আজকের সমাজে অতি পরিচিত ও বহুল আলোচিত একটি শব্দের নাম যৌতুক। যৌতুক বাংলা শব্দ। এর প্রতিশব্দ হলো পণ। বিয়ে উপলক্ষে কন্যা বা কন্যার পরিবারের পক্ষ থেকে বরকে প্রদেয় অর্থ-সম্পদকে যৌতুক বলে। বিয়ের সব আলোচনার সাথে সমাজের একটি বড় অংশে আলোচনা হয় যৌতুক নামের এই ‘দেনা-পাওনা’ নিয়ে। এই দেনা-পাওনার আলোচনাটি অনেক সময় হয় একদম শুরুতেই বর-কনে পছন্দের আগে। কখনো-সখনো বর-কনে পছন্দের পর। বহু পরিবারে বিয়ের ক্ষেত্রে এটি প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ নিয়ে হয় বিস্তর দরকষাকষি। দর মনমতো হলে থাকে না কালো আর সুন্দরের তফাৎ। যেন দেনা-পাওনাটাই বিয়ের প্রধান ও মুখ্য বিষয়। বর-কনের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি গৌণ। যৌতুক নামের এই ‘আজব’ দেনা পাওনার অক্টোপাসে আবদ্ধ আমাদের সমাজ। বহু মুসলিম রমণীর জীবন আজ দেনা-পাওনার অভিশাপের জালে আটক যাচ্ছে। শুরুতে অন্য সম্প্রদায়ের প্রভাবে মুসলিম সমাজে যৌতুক প্রথার অনুপ্রবেশ ঘটলেও এখন আর এতে প্রভাব প্রতিক্রিয়ার কিছু নেই। এটি এখন স্বাভাবিক একটি লেনদেন ও দেনা-পাওনার হিসাবে পরিণত হয়েছে।
বহু কবিরা গোনাহর সমষ্টি যৌতুক : যৌতুক গ্রহণ দৃশ্যত আর্থিকভাবে লাভজনক হলেও এর মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো অন্যায় ও অপরাধ। এর প্রতিটি অপরাধই এত জঘন্য ও ভয়ঙ্কর যে, একজন মানুষ জাহান্নামে যাওয়ার জন্য যেকোনো একটি অপরাধ করাই যথেষ্ট। যৌতুকের সবচেয়ে নিকৃষ্ট দিক হলো, এটি একটি হিন্দুয়ানি প্রথা। কোনো মুসলিম কোনো অবস্থাতেই কাফের সমাজের রীতি-রেওয়াজ অনুসরণ কল্পনায়ও আনতে পারে না। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি যে জাতির সাদৃশ্যতা অবলম্বন করবে সে ব্যক্তি সে জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে’ (আবু দাউদ-২/৫৫৯, আহমদ-২/৫০)। যৌতুকের আরেকটি অপরাধ হলো জুলুম। আর এ জুলুম শুধু ব্যক্তির হয় না। এই জুলুমের শিকার হয় গোটা পরিবার ও বংশ। যৌতুকের কারণে কনেপক্ষ যে মানসিক পীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয় তা তো বর্ণনার অতীত। অথচ কাউকে সামান্যতম কষ্ট দেয়াও কবিরা গুনাহ-হারাম। হাদিসে এসেছে, আবু সিরমা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি করে, আল্লাহও তার ক্ষতি করেন। আর যেব্যক্তি অন্যকে কষ্ট দেয় আল্লাহও তাকে কষ্ট দেন’ (আবু দাউদ-২/৫১২, বুখারি-২/১০৫৯, তিরমিজি-২/১৫)।
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, আবু বকর সিদ্দিক রা: বলেন, রাসূলে করিম সা: বলেছেন, ‘অভিশপ্ত সেই ব্যক্তি যে কোনো মুমিনের ক্ষতি করে বা তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে’ (তিরমিজি-২/১৫)। পাঠক লক্ষ করুন, হাদিস দু’টির মর্মবাণী কত কঠোর ও ভয়ঙ্কর। যে অন্যকে কষ্ট দেয় স্বয়ং আল্লাহ তাকে কষ্ট দেবেন। যে ব্যক্তি অন্যকে কষ্ট দেয় সে অভিশপ্ত। যে ব্যক্তি অভিশপ্ত এবং যাকে মহান আল্লাহ কষ্ট দেবেন তার চেয়ে ভাগ্যাহত ও নিকৃষ্ট এই পৃথিবীতে কে হতে পারে? যৌতুকের আরো একটি ভয়াবহ অপরাধ হলো- এতে অবৈধ উপায়ে অন্যের সম্পদ গ্রাস করা হয়। কারণ বিয়ে একটি পবিত্র বন্ধন। এটি ব্যবসায় বা অর্থ উপার্জনের উপায় নয়। এভাবে বর-কনে ব্যবসার পণ্য নয় যে, তাদেরকে বিক্রি করে অর্থোপার্জন করা যাবে। কুরআন মাজিদে একাধিকবার আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন- ‘তোমরা অবৈধ উপায়ে একে অন্যের সম্পদ গ্রাস করো না’ (সূরা বাকারা-১৮৮, সূরা নিসা-২৯)।
আলোচ্য আয়াতের মর্মার্থ হলো- এমন কোনো পন্থায় অর্থোপার্জন অবৈধ, যাকে আল্লাহ তায়ালা উপার্জনের মাধ্যম বানাননি। বিয়ে একটি পবিত্র বন্ধন- এটি ব্যবসায় বা সোর্স অব ইনকাম নয়। একইভাবে বর-কনেও ব্যবসার কোনো পণ্য নয় যে, তাদেরকে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করা হবে। সুতরাং যারা বিয়ের মতো একটি পবিত্র বন্ধনকে সোর্স অব ইনকাম বা অর্থ উপার্জনের উপায় বানায়, নিঃসন্দেহে তারা মহান স্রষ্টা আল্লাহর হুকুম অবজ্ঞা ও লঙ্ঘনকারী এবং রহমতের নবীর ভাষায় ‘হজের মহিমান্বিত দিবসে পবিত্র’ কাবা শরিফে হামলাকারী’ (বুখারি-১৭৩৯, মুসলিম-১৬৭৯)। এ ছাড়াও যৌতুকে রয়েছে ডাকাতি ও লুটতরাজের মতো ভয়াবহ ও নিকৃষ্ট অপরাধ। ডাকাতদল অস্ত্রের মুখে ফেলে অর্থ আদায় করে থাকে, আর বরপক্ষ আদায় করে থাকে নব পরিণীতা অবলা নারীকে অস্ত্র বানিয়ে। পার্থক্য এতটুকুই। আর কে না জানে, অন্যের সম্পদ লুট করা হারাম ও কবিরা গুনাহ।
হাদিস শরিফে এসেছে- মহানবী সা: বলেন, ‘কেউ যেন তার সঙ্গীর কোনো বস্তু ছিনিয়ে না নেয়; ইচ্ছা করেও নয়, ঠাট্টাচ্ছলেও নয়। একটি লাঠিও যদি কেউ ছিনিয়ে নেয়, তবে তা যেন অবশ্যই মালিককে ফিরিয়ে দেয়’ (সুনানে আবু দাউদ-৫০০, তিরমিজি-২১৬০)। ওই হাদিসের ভাষ্যমতে, দামি কোনো সম্পদ নয়, সামান্য একটি লাঠিও জোর করে নেয়া লুণ্ঠন ও লুটতরাজের শামিল। আর এ কথা কে না জানে, যৌতুকের সম্পদ সামান্য হয় না, হয় মোটা অঙ্কের। এ কথাও সবার জানা, যৌতুক কেউ আনন্দে আটখানা হয়ে দেয় না, দেয় প্রচণ্ড চাপে পড়ে। আদায় করা হয় কৌশলে বা বল প্রয়োগ করে।
যৌতুকের আরো একটি জঘন্য দিক হলো- এতে পাওয়া যায় ঘুষের মতো জঘন্য অপরাধ। শরিয়তের ভাষায় ঘুষ বলা হয়, কারো কোনো অধিকার বা পাওনা, যা কোনো বিনিময় ছাড়াই তার পাওয়া উচিত, তা বিনিময় ছাড়া না দেয়া। এ ক্ষেত্রে যে বিনিময় গ্রহণ করা হয় তাই ঘুষ বা উৎকোচ। বিয়ের পর স্বামী ও স্ত্রীর একে অপরের মাধ্যমে শান্তি লাভ করা তাদের প্রত্যেকের অপরিহার্য অধিকার। তাই এই অধিকারগুলোর কোনো একটি পাওয়ার জন্য বা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য কোনোরূপ অর্থ ব্যয়ের বাধ্যবাধকতা সম্পূর্ণ অবান্তর ও অযৌক্তিক। সুতরাং এ ক্ষেত্রে কোনো অর্থ-সম্পদ দাবি করা হলে কিংবা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ চাপের মাধ্যমে কোনো কিছু গ্রহণ করা হলে তা হবে সরাসরি ঘুষ বা উৎকোচ, যা সম্পূর্ণ হারাম এবং এর সাথে সম্পৃক্ত সবার ওপরই আল্লাহর লানত ও অভিশাপ। মহানবী সা: বলেন, ঘুষদাতা ও ঘুষ গ্রহীতা উভয়ের ওপর আল্লাহর অভিশাপ’ (আহমাদ-৬৭৭৮, ৬৯৮৪, ইবনে মাজাহ-৫০৭৭)। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘আল্লাহ অভিশাপ করেছেন ঘুষদাতা, ঘুষ গ্রহীতা ও ঘুষের লেনদেনের মধ্যস্থতাকারী সবার ওপর’ (মুস্তাদরাকে হাকেম-৪/১০৩)।
পারিবারিক অশান্তি ডেকে আনে যৌতুক : এ তো গেল যৌতুকের পারলৌকিক ক্ষতির কিছু চিত্র। এর ইহলৌকিক ক্ষতির ফিরিস্তিও একেবারে ছোট নয়। যৌতুকের সবচেয়ে ছোট ক্ষতির দিকটি হলো- এর কারণে দাম্পত্য জীবনের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। পরিবারে অশান্তির আগুন জ্বলতে থাকে দাউদাউ করে। সেই অনল দাহে পুড়ে ভস্ম হয় সাজানো সুখের সংসার। স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা, ভাইবোন, সন্তান-সন্ততি নিয়ে সাজানো সংসার নামের সুখের স্বর্গরাজ্য হয়ে যায় বীভৎস হাবিয়া। ঝগড়া-বিবাদ, গালি-গালাজ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। মামলা-মোকদ্দমা, নির্যাতন-নিপীড়ন, হত্যা-আত্মহত্যা পর্যন্তও ঘটে। পরিবার ও সমাজ গিয়ে দাঁড়ায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
যৌতুক থেকে বাঁচার উপায় : তাই সমাজ ও পরিবার-বিনাশী ঘাতক প্রথা যৌতুকের অক্টোপাস থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে আমাদের। অপরাধের এ নর্দমা থেকে উদ্ধার করতেই হবে উম্মাহকে। এ জন্য প্রয়োজন যৌতুক প্রথা সম্পর্কে প্রতিটি মানুষের মধ্যে ব্যাপক ও জোরালো সচেতনতা তৈরি করা। প্রলুব্ধ করা শরিয়া পরিপালনে। আল্লাহর ভয় জাগিয়ে তোলা হৃদয়ের গহিন কন্দরে। সবশেষে বলতে চাই, যৌতুকের সম্পদ ভোগ করে যারা পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন, তাদের রহমতের নবী সা:-এর প্রজ্ঞাপূর্ণ ও দয়ায় পরিপুষ্ট এই বাণীটি স্মরণ রাখা উচিত- ‘সেই দেহ বেহেশতে যাবে না, যা হারাম খাদ্য থেকে উদ্ভব হয়েছে। দোজখের আগুনই তার অধিক উপযোগী’ (ইবনে হিব্বান-১৭২৩, ৪৫১৪, মুসান্নাফে আ: রাজ্জাক-২০৭১৯)। এই অভিশপ্ত ঘাতক প্রথা থেকে আল্লাহ আমাদের সমাজ, পরিবার ও সংসারকে পবিত্র করুন।
লেখক :
- মুফতি পিয়ার মাহমুদ
ইমাম ও খতিব, মসজিদুল আমান, গাঙ্গিনারপাড়, ময়মনসিংহ