ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মনস্তত্ত্ব

  • সূর্যোদয় ডেস্ক:
  • আপডেট সময় ১১:১৮:১০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ অগাস্ট ২০২৩
  • ১১২৯ বার পড়া হয়েছে

বাংলাদেশের বয়স ৫২ বছর চলছে। এই দীর্ঘ সময়েও আমরা একটা টেকসই নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। এটা আমাদের জাতীয় জীবনের এক চরম ব্যর্থতা। তবে এ কথা বলতে হয়, স্বাধীনতা-উত্তর আমাদের নির্বাচনী ইতিহাসে কেয়ারটেকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত চারটি জাতীয় নির্বাচন ছিল সবচেয়ে সুষ্ঠু। সামান্য বিতর্ক থাকলেও ক্ষমতার পালাবদলে কোনো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে দেশে কোনো নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে এমন নজির নেই। এ কথা সত্যি যে, ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক দলের জাতীয় পর্যায়ের নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমাদের নির্বাচনী ইতিহাসে ওই সংসদকে তাই অভিহিত করা হয় ‘রেনবো পার্লামেন্ট’ হিসেবে।

প্রায় বছর হতে চলল দেশের বেশির ভাগ বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের দাবিতে সরকারের পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলন করছে। এদিকে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীজন এবং বিদেশী বন্ধু রাষ্ট্র বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব এবার বাংলাদেশে একটা অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়। এ জন্য নানা পদক্ষেপ তারা নিয়েছে এবং নিচ্ছে। এ দেশে পশ্চিমা কূটনীতিকদের তৎপরতা এখন চোখে পড়ার মতো। অপরপক্ষে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের। বর্তমান সরকারের পক্ষে জোরালো সমর্থন জোগাচ্ছে চীন-রাশিয়াসহ কয়েকটি দেশ। তবে এবারের নির্বাচনে ভারতের অবস্থান কী হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।

এই যে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পরস্পরবিরোধী অবস্থান; এটি যেন অলঙ্ঘনীয়। নির্বাচন নিয়ে দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের প্রতি কেন এই অনাস্থা? এই কেনর বিষয়টি একটু পরখ করে দেখা জরুরি বৈকি। ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি আমাদের ক্ষমতাসীনদের মন-মানসিকতায়, অস্থিমজ্জায় কখনো স্থান পায়নি। ফলে প্রতিবার নির্বাচন ঘনিয়ে এলে আমাদের রাজনীতিতে অস্থিরতা দেখা দেয়।

কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজ জরুরি। প্রশ্নটির একটি সন্তোষজনক জবাব পেতে স্বাধীন বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে চোখ বুলানো দরকার। তবে এ লেখার কলেবর যাতে বৃদ্ধি না পায় সেদিকে খেয়াল রেখে আমরা শুধু বর্তমান সরকারি দল আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত দেশের তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চিত্র দেখব। তাদের অধীনে ওই তিনটি নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো কেমন করেছে তা লক্ষ করা প্রয়োজন। কারণ, এখন রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। তাই এই দলের গঠিত সরকারের অধীনে নির্বাচন কেমন হয়েছে তা পরখ করে দেখার প্রয়াস চালানো হয়েছে এই কলামে।

সর্বপ্রথম দেখা যাক, স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত ৭ মার্চ দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে লেখক-বুদ্ধিজীবীরা কী বলেছেন। অনেকের পর্যবেক্ষণ হলো- ওই নির্বাচনে নিশ্চিত বিজয়ের সব ধরনের পূর্বশর্ত ও পরিস্থিতি থাকা সত্ত্বেও বিরোধীদের প্রতি আওয়ামী লীগের অবস্থান ছিল কঠোরতম। এর ফলে অনেক জায়গায় ভোট নিয়ে নানা প্রশ্নবিদ্ধ ঘটনার কথা জানা যায়। এ ধরনের একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে খোদ আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘বিপুলা পৃথিবী’তে লিখেছেন, ‘স্বাধীন দেশে এই প্রথম ভোট দিতে যাচ্ছি, মনের মধ্যে প্রচণ্ড উৎসাহ। ভোটকেন্দ্রে গিয়ে সে-উৎসাহ দপ করে নিভে গেল। জানলাম, আমাদের ভোট আগেই দেয়া হয়ে গেছে’ (প্রথম আলো ২৭ আগস্ট, ২০২৩)। ভাবুন তো আনিসুজ্জামানের মতো হেভিওয়েট ব্যক্তির ভোট অন্যে দিয়ে গেলে। সাধারণ নাগরিকের ভোটাধিকারের কী হাল হয়েছিল তা বলাই বাহুল্য।

এই নির্বাচনে বেশ কিছু আসনে ভোট গণনায় বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও তাদের শেষ পর্যন্ত জয়ী হতে দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছিল (তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদকে নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষণার ঘটনাটি ছিল বহুল আলোচিত)। সরকার সমর্থক সংবাদপত্রগুলোর হিসাবেও বিরোধী দলগুলো কমপক্ষে ৩০টি আসন পাবে, এমন পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ফল প্রকাশের পর দেখা গেল ২৯৯টি (একটি আসনের নির্বাচন স্থগিত ছিল) আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা ২৯২টি আসনে জয়লাভ করেছেন। বিরোধী দলগুলো দুটি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পান বাকি পাঁচটি আসন। নির্বাচনের এ ফলে জনমনে যেমন প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল, তেমনি সরকারি দলের প্রতি বিরোধী দলগুলোর অনাস্থা ও অবিশ্বাসের জন্ম নিয়েছিল।

আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল বুদ্ধিজীবী রওনক জাহান ওই নির্বাচন নিয়ে তার লেখা ‘বাংলাদেশ পলিটিকস : প্রবলেমস অ্যান্ড ইস্যুজ’ বইয়ে লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের প্রতি অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের একটি নির্বাচনী কৌশল অনুসরণ করেছিল। প্রতিটি সংসদীয় আসনে জয়লাভে সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের এই নীতি বিরোধী দলগুলোকে দৃশ্যমানভাবে সংসদ থেকে অপসারণ করেছিল’ (২৭ আগস্ট, প্রথম আলো)।

এ তো গেল আমাদের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চালচিত্র। এবার আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হাল কেমন ছিল তা দেখে নিই। ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। এর বেশ আগে নিজেদের বিজয় নিশ্চিত করতে আদালতের রায়ের কথা বলে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়। যদিও উচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়, আগামী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করা হলে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ওই নির্বাচন বর্জন করে। ফলে একতরফা ওই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট ১৫৩টি সংসদীয় আসনে বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়। বাকিগুলোতে নামকাওয়াস্তে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। তখন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে বলা হয়েছিল, এটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। কিন্তু ভোটগ্রহণের পর সেই নির্বাচনী ফলেই দলটি পাঁচ বছরের পুরো মেয়াদ পূর্ণ করে। বলে রাখা ভালো, ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভারতের নগ্ন হস্তক্ষেপ প্রত্যক্ষ করেছে পুরো জাতি।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন দলীয় সরকারের অধীনে তৃতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। সেটি ছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ‘নিশি ভোটের’ তকমা পেয়েছে। নির্বাচনের আগের রাতে প্রশাসনের সহায়তায় ব্যালট বাক্স ভরা হয়। ফলে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের যে পরিণতি হয়; বারবার ক্ষমতায় আসা দেশের জনপ্রিয় দল বিএনপির হাল একই হয়। মাত্র ছয়টি আসনে জয়ী হয় দলটি। এমন ফল যে হাস্যকর তা খোদ শাসকদলের অনেক কেন্দ্রীয় নেতাও তাদের ড্রয়িং রুমের আলাপচারিতায় বলে থাকেন।
ওই নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ওপর আস্থা রাখতে বলেছিলেন বিরোধী দলগুলোকে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে বিএনপি তার ওই কথায় আস্থা রেখে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়। পরিণতিতে দলটি রাজনীতির মাঠে চড়ামূল্য দেয়। ক্ষমতার পাশা খেলায় হয় পরাভূত।

এমন প্রেক্ষাপটে আর মাত্র কয়েক মাস বাদে আগামী জানুয়ারির মধ্যে দেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচন কার অধীনে হবে; তা নিয়ে চলছে রাজনৈতিক বাহাস। কাজিয়া। ঝগড়া-ফ্যাসাদ। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। দল দু’টি তাদের অবস্থানে অনড়। তবে আমাদের আগামী নির্বাচন সাম্প্রতিক সময়ে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জায়গা করে নিয়েছে।

প্রশ্ন হলো, আমরা যদি গণতান্ত্রিক বিশ্বের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে চাই; তা হলে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, শান্তিপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য হতে হবে। তা না হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের পথ চলা মসৃণ হবে না। প্রতি কদমে বাধাগ্রস্ত হতে হবে।

এই লেখায় যে আলোচনা তুলে ধরা হলো- তার আলোকে এবং দৃষ্টিকোণ থেকে এখন চিন্তা করে দেখুন; আওয়ামী লীগের অধীনে যে তিনটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে; তা কি সন্তোষজনক? ক্ষমতাসীনরা কি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো নির্বাচন করার সক্ষমতা রাখে? কিংবা ক্ষমতাসীনদের মনোস্তত্ত্বে আদৌ কি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতার পালাবদলের মানসিকতা রয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তর প্রিয় পাঠক, আপনাদের ওপরই ছেড়ে দেয়া হলো। যে কেউ একটু ভাবলেই জবাব পেয়ে যাবেন।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মনস্তত্ত্ব

আপডেট সময় ১১:১৮:১০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ অগাস্ট ২০২৩

বাংলাদেশের বয়স ৫২ বছর চলছে। এই দীর্ঘ সময়েও আমরা একটা টেকসই নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। এটা আমাদের জাতীয় জীবনের এক চরম ব্যর্থতা। তবে এ কথা বলতে হয়, স্বাধীনতা-উত্তর আমাদের নির্বাচনী ইতিহাসে কেয়ারটেকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত চারটি জাতীয় নির্বাচন ছিল সবচেয়ে সুষ্ঠু। সামান্য বিতর্ক থাকলেও ক্ষমতার পালাবদলে কোনো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে দেশে কোনো নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে এমন নজির নেই। এ কথা সত্যি যে, ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক দলের জাতীয় পর্যায়ের নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমাদের নির্বাচনী ইতিহাসে ওই সংসদকে তাই অভিহিত করা হয় ‘রেনবো পার্লামেন্ট’ হিসেবে।

প্রায় বছর হতে চলল দেশের বেশির ভাগ বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের দাবিতে সরকারের পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলন করছে। এদিকে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীজন এবং বিদেশী বন্ধু রাষ্ট্র বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব এবার বাংলাদেশে একটা অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়। এ জন্য নানা পদক্ষেপ তারা নিয়েছে এবং নিচ্ছে। এ দেশে পশ্চিমা কূটনীতিকদের তৎপরতা এখন চোখে পড়ার মতো। অপরপক্ষে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের। বর্তমান সরকারের পক্ষে জোরালো সমর্থন জোগাচ্ছে চীন-রাশিয়াসহ কয়েকটি দেশ। তবে এবারের নির্বাচনে ভারতের অবস্থান কী হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়।

এই যে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পরস্পরবিরোধী অবস্থান; এটি যেন অলঙ্ঘনীয়। নির্বাচন নিয়ে দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের প্রতি কেন এই অনাস্থা? এই কেনর বিষয়টি একটু পরখ করে দেখা জরুরি বৈকি। ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি আমাদের ক্ষমতাসীনদের মন-মানসিকতায়, অস্থিমজ্জায় কখনো স্থান পায়নি। ফলে প্রতিবার নির্বাচন ঘনিয়ে এলে আমাদের রাজনীতিতে অস্থিরতা দেখা দেয়।

কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজ জরুরি। প্রশ্নটির একটি সন্তোষজনক জবাব পেতে স্বাধীন বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে চোখ বুলানো দরকার। তবে এ লেখার কলেবর যাতে বৃদ্ধি না পায় সেদিকে খেয়াল রেখে আমরা শুধু বর্তমান সরকারি দল আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত দেশের তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চিত্র দেখব। তাদের অধীনে ওই তিনটি নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো কেমন করেছে তা লক্ষ করা প্রয়োজন। কারণ, এখন রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। তাই এই দলের গঠিত সরকারের অধীনে নির্বাচন কেমন হয়েছে তা পরখ করে দেখার প্রয়াস চালানো হয়েছে এই কলামে।

সর্বপ্রথম দেখা যাক, স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত ৭ মার্চ দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে লেখক-বুদ্ধিজীবীরা কী বলেছেন। অনেকের পর্যবেক্ষণ হলো- ওই নির্বাচনে নিশ্চিত বিজয়ের সব ধরনের পূর্বশর্ত ও পরিস্থিতি থাকা সত্ত্বেও বিরোধীদের প্রতি আওয়ামী লীগের অবস্থান ছিল কঠোরতম। এর ফলে অনেক জায়গায় ভোট নিয়ে নানা প্রশ্নবিদ্ধ ঘটনার কথা জানা যায়। এ ধরনের একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে খোদ আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘বিপুলা পৃথিবী’তে লিখেছেন, ‘স্বাধীন দেশে এই প্রথম ভোট দিতে যাচ্ছি, মনের মধ্যে প্রচণ্ড উৎসাহ। ভোটকেন্দ্রে গিয়ে সে-উৎসাহ দপ করে নিভে গেল। জানলাম, আমাদের ভোট আগেই দেয়া হয়ে গেছে’ (প্রথম আলো ২৭ আগস্ট, ২০২৩)। ভাবুন তো আনিসুজ্জামানের মতো হেভিওয়েট ব্যক্তির ভোট অন্যে দিয়ে গেলে। সাধারণ নাগরিকের ভোটাধিকারের কী হাল হয়েছিল তা বলাই বাহুল্য।

এই নির্বাচনে বেশ কিছু আসনে ভোট গণনায় বিরোধীদলীয় প্রার্থীরা এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও তাদের শেষ পর্যন্ত জয়ী হতে দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছিল (তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদকে নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষণার ঘটনাটি ছিল বহুল আলোচিত)। সরকার সমর্থক সংবাদপত্রগুলোর হিসাবেও বিরোধী দলগুলো কমপক্ষে ৩০টি আসন পাবে, এমন পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ফল প্রকাশের পর দেখা গেল ২৯৯টি (একটি আসনের নির্বাচন স্থগিত ছিল) আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা ২৯২টি আসনে জয়লাভ করেছেন। বিরোধী দলগুলো দুটি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পান বাকি পাঁচটি আসন। নির্বাচনের এ ফলে জনমনে যেমন প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল, তেমনি সরকারি দলের প্রতি বিরোধী দলগুলোর অনাস্থা ও অবিশ্বাসের জন্ম নিয়েছিল।

আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল বুদ্ধিজীবী রওনক জাহান ওই নির্বাচন নিয়ে তার লেখা ‘বাংলাদেশ পলিটিকস : প্রবলেমস অ্যান্ড ইস্যুজ’ বইয়ে লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের প্রতি অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের একটি নির্বাচনী কৌশল অনুসরণ করেছিল। প্রতিটি সংসদীয় আসনে জয়লাভে সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের এই নীতি বিরোধী দলগুলোকে দৃশ্যমানভাবে সংসদ থেকে অপসারণ করেছিল’ (২৭ আগস্ট, প্রথম আলো)।

এ তো গেল আমাদের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চালচিত্র। এবার আওয়ামী লীগের অধীনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হাল কেমন ছিল তা দেখে নিই। ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। এর বেশ আগে নিজেদের বিজয় নিশ্চিত করতে আদালতের রায়ের কথা বলে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়। যদিও উচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়, আগামী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করা হলে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ওই নির্বাচন বর্জন করে। ফলে একতরফা ওই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট ১৫৩টি সংসদীয় আসনে বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়। বাকিগুলোতে নামকাওয়াস্তে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। তখন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে বলা হয়েছিল, এটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। কিন্তু ভোটগ্রহণের পর সেই নির্বাচনী ফলেই দলটি পাঁচ বছরের পুরো মেয়াদ পূর্ণ করে। বলে রাখা ভালো, ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভারতের নগ্ন হস্তক্ষেপ প্রত্যক্ষ করেছে পুরো জাতি।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন দলীয় সরকারের অধীনে তৃতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। সেটি ছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ওই নির্বাচন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ‘নিশি ভোটের’ তকমা পেয়েছে। নির্বাচনের আগের রাতে প্রশাসনের সহায়তায় ব্যালট বাক্স ভরা হয়। ফলে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধী দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের যে পরিণতি হয়; বারবার ক্ষমতায় আসা দেশের জনপ্রিয় দল বিএনপির হাল একই হয়। মাত্র ছয়টি আসনে জয়ী হয় দলটি। এমন ফল যে হাস্যকর তা খোদ শাসকদলের অনেক কেন্দ্রীয় নেতাও তাদের ড্রয়িং রুমের আলাপচারিতায় বলে থাকেন।
ওই নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ওপর আস্থা রাখতে বলেছিলেন বিরোধী দলগুলোকে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে বিএনপি তার ওই কথায় আস্থা রেখে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়। পরিণতিতে দলটি রাজনীতির মাঠে চড়ামূল্য দেয়। ক্ষমতার পাশা খেলায় হয় পরাভূত।

এমন প্রেক্ষাপটে আর মাত্র কয়েক মাস বাদে আগামী জানুয়ারির মধ্যে দেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচন কার অধীনে হবে; তা নিয়ে চলছে রাজনৈতিক বাহাস। কাজিয়া। ঝগড়া-ফ্যাসাদ। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। দল দু’টি তাদের অবস্থানে অনড়। তবে আমাদের আগামী নির্বাচন সাম্প্রতিক সময়ে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জায়গা করে নিয়েছে।

প্রশ্ন হলো, আমরা যদি গণতান্ত্রিক বিশ্বের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে চাই; তা হলে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, শান্তিপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য হতে হবে। তা না হলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের পথ চলা মসৃণ হবে না। প্রতি কদমে বাধাগ্রস্ত হতে হবে।

এই লেখায় যে আলোচনা তুলে ধরা হলো- তার আলোকে এবং দৃষ্টিকোণ থেকে এখন চিন্তা করে দেখুন; আওয়ামী লীগের অধীনে যে তিনটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে; তা কি সন্তোষজনক? ক্ষমতাসীনরা কি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কোনো নির্বাচন করার সক্ষমতা রাখে? কিংবা ক্ষমতাসীনদের মনোস্তত্ত্বে আদৌ কি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতার পালাবদলের মানসিকতা রয়েছে। এসব প্রশ্নের উত্তর প্রিয় পাঠক, আপনাদের ওপরই ছেড়ে দেয়া হলো। যে কেউ একটু ভাবলেই জবাব পেয়ে যাবেন।