মুমূর্ষু রোগীকে ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে ট্রলিবাহককে দিতে হয় টাকা। শয্যা পেতেও দরকার টাকার। এরপর চিকিৎসা পেতে প্রায় প্রতিটি ধাপে নির্ধারিত ফির বাইরে গুনতে হয় অর্থ।। স্বাস্থ্যসেবায় এভাবে পদে পদে বাণিজ্য করে আসছে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালের একটি চক্র। এতে চরম ভোগান্তিতে রয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের হাজারো হতদরিদ্র রোগীকে। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি।
গত বৃহস্পতিবার নগরীর উত্তর আমানতগঞ্জ সড়কে বালুবাহী ট্রলিচাপায় মনোয়ারা বেগম নামের এক গৃহবধূ নিহত হন। তাঁর ভাতিজা ইব্রাহিম রানার অভিযোগ, আহতাবস্থায় মনোয়ারাকে শেবাচিম হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। তাঁকে জরুরি বিভাগ থেকে ওয়ার্ডের ভেতরে নেওয়ার জন্য হাসপাতালের ট্রলিতে তোলা হলে ট্রলিবাহকেরা ২০০ টাকা দাবি করেন। এ নিয়ে বাগ্বিতণ্ডায় ২০ মিনিট সময় নষ্ট হলে মনোয়ারা চিকিৎসার অভাবে জরুরি বিভাগে মারা যান।
শেবাচিম হাসপাতালে এই ট্রলি-বাণিজ্য নিত্যদিনের। এরপর রোগীকে নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে শয্যা পেতে বকশিশ দিতে হয়। তবে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক মোস্তফা জামান জানান, তিনি ট্রলিতেই রোগী পেয়েছেন। ট্রলিবাহক টাকা চেয়েছেন কি না, তাঁর জানা নেই।
গত বৃহস্পতিবার হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে দুই নারীকে বিছানার চাদর নিয়ে টানাটানি করতে দেখা যায়। কয়েক মিনিট পর তাঁদের মধ্যে সমঝোতা হলে একটি শিশু রোগী নিয়ে শয্যায় ওঠেন অভিভাবকেরা। তাঁর পাশেই অসুস্থ শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন সদর উপজেলার চন্দ্রমোহনের সালাম। স্বজনেরা জানান, দুই দিন ওয়ার্ডের মেঝেতে থাকার পর শয্যাটি পেতে বুয়াকে ১০০ টাকা দিতে হয়েছে।
সাত দিন শিশু ওয়ার্ডে ছিলেন তালতলীর সুরাইয়া আক্তার। তিনি জানান, এক বুয়াকে ১০০ টাকা ঘুষ দিয়ে শয্যা পেয়েছিলেন। ওই বুয়াকে প্রতিদিন বেড ভাড়া দিতে হয়েছে ৫০ টাকা। সকাল ও বিকেলে সিনিয়র চিকিৎসকেরা ওয়ার্ড পরিদর্শনে গেলে মেঝের রোগীদের উঠিয়ে প্রতি শয্যায় দুজন করে রাখা হয়।
হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার মশিউর রহমান তপু সাংবাদিকদের জানান, ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত শিশু রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলছে। চিকিৎসা দিতে তাঁরা হিমশিম খাচ্ছেন। একটি শয্যায় দুজন করে শিশু রোগী রেখেও তাঁরা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছেন না।
মেডিসিন ওয়ার্ডের একাধিক রোগীর স্বজন জানান, বুয়াকে বকশিশ দিলে বেডের আশপাশ পরিষ্কার ও ময়লা অপসারণ করেন দ্রুত। অন্যথায় ফিরেও তাকাবেন না তাঁরা।
এ বিষয়ে শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে রোগীর চেয়ে শয্যাসংখ্যা অনেক কম। শীতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় মেডিসিন ও শিশু ওয়ার্ডে রোগী বেড়েছে।
তাই আপাতত প্রতি শয্যায় দুজন করে রোগী রাখার জন্য বলা হয়েছে। তিনি বলেন, ট্রলিবাহককে টাকা না দেওয়ায় গৃহবধূ মারা গেছেন—এমন ঘটনা কতটা সত্য, তা খতিয়ে দেখা হবে। শয্যা পেতে কাউকে টাকা দেওয়ার দরকার নেই।
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন বরিশাল জেলার সাধারণ সম্পাদক কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার অবস্থা চরম নিম্নমানের। গরিব মানুষকে এখানে চিকিৎসা নিতে এসেও টাকা গুনতে হয়। ওষুধ থাকলেও তা দেওয়া হয় না। একটি শয্যাও পাওয়া যায় না। ট্রলিবাহককে টাকা না দেওয়ায় চিকিৎসা না পেয়ে গৃহবধূর মৃত্যুর মতো করুণ ঘটনা তো হত্যার শামিল। তিনি এসব ঘটনার সুষ্ঠু সমাধান দাবি করেছেন। সূত্র: আজকের পত্রিকা