দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চলমান বন্যা ২৪ ঘণ্টায় আরও এক জেলায় বিস্তার লাভ করেছে। নতুন করে বন্যাকবলিত হয়েছে কুড়িগ্রাম। এ ছাড়া আগে থেকে নীলফামারী, লালমনিরহাট ও নেত্রকোনায় বন্যা চলছে। এসব জেলায় হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দি। শুধু কুড়িগ্রামেই প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি পড়ে পড়েছে। শুক্রবার এ জেলার নাগেশ্বরী উপজেলায় একটি সড়ক উপচে ভেসে গেছে কয়েকটি গ্রাম।
সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি) জানিয়েছে, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার ও সোমেশ্বরী নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিমসহ ভারতের পূর্বাঞ্চলে হওয়া ভারি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানি নেমে আসায় এ বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিনিধিদের পাঠানো খরব-
কুড়িগ্রাম : শুক্রবার দুপুর দেড়টায় কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের পোড়ারচর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গৃহবধূ শাপলার বাড়ির উঠানে পানি। তলিয়ে গেছে রান্নাঘরের মেঝে। স্বামী বাবুল আলী এক সন্তানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। অপর সন্তানটি তার শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। শাপলা কিছু চাল আর কাঁঠালের বিচি ভাজছেন। দুপুরে এই খেয়েই তাদের দিন কেটে যাবে। বন্যা হলেই এমন দুর্দশা হয় এসব পরিবারে।
পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ ভগবতীপুর গ্রামের গৃহবধূ নার্গিস বলেন, চার দিন ধরে পানিবন্দি হয়ে আছি। কেউ খোঁজখবর নেন না। ঘরের চৌকিতে পানি ওঠায় পার্শ্ববর্তী উঁচু বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। ওই গ্রামে প্রায় ৪৫-৫০টি বাড়িতে পানি উঠেছে।
নাগেশ্বরী উপজেলার পানাপিকারী থেকে বড়মানি সড়ক উপচে শুক্রবার কয়েকটি গ্রাম তলিয়ে গেছে। উপজেলার নুনখাওয়া ইউনিয়নের চরকাফনা গ্রামের নুর বখত জানান, নিচু এলাকার বাড়িঘরে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। লোকজন গবাদিপশু নিয়ে শঙ্কায় আছেন। এই গ্রামের গৃহবধূ নাজমা জানান, চারদিকে পানি থাকায় ঠিকমতো রান্নাবান্না করতে পারছি না।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়নের তথ্যমতে, শুক্রবার দুপুর ৩টায় দুধকুমার নদী ৫৪ সে. মিটার, ধরলা নদী ২১ সে. মিটার বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, এই পানি বৃদ্ধির অবস্থা ৩ থেকে ৪ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। তারপর পানি নেমে যাবে। তিনি বলেন, কুড়িগ্রামে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো বাঁধ বন্যায় ডুবে বা ভেঙে যায়নি। নাগেশ্বরী উপজেলায় একটি সড়ক সংস্কারের কাজ করেছে পাউবো। সেটির দুটি অংশ প্লাবিত হয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। এতে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, ইতোমধ্যে ৬৫ মে. টন চাল উপজেলাগুলোতে উপ-বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও আমাদের কাছে ৫৮৫ মে. টন চাল, ১০ লাখ টাকা ও এক হাজার ৭০০ প্যাকেট শুকনো খাবার মজুত রয়েছে। আমরা বন্যার্তদের তালিকা করছি, তালিকা পেলে উপ-বরাদ্দ দেওয়া হবে।
ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) : ধরলা, বারোমাসিয়া, নীলকমলসহ সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে। শেখ হাসিনা ধরলা সেতুর পশ্চিম পাড়ের দক্ষিণ সোনাইকাজী সৌহার্দ্য বাজার যাওয়ার সড়কটি ধরলার পানির তোড়ে তিন জায়গায় ভেঙে গেছে। এতে প্রায় ৩০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গোরকমন্ডল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে হাঁটু পানি। বানের পানিতে তলিয়ে গেছে পশ্চিম ধনিরামের মাঝের চরের প্রায় ২০০ পরিবারের বসতঘর। বানভাসিরা শুকনা খাবার খেয়ে আপাতত ক্ষুধা নিবারণ করছেন। উপজেলা সদরের নাওডাঙ্গা পুলের পাড়ের নির্মাণাধীন সেতুর বাইপাস সড়কের লোহার সেতুটি ডুবে যাওয়ায় তিনটি ইউনিয়নের সঙ্গে ফুলবাড়ী উপজেলার যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে পড়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) সবুজ কুমার গুপ্ত বলেন, ধরলা ও বারোমাসিয়া নদী তীরবর্তী এলাকায় এক হাজার ৪০০ পরিবার পানিবন্দি। আমরা প্রথম দফায় পাঁচ টন চাল ও ৫০ হাজার টাকা বিতরণ করেছি। ছয় টন চাল মজুত আছে। বৃষ্টি কমামাত্রই পানিবন্দি পরিবারের মাঝে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করা হবে।
লালমনিরহাট : তিস্তা ও ধরলা নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে পাঁচ উপজেলার প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণে নতুন করে ১১০ মে. টন চাল ও চার লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার দুপুর ১২টায় শিমুলবাড়ি পয়েন্টে ধরলার পানি বিপৎসীমার ২৫ সে. মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তবে বেলা ৩টায় তা কিছুটা কমে বিপৎসীমার ২০ সে. মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার বলেন, উজানের ঢলে পানি বাড়ছে। তবে পানি বাড়লেও তা স্থায়ী হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা ইউপি চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক চৌধুরী জানান, তার ইউনিয়নে ছয়টি ওয়ার্ডে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে।
ডিমলা (নীলফামারী) : তিস্তার ঢলে প্লাবিত হয়েছে নীলফামারীর ১৫টি গ্রাম। শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা বিপৎসীমার ৪০ সে. মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই, পশ্চিম ছাতনাই, টেপাখড়িবাড়ী, খগাখড়িবাড়ী, খালিশা চাপানি, ঝুনাগাছ চাপানি ও গয়াবাড়ী ইউনিয়নের প্রায় ১৫টি চরে বসতবাড়িতে পানি উঠেছে বলে জানিয়েছেন ওইসব ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধিরা। গ্রামগুলোর বাসিন্দারা বৃহস্পতিবার রাত থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে শুরু করেছেন। খালিশা চাপানি ইউপি চেয়ারম্যান সহিদুজ্জামান কেনজুল বলেন, বন্যায় ছোটখাতা ও বাইশপুকুর গ্রামের সহস্রাধিক পরিবারের বাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে।
পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল লতীফ খান জানান, তার ইউনিয়নের দুটি গ্রামের প্রায় এক হাজার পরিবারের বাড়িঘরে পানি উঠেছে। ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বেলায়েত জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করতে জনপ্রতিনিধিদের বলা হয়েছে। সরকারিভাবে ত্রাণ বরাদ্দ দেওয়া আছে। তালিকা পাওয়ামাত্রই ত্রাণ বিতরণ করা হবে।