পয়গম্বরদের বিশেষ আচরণের মধ্যে সাধারণ মানুষের জন্যও একটি নির্দেশ রয়েছে। তা এই যে, তারা যেভাবে সন্তানদের লালন-পালন ও পার্থিব আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করেন, সেভাবে বরং তার চেয়েও বেশি তাদের কার্যকলাপ ও চরিত্র সংশোধনের ব্যবস্থা করা দরকার। মন্দ পথ ও মন্দ কার্যকলাপ থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা আবশ্যক। এরই মধ্যে সন্তানদের সত্যিকার ভালোবাসা ও প্রকৃত শুভেচ্ছা নিহিত। এটি কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয় যে, সন্তানকে রৌদ্রের তাপ থেকে বাঁচানোর জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করবে, কিন্তু চিরস্থায়ী আগুন ও আজাবের কবল থেকে রক্ষা করার প্রতি ভ্রুক্ষেপও করবে না। সন্তানের দেহ থেকে কাঁটা বের করার জন্য সর্ব প্রযতে চেষ্টা করবে, কিন্তু তাকে বন্দুকের গুলি থেকে রক্ষা করবে না।
পয়গম্বরদের কর্মপদ্ধতি থেকে আরো একটি মৌলিক বিষয় জানা যায়, সর্বপ্রথম সন্তানদের মঙ্গলচিন্তা করা এবং এরপর অন্য দিকে মনোযোগ দেয়া মা-বাবার কর্তব্য। মা-বাবার কাছ থেকে এটিই সন্তানদের প্রাপ্য। এতে দু’টি রহস্য নিহিত রয়েছে- প্রথমত, প্রাকৃতিক ও দৈহিক সম্পর্কের কারণে তারা মা-বাবার উপদেশ সহজে ও দ্রুত গ্রহণ করবে। এরপর সংস্থার প্রচেষ্টায় ও সত্য প্রচারে তারা মা-বাবার সাহায্যকারী হতে পারবে।
দ্বিতীয়ত, এটিই সত্য প্রচারের সবচেয়ে সহজ ও উপযোগী পথ যে, প্রত্যেক পরিবারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি আপন পরিবার-পরিজনের সংশোধনের কাজে মনেপ্রাণে আত্মনিয়োগ করবে। এভাবে সত্য প্রচার ও সত্য শিক্ষার ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়ে পরিবারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। ফলে পরিবারের লোকজনের শিক্ষার মাধ্যমে পুরো জাতিরও শিক্ষা হয়ে যায়। এ সংগঠন পদ্ধতির প্রতি লক্ষ করেই মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন- ‘হে মুমিনগণ, নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে সেই অগ্নি থেকে রক্ষা করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে পাষাণ কঠোর স্বভাব ও নির্মম হৃদয়ের ফেরেশতা, যারা অমান্য করে না আল্লাহ যা আদেশ করেন’ (সূরা আত-তাহরিম-৬)।
মহানবী সা: ছিলেন সারা বিশ্বের রাসূল। তাঁর হেদায়াত কিয়ামত পর্যন্ত সবার জন্য ব্যাপক। তাকেও সর্বপ্রথম নির্দেশ দেয়া হয়েছে- কুরআন মাজিদের ঘোষণা- ‘অর্থাৎ, নিকটাত্মীয়দের আল্লাহর শাস্তির ভয় প্রদর্শন করুন।’ আরো বলা হয়েছে- ‘অর্থাৎ, পরিবার-পরিজনকে নামাজ পড়ার নির্দেশ দিন এবং নিজেও নামাজ অব্যাহত রাখুন।’
তৃতীয়ত, আরো একটি রহস্য এই যে, কোনো মতবাদ ও কর্মসূচিতে পরিবারের লোকজনও নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজন সহযোগী ও সমমনা না হলে সে মতবাদ অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। এ কারণেই প্রাথমিক যুগে মহানবী সা:-এর প্রচারকাজের জওয়াবে সাধারণ লোকদের উত্তর ছিল, প্রথমে আপনি নিজ পরিবার কোরাইশকে ঠিক করে নিন, এরপর আমাদের কাছে আসুন। রাসূলুল্লাহ সা:-এর পরিবারে যখন ইসলাম বিস্তার লাভ করল এবং মক্কা বিজয়ের সময় তা পরিপূর্ণ রূপ পরিগ্রহ করল, তখন এর প্রতিক্রিয়া কুরআনের ভাষায় এরূপ প্রকাশ পেলো- ‘অর্থাৎ, মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকবে।’
আজকাল ধর্মহীনতার যে সয়লাব শুরু হয়েছে, তার বড় কারণ এই, মা-বাবা ধর্মজ্ঞানে জ্ঞানী ও ধার্মিক হলেও সন্তানদের ধার্মিক হওয়ার বিষয়ে চিন্তা করেন না। সাধারণভাবে আমাদের দৃষ্টি সন্তানের পার্থিব ও স্বল্পকালীন আরাম-আয়েশের প্রতিই নিবদ্ধ থাকে এবং আমরা এর ব্যবস্থ’াপনায়ই ব্যতিব্যস্ত থাকি। অক্ষয় ধন-সম্পদের দিকে মনোযোগ দেই না।
বাপ-দাদার কৃতকর্মের ফল সন্তানরা ভোগ করবে না : আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন- ‘তার চেয়ে অত্যাচারী কে, যে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার কাছে প্রমাণিত সাক্ষ্যকে গোপন করে? আল্লাহ তোমাদের কর্ম সম্পর্কে বেখবর নন। সে সম্প্রদায় অতীত হয়ে গেছে। তারা যা করেছে, তা তাদের জন্য এবং তোমরা যা করেছ, তা তোমাদের জন্য। তাদের কর্ম সম্পর্কে তোমাদের জিজ্ঞেস করা হবে না’ (সূরা বাকারা-১৪১)। আলোচ্য আয়াত থেকে বোঝা যায়, বাপ-দাদার সৎকর্ম সন্তানদের উপকারে আসে না। যতক্ষণ না তারা নিজেরা সৎকর্ম সম্পাদন করবে। এমনিভাবে বাপ-দাদার কুকর্মের শাস্তিও সন্তানরা ভোগ করবে না, যদি তারা সৎকর্মশীল হয়। এতে বোঝা যায়, মুশরিকদের সন্তান-সন্ততি সাবালক হওয়ার আগে মারা গেলে মা-বাবার কুফর ও শিরকের কারণে তারা শাস্তি ভোগ করবে না। এতে ইহুদিদের সে দাবিও ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়, আমরা যা ইচ্ছা তা-ই করব, আমাদের বাপ-দাদার সৎকর্মের দ্বারাই আমাদের মাগফিরাত হয়ে যাবে। কিন্তু তা নয়।
কুরআন এ বিষয়টি বারবার বিভিন্ন ভঙ্গিতে বর্ণনা করেছে। এক আয়াতে বলা হয়েছে- ‘প্রত্যেকের আমলের দায়িত্ব তাকেই বহন করতে হবে।’ অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে- ‘কিয়ামতের দিন একজনের বোঝা অন্যজন বহন করবে না।’ রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘হে বনি হাশেম, এমন যেন না হয়, কিয়ামতের দিন অন্যান্য লোক নিজ নিজ সৎকর্ম নিয়ে আসবে আর তোমরা আসবে সৎকর্ম থেকে উদাসীন হয়ে শুধু বংশ গৌরব নিয়ে এবং আমি বলব, আল্লাহর আজাব থেকে আমি তোমাদের বাঁচাতে পারব না।’ অন্য এক হাদিসে আছে, ‘আমল যাকে পেছনে ফেলে দেয়, বংশ তাকে এগিয়ে নিতে পারে না।’
লেখক :
- মাওলানা কাওসার আহমদ যাকারিয়া
ইসলামিক কলামিস্ট, মজলিশপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া