মুলাদী উপজেলার মুলাদী ইউনিয়নের তালুকদার হাট সংলগ্ন জয়ন্তী নদীতে শতাধিক জেলে পরিবারের মানুষের জীবনে জল আর নৌকা তাদের নিত্যসঙ্গী।
জলেই জন্ম, জলেই মৃত্যু, জলেই বসবাস, নাগরিক হয়েও তারা নিজ দেশে পরবাস। ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা বা মৌলিক অধিকার বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, স্যানিটেশন, বিশুদ্ধ খাবার পানি তো নেই, বরং অনিয়ন্ত্রিত জন্মদান, বাল্যবিবাহ আর বহু বিবাহ এবং কুসংস্কারে ভরপুর আধুনিক যুগে থেকেও লোকচক্ষুর আড়ালে গহিন এক অন্ধকার জীবনে বাস করছে বেদে ও জেলে সম্প্রদায়।
জেলে পরিবারগুলো স্বাধীনতার ৫২ বছরেও পায়নি মাথা বোঝার ঠাই। নৌকায় যাদের বসবাস আগে তারা নৌকায় করে বিভিন্ন এলাকায় অস্থায়ী ভাবে অবস্থান করেলেও। বর্তমানে তার ভিন্ন চিত্র। যুগের পর যুগ পার হয়ে অর্ধশত বছর ধরে মুলাদী উপজেলার জয়ন্তী নদীতে রয়েছে তাদের বসবাস। নদীতে মাছ ধরে কোনো রকম ভাবে যতসামান্য উপার্জন দিয়ে চলছে জেলেদের জীবন।
ভূমিহীন গৃহহীন প্রায় ৩ শত মানুষ জীবনের সাথে যুদ্ধ করে ঝড় বন্যায় নৌকায় বসবাস করে আসছে। স্থায়ী আবাসনের অভাবে বেদে সন্তানদের পড়ালেখার কোন সুযোগ নেই।
তাই জেলে বহরের সদস্যরা স্থায়ী আবাসনের দাবী জানিয়েছেন সরকারের কাছে। স্থায়ী আবাসন হলে দীর্ঘ দিনের ভাসমান জীবন থেকে বেরিয়ে এসে স্বাভাবিক ও স্থায়ী জীবন-যাপনে যুক্ত হতো তারা। তাদের সন্তানরা শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মত মৌলিক চাহিদা পূরণে সক্ষম হতো।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, মুলাদী উপজেলার গাছুয়া ইউনিয়ন,মুলাদী ইউনিয়ন সহ পৌর এলাকার জেলে পরিবারগুলো দক্ষিণ গলোইভাঙ্গা, খেজুরতলা, তালুকদার হাট সংলগ্ন জয়ন্তী নদীর মধ্যে বসবাস করে আসছে।
উপজেলার মুলাদী ইউনিয়নের তালুকদার হাট দক্ষিণ গলোইভাঙ্গা ও মুলাদী বন্দর কাঠ হাট খোলা উত্তর পাশে জয়ন্তী নদীর তীর ঘেঁষে বেদে পল্লী বা বাইদ্যা পট্টি অবস্থিত।
সেখানেও প্রায় ১ শত পরিবার নিয়ে গড়ে উঠা এই পল্লীতে বসবাস করে ৩ শতাধিক বেদে ও স্থানিয় জেলে পরিবারের লোকজন। তারা এই এলাকায় প্রায় অর্ধশত বছরের বেশি সময় ধরে বসবাস করে আসছে।
নৌকায় বসবাসরত তানজিলা বেগম জানান, তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচনে ভোট প্রদান করে আসছে। আর তাদের ভোটাধিকার দেওয়া হলেও দেওয়া হয়নি কোন নারিক সুবিধ।
ছোট ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে নৌকায় নদীর জলে জীবন ভাসছে না জানি কখন ডুবে যায়। আক্ষেপ নিয়ে অনেকেই বলেন আমরা ভোট দিতে পারলেও দেশে প্রধানমন্ত্রী ভূমিহীনদের যায়গা ও ঘর দিলেও আমরা কেউ পাইনি তার দেওয়া উপহার। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তাদেরকে বারবার আশ্বাস দিলেও কিছুই পায়নি তারা।
নৌকায় বসবাসরত ৬০ বছরের বৃদ্ধা পারুল বেগম বলেন, প্রায ৩ বছর আগে আমার স্বামী হার্ট অ্যাটাক করে প্যারাডাইসড হয়ে পড়ে।
তিনি নদীতে এখন আর মাছ ধরতে পারেনা আমার ভিক্ষা করে এখন সংসার চালাতে হয়। আমাগো দেহার কেউ নাই। তোমরা বাবা ছবি তুলে আর কি করবা।
বেদ পল্লীর সরদার মানিক জানান, আমাদের এই পল্লীতে শত শত মানুষের বসবাস। আমরা মুলাদী ইউনিয়নের ভোটার। আমাদের মধ্যে সবাই মুসলমান।
আমরা সবাই এই এলাকার নাগরিক, তবে আমাদের ভাগ্যে মিলেনা কোন নাগরিক সুবিধা। নদীতে মাছ ধরে অনাহারে কোনো মতে চলছে আমাদের জীবন। সবার কাছে শুনি মা শেখ হাসিনা কতো মানুষরে ঘরবাড়ী দিলো।
আমাদের কপালে সেই ঘরও জুটল না। চেয়ারম্যান মেম্বর আসে ভোটের জন্যে ভোট শেষে আর কেউ খোঁজ নেয়না।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার দাবি নদীর পাড়ে অথবা আশেপাশের সরকারি অনেক যায়গা খালি পরে আছে। আমাদের আবাসনের জন্যে যদি একটি যায়গা দেয় আমরা নৌকার ভাসমান জীবন থেকে মুক্তি পাব।
মুলাদী ইউপি চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন জানান, যাহারা নৌকায় বসবাস করেন সবাই আমার ইউনিয়নের লোক নয়। অনেকে পৌর এলাকার ভোটার আবার অনেকে চর কালেখা ইউনিয়নের। আমার কাছে কেউ এসে বলেনি তাদের কোনো সমস্যা আছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বকুল চন্দ্র কবিরাজ বলেন, আমরা বেদে ও জেলেদের ব্যাপারে আন্তরিক। বেদেরা যদি ভোটাধিকার পেয়ে থাকে সেই বেদেদের ব্যাপারে আমরা পরবর্তি পর্যায়ে ব্যাবস্থা গ্রহন করব।
এই উপজেলাতে প্রায় ৪৪৫ জন ভূমিহীন পরিবার রয়েছে। সকলেই এখনো ঘর পায়নি। প্রধানমন্ত্রির অভিপ্রায় অনুযায়ি আমরা পর্যায়ক্রমে সকলকে এই ঘর দেয়ার ব্যাবস্থা গ্রহন করব।