস্থান হবে ৭৫ হাজার লোকের, প্রতি বছর ১১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হবে। অস্ট্রেলিয়া এ খাত থেকে বছরে আয় করছে প্রায় ৪৭.২ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার। ২০২৫ সালের মধ্যে সমুদ্র অর্থনীতির আয়কে ১০০ বিলিয়ন ডলারে নিতে চায় দেশটি। সিঙ্গাপুরের জিডিপির ৪০ ভাগ সমুদ্রনির্ভর। চীনের মোট জিডিপির ১০ শতাংশ আসছে সমুদ্র অর্থনীতি থেকে।

বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকা ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার, যা দেশের আয়তনের প্রায় ৮২ শতাংশ। ২০১২ সালের ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতের (পিসিএ) রায়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের সাথে মামলায় বাংলাদেশ প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র এলাকার দখল পায়। ২০১৪ সালের ৮ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমার আনুমানিক ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটারের অধিকার পায় বাংলাদেশ।

তারপর সমুদ্র অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে পারলাম আমরা? বাংলাদেশের জিডিপির মাত্র ৪ থেকে ৫ শতাংশ ব্লু ইকোনমি থেকে আসে। এটার পরিমাণ বার্ষিক প্রায় ৯৬০ কোটি ডলার। অথচ সমুদ্র থেকে শুধু মাছ রফতানি থেকেই ১০-১২ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।

সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়নি, তা নয়। সমুদ্র সম্পদ আহরণ ও গবেষণা এগিয়ে নিতে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে কক্সবাজারে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা হয় সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ। ২০১৭ সালে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠন করা হয় ‘ব্লু ইকোনমি সেল’। ব্লু ইকোনমির সঙ্গে সরকারের ১৭টি মন্ত্রণালয় এবং ১২টি সংস্থা জড়িত।

কিন্তু বিশ্বব্যাংক গ্রুপ ২০১৮ সালে ‘টুয়ার্ডস এ ব্লু ইকোনমি : এ পাথওয়ে ফর সাসটেইনেবল গ্রোথ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের সমীক্ষায় জানায়, সমুদ্র অর্থনীতির ব্যাপারে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কোনো সমন্বিত নীতি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেনি।

ব্লু ইকোনমি সেলটি একটি অস্থায়ী ও ক্ষুদ্র প্রশাসনিক সেল। একে আইনগত কর্তৃত্ব দেয়া হয়নি। ফলে এই সেলের সিদ্ধান্ত মানতে আইনি বিচারে অন্যদের বাধ্যবাধকতা নেই। সেলটি যেহেতু অস্থায়ী, তাই একে কোনো আর্থিক বরাদ্দও দেয়া হয়নি। এ বাস্তবতায় সংসদীয় কমিটি ২০১৭ সালে সুপারিশ করেছিল সেলের বদলে আইনগত ক্ষমতা দিয়ে একটি কর্তৃপক্ষ গঠনের। সে সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। অথচ সামুদ্রিক আয়তনের বিশালতা, প্রকল্পগুলোর গুরুত্ব, সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাবনার বিপুলতা বিচার করে সমুদ্র মন্ত্রণালয় গঠন করার কথাও এসেছে। আমরা সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে কাজ এগিয়ে নিতে পারিনি।

কিন্তু দেখা গেলো, গ্যাস অনুসন্ধান, সমুদ্রে কূপ খনন ও গ্যাস উত্তোলনে মিয়ামনার বা ভারত প্রয়াসী অনেক আগে থেকেই। ২০১২ সালে সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তির পর নব উদ্যমে তারা এগোতে থাকল। মিয়ানমার দ্রুতই সামুদ্রিক ফসল ঘরে তুলল। মাত্র দুই বছরে তারা শুধু নতুন করে গ্যাসের মজুদ আবিষ্কার করল, তা নয়, বরং বাংলাদেশের সীমানা লাগোয়া তাদের ব্লাক থেকে শুরু করল গ্যাস উত্তোলন। সেই গ্যাস দিয়ে এখন দেশটি অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাচ্ছে। আবার গ্যাস রফতানিও করছে চীনে। ভারত এ অবধি ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আবিষ্কার করেছে বঙ্গোপসাগরে। দেশটি গ্যাস উত্তোলনও করছে নিয়মিত।

কিন্তু আমরা? সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হবার পরে ২৬টি নতুন বকে একে বিন্যাস করা হয়। এর মধ্যে ১১টিকে অগভীর ও ১৫টিকে গভীর সমুদ্রের ব্লক হিসেবে স্থির করা হয়। এরপর কেটে যায় বছরের পর বছর। ২০১৯ সালে জানা যায় মাত্র ৪টি ব্লকে অনুসন্ধানের জন্য বিদেশী কোম্পানির সাথে চুক্তি হয়েছে। তারা কাজ করে খুব ধীরগতিতে। একটি ক‚পও তখনো খনন করা হয়নি। বাকি ২২টি ব্লক খালি পড়ে থাকে। ২০২২ সালে এতটুকু অগ্রগতির তথ্য জানা যায় যে, বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানে জরিপ করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে ন্যূনতম ১৭ থেকে ১০৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট (টিসিএফ) গ্যাস হাইড্রেটস মজুদ রয়েছে সেখানে। তীব্র জ্বালানি সঙ্কটে যখন দেশ তড়পাচ্ছে, তখন এ প্রশ্ন সঙ্গত যে, কেন আমরা সমুদ্রের গ্যাসসম্পদ আহরণে সক্ষম হচ্ছি না?

শুধু গ্যাসের কথা কেন? সমুদ্রবিরোধ নিরসনের পরে ‘সেভ আওয়ার সি’-এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতি বছর বঙ্গোপসাগর থেকে আশি লাখ টন মাছ ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের জেলেরা ধরতে পারছেন মাত্র ৭ লাখ টন মাছ। দেশে বছরে যে পরিমাণ মাছ অহরণ হয়, তার মাত্র ১৫ শতাংশ আসে গভীর সমুদ্র থেকে। উপক‚লীয় এলাকার ৫০ লাখের বেশি মানুষের আয়ের প্রধান উৎস সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ। কিন্তু তারা এখনো মূলত প্রচলিত পদ্ধতিতেই সীমাবদ্ধ।

কিন্তু জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে সমুদ্রগামী ট্রলারগুলোর জ্বালানি, পরিচালন, জেলেদের খোরাকি ব্যয়, বরফ, মজুরি মিলিয়ে ব্যয় বেড়েছে ৭০ শতাংশ। ফলে আহরিত মাছ বিক্রি করে ব্যয় তুলে লাভ করা দুরূহ হয়ে গেছে। এ খাতে জ্বালানি ভর্তুকি নেই, ব্যাংক ঋণের সুবিধা অবারিত ও সহজ করা হয়নি, জেলেদের বীমা ও মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করেনি সরকার। গভীর সমুদ্রে মাছ আহরণে প্রয়োজন অত্যাধুনিক ট্রলার ও জাহাজ। সেই সক্ষমতা বাড়েনি। ফলে দেশের নৌযানগুলো গভীর সমুদ্র থেকে মৎস্য আহরণ করতে পারছে না। এই সুযোগে পার্শ্ববর্তী দুই দেশ প্রতিনিয়ত মাছ লুট করে নিচ্ছে, এমন খবর সংবাদমাধ্যমে আসে প্রায়ই।
টুনা মাছের মতো মূল্যবান সম্পদ মূলত গভীর সমুদ্রেই থাকে। আবার যেসব সামুদ্রিক মাছ আগে অগভীর সমুদ্রে দু-চার ঘণ্টার দূরত্বে পাওয়া যেত, তাদের মধ্যে লাক্ষা, সার্ডিন, পোয়া, লটিয়া, ফলি চান্দা, হরিণা চিংড়ি ও কাটা প্রজাতির মাছ এখন পেতে হলে যেতে হয় এক-দুই দিনের দূরত্বে। এ জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত জাহাজ আবশ্যক। এটি উপলব্ধি করতে সরকারের সময় লেগেছে এক দশক। সম্প্রতি এ জন্য বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু এখানে আরো জরুরি হলো বেসরকারি বিনিয়োগকে উদ্বুদ্ধ করা ও এর অনুক‚ল পরিবেশ নিশ্চিত করা।

উপকূলীয় এলাকায় সমুদ্রকেন্দ্রিক পর্যটন চলমান রয়েছে। তবে সম্ভাবনা কাজে লাগানো হচ্ছে কম। ফলে এ খাতে দেশের আয়ের পরিমাণও কম। পর্যটন স্পটগুলোর উন্নয়ন দরকার। সি ট্যুরিজমের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ক্রুজশিপ। অনেক পর্যটক ক্রুজশিপের প্রতি আগ্রহী। পর্যটন এলাকায় প্রয়োজন সার্ফিং জোন, পানির নিচে ভ্রমণ-ব্যবস্থা, কমিউনিটিভিত্তিক যোগাযোগ স্থাপন। পর্যটন এলাকায় আমাদের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক সুকৃতির প্রতিফলন থাকা উচিত। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সমুদ্রের পানি ব্যবহার করে লবণ উৎপাদন বাড়ানো যায়। জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজ ভাঙা শিল্প সমৃদ্ধ করা জরুরি।

বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় রয়েছে বিপুল পরিমাণে ভারী খনিজ। আছে ২২০ প্রজাতির সাগর-উদ্ভিদ, ৩৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস।

এসব জৈব-অজৈব সম্পদ সাগর- অর্থনীতিতে তরঙ্গ তৈরি করতে পারবে। সমুদ্রতলের গ্যাস, মৎস্যসহ অন্যান্য সম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও পর্যটনের ক্ষেত্রে যথোচিত কার্যক্রম সম্পন্ন হলে ২০৩০ সাল নাগাদ সমুদ্র থেকে প্রতি বছর আড়াই লাখ কোটি ডলার আয় করা সম্ভব। অর্থনীতিবিদরা এমনই মতামত দিয়েছেন। কিন্তু এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে রয়েছে বহু প্রতিবন্ধকতা। এখানে অভাব আছে পর্যাপ্ত নীতিমালা ও সঠিক কর্মপরিকল্পনার। এক দিকে যেমন দক্ষ জনশক্তি, প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং মেরিন রিসোর্সভিত্তিক পর্যাপ্ত গবেষণার কমতি রয়েছে, অপর দিকে রয়েছে সম্পদের গুণ, মান ও মূল্য সম্পর্কে সঠিক তথ্য ও ব্লু ইকোনমি সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক যোগাযোগের সমস্যা, গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদনে গবেষণা জাহাজসহ বিবিধ উপাদানের ঘাটতি। এ সঙ্কটগুলোর সুরাহা করতে হবে দ্রুত। নিশ্চিত করতে হবে সরকারি-বেসরকারি যথেষ্ট বিনিয়োগ ও এর পরিকল্পিত সদ্ব্যবহার।

সমুদ্রবাণিজ্য ও অর্থনীতির খাত অনেক, এর পরিসর ব্যাপক। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে সমুদ্র-সম্পদের বহুমাত্রিক ব্যবহারে সক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়েই এ খাতগুলোতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যেতে পারে। লক্ষ্যমাত্রা পূরণে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা জরুরি। পরিকল্পনা যে প্রণীত হয়নি বা হচ্ছে না, তা নয়। বরং বাস্তবায়নে আছে ধীরগতি, অব্যবস্থাপনা ও বহুকেন্দ্রিকতা।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

সামুদ্রিক অর্থনীতি ও বাংলাদেশ

আপডেট সময় ১১:১৬:৫৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ জুন ২০২৩

সমুদ্র অর্থনীতির কথা যখন বলা হয়, নতুন কিছু বলা হয় না। মূল্যবান ধাতু, সামুদ্রিক প্রাণী ও মৎস্য সম্পদ আহরণের দিক থেকে সমুদ্র অর্থনীতির প্রাচীনতম এক ভাণ্ডার। সামুদ্রিক বাণিজ্য সভ্যতার অগ্রগতির পথ রচনা করেছে। বাণিজ্যের নামে সমুদ্র অভিযান ইউরোপের ইতিহাস বদলে দিয়েছিল। সমুদ্রের পথ দিয়ে আমেরিকা নিজের সম্ভাবনা উন্মোচন করেছে। পরিবহনের জন্য সমুদ্রের গুরুত্ব চিরকালই ছিল। তবে শিল্পবিপ্লবে দেখা গেলো সামুদ্রিক সম্পদ নতুন চরিত্র নিয়েছে। তখন যন্ত্রগুলোতে ব্যবহার করা হতো সামুদ্রিক প্রাণী থেকে আহরিত তেল। এরপরে সমুদ্রকে মানুষ গভীরভাবে জেনেছে প্রকৃতিকে জানার ধারায়। ফলে সমুদ্র তার বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা অব্যাহতভাবে প্রশস্ত করছে।

সমুদ্র থেকে যে সম্পদ দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়, তাকে এখন আখ্যায়িত করা হচ্ছে ব্লু ইকোনমি তথা সুনীল (সমুদ্র) অর্থনীতি। এ পরিভাষা প্রথম ব্যবহার করেন গুন্টার পউলি। তার বিখ্যাত ‘দ্য ব্লু ইকোনমি : টেন ইয়ার্স, হান্ড্রেড ইনোভেশন, হান্ড্রেড মিলিয়ন জবস’ বইয়ে সমুদ্র অর্থনীতির মডেল প্রস্তাব করেন।
এ অর্থনীতি সমুদ্র সম্পদকে স্থিতিশীলভাবে কাজে লাগাতে বলে, যা পরিবেশজনিত সমস্যার সমাধানে সহায়ক হবে; সমুদ্র থেকে সম্পদ আহরণ ও ব্যবহার হবে এমনভাবে, যা সমুদ্রকে প্রাণবন্ত ও সুস্থ রাখতে সহায়তা করবে, এর ইকো-সিস্টেমের দীর্ঘমেয়াদি সক্ষমতার সঙ্গে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ভারসাম্য নিশ্চিত করবে। এ অর্থনীতির কেন্দ্র হচ্ছে মহাসাগর, সাগর ও উপকূল। বিশ্বব্যাংক সমুদ্র অর্থনীতিকে উপস্থাপন করেছে দু’দিক থেকে। প্রথমত, সমুদ্রের সম্পদের টেকসই ব্যবহারের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, উন্নত জীবনমান, এবং স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ। দ্বিতীয়ত, সাগরের সুস্থতা ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করে কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করা। একটির সাথে আরেকটির সম্পর্ক নিবিড়। দ্বিতীয়টি রক্ষিত না হলে প্রথমটি অর্জিত হবে না। ফলে সমুদ্র অর্থনীতি সাগর ও উপকূলীয় এলাকার সাথে সম্পর্কিত আর্থিক বিষয়মাত্র নয়, বরং এর সাথে যুক্ত আছে কার্বন সংরক্ষণ, উপকূলীয় প্রতিরক্ষা, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ এবং জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ। এসবের মধ্য দিয়ে জ্বালানি, জাহাজ চলাচল, মৎস্য শিকার, খনি থেকে সম্পদ আহরণ এবং পর্যটন ব্যবস্থাপনার একটি গতিশীল শৃঙ্খলা কামনা করে সমুদ্র অর্থনীতি।

সামুদ্রিক ঘাস, ম্যানগ্রোভ এবং উপক‚লীয় জলাভূমির প্রতি এ অর্থনীতি যেমন দৃষ্টি রাখে, তেমনি উপকূলীয় এলাকার লবণাক্ততা, প্লাবন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, অভিযোজন, উপযোগ ইত্যাদির নকশা করে। সাগর-মহাসাগর পরিবহন, জ্বালানি, জাহাজ প্রযুক্তি, সামুদ্রিক জৈব পণ্য ইত্যাদি যেমন তার মনোযোগের বিষয়, তেমনি গভীর সামুদ্রিক খনি (বিরল ধাতু, হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধান) সামুদ্রিক নবায়নযোগ্য শক্তি, বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন, সমুদ্রের ঢেউ হতে বিদ্যুৎ উৎপাদন, জোয়ারের ঢেউ হতে শক্তি উৎপাদন, তরঙ্গ, স্রোত এবং বায়ু প্রকল্পও তার আলোচ্য। এমনতরো বিষয়ে সমস্যা, সমাধানগুলোর কার্যকারিতা, অর্থনৈতিক ফলাফল এবং অনাকাক্সিক্ষত পরিণতির আশঙ্কা পরীক্ষা করার জন্য গবেষণা ও প্রকল্প উৎপাদন করে এ জ্ঞানশাখা। এর এক দিকে রয়েছে জল ও জলনির্ভর প্রাণ, প্রকৃতি ও স্থাপনা এবং সমুদ্রভিত্তিক প্রযুক্তি-কাঠামো, অন্য দিকে টেকসই জীবিকা।
প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে পৃথিবীর ১০-১২ শতাংশ মানুষের জীবিকা সামুদ্রিক খাদ্যের ওপর নির্ভর করছে। প্রতি বছর প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ মিলিয়ন টন মাছ সাগরে ধরা পড়ে। এর মধ্যে প্রায় ২৯ মিলিয়ন টন মানুষের ব্যবহারের জন্য। প্রতি বছর তিন থেকে পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে সমুদ্র ঘিরে। বিশ্বব্যাপী ৪৩০ কোটি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। পৃথিবীর প্রায় ৭২% এবং বায়োস্ফেয়ারের প্রায় ৯৫% এলাকা ঘিরে আছে সাগর। পৃথিবী ৩০% গ্যাস ও জ্বালানি তেল লাভ করছে সমুদ্রতল থেকে। কিন্তু কেবল গ্যাস ও জ্বালানি তেল নয়, সমুদ্রে রয়েছে ম্যাঙ্গানিজ, তামা, লোহা, নিকেল, কোবাল্ট, মলিবডেনাম, জিংক, লিথিয়াম, প্লাটিনাম, ইন্ডিয়াম, জার্মেনিয়াম, সেলেনিয়াম, টেলুরিয়াম, দস্তা ইত্যাদি দু®প্রাপ্য ধাতু। এসব পদার্থ সমুদ্র থেকে আহরণের চেষ্টা ও অভিযান চলছে। বিশ্বে মোট হাইড্রোকার্বনের ৩২% সরবরাহ হয় সামুদ্রিক উৎস্য থেকে। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক পরিবহনের ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয় সমুদ্রপথে। ইউরোপের উপক‚লীয় দেশগুলো সমুদ্র অর্থনীতি থেকে প্রতি বছর ৫০০ বিলিয়ন ইউরো আয় করতে পারে, যা তাদের জিডিপির ১০ শতাংশ।

ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় আয়ে বিপুল অবদান ব্লু ইকোনমির। সমুদ্র সম্পদ নিয়ে সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন হলে সমুদ্র থেকে আহরিত সম্পদের মূল্যমান হবে সে দেশের জাতীয় বাজেটের প্রায় দশগুণ। কর্মসংস্থান হবে ৭৫ হাজার লোকের, প্রতি বছর ১১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হবে। অস্ট্রেলিয়া এ খাত থেকে বছরে আয় করছে প্রায় ৪৭.২ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার। ২০২৫ সালের মধ্যে সমুদ্র অর্থনীতির আয়কে ১০০ বিলিয়ন ডলারে নিতে চায় দেশটি। সিঙ্গাপুরের জিডিপির ৪০ ভাগ সমুদ্রনির্ভর। চীনের মোট জিডিপির ১০ শতাংশ আসছে সমুদ্র অর্থনীতি থেকে।

বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকা ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার, যা দেশের আয়তনের প্রায় ৮২ শতাংশ। ২০১২ সালের ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক সালিসি আদালতের (পিসিএ) রায়ের মাধ্যমে মিয়ানমারের সাথে মামলায় বাংলাদেশ প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র এলাকার দখল পায়। ২০১৪ সালের ৮ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমার আনুমানিক ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটারের অধিকার পায় বাংলাদেশ।

তারপর সমুদ্র অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে পারলাম আমরা? বাংলাদেশের জিডিপির মাত্র ৪ থেকে ৫ শতাংশ ব্লু ইকোনমি থেকে আসে। এটার পরিমাণ বার্ষিক প্রায় ৯৬০ কোটি ডলার। অথচ সমুদ্র থেকে শুধু মাছ রফতানি থেকেই ১০-১২ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।

সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়নি, তা নয়। সমুদ্র সম্পদ আহরণ ও গবেষণা এগিয়ে নিতে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে কক্সবাজারে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করা হয় সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ। ২০১৭ সালে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠন করা হয় ‘ব্লু ইকোনমি সেল’। ব্লু ইকোনমির সঙ্গে সরকারের ১৭টি মন্ত্রণালয় এবং ১২টি সংস্থা জড়িত।

কিন্তু বিশ্বব্যাংক গ্রুপ ২০১৮ সালে ‘টুয়ার্ডস এ ব্লু ইকোনমি : এ পাথওয়ে ফর সাসটেইনেবল গ্রোথ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের সমীক্ষায় জানায়, সমুদ্র অর্থনীতির ব্যাপারে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কোনো সমন্বিত নীতি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেনি।

ব্লু ইকোনমি সেলটি একটি অস্থায়ী ও ক্ষুদ্র প্রশাসনিক সেল। একে আইনগত কর্তৃত্ব দেয়া হয়নি। ফলে এই সেলের সিদ্ধান্ত মানতে আইনি বিচারে অন্যদের বাধ্যবাধকতা নেই। সেলটি যেহেতু অস্থায়ী, তাই একে কোনো আর্থিক বরাদ্দও দেয়া হয়নি। এ বাস্তবতায় সংসদীয় কমিটি ২০১৭ সালে সুপারিশ করেছিল সেলের বদলে আইনগত ক্ষমতা দিয়ে একটি কর্তৃপক্ষ গঠনের। সে সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। অথচ সামুদ্রিক আয়তনের বিশালতা, প্রকল্পগুলোর গুরুত্ব, সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তা ও সম্ভাবনার বিপুলতা বিচার করে সমুদ্র মন্ত্রণালয় গঠন করার কথাও এসেছে। আমরা সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে কাজ এগিয়ে নিতে পারিনি।

কিন্তু দেখা গেলো, গ্যাস অনুসন্ধান, সমুদ্রে কূপ খনন ও গ্যাস উত্তোলনে মিয়ামনার বা ভারত প্রয়াসী অনেক আগে থেকেই। ২০১২ সালে সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তির পর নব উদ্যমে তারা এগোতে থাকল। মিয়ানমার দ্রুতই সামুদ্রিক ফসল ঘরে তুলল। মাত্র দুই বছরে তারা শুধু নতুন করে গ্যাসের মজুদ আবিষ্কার করল, তা নয়, বরং বাংলাদেশের সীমানা লাগোয়া তাদের ব্লাক থেকে শুরু করল গ্যাস উত্তোলন। সেই গ্যাস দিয়ে এখন দেশটি অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাচ্ছে। আবার গ্যাস রফতানিও করছে চীনে। ভারত এ অবধি ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আবিষ্কার করেছে বঙ্গোপসাগরে। দেশটি গ্যাস উত্তোলনও করছে নিয়মিত।

কিন্তু আমরা? সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হবার পরে ২৬টি নতুন বকে একে বিন্যাস করা হয়। এর মধ্যে ১১টিকে অগভীর ও ১৫টিকে গভীর সমুদ্রের ব্লক হিসেবে স্থির করা হয়। এরপর কেটে যায় বছরের পর বছর। ২০১৯ সালে জানা যায় মাত্র ৪টি ব্লকে অনুসন্ধানের জন্য বিদেশী কোম্পানির সাথে চুক্তি হয়েছে। তারা কাজ করে খুব ধীরগতিতে। একটি ক‚পও তখনো খনন করা হয়নি। বাকি ২২টি ব্লক খালি পড়ে থাকে। ২০২২ সালে এতটুকু অগ্রগতির তথ্য জানা যায় যে, বঙ্গোপসাগরের মহীসোপানে জরিপ করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে ন্যূনতম ১৭ থেকে ১০৩ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট (টিসিএফ) গ্যাস হাইড্রেটস মজুদ রয়েছে সেখানে। তীব্র জ্বালানি সঙ্কটে যখন দেশ তড়পাচ্ছে, তখন এ প্রশ্ন সঙ্গত যে, কেন আমরা সমুদ্রের গ্যাসসম্পদ আহরণে সক্ষম হচ্ছি না?

শুধু গ্যাসের কথা কেন? সমুদ্রবিরোধ নিরসনের পরে ‘সেভ আওয়ার সি’-এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতি বছর বঙ্গোপসাগর থেকে আশি লাখ টন মাছ ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের জেলেরা ধরতে পারছেন মাত্র ৭ লাখ টন মাছ। দেশে বছরে যে পরিমাণ মাছ অহরণ হয়, তার মাত্র ১৫ শতাংশ আসে গভীর সমুদ্র থেকে। উপক‚লীয় এলাকার ৫০ লাখের বেশি মানুষের আয়ের প্রধান উৎস সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ। কিন্তু তারা এখনো মূলত প্রচলিত পদ্ধতিতেই সীমাবদ্ধ।

কিন্তু জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে সমুদ্রগামী ট্রলারগুলোর জ্বালানি, পরিচালন, জেলেদের খোরাকি ব্যয়, বরফ, মজুরি মিলিয়ে ব্যয় বেড়েছে ৭০ শতাংশ। ফলে আহরিত মাছ বিক্রি করে ব্যয় তুলে লাভ করা দুরূহ হয়ে গেছে। এ খাতে জ্বালানি ভর্তুকি নেই, ব্যাংক ঋণের সুবিধা অবারিত ও সহজ করা হয়নি, জেলেদের বীমা ও মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করেনি সরকার। গভীর সমুদ্রে মাছ আহরণে প্রয়োজন অত্যাধুনিক ট্রলার ও জাহাজ। সেই সক্ষমতা বাড়েনি। ফলে দেশের নৌযানগুলো গভীর সমুদ্র থেকে মৎস্য আহরণ করতে পারছে না। এই সুযোগে পার্শ্ববর্তী দুই দেশ প্রতিনিয়ত মাছ লুট করে নিচ্ছে, এমন খবর সংবাদমাধ্যমে আসে প্রায়ই।
টুনা মাছের মতো মূল্যবান সম্পদ মূলত গভীর সমুদ্রেই থাকে। আবার যেসব সামুদ্রিক মাছ আগে অগভীর সমুদ্রে দু-চার ঘণ্টার দূরত্বে পাওয়া যেত, তাদের মধ্যে লাক্ষা, সার্ডিন, পোয়া, লটিয়া, ফলি চান্দা, হরিণা চিংড়ি ও কাটা প্রজাতির মাছ এখন পেতে হলে যেতে হয় এক-দুই দিনের দূরত্বে। এ জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নত জাহাজ আবশ্যক। এটি উপলব্ধি করতে সরকারের সময় লেগেছে এক দশক। সম্প্রতি এ জন্য বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু এখানে আরো জরুরি হলো বেসরকারি বিনিয়োগকে উদ্বুদ্ধ করা ও এর অনুক‚ল পরিবেশ নিশ্চিত করা।

উপকূলীয় এলাকায় সমুদ্রকেন্দ্রিক পর্যটন চলমান রয়েছে। তবে সম্ভাবনা কাজে লাগানো হচ্ছে কম। ফলে এ খাতে দেশের আয়ের পরিমাণও কম। পর্যটন স্পটগুলোর উন্নয়ন দরকার। সি ট্যুরিজমের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ক্রুজশিপ। অনেক পর্যটক ক্রুজশিপের প্রতি আগ্রহী। পর্যটন এলাকায় প্রয়োজন সার্ফিং জোন, পানির নিচে ভ্রমণ-ব্যবস্থা, কমিউনিটিভিত্তিক যোগাযোগ স্থাপন। পর্যটন এলাকায় আমাদের ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক সুকৃতির প্রতিফলন থাকা উচিত। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সমুদ্রের পানি ব্যবহার করে লবণ উৎপাদন বাড়ানো যায়। জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজ ভাঙা শিল্প সমৃদ্ধ করা জরুরি।

বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় রয়েছে বিপুল পরিমাণে ভারী খনিজ। আছে ২২০ প্রজাতির সাগর-উদ্ভিদ, ৩৪৭ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস।

এসব জৈব-অজৈব সম্পদ সাগর- অর্থনীতিতে তরঙ্গ তৈরি করতে পারবে। সমুদ্রতলের গ্যাস, মৎস্যসহ অন্যান্য সম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও পর্যটনের ক্ষেত্রে যথোচিত কার্যক্রম সম্পন্ন হলে ২০৩০ সাল নাগাদ সমুদ্র থেকে প্রতি বছর আড়াই লাখ কোটি ডলার আয় করা সম্ভব। অর্থনীতিবিদরা এমনই মতামত দিয়েছেন। কিন্তু এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে রয়েছে বহু প্রতিবন্ধকতা। এখানে অভাব আছে পর্যাপ্ত নীতিমালা ও সঠিক কর্মপরিকল্পনার। এক দিকে যেমন দক্ষ জনশক্তি, প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং মেরিন রিসোর্সভিত্তিক পর্যাপ্ত গবেষণার কমতি রয়েছে, অপর দিকে রয়েছে সম্পদের গুণ, মান ও মূল্য সম্পর্কে সঠিক তথ্য ও ব্লু ইকোনমি সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক যোগাযোগের সমস্যা, গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদনে গবেষণা জাহাজসহ বিবিধ উপাদানের ঘাটতি। এ সঙ্কটগুলোর সুরাহা করতে হবে দ্রুত। নিশ্চিত করতে হবে সরকারি-বেসরকারি যথেষ্ট বিনিয়োগ ও এর পরিকল্পিত সদ্ব্যবহার।

সমুদ্রবাণিজ্য ও অর্থনীতির খাত অনেক, এর পরিসর ব্যাপক। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে সমুদ্র-সম্পদের বহুমাত্রিক ব্যবহারে সক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়েই এ খাতগুলোতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যেতে পারে। লক্ষ্যমাত্রা পূরণে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা জরুরি। পরিকল্পনা যে প্রণীত হয়নি বা হচ্ছে না, তা নয়। বরং বাস্তবায়নে আছে ধীরগতি, অব্যবস্থাপনা ও বহুকেন্দ্রিকতা।