ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

রাজনীতিতে ভর করেছে ভয়ের সংস্কৃতি

  • মো: হারুন-অর-রশিদ
  • আপডেট সময় ১১:১৫:৩৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩০ জুলাই ২০২৩
  • ১১৩৪ বার পড়া হয়েছে

রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তি মননে ভয় সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। রাষ্ট্রের বর্তমান শাসক এবং শাসকের হুকুম যারা পালন করেন, তারা সুচারুভাবে সমাজে ভয়ের জায়গা তৈরি করেছেন, যা ব্যক্তিগত জীবনেও প্রবলভাবে উপস্থিত। রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখতে গিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজে একদিকে বৈষম্য অন্যদিকে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে একপক্ষকে দমিয়ে রাখার প্রবণতা প্রবলভাবে জেঁকে বসেছে।

অপশাসন, দুর্নীতি, গুম, খুনের মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করে একটি পক্ষ জগদ্দল পাথরের মতো ক্ষমতার আসনে চিরস্থায়ী হতে চায়। ফলে সমাজের বঞ্চিত গোষ্ঠীর মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ ও প্রতিবাদের আওয়াজ বিরাজমান। কিন্তু তারা সেই আওয়াজ বাইরে প্রকাশ করতে পারছেন না। ভয় দেখিয়ে তাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করে রাখতে সচেষ্ট শাসকগোষ্ঠী এবং একটি সঙ্ঘবদ্ধ চক্র। রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী জনগণের মতামত উপেক্ষা করে, মানে ভোটাধিকার হরণ করে ক্ষমতায় আসীন হয়েছে, ফলে তারা পরমতসহিষ্ণুতা দেখাতে পুরোপুরি ব্যর্থ। প্রতিবাদী পক্ষকে দমনে শাসকগোষ্ঠী মরিয়া। তাদের এখন এটিই প্রধান কাজ বলে মনে হচ্ছে।

রাষ্ট্রে যদি কোনো জবাবদিহি না থাকে, তাহলে অন্যত্রও জবাবদিহি থাকে না। অপরাধ, বিচারহীনতা, জবাবদিহির অভাব ও নিপীড়ন চলছে। কিন্তু প্রতিবাদী কণ্ঠ ভয়ের কাছে চুপসে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দিক বিচারে এর দায়ভার শুধু বিরোধী রাজনৈতিক দলের নয়; সামগ্রিক বিচারে সমাজের জনগণও এর জন্য দায়ী। সমাজের সব মানুষেরই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত। কিন্তু সমাজের একটি শ্রেণী অপ্রত্যাশিত সুবিধা পেয়ে সমাজের বেশির ভাগ মানুষের অসুবিধার কথা ভুলে যাচ্ছেন। মূলত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ করতে শাসকগোষ্ঠী নানা অপকৌশলে সমাজের একটি শ্রেণীকে সুবিধা দিয়ে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর প্রতিবাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করতে দীর্ঘদিন ধরে দেশে-রাষ্ট্রে-সমাজে ভীতির সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন।

তারা শুধু সাধারণ জনগণই নন, সচেতন ব্যক্তিবর্গের মধ্যেও বিভাজন তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন। শাসকগোষ্ঠী ওই মুষ্টিমেয় মানুষকে লোভ দেখান এবং ভয় দেখান। অনেক বুদ্ধিজীবী লোভের কাছে বশীভূত, অনেকে ভয়ের কাছে নতজানু। তারা সংগঠিতও নন। তার ওপর তারা দলীয়ভাবে বিভক্ত। স্বাভাবিকভাবে সরকারপন্থী হওয়ার দিকে ঝোঁকটা থাকে বেশি। সে কারণে সরকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের অবস্থানটা সবল নয়। ফলে শাসকগোষ্ঠীর অনাচারের চিত্র সঠিকভাবে ফুটে উঠছে না। সহজ করে বললে বলতে হয়, বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মধ্যে সুবিধাবাদ আছে এবং ভয়ও কাজ করছে।

দেশের মানুষ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কার্যক্রম বা সরকারের কাজের সমালোচনা রাজপথেও করতে পারছেন না, করলে বাধা ও নির্যাতন; সংবাদমাধ্যমে সমালোচনা করলে বিপদ, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে করলে গ্রেফতার।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ দেশের এ পরিস্থিতিকে ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ বলে উল্লেখ করেছেন। আজকে রাজনৈতিক অঙ্গনে ভয়ের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, সেই ভয়ের মধ্যে শুধু বিরোধী রাজনৈতিক দলই নয় বরং সরকারও অধিক ভয়ে আছে। সরকার জনগণকে ভয় পায়। জনগণ যদি সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তারা ক্ষমতায় যেমন থাকতে পারবেন না, তেমনি সব অপকর্মের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে এ ভয় তাদের গ্রাস করছে। ফলে তারা আরো বেশি অপরাধ করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চান। তাদের এ অপরাধের সঙ্গী হিসেবে ব্যবহার করছে পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থাকে।

সরকার কৌশলগতভাবে অপরাধের সাথে যুক্ত পুলিশ, সিভিল প্রশাসন কিংবা অন্যান্য বাহিনী ও সংস্থার লোকজনকে এই বলে ভয় দেখাচ্ছে যে, আমরা ক্ষমতায় না থাকলে তোমাদেরও বিচারের মুখোমুখি হতে হবে এবং শাস্তি পেতে হবে। এ ভয়ে, বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রাখতে তারা আরো বেশি অপরাধের সাথে যুক্ত হচ্ছে। অর্থাৎ ক্ষমতাসীনরা টিকে থাকতে প্রকারান্তরে গোটা রাষ্ট্রটাকে এর সাথে যুক্ত করতে সচেষ্ট। আজ যারা ব্যক্তিগত ভালো-ক্ষতির চিন্তায় পুরো সমাজটাকে ভয় ও অপরাধের কাছে নতজানু করছে তাদের সংখ্যা কম হলেও ভয়ের রাজ্যে তারা ত্রাস। এই স্বল্পসংখ্যক মহারথী গোটা সমাজ নিয়ন্ত্রণ করছেন। সমাজের বাকি লোকদের চলার পথও তারা দেখিয়ে দিচ্ছেন। বাকি বেশি সংখ্যক সুবিধাবঞ্চিতরা ত্রাসের কারণে কথা বলছেন না, পাছে তাদের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়ে।

সরকার দাবি করছে, জনগণ তাদের শক্তি কিন্তু তারা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে ভয় পায়। প্রকারান্তরে তারা জনগণের ম্যান্ডেট নিতে ভয় পায়। কারণ তারা জানে, জনগণ তাদের শক্তি বলে প্রচার করলেও আমজনতার সমর্থন তাদের রয়েছে কী না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। সত্যিকার অর্থে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে এবং জনগণ তাদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার পেলে ভোটারদের সমর্থন আছে বলে যে দাবি সরকারি দল করছে তার মুখোশ উন্মোচন হয়ে যাবে।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে জনগণ ভয়ের মধ্যে থাকতে চান না। তারা তাদের সাংবিধানিক অধিকার স্বাধীনভাবে ভোগ করতে চান। তারা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে চান, কথা বলতে চান, নির্ভয়ে, নির্বিঘ্নে জীবন চালাতে চান। মূলত এসব অধিকার প্রতিষ্ঠায় ৫২ বছর আগে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন হয়েছিল, তাই সেদিন মানুষ রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে ইজ্জত সম্ভ্রম হারিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু আজকে ৫২ বছর পরেও সেই একই ভয়ের মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হচ্ছে। সেই একই বঞ্চনা, নিপীড়ন হজম করতে হচ্ছে। সেই একই অধিকার আদায়ে এখনো সংগ্রাম করতে হচ্ছে, রক্ত ও জীবন দিতে হচ্ছে।

কী এক আজব বাস্তবতা! একই রাষ্ট্রে সরকারি দল সভা-সমাবেশ করার জন্য গাড়ি ঘোড়া, লঞ্চ স্টিমারে আনন্দনৃত্য করে লোক সমাগম করে। অন্যদিকে বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে সব বন্ধ হয়ে যায়। পথে পথে পুলিশের হয়রানি, গ্রেফতার, সরকারদলীয় লোকজনের আক্রমণ মোকাবেলা করে এ দেশে বিরোধী রাজনীতির সভা-সমাবেশ করতে হয়। আরেকটি আতঙ্ক হলো, মোবাইল ফোন চেক করে সেই মোবাইলে বিএনপির কোনো নেতাকর্মীর ছবি পেলে তার আর রক্ষে নেই। লাল দালানের বাসিন্দা হতে হয়। তাদের এই অসাংবিধানিক ও বেআইনি আচরণে মনে হয় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি এবং বিএনপির নেতাকর্মীরা এ দেশে নিষিদ্ধ কিছু। কোনো বৈধ সংগঠনের নেতাকর্মীরা সাংবিধানিক অধিকার বলে সভা-সমাবেশ, মিছিল, মিটিং করতে গিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের কাছে গ্রেফতার হয়ে মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে সর্বোচ্চ আদালতের কাছে জামিন প্রার্থনা করতে যান তখন সেই আদালত যদি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকারের কথা ভুলে জামিন না দেন এবং বলেন কে আপনাকে মিছিল মিটিং করতে বলেছেন? এর থেকে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে? অর্থাৎ আদালতের সামনে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে রেখে বিচার বিভাগকে ভয়ের মধ্যে কুক্ষিগত করতে সক্ষম হয়েছে। আজকের আসল বাস্তবতা হলো, সরকার গোটা সমাজটাকে ভয়ের মধ্যে আটকে রাখতে সক্ষম হয়েছে।

এখন ভয়ের সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পাওয়া খুব বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। যেভাবে সমাজের মধ্যে এ ভয়ের সৃষ্টি করা হয়েছে একই প্রক্রিয়ায় তার নিঃশেষ করার ব্যবস্থাও আছে। তবে জনগণকে সবার আগে রুখে দাঁড়াতে হবে। পৃথিবীর রাজনীতির ইতিহাস বলে, কোনো সমস্যার সমাধান আইনি প্রক্রিয়ায় শুরু হলে তা একই প্রক্রিয়ায় শেষ হয়; রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় শুরু হলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় শেষ করা যায়, আর বল প্রয়োগের মাধ্যমে শুরু হলে তা বলপ্রয়োগ দিয়ে শেষ করতে হয়। সামাজিক বোধোদয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় আনাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ঘোষণা দিতে হবে। কারণ বাঁচার জন্য আমাদের রাজনৈতিক বা সামাজিক মুক্তি আজ খুব বেশি প্রয়োজন।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

রাজনীতিতে ভর করেছে ভয়ের সংস্কৃতি

আপডেট সময় ১১:১৫:৩৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩০ জুলাই ২০২৩

রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তি মননে ভয় সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। রাষ্ট্রের বর্তমান শাসক এবং শাসকের হুকুম যারা পালন করেন, তারা সুচারুভাবে সমাজে ভয়ের জায়গা তৈরি করেছেন, যা ব্যক্তিগত জীবনেও প্রবলভাবে উপস্থিত। রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখতে গিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজে একদিকে বৈষম্য অন্যদিকে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে একপক্ষকে দমিয়ে রাখার প্রবণতা প্রবলভাবে জেঁকে বসেছে।

অপশাসন, দুর্নীতি, গুম, খুনের মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করে একটি পক্ষ জগদ্দল পাথরের মতো ক্ষমতার আসনে চিরস্থায়ী হতে চায়। ফলে সমাজের বঞ্চিত গোষ্ঠীর মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ ও প্রতিবাদের আওয়াজ বিরাজমান। কিন্তু তারা সেই আওয়াজ বাইরে প্রকাশ করতে পারছেন না। ভয় দেখিয়ে তাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করে রাখতে সচেষ্ট শাসকগোষ্ঠী এবং একটি সঙ্ঘবদ্ধ চক্র। রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী জনগণের মতামত উপেক্ষা করে, মানে ভোটাধিকার হরণ করে ক্ষমতায় আসীন হয়েছে, ফলে তারা পরমতসহিষ্ণুতা দেখাতে পুরোপুরি ব্যর্থ। প্রতিবাদী পক্ষকে দমনে শাসকগোষ্ঠী মরিয়া। তাদের এখন এটিই প্রধান কাজ বলে মনে হচ্ছে।

রাষ্ট্রে যদি কোনো জবাবদিহি না থাকে, তাহলে অন্যত্রও জবাবদিহি থাকে না। অপরাধ, বিচারহীনতা, জবাবদিহির অভাব ও নিপীড়ন চলছে। কিন্তু প্রতিবাদী কণ্ঠ ভয়ের কাছে চুপসে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দিক বিচারে এর দায়ভার শুধু বিরোধী রাজনৈতিক দলের নয়; সামগ্রিক বিচারে সমাজের জনগণও এর জন্য দায়ী। সমাজের সব মানুষেরই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত। কিন্তু সমাজের একটি শ্রেণী অপ্রত্যাশিত সুবিধা পেয়ে সমাজের বেশির ভাগ মানুষের অসুবিধার কথা ভুলে যাচ্ছেন। মূলত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ করতে শাসকগোষ্ঠী নানা অপকৌশলে সমাজের একটি শ্রেণীকে সুবিধা দিয়ে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর প্রতিবাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করতে দীর্ঘদিন ধরে দেশে-রাষ্ট্রে-সমাজে ভীতির সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন।

তারা শুধু সাধারণ জনগণই নন, সচেতন ব্যক্তিবর্গের মধ্যেও বিভাজন তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন। শাসকগোষ্ঠী ওই মুষ্টিমেয় মানুষকে লোভ দেখান এবং ভয় দেখান। অনেক বুদ্ধিজীবী লোভের কাছে বশীভূত, অনেকে ভয়ের কাছে নতজানু। তারা সংগঠিতও নন। তার ওপর তারা দলীয়ভাবে বিভক্ত। স্বাভাবিকভাবে সরকারপন্থী হওয়ার দিকে ঝোঁকটা থাকে বেশি। সে কারণে সরকারের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের অবস্থানটা সবল নয়। ফলে শাসকগোষ্ঠীর অনাচারের চিত্র সঠিকভাবে ফুটে উঠছে না। সহজ করে বললে বলতে হয়, বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মধ্যে সুবিধাবাদ আছে এবং ভয়ও কাজ করছে।

দেশের মানুষ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কার্যক্রম বা সরকারের কাজের সমালোচনা রাজপথেও করতে পারছেন না, করলে বাধা ও নির্যাতন; সংবাদমাধ্যমে সমালোচনা করলে বিপদ, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে করলে গ্রেফতার।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ দেশের এ পরিস্থিতিকে ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ বলে উল্লেখ করেছেন। আজকে রাজনৈতিক অঙ্গনে ভয়ের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, সেই ভয়ের মধ্যে শুধু বিরোধী রাজনৈতিক দলই নয় বরং সরকারও অধিক ভয়ে আছে। সরকার জনগণকে ভয় পায়। জনগণ যদি সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তারা ক্ষমতায় যেমন থাকতে পারবেন না, তেমনি সব অপকর্মের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে এ ভয় তাদের গ্রাস করছে। ফলে তারা আরো বেশি অপরাধ করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চান। তাদের এ অপরাধের সঙ্গী হিসেবে ব্যবহার করছে পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থাকে।

সরকার কৌশলগতভাবে অপরাধের সাথে যুক্ত পুলিশ, সিভিল প্রশাসন কিংবা অন্যান্য বাহিনী ও সংস্থার লোকজনকে এই বলে ভয় দেখাচ্ছে যে, আমরা ক্ষমতায় না থাকলে তোমাদেরও বিচারের মুখোমুখি হতে হবে এবং শাস্তি পেতে হবে। এ ভয়ে, বর্তমান সরকারকে টিকিয়ে রাখতে তারা আরো বেশি অপরাধের সাথে যুক্ত হচ্ছে। অর্থাৎ ক্ষমতাসীনরা টিকে থাকতে প্রকারান্তরে গোটা রাষ্ট্রটাকে এর সাথে যুক্ত করতে সচেষ্ট। আজ যারা ব্যক্তিগত ভালো-ক্ষতির চিন্তায় পুরো সমাজটাকে ভয় ও অপরাধের কাছে নতজানু করছে তাদের সংখ্যা কম হলেও ভয়ের রাজ্যে তারা ত্রাস। এই স্বল্পসংখ্যক মহারথী গোটা সমাজ নিয়ন্ত্রণ করছেন। সমাজের বাকি লোকদের চলার পথও তারা দেখিয়ে দিচ্ছেন। বাকি বেশি সংখ্যক সুবিধাবঞ্চিতরা ত্রাসের কারণে কথা বলছেন না, পাছে তাদের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়ে।

সরকার দাবি করছে, জনগণ তাদের শক্তি কিন্তু তারা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে ভয় পায়। প্রকারান্তরে তারা জনগণের ম্যান্ডেট নিতে ভয় পায়। কারণ তারা জানে, জনগণ তাদের শক্তি বলে প্রচার করলেও আমজনতার সমর্থন তাদের রয়েছে কী না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। সত্যিকার অর্থে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে এবং জনগণ তাদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার পেলে ভোটারদের সমর্থন আছে বলে যে দাবি সরকারি দল করছে তার মুখোশ উন্মোচন হয়ে যাবে।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে জনগণ ভয়ের মধ্যে থাকতে চান না। তারা তাদের সাংবিধানিক অধিকার স্বাধীনভাবে ভোগ করতে চান। তারা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে চান, কথা বলতে চান, নির্ভয়ে, নির্বিঘ্নে জীবন চালাতে চান। মূলত এসব অধিকার প্রতিষ্ঠায় ৫২ বছর আগে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন হয়েছিল, তাই সেদিন মানুষ রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে ইজ্জত সম্ভ্রম হারিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু আজকে ৫২ বছর পরেও সেই একই ভয়ের মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হচ্ছে। সেই একই বঞ্চনা, নিপীড়ন হজম করতে হচ্ছে। সেই একই অধিকার আদায়ে এখনো সংগ্রাম করতে হচ্ছে, রক্ত ও জীবন দিতে হচ্ছে।

কী এক আজব বাস্তবতা! একই রাষ্ট্রে সরকারি দল সভা-সমাবেশ করার জন্য গাড়ি ঘোড়া, লঞ্চ স্টিমারে আনন্দনৃত্য করে লোক সমাগম করে। অন্যদিকে বিরোধী দলের সভা-সমাবেশে সব বন্ধ হয়ে যায়। পথে পথে পুলিশের হয়রানি, গ্রেফতার, সরকারদলীয় লোকজনের আক্রমণ মোকাবেলা করে এ দেশে বিরোধী রাজনীতির সভা-সমাবেশ করতে হয়। আরেকটি আতঙ্ক হলো, মোবাইল ফোন চেক করে সেই মোবাইলে বিএনপির কোনো নেতাকর্মীর ছবি পেলে তার আর রক্ষে নেই। লাল দালানের বাসিন্দা হতে হয়। তাদের এই অসাংবিধানিক ও বেআইনি আচরণে মনে হয় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি এবং বিএনপির নেতাকর্মীরা এ দেশে নিষিদ্ধ কিছু। কোনো বৈধ সংগঠনের নেতাকর্মীরা সাংবিধানিক অধিকার বলে সভা-সমাবেশ, মিছিল, মিটিং করতে গিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের কাছে গ্রেফতার হয়ে মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে সর্বোচ্চ আদালতের কাছে জামিন প্রার্থনা করতে যান তখন সেই আদালত যদি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকারের কথা ভুলে জামিন না দেন এবং বলেন কে আপনাকে মিছিল মিটিং করতে বলেছেন? এর থেকে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে? অর্থাৎ আদালতের সামনে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে রেখে বিচার বিভাগকে ভয়ের মধ্যে কুক্ষিগত করতে সক্ষম হয়েছে। আজকের আসল বাস্তবতা হলো, সরকার গোটা সমাজটাকে ভয়ের মধ্যে আটকে রাখতে সক্ষম হয়েছে।

এখন ভয়ের সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পাওয়া খুব বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। যেভাবে সমাজের মধ্যে এ ভয়ের সৃষ্টি করা হয়েছে একই প্রক্রিয়ায় তার নিঃশেষ করার ব্যবস্থাও আছে। তবে জনগণকে সবার আগে রুখে দাঁড়াতে হবে। পৃথিবীর রাজনীতির ইতিহাস বলে, কোনো সমস্যার সমাধান আইনি প্রক্রিয়ায় শুরু হলে তা একই প্রক্রিয়ায় শেষ হয়; রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় শুরু হলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় শেষ করা যায়, আর বল প্রয়োগের মাধ্যমে শুরু হলে তা বলপ্রয়োগ দিয়ে শেষ করতে হয়। সামাজিক বোধোদয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় আনাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ঘোষণা দিতে হবে। কারণ বাঁচার জন্য আমাদের রাজনৈতিক বা সামাজিক মুক্তি আজ খুব বেশি প্রয়োজন।