ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

বিশ্ব ইজতেমা ও ইসলামের মর্মবাণী প্রচার

করোনা মহামারীর কারণে দুই বছর বন্ধ থাকার পর এ বছর আবার তাবলিগ জামাতের দুই গ্রুপের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতি বছরই বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সময়ে সময়ে বেশ কিছু ইজতেমা হয়। বাংলাদেশে মূল ইজতেমা ছাড়াও বিভিন্ন জেলায় (কয়েকটি জেলা মিলে) ইজতেমা হয়। যেগুলোকে আঞ্চলিক ইজতেমা বলা হয়। টঙ্গিসহ অন্যান্য স্থানে অনুষ্ঠিত ইজতেমাগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো- দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার লক্ষ্যে বেশি পরিমাণে জামাত আল্লাহর রাস্তায় বের করা। বর্তমান সময়ে কেউ শুধু কয়েকটি বয়ান শুনে ইসলাম পালন শুরু করবে- এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে জামাতে গিয়ে যখন কেউ একনাগাড়ে কিছুটা সময় দ্বীনী পরিবেশে থাকে; তখন তার জন্য ইসলাম মানা অনেকটা সহজ হয়ে যায়। এ জন্য শুধু ইজতেমা নয়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে মানুষকে জামাতে বের করার চেষ্টা করা হয়। বেশি বেশি ইজতেমা হলে, ইজতেমাকে উপলক্ষ করে অনেকের জন্যই জামাতে বের হওয়া সহজ হয়। এ জন্য ইজতেমায় বিশেষভাবে দ্বীনের দাওয়াতের গুরুত্ব ও ঈমান-আমল সংক্রান্ত কথা বলা হয়।
ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে নবী-রাসূল সা: এবং সাহাবায়ে কেরামদের কষ্ট ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিভিন্ন ঘটনাবলি উল্লেখ করা হয়। এর ফলে সাধারণ মানুষ দ্বীনের কাজে আত্মনিয়োগে উৎসাহী হয়। এ জন্য দেখা যায়, সারা বছর মিলে যে পরিমাণ জামাত বের হয়, ইজতেমা থেকেই তার অনেক বেশি জামাত আল্লাহর রাস্তায় ঈমানের দাওয়াত নিয়ে বের হয়।

উপমহাদেশের মুসলমানদের ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে তাবলিগ জামাতের শুভ সূচনা হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও সাধক মাওলানা ইলিয়াস আখতার কান্ধলভি রাহ: (১৮৮৫-১৯৪৪ খ্রি.) দাওয়াতে তাবলিগ জামাতের পুনর্জাগরণ করেন। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিল্লির দক্ষিণ পাশে অবস্থিত এক জনবিরল নীরব অঞ্চল ‘মেওয়াত’। চারিত্রিক বিপর্যস্ত ধর্মকর্মহীন, অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন নামেমাত্র মুসলমান ‘মেও’ জনগোষ্ঠীকে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস, ধর্মের পূর্ণাঙ্গ অনুশীলন ও কালেমার দাওয়াতি মর্ম শিক্ষাদান এবং বিভ্রান্তির কবল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে মাওলানা ইলিয়াস রাহ: তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম শুরু করেন। ১৩৪৫ হিজরিতে হজ থেকে ফিরে এসে তিনি তাবলিগি গাশ্ত শুরু করলেন, জনসাধারণের মধ্যে কালেমা ও নামাজের দাওয়াত দিতে লাগলেন। তাবলিগ জামাত বানিয়ে বিভিন্ন এলাকায় বের হওয়ার দাওয়াত দিলেন। এভাবে গ্রামে গ্রামে সৎ কাজ করার জন্য জামাত তৈরি করে দিতেন। কয়েক বছর মেওয়াতে এ পদ্ধতিতে দাওয়াতি কাজ অব্যাহত থাকল।

১৩৫২ হিজরিতে আবার হজ পালনের পর তিনি বুঝতে পারলেন, গরিব মেওয়াতি (আঞ্চলিক) কৃষকদের পক্ষে দ্বীন শেখার সময় পাওয়া কষ্টকর। ঘরসংসার ছেড়ে মাদরাসায় দ্বীন শেখাও অসম্ভব। ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে সামগ্রিক জীবন পাল্টে দেয়া বা জাহেলি বিশ্বাসকে পরিবর্তন করাও সম্ভব নয়। তাই ক্ষুদ্র দল বা ছোট জামাত আকারে ইলমি ও দ্বীনী প্রতিষ্ঠানগুলোয় গিয়ে সময় কাটানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করলেন এবং ধর্মীয় পরিবেশে তালিম দিতে আরম্ভ করলেন। সেসব ধর্মীয় মজলিসে ওলামা-মাশায়েখদের ওয়াজ-নসিহতের পাশাপাশি তাদের দৈনন্দিন জীবনের নিয়ম-নীতি বাতলে দেয়া হতো। মানুষ দ্বীনদার পরহেজগার লোকদের জীবনযাপন, কথাবার্তা, আচার-আচরণ, চালচলন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। শুরুতে তাবলিগি কার্যক্রম ব্যাপক সমর্থন পায়নি, কিন্তু ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।

রাসূলুল্লাহ সা:-এর মুখনিঃসৃত শাশ্বত বাণী : তোমার কাছে যদি আমার কোনো বাণী থাকে, তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও’- এ দাওয়াতি আহ্বানকে কেন্দ্র করেই পর্যায়ক্রমে তাবলিগের বিশ্বব্যাপী প্রচার ও প্রসার ঘটে। এ ব্যাপারে তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস রহ: অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠা, ধৈর্য, পরিশ্রম করেন। পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনায় অপরিসীম ভূমিকা রাখেন।

তাবলিগ জামাতের দ্বিতীয় আমির মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভি রহ:-এর যুগে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এ আন্দোলন সবচেয়ে বেশি ও শক্তিশালী ছিল। প্রথম ইজতেমা ১৯৪১ সালে দিল্লির নিজামউদ্দীন মসজিদের ছোট এলাকা মেওয়াতের নুহ মাদরাসায় আয়োজন করা হয়। এতে প্রায় ২৫ হাজার তাবলিগ দ্বীনদার মুসলমান অংশ নেন। এভাবে অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে মেওয়াতের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার কিছু মানুষের কাছে দ্বীনের কথা প্রচারের মধ্য দিয়ে তাবলিগ জামাতের যাত্রা শুরু হয়।

বাংলাদেশে ১৯৪৬ সালে ঢাকার রমনা পার্কসংলগ্ন কাকরাইল মসজিদে তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সম্মেলন বা ইজতেমা প্রথম অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামে তৎকালীন হাজী ক্যাম্পে ইজতেমা হয়, ১৯৫৮ সালে বর্তমান নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। তখন এটি কেবল ইজতেমা হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রতি বছর ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা আশাতীতভাবে বাড়তে থাকায় ১৯৬৬ সালে ইজতেমা টঙ্গীর পাগার গ্রামের খোলা মাঠে আয়োজন করা হয়। ওই বছর স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অংশ নেয়ায় ‘বিশ্ব ইজতেমা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৬৭ সাল থেকে বর্তমান অবধি (২০১১ সাল থেকে দুই পর্বে) ‘বিশ্ব ইজতেমা’ টঙ্গীর কহর দরিয়াখ্যাত তুরাগ নদের উত্তর-পূর্ব তীরসংলগ্ন ডোবা-নালা, উঁচু-নিচু মিলিয়ে রাজউকের হুকুমদখলকৃত ১৬০ একর জায়গার বিশাল খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম-শহর-বন্দর থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও বিশ্বের প্রায় ৫০ থেকে ৫৫টি দেশের তাবলিগি দ্বীনদার মুসলমান জামাতসহ লাখ লাখ মুসল্লি বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেন।

বিশ্ব ইজতেমার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, তিন দিন দেশ-বিদেশের ঈমানদার ত্যাগী আলেম-ওলামাদের কাছ থেকে পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে বয়ান শুনে ঈমান-আমলের দাওয়াত সারা বিশ্বে পৌঁছে দেয়া। শুধু ইসলামী বয়ান শোনা কিংবা আখেরি মুনাজাতে প্রচুর লোকজনের অংশগ্রহণ করা ইজতেমার মূল উদ্দেশ্য নয়। লক্ষ্য হলো, যাতে বেশি তাবলিগ জামাত বের হয়। প্রতি বছর এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৭০০ জামাত বিশ্ব ইজতেমা থেকে দেশে-বিদেশে এক চিল্লা (৪০ দিন), তিন চিল্লা (চার মাস), ছয় মাস ও এক বছরের জন্য আল্লাহর দ্বীনের তাবলিগ ও দাওয়াতের জন্য বের হয়। তাবলিগের প্রতি জামাতে ১৪ থেকে ১৫ জন মুসল্লি থাকেন। জামাত বের হওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রথমত, জামাতের সাথীদের ঈমান-আমল ও ইলম অর্জন করা ও আত্মশুদ্ধি হওয়া। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি মসজিদ থেকে জামাত বের করা। তৃতীয়ত, প্রতিটি মসজিদে পাঁচ আমল পরিপূর্ণ চালু করা (সপ্তাহে দুই দিন গাশ্ত করা, প্রতিদিন মাশওয়ারা করা, প্রতিদিন আড়াই ঘণ্টা দ্বীনের দাওয়াত দেয়া, প্রতিদিন মসজিদ ও বাড়িতে তালিম করা এবং মাসে তিন দিন তাবলিগে যাওয়া)। প্রতিটি জামাত নির্ধারিত এলাকার প্রতি মসজিদে দুই-তিন দিন করে থেকে তাওহিদ, রিসালাত, আখিরাত, ঈমান ও আমলের দাওয়াত দেয়া।

এ বছর দেশের প্রতিটি মসজিদ থেকে একটি করে তাবলিগ-জামাত বের করার লক্ষ্য নিয়ে ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমা ২০২৩ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবারও দুই পর্বে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ১৩ থেকে ১৫ জানুয়ারি প্রথম পর্ব ও ২০ থেকে ২২ জানুয়ারি দ্বিতীয় পর্ব।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

বিশ্ব ইজতেমা ও ইসলামের মর্মবাণী প্রচার

আপডেট সময় ১০:৪০:২৭ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২৩

করোনা মহামারীর কারণে দুই বছর বন্ধ থাকার পর এ বছর আবার তাবলিগ জামাতের দুই গ্রুপের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতি বছরই বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সময়ে সময়ে বেশ কিছু ইজতেমা হয়। বাংলাদেশে মূল ইজতেমা ছাড়াও বিভিন্ন জেলায় (কয়েকটি জেলা মিলে) ইজতেমা হয়। যেগুলোকে আঞ্চলিক ইজতেমা বলা হয়। টঙ্গিসহ অন্যান্য স্থানে অনুষ্ঠিত ইজতেমাগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো- দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার লক্ষ্যে বেশি পরিমাণে জামাত আল্লাহর রাস্তায় বের করা। বর্তমান সময়ে কেউ শুধু কয়েকটি বয়ান শুনে ইসলাম পালন শুরু করবে- এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে জামাতে গিয়ে যখন কেউ একনাগাড়ে কিছুটা সময় দ্বীনী পরিবেশে থাকে; তখন তার জন্য ইসলাম মানা অনেকটা সহজ হয়ে যায়। এ জন্য শুধু ইজতেমা নয়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে মানুষকে জামাতে বের করার চেষ্টা করা হয়। বেশি বেশি ইজতেমা হলে, ইজতেমাকে উপলক্ষ করে অনেকের জন্যই জামাতে বের হওয়া সহজ হয়। এ জন্য ইজতেমায় বিশেষভাবে দ্বীনের দাওয়াতের গুরুত্ব ও ঈমান-আমল সংক্রান্ত কথা বলা হয়।
ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে নবী-রাসূল সা: এবং সাহাবায়ে কেরামদের কষ্ট ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিভিন্ন ঘটনাবলি উল্লেখ করা হয়। এর ফলে সাধারণ মানুষ দ্বীনের কাজে আত্মনিয়োগে উৎসাহী হয়। এ জন্য দেখা যায়, সারা বছর মিলে যে পরিমাণ জামাত বের হয়, ইজতেমা থেকেই তার অনেক বেশি জামাত আল্লাহর রাস্তায় ঈমানের দাওয়াত নিয়ে বের হয়।

উপমহাদেশের মুসলমানদের ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে তাবলিগ জামাতের শুভ সূচনা হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও সাধক মাওলানা ইলিয়াস আখতার কান্ধলভি রাহ: (১৮৮৫-১৯৪৪ খ্রি.) দাওয়াতে তাবলিগ জামাতের পুনর্জাগরণ করেন। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিল্লির দক্ষিণ পাশে অবস্থিত এক জনবিরল নীরব অঞ্চল ‘মেওয়াত’। চারিত্রিক বিপর্যস্ত ধর্মকর্মহীন, অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন নামেমাত্র মুসলমান ‘মেও’ জনগোষ্ঠীকে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস, ধর্মের পূর্ণাঙ্গ অনুশীলন ও কালেমার দাওয়াতি মর্ম শিক্ষাদান এবং বিভ্রান্তির কবল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে মাওলানা ইলিয়াস রাহ: তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম শুরু করেন। ১৩৪৫ হিজরিতে হজ থেকে ফিরে এসে তিনি তাবলিগি গাশ্ত শুরু করলেন, জনসাধারণের মধ্যে কালেমা ও নামাজের দাওয়াত দিতে লাগলেন। তাবলিগ জামাত বানিয়ে বিভিন্ন এলাকায় বের হওয়ার দাওয়াত দিলেন। এভাবে গ্রামে গ্রামে সৎ কাজ করার জন্য জামাত তৈরি করে দিতেন। কয়েক বছর মেওয়াতে এ পদ্ধতিতে দাওয়াতি কাজ অব্যাহত থাকল।

১৩৫২ হিজরিতে আবার হজ পালনের পর তিনি বুঝতে পারলেন, গরিব মেওয়াতি (আঞ্চলিক) কৃষকদের পক্ষে দ্বীন শেখার সময় পাওয়া কষ্টকর। ঘরসংসার ছেড়ে মাদরাসায় দ্বীন শেখাও অসম্ভব। ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে সামগ্রিক জীবন পাল্টে দেয়া বা জাহেলি বিশ্বাসকে পরিবর্তন করাও সম্ভব নয়। তাই ক্ষুদ্র দল বা ছোট জামাত আকারে ইলমি ও দ্বীনী প্রতিষ্ঠানগুলোয় গিয়ে সময় কাটানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করলেন এবং ধর্মীয় পরিবেশে তালিম দিতে আরম্ভ করলেন। সেসব ধর্মীয় মজলিসে ওলামা-মাশায়েখদের ওয়াজ-নসিহতের পাশাপাশি তাদের দৈনন্দিন জীবনের নিয়ম-নীতি বাতলে দেয়া হতো। মানুষ দ্বীনদার পরহেজগার লোকদের জীবনযাপন, কথাবার্তা, আচার-আচরণ, চালচলন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। শুরুতে তাবলিগি কার্যক্রম ব্যাপক সমর্থন পায়নি, কিন্তু ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।

রাসূলুল্লাহ সা:-এর মুখনিঃসৃত শাশ্বত বাণী : তোমার কাছে যদি আমার কোনো বাণী থাকে, তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও’- এ দাওয়াতি আহ্বানকে কেন্দ্র করেই পর্যায়ক্রমে তাবলিগের বিশ্বব্যাপী প্রচার ও প্রসার ঘটে। এ ব্যাপারে তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস রহ: অত্যন্ত ন্যায়নিষ্ঠা, ধৈর্য, পরিশ্রম করেন। পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনায় অপরিসীম ভূমিকা রাখেন।

তাবলিগ জামাতের দ্বিতীয় আমির মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভি রহ:-এর যুগে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এ আন্দোলন সবচেয়ে বেশি ও শক্তিশালী ছিল। প্রথম ইজতেমা ১৯৪১ সালে দিল্লির নিজামউদ্দীন মসজিদের ছোট এলাকা মেওয়াতের নুহ মাদরাসায় আয়োজন করা হয়। এতে প্রায় ২৫ হাজার তাবলিগ দ্বীনদার মুসলমান অংশ নেন। এভাবে অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে মেওয়াতের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার কিছু মানুষের কাছে দ্বীনের কথা প্রচারের মধ্য দিয়ে তাবলিগ জামাতের যাত্রা শুরু হয়।

বাংলাদেশে ১৯৪৬ সালে ঢাকার রমনা পার্কসংলগ্ন কাকরাইল মসজিদে তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সম্মেলন বা ইজতেমা প্রথম অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামে তৎকালীন হাজী ক্যাম্পে ইজতেমা হয়, ১৯৫৮ সালে বর্তমান নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। তখন এটি কেবল ইজতেমা হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রতি বছর ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা আশাতীতভাবে বাড়তে থাকায় ১৯৬৬ সালে ইজতেমা টঙ্গীর পাগার গ্রামের খোলা মাঠে আয়োজন করা হয়। ওই বছর স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অংশ নেয়ায় ‘বিশ্ব ইজতেমা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৬৭ সাল থেকে বর্তমান অবধি (২০১১ সাল থেকে দুই পর্বে) ‘বিশ্ব ইজতেমা’ টঙ্গীর কহর দরিয়াখ্যাত তুরাগ নদের উত্তর-পূর্ব তীরসংলগ্ন ডোবা-নালা, উঁচু-নিচু মিলিয়ে রাজউকের হুকুমদখলকৃত ১৬০ একর জায়গার বিশাল খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম-শহর-বন্দর থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও বিশ্বের প্রায় ৫০ থেকে ৫৫টি দেশের তাবলিগি দ্বীনদার মুসলমান জামাতসহ লাখ লাখ মুসল্লি বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেন।

বিশ্ব ইজতেমার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, তিন দিন দেশ-বিদেশের ঈমানদার ত্যাগী আলেম-ওলামাদের কাছ থেকে পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে বয়ান শুনে ঈমান-আমলের দাওয়াত সারা বিশ্বে পৌঁছে দেয়া। শুধু ইসলামী বয়ান শোনা কিংবা আখেরি মুনাজাতে প্রচুর লোকজনের অংশগ্রহণ করা ইজতেমার মূল উদ্দেশ্য নয়। লক্ষ্য হলো, যাতে বেশি তাবলিগ জামাত বের হয়। প্রতি বছর এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৭০০ জামাত বিশ্ব ইজতেমা থেকে দেশে-বিদেশে এক চিল্লা (৪০ দিন), তিন চিল্লা (চার মাস), ছয় মাস ও এক বছরের জন্য আল্লাহর দ্বীনের তাবলিগ ও দাওয়াতের জন্য বের হয়। তাবলিগের প্রতি জামাতে ১৪ থেকে ১৫ জন মুসল্লি থাকেন। জামাত বের হওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রথমত, জামাতের সাথীদের ঈমান-আমল ও ইলম অর্জন করা ও আত্মশুদ্ধি হওয়া। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি মসজিদ থেকে জামাত বের করা। তৃতীয়ত, প্রতিটি মসজিদে পাঁচ আমল পরিপূর্ণ চালু করা (সপ্তাহে দুই দিন গাশ্ত করা, প্রতিদিন মাশওয়ারা করা, প্রতিদিন আড়াই ঘণ্টা দ্বীনের দাওয়াত দেয়া, প্রতিদিন মসজিদ ও বাড়িতে তালিম করা এবং মাসে তিন দিন তাবলিগে যাওয়া)। প্রতিটি জামাত নির্ধারিত এলাকার প্রতি মসজিদে দুই-তিন দিন করে থেকে তাওহিদ, রিসালাত, আখিরাত, ঈমান ও আমলের দাওয়াত দেয়া।

এ বছর দেশের প্রতিটি মসজিদ থেকে একটি করে তাবলিগ-জামাত বের করার লক্ষ্য নিয়ে ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমা ২০২৩ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবারও দুই পর্বে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ১৩ থেকে ১৫ জানুয়ারি প্রথম পর্ব ও ২০ থেকে ২২ জানুয়ারি দ্বিতীয় পর্ব।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি